আমাদের সমাজ ও রাজনীতির আঙিনায় চোখ রাখলে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে—এখানে কথার কোনো অভাব নেই। চায়ের কাপের ঝড় থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টকশো, রাজপথের জনসভা থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেমিনার কক্ষ; সর্বত্রই যেন কথার খই ফুটছে। সুবচন, প্রতিশ্রুতি আর পরিকল্পনার কোনো কমতি নেই। কিন্তু দিন শেষে যখন প্রাপ্তির খাতা মেলানো হয়, তখন দেখা যায় অর্জনের ঝুলিটি আশানুরূপ ভারী নয়। স্বাধীনতার পাঁচ দশকের বেশি সময় পেরিয়ে এসেও আমাদের অনেক মৌলিক সমস্যার সমাধান হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত একটাই—আমরা কথা বলি বেশি, কাজ করি কম। একটি রাষ্ট্র ও সমাজকে শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করাতে হলে কথার ফুলঝুরি নয়, প্রয়োজন নিঃস্বার্থ ও দক্ষ ‘কাজের মানুষ’।
আমাদের জাতীয় চরিত্রের একটি বড় দুর্বলতা হলো আবেগপ্রবণতা ও বাগাড়ম্বর। আমরা অতীত নিয়ে গর্ব করতে পছন্দ করি, ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি, কিন্তু বর্তমানের কঠোর পরিশ্রমকে ভয় পাই। রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি কোনো জাদুকরী বক্তৃতায় রচিত হয় না, তা রচিত হয় ঘাম, শ্রম, সততা আর মেধার সমন্বয়ে। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো ‘কর্মসংস্কৃতি’ বা ওয়ার্ক এথিকস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া জাপান কিংবা দক্ষিণ কোরিয়া আজ বিশ্ব অর্থনীতিতে দাপট দেখাচ্ছে কেবল তাদের নাগরিকদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। তারা কথা কম বলে কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছে। আর আমরা সেখানে ছোটখাটো অর্জন নিয়েই আত্মতুষ্টির ঢেকুর তুলি এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করি অনর্থক বাহাসে।
রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে—প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিল্পখাতে—আজ ‘কাজের মানুষ’-এর বড্ড অভাব। এখানে ‘কাজের মানুষ’ বলতে কেবল অফিসে উপস্থিত থাকা ব্যক্তিকে বোঝানো হচ্ছে না। কাজের মানুষ তিনি, যার মধ্যে তিনটি গুণ বিদ্যমান: দক্ষতা, সততা এবং দায়বদ্ধতা। আমাদের প্রশাসনে ফাইলে সই করার লোকের অভাব নেই, কিন্তু ফাইলটি যাতে জনকল্যাণে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেই মানসিকতা লালন করা লোকের অভাব প্রকট। আমাদের প্রকৌশলীরা বড় বড় ডিগ্রিধারী, কিন্তু রাস্তার কাজ শেষ হওয়ার ছ’মাসের মধ্যে যখন কার্পেটিং উঠে যায়, তখন বোঝা যায় সেখানে দক্ষতার চেয়ে দুর্নীতির প্রাধান্য ছিল বেশি। অর্থাৎ, নিছক কাজ করা নয়, কাজটি সঠিক নিয়মে ও নিষ্ঠার সঙ্গে করাই হলো আসল চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ মেধা ও শ্রম ব্যয় করছে কেবল সরকারি চাকরির পেছনে ছুটে। সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার চেয়ে ‘নিরাপদ জীবন’ তাদের কাছে বেশি কাঙ্ক্ষিত। এর ফলে সমাজ এমন একদল মানুষ পাচ্ছে, যারা রুটিন মাফিক কাজ করতে পারে, কিন্তু সংকট মোকাবিলায় বা নতুন কিছু সৃষ্টিতে তারা অপারগ। রাষ্ট্র গঠনে দরকার ভিশনারি বা দূরদর্শী মানুষ, যারা সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধান খুঁজবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক কাঠামো অনেক ক্ষেত্রেই সেই ‘কাজের মানুষ’ তৈরির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা সনদসর্বস্ব শিক্ষিত তৈরি করছি, কিন্তু কর্মদক্ষ মানবসম্পদ গড়তে পারছি না।
রাজনীতির মাঠেও একই চিত্র। নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়। নেতারা আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখান। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয় যৎসামান্যই। অথচ রাষ্ট্রনায়ক বা জনপ্রতিনিধিদের হওয়ার কথা ছিল সমাজের সবচেয়ে বড় ‘কাজের মানুষ’। তাদের কাজ শুধু ফিতা কাটা বা বক্তৃতা দেওয়া নয়, বরং নীতি নির্ধারণ করা এবং তা বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে তদারকি করা। যখনই কোনো নেতা কথার চেয়ে কাজকে প্রাধান্য দেন, তখনই দৃশ্যমান পরিবর্তন আসে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কর্মবীরদের চেয়ে বাগপটুদের কদর বেশি।
সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও আমরা বড্ড বেশি পরনির্ভরশীল। আমরা চাই সমাজ বদলাক, রাস্তাঘাট পরিষ্কার থাকুক, ট্রাফিক আইন মানা হোক—কিন্তু এই কাজগুলো নিজে করার দায় নিতে চাই না। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যায়ের প্রতিবাদে ঝড় তুলি, কিন্তু বাস্তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই না। এটি এক ধরনের পলায়নপর মানসিকতা। সমাজ গঠনে প্রতিটি নাগরিকের ভূমিকা রয়েছে। একজন কৃষক যখন রোদে পুড়ে ফসল ফলান, একজন শ্রমিক যখন কারখানায় চাকা সচল রাখেন, কিংবা একজন প্রবাসী যখন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে রেমিট্যান্স পাঠান—তারা প্রত্যেকেই একেকজন নীরব দেশপ্রেমিক ও কাজের মানুষ। তাদের এই শ্রমের ওপরই রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তথাকথিত ‘এলিট’ বা বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কথার আড়ালে এই শ্রমজীবী মানুষের অবদান অনেক সময় ম্লান হয়ে যায়।
এখন সময় এসেছে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর। বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। এখানে টিকে থাকতে হলে কথার জাদুতে কাজ হবে না, প্রয়োজন কারিগরি দক্ষতা ও নিরলস পরিশ্রম। আমাদের বিশাল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন কর্মমুখী শিক্ষা এবং কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। যে সমাজ কাজকে ছোট করে দেখে এবং চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দেয়, সে সমাজ কখনোই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।
পরিশেষে বলা যায়, একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের ‘মাইক সর্বস্ব’ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সভা-সেমিনারের টেবিলে ঝড় না তুলে, মাঠপর্যায়ে কাজের গতি বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রকে মূল্যায়ন করতে হবে কাজের ভিত্তিতে, কথার ভিত্তিতে নয়। যে ব্যক্তি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সততার সাথে পালন করেন, তিনিই প্রকৃত দেশপ্রেমিক। আজ আমাদের প্রয়োজন এমন একদল মানুষ, যারা সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনে না ছুটে নীরবে নিভৃতে দেশের জন্য কাজ করে যাবেন। কারণ, ইতিহাস সাক্ষী—শব্দ মিলিয়ে যায়, কিন্তু কর্মের ফল অনন্তকাল বেঁচে থাকে। তাই আসুন, কথার ফুলঝুরি থামিয়ে আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রকৃত ‘কাজের মানুষ’ হয়ে উঠি।