leadT1ad

নাগরিক অধিকারের পোড়া দলিল কড়াইল বস্তি

ইমরান নাফিস
ইমরান নাফিস

কড়াইল বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের একাংশ।

ঢাকার মানচিত্রে কড়াইল অদ্ভুত এক জনপদ। গুলশান লেকের ওপারে তাকালে ঘিঞ্জি ও ব্যস্ত যে বসতি, সেটিই কড়াইল। দূর থেকে প্রথম দেখলে একে দারিদ্র্যের একঘেয়ে মানচিত্র মনে হবে। পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গুলশান-বনানীর জৌলুসপূর্ণ অট্টালিকা দেখলে কড়াইল নিয়ে যে কারও মনে জাগবে বাড়তি কৌতূহল। কিন্তু বস্তির ভেতরে পা রাখলে জীবনযাপনের যে সমীকরণ, তা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি অবিশ্বাস্য।

আগুন নিছক দুর্ঘটনা নাকি নকশা

কড়াইলে টিকে থাকা কোনো সহজ যুদ্ধ নয়। সেখানে নিয়মিত বিরতিতে আগুনের লেলিহান শিখা তাড়া করে ফেরে বাসিন্দাদের। বিগত এক দশকের (২০১৫-২০২৫) পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যায়, কড়াইল বস্তি যেন বারুদের স্তূপে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

২০১৬: মার্চে আগুন লাগে এবং একই বছরের ৪ ডিসেম্বর মহাখালীর বউবাজার অংশে ভয়াবহ আগুন। প্রায় ৫০০ ঘর ছাই। চোখের সামনে গুলশান লেক থাকলেও পানির অভাবে পুড়ে যায় শত শত স্বপ্ন।

২০১৭: ১৬ মার্চ রাত ২টার সেই বিভীষিকাময় আগুন। মুহূর্তেই হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত। অভিযোগ ওঠে, আইটি ভিলেজ বা হাই-টেক পার্ক প্রকল্পের জন্য জমি খালি করতেই এই নাশকতার আয়োজন।

২০১৮-২০২৪: আগুনের মিছিল থামেনি। ২০১৮ সালের মার্চ, ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি এবং ২০২৪-এর মার্চ। বিশেষ করে ২০২৪-এর ২৪ মার্চের আগুনে পুড়ে যায় ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা হাব, যা কেড়ে নেয় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের শেষ আশ্রয়স্থল।

কড়াইল বস্তিতে আগুন। স্ট্রিম ছবি
কড়াইল বস্তিতে আগুন। স্ট্রিম ছবি

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে একটি অদ্ভুত ‘সিজনাল প্যাটার্ন’ বা ঋতুভিত্তিক নকশা চোখে পড়ে। অধিকাংশ বড় আগুন লেগেছে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে। বস্তিবাসীর কাছে এই সময়টা এখন ‘মার্চ ফোবিয়া’ নামে পরিচিত। শুষ্ক আবহাওয়া হয়তো একটি কারণ। কিন্তু ঠিক এই সময়েই উন্নয়ন প্রকল্প বা উচ্ছেদের গুঞ্জনগুলো সবচেয়ে বেশি ডালপালা মেলে। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) আবার পুড়ল কড়াইল বস্তি।

জীবন যেখানে কঠিন

বস্তির সরু গলিতে কান পাতলে শোনা যায় এক অবিশ্বাস্য বাস্তবতার গল্প। এখানকার জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক ক্ষেত্রে শহরের অনেক অভিজাত এলাকার চেয়েও বেশি। শুনতে অবাক লাগলেও সত্য, ছোট একটি রুম ভাড়ার হিসেবে পার স্কয়ার ফুটে এখানকার বাসিন্দারা মাস শেষে যে পয়সা গুনেন, আনুপাতিক হারে ধানমন্ডি বা গুলশানের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদেরও এত দিতে হয় না। অথচ এই চড়া মূল্যের বিনিময়ে কী পান তারা? নাগরিক হিসেবে সংবিধান স্বীকৃত অধিকারের ছিটেফোঁটাও মেলে না। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন অথবা রাস্তাঘাট কোনো কিছুতেই রাষ্ট্র এখানে স্বাভাবিক নিয়মে ধরা দেয় না। এখানে সবকিছুই খুব সংকীর্ণ, কঠিন এবং সর্বপরি বড্ড অনিশ্চিত।

গ্রাম থেকে নদীভাঙন বা অভাবের তাড়নায় আসা মানুষগুলোর কাছে নিজের অধিকার বলতে শুধুই কোনোমতে টিকে থাকা। গুলশানের অট্টালিকায় বসে যে এখন কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন, তাঁর পূর্বপুরুষও হয়তো কোনো এক সময় এই বাঁচার স্বপ্ন নিয়েই ঢাকা শহরে এসেছিলেন।

প্যাসিভ এভিকশন ও আইনি লড়াই

আইনি প্রেক্ষাপট বিচার করলে কড়াইলবাসীর পরিণতি আরও মর্মান্তিক। সংবিধানের ১৫(ক), ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে জীবন ও বাসস্থানের অধিকার স্বীকৃত হলেও কড়াইলে তা কাগুজে দলিল। ১৯৯৯ সালে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল, পুনর্বাসন ছাড়া বস্তিবাসী উচ্ছেদ করা যাবে না। ২০১২ সালে আবারও আদালত উচ্ছেদে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু এখানেই দখলদারত্বের চতুরতা বা নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়।

খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা। স্ট্রিম ছবি
খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা। স্ট্রিম ছবি

যখন আদালতের রায়ে বুলডোজার থামিয়ে দেওয়া হয়, তখন আসে আগুন। সমাজবিজ্ঞানী ও নগর গবেষকরা একে ‘প্যাসিভ এভিকশন’ বা পরোক্ষ উচ্ছেদ নাম দিয়েছেন। সরাসরি উচ্ছেদ না করে এমন এক ভয়ের সংস্কৃতি ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করা হয়, যেখানে মানুষ টিকে থাকতে না পেরে নিজেই সরে যায়। আগুন সব কেড়ে নেওয়ার পর উচ্ছেদের আর আইনি নোটিশ লাগে না; পুড়ে যাওয়া ভিটায় দাঁড়িয়ে মানুষ তখন অধিকারের বদলে কেবল ৫ হাজার টাকার ত্রাণের জন্য হাত পাতে।

উন্নয়নের প্যারাডক্স ও জেন্ট্রিফিকেশন

রাষ্ট্র প্রায়ই আগুনের কারণ হিসেবে শর্ট সার্কিট বা গ্যাস সিলিন্ডারের দোহাই দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র যখন বৈধ সংযোগ দেয় না, তখন কারা সেখানে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ সিন্ডিকেট গড়ে তোলে? এটি নাগরিক অধিকারের পদ্ধতিগত অস্বীকার।

এদিকে, ডিজিটাল বা স্মার্ট বাংলাদেশের দোহাই দিয়ে এখানে হাই-টেক পার্ক বা কাঁচের ভবন গড়ার স্বপ্ন অনেক দিন ধরেই দেখানো হচ্ছে। কাঁচের ভবনের জন্য কড়াইল বস্তিটা চাই চাই। আর সেটা একমাত্র উচ্ছেদের মাধ্যমে সম্ভব। যেহেতু আইনত করা যাচ্ছে না। তবে অগ্নিকাণ্ডের এই ক্রনিকল চিত্র অন্যভাবে উচ্ছেদকেই সমর্থন করে।

নগর পরিকল্পনাবিদদের ভাষায়, জেন্ট্রিফিকেশন। সোজা কথায়, গরিব হটিয়ে ধনীদের জন্য এলাকা তৈরি করা। হাই-টেক পার্কের ঝকঝকে দেয়ালের নিচে মেহনতি মানুষের নিঃশ্বাস চাপা পড়া কোনো সভ্য নগরের চিত্র হতে পারে না।

Ad 300x250

সম্পর্কিত