আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে জটিল ও মতবিরোধে পূর্ণ মনে হলেও, এর গভীরে একটি নির্বাচনমুখী স্রোত সক্রিয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রায় সবাই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি যেসব দল বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছে, তারাও পরোক্ষভাবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ও প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষও রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা কর্মসূচিতে শামিল হচ্ছে, যা প্রমাণ করে দেশের মানুষ ভোট প্রদানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তবে এই আশাবাদের বিপরীতে রয়েছে সংশয়, প্রস্তুতির ঘাটতি এবং নতুন যুগের নতুন চ্যালেঞ্জ।
সংশয়ের মেঘ বনাম প্রস্তুতির আশ্বাস
সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং বারংবার সে কথাই বলে আসছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বমূলক বার্তা না থাকায় নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠানের একটি আনুষ্ঠানিক চিত্র ফুটে উঠেছে। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) তাদের কার্যক্রম জোরেশোরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস, প্রবাসী ভোটারদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু এবং মাঠ প্রশাসনে রদবদল—এই সবই নির্বাচন পূর্ববর্তী প্রস্তুতিরই অংশ।
তবুও, জনমনে একটি চাপা সংশয় রয়েই গেছে। বিশেষ করে ‘জুলাই সনদ’ এবং গণভোটের মতো বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান মতবিরোধ এই সংশয়কে আরও ঘনীভূত করছে। বিএনপি যে কোন মূল্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী জাতীয় নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ ইস্যুতে গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে কিছুদিন আগে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করেছে। এখনো দলটি একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠানের পক্ষে নয়। আর বিএনপি একই দিনে দুটি ভোট অনুষ্ঠানের পক্ষে। ভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন পরস্পরবিরোধী অবস্থান সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি করছে—আসলেই কি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে? এই দ্বিধা সত্ত্বেও, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দৃশ্যমান তৎপরতা ইঙ্গিত দেয় যে, সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনের পথেই হাঁটছে।
প্রস্তুতির মূল্যায়ন: ঘাটতি ও সক্ষমতা
নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের প্রস্তুতি কতটুকু সম্পন্ন হয়েছে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থান এবং বিগত বছরগুলোতে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থাহীনতা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। বিচার বিভাগীয় সংস্কারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে নির্বাচনী প্রস্তুতি শতভাগ নিখুঁত বলা কঠিন। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার নির্বাচন আয়োজনের মতো একটি ন্যূনতম প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়টি এখনো উদ্বেগের। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি এবং সরকারের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এখনো কিছু ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনে যেসব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের প্রশিক্ষণের বিষয় রয়েছে। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। নির্বাচনে মোট ৯ লাখ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নানা সময়ে জানানো হয়েছে। কাজেই এই অল্প সময়ের মধ্যে সবার প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা বেশ চ্যালেঞ্জিং, যা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিতে ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে এই ঘাটতিগুলো কাটিয়ে ওঠার সুযোগ এখনো রয়েছে।
নতুন চ্যালেঞ্জ: ডিজিটাল ষড়যন্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
বিগত নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। সোশ্যাল মিডিয়া এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে নির্বাচনী প্রচারণায় নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হলে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়ানো, প্রতিপক্ষকে হেয় করা এবং জনমতকে বিভ্রান্ত করার একটি বড় আশঙ্কা রয়েছে। ‘ডিপফেক’ বা এআই-জেনারেটেড কন্টেন্ট ব্যবহার করে বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতাও তৈরি করা সম্ভব।
এই ডিজিটাল ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি এখনো স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বিশেষ সেল গঠন করে সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং এবং ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের একটি সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণয়ন করা অপরিহার্য। অন্যথায়, এই প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
সনাতন ঝুঁকি: নির্বাচনী সহিংসতা ও প্রতিকার
বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে ভোটকেন্দ্র দখল, সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা একটি পরিচিত চিত্র। যদিও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার পরিবর্তনের ঢেউ উঠেছে, যা ইতিবাচক আচরণের বার্তা দেয়, তবুও পুরনো অভ্যাসগুলো থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়।
এবারের নির্বাচনেও এমন সহিংসতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই ঝুঁকি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন অনেকে। তবে নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত একটি বড় রক্ষাকবচ হতে পারে। সেনাবাহিনী প্রধানের পক্ষ থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে আরও সক্রিয় ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। এর পাশাপাশি, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ভোটকেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরা বা আধুনিক মনিটরিং ব্যবস্থা স্থাপন একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে। এর মাধ্যমে কোনো কেন্দ্রে অনিয়ম বা সহিংসতা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে সেই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকেও এড়িয়ে যেত পারবে।
শেষ মুহূর্তের করণীয়
নির্বাচনের বাকি আর মাত্র দুই মাস। এই সময়ে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে কয়েকটি বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন: প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয়, সুসংগঠিত ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতা কঠোরভাবে দমনের মানসিকতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়া ও এআই-এর অপব্যবহার রোধে একটি কার্যকর কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তৃতীয়ত, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, ভোটকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রেরণ এবং প্রবাসী ভোটারদের ভোট গ্রহণ ও গণনার একটি স্বচ্ছ ও কার্যকর পদ্ধতি দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে। পাশাপাশি, রাজনৈতিক দলগুলোকে নেতিবাচক প্রচারণা পরিহার করে ইস্যুভিত্তিক ও নীতিভিত্তিক প্রচারণায় মনোনিবেশ করতে হবে। তারা নির্বাচিত হলে দেশের জন্য কী করবেন, সেই পরিকল্পনা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।
সবশেষে, বাংলাদেশের জনগণ একটি নির্বাচনমুখী অবস্থায় রয়েছে। নানা সংশয় ও চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা এখনো উজ্জ্বল। সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত ও আন্তরিক প্রচেষ্টা একটি শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরি করতে পারে, যা দেশের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে। আগামী দুই মাস তাদের সম্মিলিত প্রজ্ঞা ও দায়িত্বশীলতার চূড়ান্ত পরীক্ষা নেবে।
লেখক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও উপ-উপাচার্য, কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ