leadT1ad

সংকট বাড়ায় কারা: বাজার নাকি মিডিয়া

প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ২৩
বাজার ও মিডিয়া। স্ট্রিম গ্রাফিক

আমার দৃষ্টিতে সংকটের সময়ে গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো মানুষের মনকে স্থির করা। সংবাদ কেবল তথ্য নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। যখন অর্থনীতি চাপের মুখে, তখন শিরোনামের একটি ভুল শব্দই বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে পারে। তাই সংবাদ কেবল তথ্য জানানোই নয়; পাশাপাশি ঘটনার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করা, সম্ভাব্য সমাধান দেখানো এবং নাগরিককে প্রস্তুত হওয়ার পথ বোঝানো।

আমরা দেখতে পাই, সংকট এলেই অনেক সময় গণমাধ্যম দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেউ অন্ধভাবে সরকারের পক্ষে কথা বলেন, আবার কেউ শুধু সমালোচনা করতে থাকেন। অথচ সাংবাদিকতার মূল শক্তি হলো নিরপেক্ষতা। জনগণ সত্য জানতে চায়, পক্ষপাত নয়। সংবাদে পক্ষপাত থাকলে আস্থা নষ্ট হয়। আর গণমাধ্যম আস্থা হারালে গণতন্ত্র দুর্বল হয়।

এই জায়গায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু সংবাদমাধ্যম ‘বাজার ধসে পড়ছে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে শেয়ারবাজারে অযথা বিক্রির চাপ বাড়ে, সাধারণ মানুষ সঞ্চয় তুলে নেয়। অন্যদিকে জার্মানির কিছু সংবাদপত্র তখন বিশ্লেষণসহ প্রকাশ করে কেন মন্দা ঘটেছে, সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং নাগরিকরা কীভাবে ব্যয় পরিকল্পনা করবেন। ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জার্মানিতে আতঙ্ক তুলনামূলকভাবে কম ছড়ায়। একই সংকটে ভিন্ন মিডিয়া কভারেজ কীভাবে পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে, সেটিই এই উদাহরণে স্পষ্ট হয়।

আজকের যুগে তথ্য সবচেয়ে দ্রুত ছড়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ‘ব্যাংকে ডলার নেই’—এমন কোনো ভুয়া পোস্ট ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই লক্ষাধিক মানুষ শেয়ার করে ফেলে। এরফলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংকের সামনে ভিড় জমায়। শুরু হয় ডলার মজুত। সবমিলিয়ে অকারণেই সংকট তৈরি হয়। কোভিডের সময়েও এমনটা ঘটেছিল। ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘চালের ঘাটতির সম্ভাব্যতা’ নিয়ে একটি ভুয়া পোস্ট ভাইরাল হয়। এতে মানুষ হুড়োহুড়ি করে চাল কিনতে শুরু করে, দামও কয়েক দিনের মধ্যেই দ্বিগুণ হয়ে যায়। অথচ একই সময়ে বাংলাদেশে তখন প্রধান কয়েকটি সংবাদপত্র যাচাই করা তথ্য দিয়ে জানায় যে গুদামে পর্যাপ্ত চাল মজুত আছে। এতে আতঙ্ক কমে যায়। এখান থেকেই বোঝা যায়, যাচাই ছাড়া সংবাদ প্রকাশ মানে আসলে গুজবকে সহযোগিতা করা।

দুর্নীতির সংবাদ সমাজে সচেতনতা আনে, আবার হতাশাও সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসেবে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়। সেখানকার ‘অপারেশন কার ওয়াশ’ দুর্নীতির খবর যখন মিডিয়ায় আসে, তখন জনগণ ব্যাপকভাবে প্রতিবাদে নামে, নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম হয়। তবে একই সঙ্গে মানুষ রাজনীতিতে আস্থা হারায়, ভোটার উপস্থিতি কমে যায়। তাই সঠিক ভারসাম্য জরুরি। দুর্নীতির খবর প্রকাশের পাশাপাশি দেখাতে হবে কীভাবে সিস্টেমিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। না হলে মানুষ ভাববে দুর্নীতি চিরস্থায়ী, আর আস্থা ভেঙে পড়বে।

অর্থনৈতিক সংবাদে এই ভারসাম্য সবচেয়ে বেশি দরকার। পরিসংখ্যান যদি শুধু ভয় দেখায়, তবে মানুষ আতঙ্কিত হয়। কিন্তু যদি বলা হয় কেন দাম বাড়ছে, কতদিন স্থায়ী হতে পারে, সরকার কী করছে এবং নাগরিক কীভাবে প্রস্তুতি নেবে, তাহলে একই সংবাদ আস্থা তৈরি করে। যেমন ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটে স্থানীয় গণমাধ্যম অনেক সময় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ফলে ব্যাংকে লাইন লেগেছে, পণ্য মজুত শুরু হয়েছে। অন্যদিকে ভারত একই সময়ে জ্বালানি সংকটের খবর দিয়েছে প্রেক্ষাপট ও সমাধানসহ। ফলে মানুষ বুঝেছে কীভাবে ব্যয় সামলাতে হবে, আতঙ্ক তুলনামূলকভাবে কমেছে।

আমার মতে, অর্থনৈতিক রিপোর্টে একটি কাঠামো থাকা উচিত: কী ঘটেছে; কেন ঘটেছে; সামনে কী হতে পারে; নাগরিক বা ব্যবসায়ীর করণীয় এবং কোন সূত্র থেকে তথ্য এসেছে। এই পাঁচটি অংশ থাকলে সংবাদ শুধু তথ্য দেয় না, দিকনির্দেশনাও দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল নিয়মিত এই কাঠামো মেনে রিপোর্ট করে, ফলে পাঠক আতঙ্কিত না হয়ে পরিকল্পনা নিতে পারেন।

কিন্তু সমস্যা হয় মিডিয়া ট্রায়ালে। বিচার হওয়ার আগেই কাউকে দোষী ঘোষণা করা শুধু অন্যায়ই নয়, সমাজে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। পাকিস্তানে একাধিক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে এভাবে মিডিয়া ট্রায়াল হয়েছে, যার ফলে বিনিয়োগকারীরা দেশ ছাড়তে শুরু করে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার ইউরোপে ফ্রান্সের কয়েকটি বড় কেলেঙ্কারিতে মিডিয়া অপেক্ষা করেছে আদালতের রায়ের জন্য, আর সেই সতর্কতার কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারায়নি। এই দুটি বিপরীত অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায়, ‘তথ্য প্রকাশ করো কিন্তু রায় দিও না’।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে হলে আর্থিক স্বচ্ছতা জরুরি। মালিকানা আর সম্পাদকীয় নীতি আলাদা রাখতে হবে। বিজ্ঞাপনের চাপ যেন সংবাদকক্ষকে প্রভাবিত না করে। যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ানের উদাহরণ দেওয়া যায়। এটি একটি ট্রাস্ট মডেলে চলে, ফলে মালিকানার চাপ থেকে অনেকটাই মুক্ত। আবার ভারতের বহু মিডিয়া কেবল বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল, তাই ব্যবসায়িক স্বার্থ অনেক সময় সম্পাদকীয় নীতি নির্ধারণ করে ফেলে। আমাদের শেখার বিষয় হলো, স্বাধীন কনটেন্ট তৈরি করতে চাইলে টেকসই আর্থিক মডেল গড়ে তুলতে হবে।

আইন ও নীতির ক্ষেত্রেও একই কথা। কোভিডের সময় অনেক দেশে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয়েছে, তথ্য প্রকাশে বাধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিউজিল্যান্ড তার ব্যতিক্রম। সেখানে সরকার প্রতিদিন গণমাধ্যমকে তথ্য দিয়েছে, সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করেছেন। ফলে নাগরিকরা আতঙ্কিত না হয়ে প্রস্তুত হয়েছে। বাংলাদেশেও এমন স্বচ্ছতা দরকার। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, তথ্য পাওয়ার অধিকার ও সূত্র সুরক্ষা আইনে নিশ্চিত না হলে সত্যিকার স্বাধীনতা আসবে না।

সংখ্যার খেলায় স্বচ্ছতাও জরুরি। সংবাদপত্রের ঘোষিত প্রচারসংখ্যা যদি বাস্তব বিক্রির সঙ্গে না মেলে, বিজ্ঞাপন বাজার বিকৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে অডিট ব্যুরো অব সার্কুলেশনস এই কাজটি করে, ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা প্রকৃত সংখ্যা জানেন। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক সময় এই স্বচ্ছতা থাকে না। ফলে সংখ্যার নামে ব্যবসা চলে, কনটেন্ট মানসম্মত হয় না।

সবশেষে আসি মানবিক দৃষ্টিকোণে। অর্থনৈতিক সংকট কেবল সংখ্যার খেলা নয়, এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। মিরপুরের একজন বাবা যখন সন্তানের ফি নিয়ে চিন্তিত, গুলশানের দোকানি যখন ভাবছেন নতুন চালান আনবেন কি না, খিলগাঁওয়ের গৃহিণী যখন বাজারতালিকা মেলাচ্ছেন, তখন তাঁদের কাছে খবর মানে আগামী মাসের পরিকল্পনা। তাই সংবাদে গল্পের পাশাপাশি টুলও দিতে হবে, যেমন বাজেটিং টিপস, সাশ্রয়ের উপায় এবং সরকারি সহায়তা পাওয়ার নিয়ম। এতে পাঠক আতঙ্কিত না হয়ে প্রস্তুত হতে পারেন।

সবশেষে বলা যায়, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। শক্তি আছে বলেই দায়িত্বও বেশি। সংকটকালে সাংবাদিকতার কাজ আতঙ্ক ছড়ানো নয়, আস্থা তৈরি করা। আমরা যদি তথ্য, প্রেক্ষাপট ও সমাধান একসঙ্গে দিই, তবে মানুষ সচেতন হবে, সমাজ স্থিতিশীল থাকবে, আর গণতন্ত্র টিকবে। আমার মতে আজকের বার্তা একটাই: আতঙ্ক নয়, আস্থার ভাষায় কথা বলুক গণমাধ্যম। তবেই নাগরিকের আস্থা ফিরবে, অর্থনীতি বাঁচবে, আর সাংবাদিকতার মর্যাদা অটুট থাকবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত