রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে আগুনে পুড়েছে দেড় হাজারের বেশি ঘর। এতে আশ্রয়হীন হয়ে পড়া পরিবারগুলো ছোট সন্তান নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছে বস্তির অন্য অংশে। কিন্তু বিধি বাম। ঘরপোড়া মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগে বস্তির বাড়িওয়ালারা খালি কক্ষগুলোর ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আজ বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) কড়াইল বস্তি ঘুরে এমন একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে মঙ্গলবার ঢাকার সবচেয়ে বড় এ বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ফায়ার সার্ভিস, বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিট ও স্বেচ্ছাসেবকদের চেষ্টায় যতক্ষণে আগুন নিভে তার আগেই বস্তির বউবাজার, ক ব্লক, কুমিল্লা পট্টি, শেরপুর পট্টির দেড় হাজারের বেশি ঘর পুড়ে যায়। ১৬ ঘণ্টার এ আগুনে কেউ হতাহত না হলেও আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে নিম্নআয়ের মানুষগুলো।
আগুনে ঘর ভস্মীভূত হওয়া এমনই একজন মিনা বেগম। তিনি স্ট্রিমকে জানান, আগুনে হাজার হাজার মানুষের ঘর পুড়ে যাওয়ায় থাকার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। খালি ঘরের চাহিদা বাড়ায় বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। বউবাজার এলাকার ঘর পুড়ে যাওয়ায় আজ তিনি বস্তির জামাইবাজারে একটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছেন। ভাড়া ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩০০ টাকা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিল আলাদা দিতে হবে। অথচ আগের বাসায় এমন নিয়ম ছিল না। সেখানে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব খরচ ছিল ৩ হাজার টাকা।
স্বামী ও এক শিশু সন্তানের সংসারে সবকিছু পুড়ে গেছে জানিয়ে মিনা বেগম বলেন, ‘আগের ঘরের তুলনায় নতুনটি অনেক ছোট। তারপরও তিনজনে থাকা যাবে, কারণ সংসারের আর কিছুই তো নেই। সবই তো পুড়ে গেছে।’
সহায়তা না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘সরকারসহ কতজনই তো নাম নিয়ে গেল। তালিকা করে গেল। কেউ কিছুই দেয়নি। শুনেছি বাড়িওয়ালারা পেয়েছে। আমরা যারা ভাড়াটিয়া তাদের কিছুই দেওয়া হয়নি।’
আরেক ভুক্তভোগী বউবাজারের ভাড়াটিয়া হনুফা খাতুন বলেন, ‘ঘর পুড়ে যাওয়ার পর নতুন করে রুম খুঁজছি। কিন্তু আগের তুলনায় এখন ভাড়া বেশি চাচ্ছে। একসাথে অনেকে রুম খোঁজার কারণে ভাড়া বেশি চাচ্ছে বাড়িওয়ালারা।’
এদিকে গতকাল বুধবার সকালে কড়াইল বস্তি পরিদর্শনে যান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) রেজওয়ানুর রহমান। ওই সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে তাঁরা মিটিং করবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তাদের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। কিছু সংস্থা তাৎক্ষণিক চাল, ডাল, শুকনা খাবার, পোশাক ও কম্বল দেয়। তবে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় অনেকেই কিছু পাননি।
এ বিষয়ে বউবাজারের ভাড়াটিয়া তামান্না স্ট্রিমকে জানান, অনেকেই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করেছেন। নাম নিয়ে গেছেন। তবে ব্র্যাক থেকে দেড় হাজার টাকা ও শিশু সন্তানের জন্য দুটি পোশাক ছাড়া আর কোনো সহায়তা পাননি। তারা এখন তাঁবু টানিয়ে আগের ঘরেই জায়গায়ই আছেন।
বস্তিতে ভাড়া বেড়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার আগেই আমাদের বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়েছে। আগুন লাগার পর আমি আর নতুন বাসা খুঁজি নাই। হাতে কিছুই নাই।’
বিপদে পড়েছেন ঘর পুড়ে যাওয়া বাড়ির মালিকরাও। আব্দুস সোবহান নামে এমন একজন জানান, বস্তির অধিকাংশ জমির মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তর, টিঅ্যান্ডটিসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। এসব জমি অনেক দিন আগে দখল করেন প্রভাবশালীরা। এরপর শুধু স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিভিন্নজনের কাছে বিক্রি করে দেন। আর কোনো কাগজপত্র নাই। স্ট্যাম্পই দলিল। এভাবেই বিভিন্নজনের হাত ঘুরে নতুন নতুন মালিকরা এই জমি ভোগ করছে।
আব্দুস সোবহান আরও জানান, প্রায় ১৪ বছর আগে এক মালিকের কাছ থেকে চার লাখ টাকা দিয়ে এখানে প্রায় চার শতাংশ জমি কিনে কাঠের দোতলা বাড়ি করেন। ২০১৭ সালের আগুনে ওই বাড়ি পুড়ে যায়। এরপর গ্রামের বাড়ির জমি বিক্রি করে ও বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ২৭ লাখ টাকায় পাকাবাড়ি করেন। নিচতলা, দোতলা ও তৃতীয় তলা মিলে তার ২৪টি কক্ষ ছিল। ৯ থেকে ১০ বর্গফুটের এসব ঘরের প্রতিটি থেকে মাসে ভাড়া পেতেন চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। তবে প্রায় পুরোটাই চলে যেত ধার শোধ করতে। এখন ধার কীভাবে শোধ করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।