leadT1ad

ক্যাম্পাসের পিঠা ফিরিয়ে আনে গ্রামের শৈশব

অমিত বাপি বিশ্বাস
অমিত বাপি বিশ্বাস

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২: ৩৭
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ‘পিঠা চত্বর’ থাকলেও এখন আর নেই। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

শীতের সকাল মানেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো হলগুলোতে আয়েশি ঘুমভাঙা। জানালার কাঁচ চুইয়ে আসা ফ্যাকাশে রোদটুকু শরীরে মেখে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকার মধ্যে সে এক অপার আনন্দ। কিন্তু শীতের এই সকালেবলা আমার মতো গ্রামের আবহে বেড়ে ওঠা ছেলেদের জন্য অন্য এক স্মৃতির দরজাও খুলে দেয়—পিঠার স্মৃতি। ক্যাম্পাসের পরিবহন চত্ত্বরে, বটতলায়, টারজানে বা রাস্তার মোড়ে মোড়ে যখন গরম পিঠার মৌ-মৌ গন্ধ ভাসে, তখন মনটা ছটফট করে ফেরে ফেলে আসা শৈশবে।

আমার মা আর দিদিমা, এই দুজনই হলেন পিঠা তৈরির জাদুকর। গ্রামে শীত পড়ত জাঁকিয়ে। কুয়াশায় ভেজা নরম সকালে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসে থাকতাম চুলার পাশে। একদিকে আগুন পোহানো, অন্যদিকে দেখতাম পিঠা বানানো। সেই দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। দিদিমা চালের গুঁড়ো চেলে, খেজুরের গুড় জাল দিয়ে, আর নারকেল কোরা মিশিয়ে যে প্রস্তুতি পর্ব শুরু করতেন, তা-ই ছিল উৎসবের শুরু।

প্রথমেই আসত ভাপাপিঠা। এ পিঠা যেন শীতের সকালের প্রতীক। মাটির হাঁড়িতে জল ফুটছে, তার ওপর ছোট মাটির সরা বা কাঁথা দিয়ে ঢাকা। ভেতরে চালের গুঁড়ো, নারকেল আর গুড়ের উষ্ণ-মিষ্টি পুর। সরার ঢাকনা সরিয়ে যখন গরম ধোঁয়া ওঠা নরম পিঠাটি হাতে দিতেন দিদিমা, তখন হাতের তালু পুড়ত, কিন্তু মুখে দেওয়ার পর তা মনেও থাকত না। সে এক স্বর্গীয় স্বাদ!

আর ছিল তেলপিঠা, যার আরেক নাম পাকান পিঠা। মা খুব যত্ন নিয়ে আটার গোলা তৈরি করতেন, যেন সেটি একদম মসৃণ হয়। গরম তেলে যখন একটা একটা করে পিঠা ছাড়া হতো, তখন সেগুলো ফুলে বেলুনের মতো হয়ে যেত। লালচে হয়ে ওঠা সেই পিঠাগুলো গুড়ের রসে ডুবিয়ে রাখলে তৈরি হতো আরেক অমৃত। দিদিমা এ পিঠাকে বলতেন ‘রসের পিঠা’।

কুয়াশায় মোড়া শীত নেমেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
কুয়াশায় মোড়া শীত নেমেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

দিদিমার হাতে বানানো আরও ছিল বাহারি পিঠা। চিতই পিঠা বানানো হতো মাটির ছাঁচে। সেই ছাঁচ ভরে চালের গোলা দেওয়ার পর যখন পিঠাগুলো টুপটাপ করে উঠে আসত, তা ছিল দেখার মতো। এই চিতই পিঠা খাওয়ার দুটো ধরন ছিল—মাঝে মাঝে মাংসের ঝোলে ডুবিয়ে ঝাল-ঝাল স্বাদ নেওয়া, আর অন্য সময় ঘন দুধের ক্ষীরে ভিজিয়ে মিষ্টান্নর মতো খাওয়া। দুধ-চিতই পিঠা বানানোর জন্য মা আগের দিন রাতে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে রাখতেন। পরদিন সকালে চিতইগুলো দুধে ডোবালেই হয়ে যেত দুধ-চিতই।

মা আর দিদিমা পিঠা বানানোর সময় গল্প করতেন, হাসতেন। সেই দৃশ্যগুলোই এখন আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ। শহুরে যান্ত্রিক পরিবেশে বা হলরুমে থেকে সেই দৃশ্য তো আর ফেরে না, কিন্তু ক্যাম্পাস তার নিজের মতো করে শীতের সেই আমেজ ধরে রেখেছে।

জাহাঙ্গীরনগরের প্রতিটি শীতকালই যেন পিঠার মেলা। হলের গেটের সামনে, লাইব্রেরির পাশে বা ক্যম্পাসের মূল গেটের বাইরে বসে অসংখ্য পিঠাবিক্রেতা। তাদের পিঠার স্বাদ গ্রামের মায়ের হাতের মতো না হলেও, এখানকার পিঠার মধ্যেও একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। এসব পিঠা ফিরিয়ে আনে গ্রামে ফেলে আসা এক টুকরো শৈশব।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ‘পিঠা চত্বর’ থাকলেও এখন আর নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ডজনখানেক পিঠার অস্থায়ী দোকান গড়ে উঠেছে। বটতলার মোড়ে, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে, পরিবহন চত্বর, মুরাদ চত্বর, ছবি চত্বর, অমর একুশের পাশে, টারজান পয়েন্ট, বটতলা, আলরেুনি হল, প্রীতিলতা ও শেখ হাসিনা হলের সামনে বসে পিঠার দোকানগুলো।

শীতকাল এলে হলের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আমরাও মেতে উঠি যেন পিঠা-উৎসবে। এখানে চিতই আর ভাপাপিঠাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে জটলা করে পিঠাবিক্রেতাদের ঘিরে ধরে। হাতে তুলে নেয় গরম ভাপা। এখানকার ভাপার বৈচিত্র্যও কম নয়—কেউ নারকেল-গুড় ছাড়াও ধনেপাতা, কাঁচামরিচ দিয়ে ঝাল স্বাদের ভাপা তৈরি করছে। আর চিতইয়ের সঙ্গে তো ধনেপাতা ভর্তা, শুটকি ভর্তা, মরিচ ভর্তা, কালোজিরা ভর্তা, সরিষা ভর্তাসহ নানাপ্রকার মুখরোচক ভর্তা থাকেই। বাইরের ঠান্ডা হাওয়া আর মুখের ভেতরে নিদারুণ ঝালের এক অসাধারণ অনুভূতি নিতে কেউ পিছপা হয় না।

এছাড়াও, সন্ধ্যায় পাওয়া যায় ফুল পিঠা বা ঝিনুক পিঠা। সুন্দর নকশা করা ছোট ছোট পিঠাগুলো তেলে ভেজে চিনির শিরায় ডুবিয়ে রাখা হয়। দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও তেমনি মিষ্টি। ক্যাম্পাসে এসেই এগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার। পাটিসাপটা পিঠাও ক্যাম্পাসে বেশ প্রসিদ্ধ। গুড় আর নারকেলের সমন্বয়ে বানানো ১৫ টাকার এমন অমৃত নিয়ে কাড়াকাড়ি বাঁধে। বানানোর সঙ্গে সঙ্গে ডালা হয়ে যায় খালি।

প্রায়শই বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে বিলম্বিত দীর্ঘ ক্লাসগুলো শেষ করে বিকেলে পিঠার দোকানে গিয়ে প্রতিযোগিতা হয় পিঠা খাওয়ার। কে একটানা কতগুলো পিঠা খেতে পারে! শিক্ষকরাও কম যায় না, তারাও এসে যোগ দেন এই প্রতিযোগিতায়। অবশ্য একপ্রকার বাধ্য হয়েই আসেন তারা, বলা ভালো ধরে নিয়ে আসা হয়। সবাই যে যত পারি পিঠা খাওয়া যাবে, পয়সা দেওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না একদম।

ক্যাম্পাসের অদূরেই গ্রাম, সেখানে সাইকেল চালিয়ে ভোরবেলা খেজুরের রস খেতে যাওয়াও কিন্তু শীতের সকালের অন্যতম আকর্ষণ। খুব ভোরে উঠে কয়েকজন বন্ধু মিলে যেতে হয় গেরুয়া, পানধোয়া বা গকুলনগরের দিকে। সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা খেজুর রস পান করে আবার হলে ফিরে ঘুম। তবে সকালে প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়াটাও এক বিশাল যুদ্ধ। বেশিরভাগ সময়েই আলসেমিতে ঘুম থেকে উঠতে না পারার কারণে সময় পেরিয়ে যেত।

ঢাকা শহরে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে শীতের দিনে পিঠা সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেটা চোখে পড়ে সেটা হলো বিভিন্ন রকম ভাজাপোড়া আর পাকোড়া। ক্যাম্পাসে যে কতপ্রকার ভাজাপোড়া রয়েছে বলে শেষ করা প্রায় অসম্ভব। পিঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি এসব তো রয়েছেই সঙ্গে থাকে মাশরুম চপ, ডিম চপ, ভেজিটেবল চপ, ফুলকপি চপ, চিকেন চপ, মরিচ চপ, ধনে পাতার চপ আরও কত কি!

এমনিতেই সারা বছর বন্ধের দিনে দর্শনার্থীতে ভরে থাকে ক্যাম্পাস। শীতের সময় এই দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। কারণ শীতের পাখি দেখার সঙ্গে শীতের পিঠা খাওয়ার সুযোগ অনেকেই হাতছাড়া করতে চান না। অনেকটা রথও দেখা কলাও বেচার মতো। তাই তো দেখা যায় অনেকে পরিবারসহ ভোরবেলায় উপস্থিত হয়েছেন পাখি দেখতে। এরপর সারাদিন ক্যাম্পাসে ঘুরে সন্ধায় ঠিকই উপস্থিত হয়েছেন এই সব পিঠার দোকানে। কেউ কেউ পিঠা খেয়ে যান, আবার কেউ কেউ কিনে নিয়ে যান বাড়ির অন্যান্যদের জন্য।

তবে সে যাই হোক, গ্রামের মা-দিদিমার উষ্ণতা ভরা চুলার ধোঁয়ার মধ্যে তৈরি হওয়া পিঠাগুলোর সঙ্গে ক্যাম্পাসের এই পিঠার স্বাদ ও অভিজ্ঞতার পার্থক্য আছে। গ্রামে আছে আন্তরিকতা ও সরলতা, আর ক্যাম্পাসে আছে তারুণ্যের হুল্লোড় ও আধুনিকতার ছোঁয়া। কিন্তু দুটো জায়গারই মূল উদ্দেশ্য এক—শীতকে স্বাগত জানানো, আর পিঠার মাধ্যমে এক টুকরো মিষ্টি আনন্দ ভাগ করে নেওয়া।

Ad 300x250

সম্পর্কিত