সৈকত আমীন
প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তথ্যপ্রবাহকে করেছে দ্রুততর, সম্পর্কগুলোকে করেছে গতিশীল। কিন্তু এই সহজাত বাস্তবতা প্রায়ই আমাদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য ও গোপনীয়তাকে ভার্চুয়াল জগতের হাতে তুলে দিচ্ছি। কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও অজান্তেই আমরা প্রাইভেসির সীমানাকে প্রতিদিন ছোট করে আনছি। একসময় যে তথ্য কেবল পরিবার-পরিজন বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ তা প্রকাশ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে।
অতীতে প্রাইভেসি মানে ছিল বাড়ির চার দেয়ালের ভেতরকার জীবন। ব্যক্তিগত চিঠি, পারিবারিক অ্যালবাম, পোস্ট কার্ড কিংবা ডায়েরি। খুব ঘনিষ্ঠ মানুষের বাইরে কেউ এসব দেখলে সেটাই ছিল গোপনীয়তা লঙ্ঘন। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তি এই ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। এখন আমরা নিজেরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পারিবারিক ছবি, অবস্থান, এমনকি আমাদের আবেগঘন সম্পর্কের গল্প প্রকাশ্যে ভাগ করে নেই।
ডিজিটাল যুগে আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তর যেন ধীরে ধীরে ভার্চুয়াল জগতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে ই-কমার্স, অনলাইন ব্যাংকিং, ভিডিও স্ট্রিমিং, এমনকি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও আমরা নিজেদের উপস্থিতি তৈরি করেছি ভার্চুয়াল দুনিয়ায়।
একদিকে এই সংযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করছে, অন্যদিকে নিঃশব্দে সঙ্কুচিত করছে আমাদের ব্যক্তিগত পরিসর। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো—আমরা অনেক সময় নিজেরাই এই প্রাইভেসির কবর রচনা করছি।
তরুণ প্রজন্মের জীবনের কেন্দ্রে আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এখানে আমরা শেয়ার করি আমাদের জন্মদিন, ঠিকানা, বেড়ানোর অভিজ্ঞতা, ছবি। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন এক প্রকার উন্মুক্ত ডায়েরিতে পরিণত হয়েছে। ফেসবুকে চেক-ইন দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি আমরা কোথায় আছি, কখন যাচ্ছি, কখন ফিরব। ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে জানাচ্ছি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার ধরন, ভোগের ক্ষমতা কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শ।
অনেক সময় এটি সামাজিক মর্যাদা প্রদর্শনের এক মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, বিদেশ ভ্রমণ বা দামি পণ্যের ছবি শেয়ার করা এখন একধরনের ‘ডিজিটাল স্ট্যাটাস সিম্বল’।
এই তথ্যগুলো কেবলই বন্ধুবান্ধবের জন্য সীমিত থাকে না। সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রতিটি পোস্ট, লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বিশ্লেষণ করে তৈরি করছে আমাদের ডিজিটাল প্রোফাইল। কে কোন ধরনের কনটেন্ট পছন্দ করে, কোন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে, কোন ধরনের বিজ্ঞাপন দেখতে চাইবে—সবই অনুমান করা সম্ভব হয়ে উঠছে এই তথ্যের ওপর ভর করে।
ভার্চুয়াল নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারেস্কির এক প্রতিবেদন অনুসারে, ৯৩ শতাংশ ব্যবহারকারী এক বছরে অন্তত একবার ব্যক্তিগত তথ্য যেমন—বাসার ঠিকানা, ভ্রমণ পরিকল্পনা বা আর্থিক বিষয়ে অনলাইনে শেয়ার করেছেন। অথচ এ ধরনের তথ্যের প্রকাশ একজন মানুষের নিরাপত্তাকে সরাসরি ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়।
শুধু স্বেচ্ছায় নয়, আমাদের অজান্তেও প্রাইভেসি লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি ব্যবহারকারীর ডেটা সংগ্রহ করছে বিজ্ঞাপন বা বাজার গবেষণার কাজে।
২০২৪ সালের ডেটা ব্রোকার ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যাটিস্টিকস রিপোর্ট অনুযায়ী, ডেটা ব্রোকাররা গড়ে প্রতি ব্যক্তির সম্পর্কে প্রায় এক হাজার পাঁচশোটি তথ্য সংগ্রহ ও বিক্রি করে।
এই তথ্যের মধ্যে থাকে ব্যক্তির কেনাকাটার অভ্যাস, অনলাইন কার্যক্রম, অবস্থানসহ নানা ব্যক্তিগত ডেটা।
ফলাফল দাঁড়ায়—আমাদের ভার্চুয়াল জীবন একটি স্বচ্ছ কাচের ঘরে পরিণত হয়, যেখানে আমরা ভাবি বেশ গোপনে আছি, কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি পদক্ষেপই নথিভুক্ত হচ্ছে।
যখন আমরা শুনি আমাদের আইডি হ্যাক হয়েছে, অথবা আমাদের ডেটা ডার্ক ওয়েবে বিক্রি হচ্ছে, তখন আমরা আতঙ্কিত হই। অথচ প্রতিদিনই আমরা নিজ হাতে এই তথ্য ফাঁস করছি—বিনোদনের নামে, জনপ্রিয়তার লোভে বা সুবিধার খাতিরে।
একদিকে স্বেচ্ছায় তথ্য দিয়ে যাচ্ছি, অন্যদিকে জোরপূর্বক নজরদারি হলে শঙ্কিত হচ্ছি। এই দ্বৈত অবস্থান আমাদের ডিজিটাল সংস্কৃতির এক বড় ট্র্যাজেডি।
মানুষের এক অদ্ভুত বৈপরীত্য হলো, সে তার স্বাধীনতাকে মূল্য দেয়, কিন্তু আরামের জন্য তা বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করে না। অনলাইনে ফ্রি সার্ভিস ব্যবহার করার বিনিময়ে আমরা আনন্দের সঙ্গেই নিজের তথ্য দিয়ে দিচ্ছি।
আমরা মনে করি, আমি যদি অপরাধ না করি, তবে আমার ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু ভুলে যাই—এই তথ্যগুলো দিয়ে আমাদের ভোগবাদী প্রবণতা, রাজনৈতিক পছন্দ, এমনকি মানসিক দুর্বলতাও সহজে শোষণ করা যায়।
২০১৮ সালের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি দেখিয়েছে, কীভাবে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য রাজনৈতিক প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছিল। কোটি কোটি ব্যবহারকারী হঠাৎ বুঝতে পারলেন, তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দও বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানো সম্ভব।
এমনকি বাংলাদেশেও বহুবার দেখা গেছে, ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত ছবি বা কথোপকথন চুরি করে ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা। শেখা হাসিনার আমলে তো এটা হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় আয়োজন।
‘ডেটা ইজ দ্য নিউ অয়েল’ -- কথা বহুদিন ধরেই বাজারে প্রচলিত। একুশ শতকের অর্থনীতিতে তেলের মতো মূল্যবান সম্পদ হয়ে উঠেছে তথ্য। গুগল, ফেসবুক, টিকটক কিংবা অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ডেটাকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করছে, রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছে কিংবা ভবিষ্যৎ বাজারের পূর্বাভাস তৈরি করছে।
শুধু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও প্রাইভেসি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। ডিজিটাল নজরদারি এখন বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রে। চীনের ‘সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম’, যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি)-এর তথ্য সংগ্রহ কেলেঙ্কারি দেখিয়েছে—কীভাবে রাষ্ট্র প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে নাগরিকদের নজরদারির জন্য।
বাংলাদেশেও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)-এর মতো প্রতিষ্ঠান, যার কাজই হলো, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর আইপি ট্রেসিং, ফোন কলে আড়ি পাতা থেকে শুরু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট মনিটরিং করা— তারাও নজরদারির একটি কাঠামো তৈরি করেছে। যদিও বলা হয় এগুলো নিরাপত্তার স্বার্থে, বাস্তবে তা প্রাইভেসির সীমা সংকুচিত করছে প্রতিদিন।
প্রাইভেসি সংকট কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয় নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গেও সম্পর্কিত। যদি নাগরিকদের সব তথ্য সহজে সংগ্রহ করা যায়, তবে তা স্বৈরশাসনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
একই সঙ্গে প্রাইভেসি মানুষের স্বাধীন অস্তিত্বেরও প্রশ্ন। যদি সবকিছু প্রকাশ্য হয়ে যায়, তবে ব্যক্তি তার অন্তর্জগত হারিয়ে ফেলে। অথচ ডিজিটাল যুগ আমাদের এমন অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে যেখানে ‘প্রাইভেট’ আর ‘পাবলিক’-এর সীমারেখা ঝাপসা হয়ে গেছে।
ফুকোর ‘প্যানঅপ্টিকন’ ধারণা এখানে প্রাসঙ্গিক। কারাগারের বন্দিরা যখন জানে তারা সবসময় নজরদারির আওতায়, তখন তাদের আচরণ পরিবর্তিত হয়। একইভাবে আমরা যখন জানি আমাদের অনলাইন কার্যক্রম সর্বদা মনিটর করা হচ্ছে, তখন আমাদের মত প্রকাশও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ প্রাইভেসি হারানো মানে কেবল তথ্য হারানো নয়, বরং স্বাধীন চিন্তারও ক্ষতি।
ভার্চুয়াল জগতে আমরা নিজেদের প্রাইভেসির কবর রচনা করছি মূলত নিজেরাই। প্রতিদিন একটু একটু করে শেয়ার করছি জীবনের ব্যক্তিগত মুহূর্তগু, অজান্তেই রেখে যাচ্ছি ডিজিটাল ছাপ। অথচ সেই তথ্যই একসময় আমাদের বিপক্ষে ব্যবহৃত হতে পারে। তাই এখনই আমাদের ভাবতে হবে—কোন তথ্য আমি প্রকাশ করব, কোনটা করব না।
গোপনীয়তা মানে কেবল তথ্য গোপন রাখা নয়, বরং নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা রক্ষাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ভার্চুয়াল জগৎ আমাদের জীবনকে যেমন দ্রুততর করেছে, তেমনি আমাদের অদৃশ্য শেকলে বেঁধে ফেলেছে। আমরা নিজেরাই প্রাইভেসির কবর খুঁড়ছি প্রতিদিন, আবার সেই কবরের ভিতর থেকে ভয় জড়ানো কণ্ঠে বলছি, ‘আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদ থাকুক।’ এ-ই হলো আমাদের স্ববিরোধী জীবন।
ডিজিটাল নজরদারির যুগে ব্যক্তি আর তথ্য আলাদা সত্তা নয়; আমরা নিজেরাই হয়ে উঠেছি একটি চলমান ডাটাবেস, হয়ে উঠছি এক টুকরো ‘পণ্য’।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি প্রস্তুত নিজেদের প্রাইভেসির বিনিময়ে এক টুকরো ডিজিটাল স্বাচ্ছন্দ্য কিনতে? নাকি আবার শিখব কীভাবে নিজের অস্তিত্বকে অদৃশ্য চোখ থেকে রক্ষা করা যায়?
প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তথ্যপ্রবাহকে করেছে দ্রুততর, সম্পর্কগুলোকে করেছে গতিশীল। কিন্তু এই সহজাত বাস্তবতা প্রায়ই আমাদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য ও গোপনীয়তাকে ভার্চুয়াল জগতের হাতে তুলে দিচ্ছি। কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও অজান্তেই আমরা প্রাইভেসির সীমানাকে প্রতিদিন ছোট করে আনছি। একসময় যে তথ্য কেবল পরিবার-পরিজন বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ তা প্রকাশ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে।
অতীতে প্রাইভেসি মানে ছিল বাড়ির চার দেয়ালের ভেতরকার জীবন। ব্যক্তিগত চিঠি, পারিবারিক অ্যালবাম, পোস্ট কার্ড কিংবা ডায়েরি। খুব ঘনিষ্ঠ মানুষের বাইরে কেউ এসব দেখলে সেটাই ছিল গোপনীয়তা লঙ্ঘন। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তি এই ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। এখন আমরা নিজেরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পারিবারিক ছবি, অবস্থান, এমনকি আমাদের আবেগঘন সম্পর্কের গল্প প্রকাশ্যে ভাগ করে নেই।
ডিজিটাল যুগে আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তর যেন ধীরে ধীরে ভার্চুয়াল জগতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে ই-কমার্স, অনলাইন ব্যাংকিং, ভিডিও স্ট্রিমিং, এমনকি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও আমরা নিজেদের উপস্থিতি তৈরি করেছি ভার্চুয়াল দুনিয়ায়।
একদিকে এই সংযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করছে, অন্যদিকে নিঃশব্দে সঙ্কুচিত করছে আমাদের ব্যক্তিগত পরিসর। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো—আমরা অনেক সময় নিজেরাই এই প্রাইভেসির কবর রচনা করছি।
তরুণ প্রজন্মের জীবনের কেন্দ্রে আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এখানে আমরা শেয়ার করি আমাদের জন্মদিন, ঠিকানা, বেড়ানোর অভিজ্ঞতা, ছবি। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন এক প্রকার উন্মুক্ত ডায়েরিতে পরিণত হয়েছে। ফেসবুকে চেক-ইন দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি আমরা কোথায় আছি, কখন যাচ্ছি, কখন ফিরব। ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে জানাচ্ছি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার ধরন, ভোগের ক্ষমতা কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শ।
অনেক সময় এটি সামাজিক মর্যাদা প্রদর্শনের এক মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, বিদেশ ভ্রমণ বা দামি পণ্যের ছবি শেয়ার করা এখন একধরনের ‘ডিজিটাল স্ট্যাটাস সিম্বল’।
এই তথ্যগুলো কেবলই বন্ধুবান্ধবের জন্য সীমিত থাকে না। সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রতিটি পোস্ট, লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বিশ্লেষণ করে তৈরি করছে আমাদের ডিজিটাল প্রোফাইল। কে কোন ধরনের কনটেন্ট পছন্দ করে, কোন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে, কোন ধরনের বিজ্ঞাপন দেখতে চাইবে—সবই অনুমান করা সম্ভব হয়ে উঠছে এই তথ্যের ওপর ভর করে।
ভার্চুয়াল নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারেস্কির এক প্রতিবেদন অনুসারে, ৯৩ শতাংশ ব্যবহারকারী এক বছরে অন্তত একবার ব্যক্তিগত তথ্য যেমন—বাসার ঠিকানা, ভ্রমণ পরিকল্পনা বা আর্থিক বিষয়ে অনলাইনে শেয়ার করেছেন। অথচ এ ধরনের তথ্যের প্রকাশ একজন মানুষের নিরাপত্তাকে সরাসরি ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়।
শুধু স্বেচ্ছায় নয়, আমাদের অজান্তেও প্রাইভেসি লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি ব্যবহারকারীর ডেটা সংগ্রহ করছে বিজ্ঞাপন বা বাজার গবেষণার কাজে।
২০২৪ সালের ডেটা ব্রোকার ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যাটিস্টিকস রিপোর্ট অনুযায়ী, ডেটা ব্রোকাররা গড়ে প্রতি ব্যক্তির সম্পর্কে প্রায় এক হাজার পাঁচশোটি তথ্য সংগ্রহ ও বিক্রি করে।
এই তথ্যের মধ্যে থাকে ব্যক্তির কেনাকাটার অভ্যাস, অনলাইন কার্যক্রম, অবস্থানসহ নানা ব্যক্তিগত ডেটা।
ফলাফল দাঁড়ায়—আমাদের ভার্চুয়াল জীবন একটি স্বচ্ছ কাচের ঘরে পরিণত হয়, যেখানে আমরা ভাবি বেশ গোপনে আছি, কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি পদক্ষেপই নথিভুক্ত হচ্ছে।
যখন আমরা শুনি আমাদের আইডি হ্যাক হয়েছে, অথবা আমাদের ডেটা ডার্ক ওয়েবে বিক্রি হচ্ছে, তখন আমরা আতঙ্কিত হই। অথচ প্রতিদিনই আমরা নিজ হাতে এই তথ্য ফাঁস করছি—বিনোদনের নামে, জনপ্রিয়তার লোভে বা সুবিধার খাতিরে।
একদিকে স্বেচ্ছায় তথ্য দিয়ে যাচ্ছি, অন্যদিকে জোরপূর্বক নজরদারি হলে শঙ্কিত হচ্ছি। এই দ্বৈত অবস্থান আমাদের ডিজিটাল সংস্কৃতির এক বড় ট্র্যাজেডি।
মানুষের এক অদ্ভুত বৈপরীত্য হলো, সে তার স্বাধীনতাকে মূল্য দেয়, কিন্তু আরামের জন্য তা বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করে না। অনলাইনে ফ্রি সার্ভিস ব্যবহার করার বিনিময়ে আমরা আনন্দের সঙ্গেই নিজের তথ্য দিয়ে দিচ্ছি।
আমরা মনে করি, আমি যদি অপরাধ না করি, তবে আমার ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু ভুলে যাই—এই তথ্যগুলো দিয়ে আমাদের ভোগবাদী প্রবণতা, রাজনৈতিক পছন্দ, এমনকি মানসিক দুর্বলতাও সহজে শোষণ করা যায়।
২০১৮ সালের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি দেখিয়েছে, কীভাবে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য রাজনৈতিক প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছিল। কোটি কোটি ব্যবহারকারী হঠাৎ বুঝতে পারলেন, তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দও বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানো সম্ভব।
এমনকি বাংলাদেশেও বহুবার দেখা গেছে, ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত ছবি বা কথোপকথন চুরি করে ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা। শেখা হাসিনার আমলে তো এটা হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় আয়োজন।
‘ডেটা ইজ দ্য নিউ অয়েল’ -- কথা বহুদিন ধরেই বাজারে প্রচলিত। একুশ শতকের অর্থনীতিতে তেলের মতো মূল্যবান সম্পদ হয়ে উঠেছে তথ্য। গুগল, ফেসবুক, টিকটক কিংবা অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ডেটাকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করছে, রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছে কিংবা ভবিষ্যৎ বাজারের পূর্বাভাস তৈরি করছে।
শুধু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও প্রাইভেসি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। ডিজিটাল নজরদারি এখন বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রে। চীনের ‘সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম’, যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি)-এর তথ্য সংগ্রহ কেলেঙ্কারি দেখিয়েছে—কীভাবে রাষ্ট্র প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে নাগরিকদের নজরদারির জন্য।
বাংলাদেশেও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)-এর মতো প্রতিষ্ঠান, যার কাজই হলো, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর আইপি ট্রেসিং, ফোন কলে আড়ি পাতা থেকে শুরু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট মনিটরিং করা— তারাও নজরদারির একটি কাঠামো তৈরি করেছে। যদিও বলা হয় এগুলো নিরাপত্তার স্বার্থে, বাস্তবে তা প্রাইভেসির সীমা সংকুচিত করছে প্রতিদিন।
প্রাইভেসি সংকট কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয় নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গেও সম্পর্কিত। যদি নাগরিকদের সব তথ্য সহজে সংগ্রহ করা যায়, তবে তা স্বৈরশাসনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
একই সঙ্গে প্রাইভেসি মানুষের স্বাধীন অস্তিত্বেরও প্রশ্ন। যদি সবকিছু প্রকাশ্য হয়ে যায়, তবে ব্যক্তি তার অন্তর্জগত হারিয়ে ফেলে। অথচ ডিজিটাল যুগ আমাদের এমন অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে যেখানে ‘প্রাইভেট’ আর ‘পাবলিক’-এর সীমারেখা ঝাপসা হয়ে গেছে।
ফুকোর ‘প্যানঅপ্টিকন’ ধারণা এখানে প্রাসঙ্গিক। কারাগারের বন্দিরা যখন জানে তারা সবসময় নজরদারির আওতায়, তখন তাদের আচরণ পরিবর্তিত হয়। একইভাবে আমরা যখন জানি আমাদের অনলাইন কার্যক্রম সর্বদা মনিটর করা হচ্ছে, তখন আমাদের মত প্রকাশও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ প্রাইভেসি হারানো মানে কেবল তথ্য হারানো নয়, বরং স্বাধীন চিন্তারও ক্ষতি।
ভার্চুয়াল জগতে আমরা নিজেদের প্রাইভেসির কবর রচনা করছি মূলত নিজেরাই। প্রতিদিন একটু একটু করে শেয়ার করছি জীবনের ব্যক্তিগত মুহূর্তগু, অজান্তেই রেখে যাচ্ছি ডিজিটাল ছাপ। অথচ সেই তথ্যই একসময় আমাদের বিপক্ষে ব্যবহৃত হতে পারে। তাই এখনই আমাদের ভাবতে হবে—কোন তথ্য আমি প্রকাশ করব, কোনটা করব না।
গোপনীয়তা মানে কেবল তথ্য গোপন রাখা নয়, বরং নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা রক্ষাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ভার্চুয়াল জগৎ আমাদের জীবনকে যেমন দ্রুততর করেছে, তেমনি আমাদের অদৃশ্য শেকলে বেঁধে ফেলেছে। আমরা নিজেরাই প্রাইভেসির কবর খুঁড়ছি প্রতিদিন, আবার সেই কবরের ভিতর থেকে ভয় জড়ানো কণ্ঠে বলছি, ‘আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদ থাকুক।’ এ-ই হলো আমাদের স্ববিরোধী জীবন।
ডিজিটাল নজরদারির যুগে ব্যক্তি আর তথ্য আলাদা সত্তা নয়; আমরা নিজেরাই হয়ে উঠেছি একটি চলমান ডাটাবেস, হয়ে উঠছি এক টুকরো ‘পণ্য’।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি প্রস্তুত নিজেদের প্রাইভেসির বিনিময়ে এক টুকরো ডিজিটাল স্বাচ্ছন্দ্য কিনতে? নাকি আবার শিখব কীভাবে নিজের অস্তিত্বকে অদৃশ্য চোখ থেকে রক্ষা করা যায়?
বিসিবি নির্বাচনের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের পর থেকেই শুরু হয়েছে নানা প্রশ্ন। এই তালিকাটিই নির্বাচনের মূলভিত্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে স্বচ্ছতার আলো কম, সন্দেহের ছায়া বেশি। সময়মতো তালিকা প্রকাশ হয়নি, সংশোধন নিয়ে বিতর্ক, এমনকি কাউন্সিলরের বৈধতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
৬ ঘণ্টা আগেবিশ্বের অনেক দেশ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২১-পদক্ষেপের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে। এই প্রস্তাবের লক্ষ্য প্রায় দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শেষ করা এবং গাজা স্ট্রিপ পুনর্গঠন করা। তবে বিশ্লেষকরা প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথ নিয়ে সন্দিহান।
১ দিন আগেভারত কি বাংলাদেশের বন্ধু? মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আপনি যেকোনো আওয়ামী লীগের সমর্থক বা কর্মীকে প্রশ্নটি করলে তাঁরা কোনো দ্বিধা না করে বলবেন, অবশ্যই। এমনকি এটাও বলতে পারেন, ভারত না থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকত না।
২ দিন আগে‘নির্বাচনী রাজনীতিতে ধর্মীয় দলগুলো পিছিয়ে কেন’ শিরোনামটি প্রাসঙ্গিকভাবেই আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাই লেখাটি একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক।
৩ দিন আগে