বাংলা গদ্যরীতির শুরু হয়েছিল তিনটি পৃথক ছাঁচ ধরে; যথাক্রমে জনবুলি অসংস্কৃত ছাঁচে উইলিয়াম কেরির ‘কথোপকথন’, আরবি-ফারসিমিশ্রিত ছাঁচে রাম রাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ এবং সংস্কৃত ব্যাকরণে তৎসম শব্দবহুল ছাঁচে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘বত্রিশ সিংহাসনে’র মাধ্যমে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যাসাগর নিয়ে এলেন দুই ধরনের গদ্যরীতি। একটি মৃত্যুঞ্জয়ের রীতির শিল্পিত ও সাহিত্যিক বুননে, অপরটি রাম রাম বসুর আরবি-ফারসির হাল্কা চালের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপমূলক রচনায়। সামান্য পরে আরেকটি রীতির চল হয় কথ্যবুলির সরস প্রয়োগে টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও দীনবন্ধুর মিত্রের প্রহসনগুলোতে।
বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও টেকচাঁদকে সমন্বয় করে বিদ্যাসাগরীয় রীতিকেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন সৃষ্টিশীল উপায়ে। বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের রীতি পুনর্গঠিত ও বিদগ্ধ হয়ে এলো পরে রবীন্দ্রনাথের গদ্যে। সবকিছু পেছনে ফেলে বিশ শতকে দ্বিতীয় দশকে নয়া রীতির প্রবর্তন করেন প্রমথ চৌধুরী। তাঁর আদর্শ ছিল কলকাতা ও তার আশপাশ অঞ্চলের শিক্ষিত সমাজের মৌখিক ভাষা। সেটা অবশ্য সরাসরি নয়; সংস্কৃত, প্রখর ও শাণিত করে। কিন্তু গদ্যরীতির এমন প্রচল নিয়ে শুরু থেকে যেমন পরবর্তীকালেও ছিল মতদ্বৈততা এবং পক্ষ-বিপক্ষ। কারণ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অঞ্চল, সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রভৃতি বিষয়। তাই উনিশ শতকেই সংস্কৃতঘেষা মূলধারার গদ্যরীতি ‘হিন্দুয়ানি’ তকমা পেয়ে যায় অনেক মুসলমান লেখকের কাছে। যদিও শতকের শেষে মুসলমান সমাজের বড়ো লেখক এই ধারার গদ্যরীতিতে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ লিখেন এবং উভয় সমাজে খ্যাতিমান হন। যদিও একটি দেশের ভাষারীতি গড়ে উঠা উচিৎ তার প্রয়োগক্ষেত্র অনুযায়ী, স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং জনভাষাকে সামনে রেখে।
প্রমথ চৌধুরীর চলতিরীতিতে মুসলমান সমাজের বেশিরভাগ লেখক সাহিত্যচর্চা করে আসলেও অনেকে তা সাধুরীতির মতো হিন্দু-আদর্শের বলে গণ্য করতে থাকেন। তাঁদের কথা ছিল ভাষার এই রূপ বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের ভাষার মুখোশ মাত্র; মূলত হিন্দুয়ানি এবং তা পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, পূর্ববঙ্গের মুসলমানের ভাষা এটা নয়। বিশ শতকের চল্লিশ-পঞ্চশের দশকে এসে দেখা গেল ভাষারীতিটি বর্জনের দিকেই শোরগোল উঠছে। অবশ্য এই বিরুদ্ধাচরণ যতটা না বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের রীতির প্রতি ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল মোশাররফ হোসেন-নজিবুর রহমান-ইসমাইল হোসেন সিরাজীর রীতির প্রতি।
বাংলা গদ্যরীতির চলমান রূপের বিরুদ্ধাচরণকারীরা ছিলেন মূলত ইসলামি আদর্শে উদ্বুদ্ধ। এই গোষ্ঠীর নেতারা গদ্যরীতির সংস্কার চাইলেন এবং তাঁরা মুসলিম তমদ্দুন সত্তার স্বতন্ত্র প্রকাশ হিসেবে গদ্যরীতিতে উর্দুর ঋণ-গ্রহণের প্রস্তাব করলেন। শুধু শব্দভান্ডারে নয়, বাক্ভঙ্গিতেও ইসলামিকরণের নির্দেশনা এলো একসময়। কেউ কেউ উগ্রভাবে প্রয়োজনে বাংলাকে বাদ দিতেও কুণ্ঠা বোধ করলেন না। সংস্কারপন্থী একটি দল যদিও অতীতের ঐতিহ্যকে বাতিল করে সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন না, তাঁরা ভারসাম্য পন্থী ছিলেন। এঁরা বিদ্যাসাগরের আরবি-ফারসিজাত দ্বিতীয় ভাষারীতির ধর্মনিরপেক্ষ ছাঁচকে উত্তম বলে মনে করলেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর সরকারি ভাষাকমিটি গঠিত হয় এবং দেশভাগের আগে যাঁরা আরবি-ফারসি শব্দবহুল রীতির কথা বলে আসছিলেন তাঁদের বোল পালটে যায়। এবার দাবি ওঠে পাকিস্তানের জন্য আলাদা ভাষারীতি হতে হবে, যা পশ্চিমবঙ্গীয় নয়। অর্থাৎ ভাষার সরলীকরণ ও আঞ্চলিকীকরণ চান এঁরা। আঞ্চলিকীকরণের পক্ষে বলিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। তিনি মনে করতেন মুসলমানের মুখের বাংলা হিন্দুর মুখের বাংলার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাই পূর্ববাংলার মান্য কথ্যভাষায় এই অঞ্চলের সাহিত্যকদের গ্রহণ করা আবশ্যক!
পাকিস্তান-উত্তর সময়ে যখন ভাষা সংস্কার নিয়ে কথা উঠল এবং ভাষাকমিটি গঠিত হলো মুনীর চৌধুরী তখন সাহিত্যিক হিসেবে উদীয়মান। গল্প-প্রবন্ধ এবং নাটক লিখে যাচ্ছেন এবং একই সময়ে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে ভাষা-আন্দোলন সহ নানা আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন। যে-অর্থে ও উদ্দেশ্যে পাকিস্তানসৃষ্টি হয়েছিল তিনি দেখতে পেয়েছিলেন অঙ্কুরে তার বিনাশ ঘটেছে। ভাষাকমিটি গঠন, উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা ও বিভিন্ন দমন-পীড়ন তার বড়ো প্রমাণ।
একজন সৃষ্টিশীল লেখক, সাহিত্যিক ও ভাষাচিন্তক হিসেবে মুনীর চৌধুরী ভাষা-সংস্কার সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড অবলোকন করছিলেন। নিজের একটা দৃষ্টিকোণও তাঁর মধ্যে ছিল, আবার অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিও তিনি বিচার করছিলেন। চূড়ান্তভাবে যখন ভাষাকমিটি প্রতিবেদন প্রস্তাবাকারে প্রদান করে তখন তিনি এর বিরুদ্ধাচরণ করেন। সর্বোপরি মুনীর চৌধুরীর রচনাতেও তাঁর গদ্যরীতির দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়। এসব থেকে বাংলা গদ্যরীতি নিয়ে মুনীর চৌধুরীর মনোভাব শুধু বোঝাই যায় না, বাংলা গদ্যরীতির পরবর্তী খাত নিয়েও তাঁর চিন্তাভাবনা ও ধারণার সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়।
ভাষাকমিটির প্রতিবেদন পেশের প্রায় আট বছর পর তা প্রকাশ্যে আসে, আর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬০ সালে ‘সমকাল’ পত্রিকায় মুনীর চৌধুরী তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এই প্রতিক্রিয়ায় ভাষাসংস্কার নিয়ে মুনীর চৌধুরীর অবস্থান কিংবা তাঁর ভাষাদর্শের দিকগুলো চিহ্নিত করা যায়। কমিটিতে মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মুহম্মদ এনামুল হক সহ অনেকে ছিলেন। কমিটির বিবেচনার বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করে দেওয়া ছিল। যেমন চতুর্থ প্রস্তাবে ছিল নতুন ভাষাসৃষ্টির নিয়মকানুন নিয়ে। অর্থাৎ পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা যেন তার নিজের এবং একই সঙ্গে সারা পাকিস্তানের সংস্কৃতি ও আন্তঃপ্রেরণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমৃদ্ধ হতে পারে এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে। বাংলা গদ্যরীতির ব্যাপারে এটি গুরুত্বপূর্র্ণ বিষয় ছিল।
পূর্ব-পাকিস্তানের গদ্যরীতির সাধারণ প্রস্তাবটি ছিল সাধু কিংবা চলিত উভয় রূপেরই সহজীকরণ, আর তার গভীরের দর্শন ছিল চলমান রীতির বিপরীতে পূর্ববঙ্গবাসীর ঐতিহ্য ও প্রেরণাসঞ্চারী রীতির প্রতিষ্ঠা। এখানে পূর্ববঙ্গবাসী বলতে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজকে বুঝতে হবে। ভাষারীতি প্রস্তাবের প্রথমেই বলা হয়েছে সংস্কৃতের প্রভাবমুক্তি এবং পূর্ববঙ্গের ভাষার সরল গঠনরীতি ও সহজ বাক্ভঙ্গির প্রচলন ঘটাতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভাষার কোনো রূপে ইসলামের খেলাপ করা যাবে না এবং তৃতীয়ত, পূর্ববঙ্গীয় বুলি বা শব্দগুচ্ছের যথেচ্ছ ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে পুঁথিসাহিত্য ও জনপ্রিয় লোকসাহিত্যের ভাষা হতে হবে গদ্যরীতির আদর্শ দিক। উল্লিখিত প্রায় সবগুলো প্রস্তাবেই মুনীর চৌধুরী দ্বিমত পোষণ করে নিজের অভিমত প্রকাশ করেন।
ভাষার সহজীকরণের বিষয়ে মুনীর চৌধুরীর কথা ছিল ভাষায় সরলতা ও স্পষ্টতা বাঞ্ছনীয়, জনগণের মুখের ভাষা সরলও এবং এই সরলতা দৈনন্দিন জীবনবোধ থেকে আসে। অর্থাৎ ভাষার সরলতা আরোপের বিষয় নয়, ভাষাবিজ্ঞানও তা-ই বলে। ভাষাবিজ্ঞানের সূত্র ধরে তিনি দেখিয়েছেন ভাষার বাহ্যপ্রকৃতি বা গঠন ভাবকে বেঁধে রাখতে পারে না। নতুন ভাব ভাষার নতুন রূপ তৈরি করে, জবরদস্তি করে ভাষার রূপ বদলালে আখেরে তা কাজে আসেনা। সুতরাং বিষয়টি ভাষাসংস্কার না হয়ে ভাবসংস্কারে পরিণত হয়েছে, যা অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক।
সংস্কৃত শব্দের অপসারণ প্রসঙ্গে মুনীর চৌধুরীর অভিমত হচ্ছে এই জেহাদ নতুন কোনো ঘটনা নয়, বরং উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে টেকচাঁদি রীতি এই বিদ্রোহের প্রমাণ। এছাড়া চলমান বাংলা গদ্যরীতিতে সংস্কৃতের আধিপত্যকে তিনি কল্পিত ও ভ্রান্তিকর বলে মনে করেছেন। কারণ বাংলায় তৎসম শব্দ কদাচ ব্যবহৃত হয়; গদ্যরীতির গাঠনিক দিক থেকে তা আপনাতেই অপসৃত হয়ে যাচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘যে-শত্রু মৃত এবং বহুলাংশে অলীক তার সম্ভাব্য আতঙ্কে ব্যাকুল হয়ে আস্ফালন করার মধ্যে একটা হাস্যকর অসংগতির দিক আছে।’ মুনীর চৌধুরী দেখিয়েছেন শত বছরের সাধনায় গদ্যশিল্পীরা কীভাবে সংস্কৃতের বন্দিশালা থেকে বাংলাকে উদ্ধার করে সহজ, স্বাধীন ও দেশজ রূপ দিয়েছেন। তাই এই প্রস্তাবের মধ্যে তিনি ধর্মীয় ভাবের অভিপ্রায় খুঁজে পেয়েছেন, ভাষারীতির কিছু নয়।
পুঁথিসাহিত্যের ভাষাকে ব্যাপকভাবে গদ্যরীতিতে অনুসৃত হওয়ার প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেন মুনীর চৌধুরী। তাঁর মতে, পুঁথির ভাষা নিয়ে নিশ্চয়ই গৌরব করার মতো কিছু আছে, তবে তা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই রাখতে হবে। কারণ তখনকার সময়ে ভাষাটি শুধু স্তিমিতই নয়, পরিশীলিত আধুনিক মননের কাছে দূরবর্তীও হয়ে পড়েছিল। মুনীর চৌধুরী এর পেছনে কারণও খুঁজেছেন; দেখিয়েছেন পুঁথিসাহিত্যের ভাষা উদ্ভবের পেছনে যেমন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে, তেমনি তা কৃত্রিম ও অস্বাভাবিকও। এছাড়া এটি ধরনের কাব্যভাষা, যা গদ্যের অনুপযোগী। ভাষাটি একদা মুসলমান আমজনতার সাহিত্যক্ষুধা নিবারণে আদরণীয় হয়ে উঠলেও তা ছিল মুনীর চৌধুরীর ভাষায় অপেক্ষাকৃত প্রাণহীন, গ্রামীণ ও স্থূল পোয়েটিক ডিকশনে ভরা।
আরও একটি বিষয়ে মুনীর চৌধুরী দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানিয়েছেন যে-ইসলামি ভাবমণ্ডলের জন্য এমনতর ভাষারীতির প্রসঙ্গ আসছে সে-রীতি উনিশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে মধ্যবিত্ত মুসলমান লেখকরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এঁরা সকলে ছিলেন সেই জাতের লেখক যাঁরা ইসলামের ভাবাদর্শ প্রচারে ব্রতী হয়েছিলেন। মুনীর চৌধুরী এও জানান যে, পুঁথিসাহিত্যের অনেক বিষয়ের সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধের বিরোধও রয়েছে। তাই আধুনিক মানুষের জীবনবোধ ও মননে যে-ভাষা লালিত তার সঙ্গে পুঁথির ভাষার বেশ ফারাক। তাই এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা যেমন উচিৎ নয়, তেমনি প্রচলনে চেষ্টা করাও সংগত নয়।
এভাবে ভাষাকমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী সম্ভাব্য গদ্যরীতির যে-ছাঁচ মুনীর চৌধুরী দেখতে পেয়েছিলেন তা অযৌক্তিক ও অন্তঃসারশূন্য বলে মনে করলেন। সরলীকরণের নামে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা গদ্যরীতির উৎখাতকরণকে একধরনের মননশীল দেউলিয়াপনা বলে তার মনে হয়। এ ধরনের রীতির পেছনে যে জাতীয়তাবোধ কিংবা ঐতিহ্যের কথা বলা হয় তাতেও তিনি দ্বিমত পোষণ করেন।
গদ্যরীতির বিষয়ে মুনীর চৌধুরীর সাধারণ দর্শন ছিল পৃথিবীর সেরা ভাষাগুলোর গদ্যরীতি যেভাবে গড়ে উঠেছে বাংলা গদ্যরীতি সেভাবেই গড়ে উঠুক; জবরদস্তি করেও নয় কিংবা বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষেও নয়। কারণ ভাষাচেতনা শুধু জীবনচেতনার অংশ নয়, তা মানুষের শিল্পচেতনারও অচ্ছেদ্য অংশ এবং তা সাহিত্যরস আস্বাদনেরও মাধ্যম। তাই জীবনের মর্মগত ও বৌদ্ধিক দিক উন্মোচনের লক্ষে কথাশিল্পী বা গদ্যলেখকেরা ভাষায় বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশল দেখান, ভাষাকে শিল্পসৌকর্যে পৌঁছান। মুনীর চৌধুরীর দৃষ্টিতে সরল ও সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক ভাষায় শিল্পীরা সন্তুষ্ট নন; শুধু তাই নয়, তিনি মনে করেন শিল্পীদের দায়িত্ব হলো অভ্যাসের দাসত্ব থেকে ভাষাকে মুক্ত করা। বাংলা গদ্যরীতিতে এমন প্রয়াস মুনীর চৌধুরী পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং দেখেছেন কীভাবে সৃষ্টিশীল ও ভাবুক লেখকদের সাধনায় বাংলা গদ্যরীতি বিভিন্নমুখী প্রয়াস পেয়েছে।
ভাষার স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে বাংলা ভাষারও নানা ঔপভাষী রূপ রয়েছে, আর তাই পশ্চিমবঙ্গের ভাষার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও সমাজভাষাতাত্ত্বিক রকমফের বিদ্যমান। কলকাতা নানা কারণে বঙ্গদেশের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল, বঙ্গভঙ্গ ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকাও আরেকটা কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ধর্ম ও সমাজসংস্কৃতিগত আলাদা বিশেষত্ব দুই অঞ্চলে তো ছিলই, তাই পূর্ববঙ্গের সৃষ্টিশীল লেখকরা যখন নতুন বাস্তবতায় সাহিত্যচর্চা করতে এলেন, বিশেষ করে কথাসাহিত্যিকেরা গ্রামকে কেন্দ্রবিন্দু করে জীবনের রূপায়ণে ভাষায় গ্রামীণ উপাদান ব্যবহার করতে থাকেন। এমন নয় যে তাঁরা শুধু সংলাপে পূর্ববঙ্গীয় রূপ ব্যবহার করছেন, অনেকে সচেতনভাবে কাহিনি বর্ণনায়ও রচনারীতি হিসেবে পূর্ববঙ্গীয় ঢং ব্যবহার করেছেন। পূর্ববঙ্গের ভাষায় কীভাবে একটা নিজস্ব রীতি গড়ে তোলা যায় এটা তাঁদের সুপ্ত কিংবা সচেতন অভিপ্রায় ছিল।
মুনীর চৌধুরী এক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘দুই তীর’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলি ও ‘ক্ষুধা ও আশা’, শাহেদ আলীর ‘একই সমতলে’ এবং শহীদুল্লা কায়সারের ‘সারেং বৌ’ প্রভৃতি রচনার ভাষারীতিকে পর্যবেক্ষণ করে চমৎকৃত হয়েছেন। এছাড়াও তিনি দেখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও শহীদুল্লা কায়সার নোয়াখালির, শামসুদ্দীন আবুল কালাম বরিশালের, শাহেদ আলী সিলেটের এবং হাসান আজিজুল হক কুষ্টিয়ার উপভাষাকে গদ্যে কীভাবে নিপুণতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন এবং এসব অঞ্চলের ভাষা-উপাদান বাংলা গদ্যের নবায়নে/রূপ ও রীতিতে কেমন সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে। মুনীর চৌধুরী এসব সাহিত্যিকের গদ্যকে বাংলা গদ্যরীতির একটি উৎকর্ষ রূপ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
তবে তাঁর মূল্যায়নে এই রীতি আঞ্চলিক কিংবা গ্রাম্য দোষে দুষ্ট ছিল না। এর পেছনে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন উল্লিখিত লেখকদের মনন ছিল আধুনিক শিল্পীর এবং সকলেই ছিলেন নাগরিক-জীবনের অধিকারী। কেউ কেউ বিশ্বনাগরিক মনন নিয়ে লেখালেখিতে এসেছিলেন। সকলের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল উদার, কোনোরূপ সংকীর্ণতা তাঁদের মধ্যে ছিল না। তাই তাদের গদ্য বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।
মুনীর চৌধুরী পূর্ববাংলার গদ্যের দ্বিতীয় একটা রীতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, ভাষায় বহুল পরিমাণে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার। তিনি একে রাম রাম বসু, টেকচাঁদ ঠাকুর ও বিদ্যাসাগরের বিদ্রূপাত্মক রচনার সর্বজন অনুসৃত ধারাজাত বলে অভিহিত করেন। আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’ ও হাবীবুল্লাহ বাহারের ‘হিং ও হালিম’ রচনা-দুটিকে এই রীতির চূড়ান্ত রূপ বলে বিবেচনা করেন। তবে ষাটের দশক থেকে ধারাটি ক্ষীণ হয়ে যায় নানা কারণে।
মুনীর চৌধুরী এক্ষেত্রে প্রধান কারণ হিসেবে দেখেন একদল তরুণ লেখকদের আবির্ভাব, যাঁরা নতুন রীতির উদ্ভাবনে ও অনুশীলনে প্রয়াসী হন। এমনকি যাঁরা আরবি-ফারসির প্রধান্য বজায় রেখেছিলেন তাঁরাও জীবনের রূপায়ণের প্রয়োজনে এমনটি ব্যবহার করেন। এছাড়াও তাঁদের রচনারীতিতে মুনীর চৌধুরী দেখেছেন বিদেশি শব্দের পরিচিত দেশজ রূপ-রূপান্তরও। কথাশিল্পী ও বিদগ্ধ শওকত ওসমানকে মুনীর চৌধুরী পূর্বপাকিস্তানের আধুনিক গদ্যকারদের পথিকৃত বলে মনে করেন। গদ্যে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারের এমন কুশলতাকে বাংলায় ব্যতিক্রম ও অনন্য বলেও মন্তব্য করেন। শওকত ওসমানের গদ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বিদগ্ধতা। ব্যাকরণসম্মত পদগঠন ও অভিপ্রায় অনুযায়ী আরবি-ফারসি উপাদানের মিশ্রণ বাংলা গদ্যরীতির একটি বিশেষ দিক হিসেবে তিনি দেখেছেন। শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’কে এই শ্রেণির গদ্যরীতির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেন মুনীর চৌধুরী।
ষাটের দশকে আরও একদল তরুণ লেখকের রচনার মধ্যে মুনীর চৌধুরী প্রত্যক্ষ করেছেন এই অঞ্চলের গদ্যরীতির একটি বিশেষ রূপ। এঁরা সকলে বয়সে তরুণ ছিলেন; দেশপ্রেমের নামে গ্রাম্যতা, ধার্মিকতার নামে কূপমণ্ডূকতা এবং নীতিপরায়ণতার নামে অমানবিকতা ও ভণ্ডামো এঁরা পছন্দ করতেন না। শিল্পদর্শনে এই তরুণেরা ছিলেন নতুনের বাহক, অকপট ও বিশুদ্ধবাদী।
মুনীর চৌধুরী এঁদের মনোভাবকে মধ্যযুগীয়তা বিরোধী ও লোকসংস্কৃতির স্থ’ূল সরলতার পরিপন্থী বলে অভিহিত করেন। এই লেখকদের গদ্যরীতিকে তিনি অনভ্যস্ত রূপের এবং অনাধুনিক পাঠকের কাছে অবোধ্য বলেও চিহ্নিত করেন। নতুনভাবে প্রবর্তিত এই গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য ছিল অভিধান ঘেঁটে শব্দনির্বাচন, ব্যাকরণের কঠিন নিয়মে পদের গঠন, আর বাক্যের গ্রন্থী জটিল ও দীর্ঘসূত্রী করা। শওকত ওসমানের বরাত দিয়ে মুনীর চৌধুরী এই গদ্যরীতিকে ‘প্রখর আত্মস্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত দুরূহ কলারীতি’র বলেও অভিহিত করেন। এই ধারার উল্লেখযোগ্য গদ্যকার হিসেবে তিনি আবদুল মান্নান সৈয়দের নাম উদ্ধৃত করেন। সৃষ্টিশীল লেখকদের নিজস্ব গদ্যশৈলী নির্মাণের নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং মুনীর চৌধুরীর এমন পর্যবেক্ষণ তৎকালীন বাস্তবতায় খুব তাৎপর্যবহ ছিল।
বাংলা ভাষার সহজীকরণ, নতুন ভাষারীতির আয়োজন কিংবা ভাষার আঞ্চলিকীকরণ ইত্যাদি নিয়ে নানা কর্মকাণ্ড যখন পাকিস্তান-উত্তর কালে চলছিল মুনীর চৌধুরী শুধু পর্যবেক্ষক কিংবা সৃষ্টিশীল বা মননশীল লেখক হয়েই থাকেননি, সংস্কারপন্থীদের গদ্যরীতি পরিবর্তনের কর্মকাণ্ডকে রোধ করতেও চেয়েছেন। শুধু ভাষাকমিটির সুপারিশের বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তই করেননি তিনি; বাংলা গদ্যরীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস ও বিবর্তনের ধারাও বিশ্লেষণাত্মসূত্রে হাজির করে জনমত গঠনের চেষ্টাও করেছেন।
ভাষার স্বাভাবিক গতিবিধি ও বিবর্তনধারায় ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ প্রয়োগ করে মুনীর চৌধুরী দেখিয়েছেন সংস্কারের নামে যা প্রস্তাবাকারে উপস্থাপন করা হয়েছে তা অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক। এছাড়াও ভাষারীতি গড়ে উঠার ব্যাপারে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা পালন করেন যে-সৃষ্টিশীল লেখক সম্প্রদায়, প্রায় বিশ বছরের বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের রচনাভঙ্গি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও দেখিয়েছেন লেখকেরা প্রস্তাবিত ভাষারীতির ধারেকাছেও নেই। বরং মুনীর চৌধুরী দেখিয়েছেন পূর্বপাকিস্তানে তিনটি পৃথক রীতির গদ্য গড়ে উঠছে মূলধারার ভাষারীতির বিবর্তনের পথ ধরে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য কেমন হবে তার ডিসকোর্সও তাতে সন্ধান করলে পাওয়া যেতে পারে।