ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ সম্মেলন বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নেতাদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন উজাড়, তাপপ্রবাহ, খরা ও জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে বিশ্ব এখন অতিসংবেদনশীল অবস্থায়, এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এখন সবচেয়ে জরুরি। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা প্যারিস চুক্তির ধারা ৬-এর বাস্তবায়ন, কার্বন মার্কেট এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করছেন।
১২ নভেম্বর, বুধবার জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য অখণ্ডতা সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে প্রথমবারের মতো জলবায়ু সংক্রান্ত বিকৃত তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সবাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। ১২টি দেশ স্বাক্ষরিত এই ঘোষণাপত্রে সরকার, ব্যবসায়ী এবং শিক্ষাবিদদের সঠিক তথ্য প্রচার এবং জলবায়ু সংকটকে অস্বীকারকারী এবং পরিবেশ বিজ্ঞান ও পরিবেশ সাংবাদিকতার উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে প্রতিটি দেশকে একটি শক্তিশালী মিডিয়া ইকোসিস্টেমকে সমর্থন করা, জলবায়ু সমস্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও সংবাদ প্রচার করতে সবাইকে সমান অ্যাক্সেস দেয়া, তথ্যের অখণ্ডতা প্রচারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে, ভুল তথ্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বিজ্ঞাপন প্রতিরোধে বৃহৎ প্রযুক্তি সম্মিলিতভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। এখন পর্যন্ত স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, সুইডেন, উরুগুয়ে, নেদারল্যান্ডস এবং বেলজিয়াম। আন্তর্জাতিক মিডিয়া কন্টেন্ট ওয়াচডগ কোয়ালিশন অ্যাগেইনস্ট ক্লাইমেট ডিসইনফরমেশন এবং পরিবেশ ও গণতন্ত্র-কেন্দ্রিক গবেষণা সংস্থা অবজারভেটরি ফর ইনফরমেশন ইন্টিগ্রিটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ২০২৫ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিডিয়া এবং অনলাইনে প্রচারিত কপ-সম্পর্কিত বিভ্রান্তির পরিমাণ ২৬৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে পর কপ৩০ প্রেসিডেন্সির উন্মুক্ত পূর্ণাঙ্গ “স্টকটেক” মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় পরবর্তীতে আরও পরামর্শের প্রয়োজন বলে ঘোষনা করা হয় এবং “স্টকটেক” শনিবার পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। এই নিয়ে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার অতিরিক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবস্থা সংঘাত, দখলদারিত্ব এবং জলবায়ু সংকটের সাথে গভীরভাবে জড়িত। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক কনফ্লিক্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট অবজারভেটরি এর গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের সমগ্র সামরিক বাহিনী বিশ্বব্যাপী মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের কমপক্ষে ৫.৫% এর জন্য দায়ী। এর ফলে বিশ্ব সামরিক বাহিনী পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম কার্বন দূষণকারী, যেটি রাশিয়ার চেয়েও বড় অর্থাৎ কেবল চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের পরেই তার অবস্থান। গ্লোবাল নর্থ তার সামরিক বাহিনীতে জলবায়ু অর্থায়নের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ব্যয় করে। ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা ব্যয় ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের একটি দল সামরিক নির্গমনের সম্পূর্ণ হিসাব রাখার আহ্বান জানান।
কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলনে সাবেক মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট আল গোর সতর্ক করেছেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রভাব ও নিপীড়নের আশঙ্কায় বিল গেটস জলবায়ু সংকট নিয়ে তাঁর অবস্থান থেকে সরে যেতে পারেন। তিনি বিল গেটসের নতুন অবস্থানকে “মূর্খতা” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, ট্রাম্প নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মুখ ফিরিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রচার করে মার্কিন অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি করছেন। আল গোরের মতে, ট্রাম্পের জলবায়ু বিরোধী নীতি যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে; বর্তমানে চীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবুজ প্রযুক্তি রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে এবং এই প্রবণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক এনার্জি সংস্থা (আইইএ) তাদের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, আগামী দশকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশ্বের প্রধানতম শক্তি উৎসে পরিণত হবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসা এখন "অনিবার্য"। সংস্থাটির তথ্যমতে, আগামী পাঁচ বছরে পৃথিবী বিগত ৪০ বছরের তুলনায় বেশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প চালু হবে। এই প্রবৃদ্ধি বৈদ্যুতিক যানবাহন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ডেটাসেন্টারের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। প্রতিবেদনটিতে পারমাণবিক শক্তির এক নবজাগরণের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে এবং বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তাদের ডেটাসেন্টার পরিচালনায় নিম্ন-কার্বন বিদ্যুৎ ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে। ২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী ডেটাসেন্টার বিনিয়োগ ৫৮০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যা তেল সরবরাহে ব্যয় হওয়া অর্থের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আইইএ জানায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম-কার্বন জ্বালানি ব্যবস্থায় রূপান্তর টেকসই ভবিষ্যতের একমাত্র পথ। অয়েল চেঞ্জ ইন্টারন্যাশনালের ডেভিড টং কপ৩০ সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন “দ্রুত, ন্যায্য ও অর্থায়ননির্ভরভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধের” জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে। বিশ্ব এখনও ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ তেল এবং কয়লা উত্তোলনের সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর পথে রয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি নতুন প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, বিশ্বের জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পের তিন মাইল (৫ কিলোমিটার) এর মধ্যে বাস করে, যা সম্ভাব্যভাবে ২ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত কপ৩০ সম্মেলনের আগে দেশগুলো যে নতুন নির্গমন হ্রাস পরিকল্পনা জমা দিয়েছে, তা জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় খুবই সীমিত প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির দ্রুত সম্প্রসারণ সত্ত্বেও, কয়লা, তেল ও গ্যাস থেকে নির্গমন গত দশকে গড়ে ০.৮% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্ট–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালেও জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমন আরও ১% বৃদ্ধি পেতে পারে। ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার–এর সর্বশেষ তথ্যে বলা হয়েছে, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে, যা প্যারিস চুক্তিতে নির্ধারিত সীমাকে অনেক বেশি অতিক্রম করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি উষ্ণতা ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবে বিশ্বজুড়ে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে, যেমন প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস, বরফস্তর গলন, এবং আমাজন বনভূমির অবক্ষয় সহ চরম জলবায়ু বিপর্যয় দেখা দেবে। এখন পর্যন্ত মাত্র ১০০টি দেশ তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (NDCs) হালনাগাদ করেছে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ সম্মেলনের চতুর্থ দিনে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে আয়োজিত “প্যারিস চুক্তির ধারা ৬: নির্গমন হ্রাসের পথ” শীর্ষক সেশনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, কার্বন মার্কেট এবং নির্গমন হ্রাসের বাস্তবসম্মত কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। সেশন চেয়ার ছিলেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ সাফিউল্লাহ এবং পরিচালনা করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চ.দা.) মো. জিয়াউল হক। প্যানেলিস্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শরীফ জামিল ও মো. আলী আহমেদ, যারা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ শেয়ার করেন। একই অনুষ্ঠানে “Nature and Climate Change” ম্যাগাজিনের উদ্বোধন করা হয়। ধারা ৬.২ ও ৬.৪ অনুযায়ী স্বচ্ছ কার্বন বাণিজ্য ব্যবস্থা ও সহযোগিতামূলক পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় গুরুত্বারোপ করা হয়, যা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক জলবায়ু উদ্যোগে নেতৃত্ব ও টেকসই উন্নয়নে প্রতিশ্রুতি আরও দৃঢ় করবে।
ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলন শুরুর জন্য ৫,০০০ আদিবাসী কর্মী, বন রক্ষাকারী এবং অন্যান্য নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে ১০০ টিরও বেশি নৌকার একটি জলবায়ু ন্যায়বিচারের ফ্লোটিলা দল আয়োজক শহরে পৌঁছেছে, এটি মূল জলবায়ু আলোচনার পাশাপাশি চলতে থাকবে। এছাড়া বিশ্বের প্রায় ৫০ জন নেতা অংশ নিলেও অনেকেই উদ্বোধনী বৈঠক শেষে সভা ত্যাগ করেন। বন উজাড়, খরা ও জলবায়ু সংকটে আমাজন রেইনফরেস্ট দ্রুত “টিপিং পয়েন্ট”-এর দিকে এগোচ্ছে, যা রেইনফরেস্টকে কার্বন শোষক থেকে নির্গমন উৎসে পরিণত করতে পারে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, এই বিপর্যয় এড়াতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে। সম্মেলনে যুক্তরাজ্য, ইইউ ও জার্মানির নেতারা উপস্থিত থাকলেও চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুপস্থিত ছিলেন। এখন সবার একটাই প্রশ্ন - কপ৩০ কি এই বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে?
লেখক: ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।