leadT1ad

কপ৩০-এর পঞ্চম দিন

জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের উপস্থিতি ও করপোরেট প্রভাব লক্ষণীয়

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ২০: ১৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

বেলেমের কপ৩০ সম্মেলনে জলবায়ু আলোচনায় ১,৬০০ জনেরও বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই সংখ্যা আয়োজক দেশ ব্রাজিল ছাড়া অন্য সব দেশের প্রতিনিধিদলের তুলনায় বেশি। কিক বিগ পলিউটার্স আউট (কেবিপিও) জোটের বিশ্লেষণ অনুসারে, এই বছরের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতি ২৫ জনে একজন জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্ট, করপোরেটদের এই দখলদারিত্ব নিয়ে কপ-এর উপর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠছে। এটি গত বছরের তুলনায় ১২% বৃদ্ধি এবং ২০২১ সালে তথ্যানুসন্ধান শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ অনুপাত। গত পাঁচ বছরে কপ সম্মেলনগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টের মোট সংখ্যা ৭,০০০-এ পৌঁছেছে, যা করপোরেট প্রভাব, বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং বিশাল তেল-গ্যাস মুনাফার সময়কালে জলবায়ু আলোচনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন কেন্দ্র (সিআইইএল)-এর মানবাধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সিনিয়র অ্যাডভোকেট লিয়েন ভ্যান্ডামে মন্তব্য করেন যে, এই পরিস্থিতি জলবায়ু শাসন নয়, বরং করপোরেট দখলের ইঙ্গিত বহন করে।

কপ৩০–এর প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান নিয়েও বেলেমে একটি জটিল পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। একদিকে, ইইউ আলোচকরা অন্যান্য দেশকে জলবায়ু উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়াতে আহ্বান জানাচ্ছেন। অন্যদিকে, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নিজস্ব জলবায়ু নীতি শিথিল করার পক্ষে ভোট দিয়েছে। বৃহস্পতিবার গৃহীত নতুন প্রস্তাবে ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০৪০ সালের মধ্যে ইউরোপের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৯০% কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫% বিদেশি কার্বন ক্রেডিট ব্যবহারের অনুমতি থাকবে, যেটি বৈজ্ঞানিক সুপারিশের চেয়ে দুর্বল। একই দিনে ইউরোপীয় সংসদের সদস্যরা বন উজাড় বন্ধে সরবরাহ শৃঙ্খল–সংক্রান্ত আইন দুর্বল করার উদ্যোগ এবং করপোরেট সবুজ নীতির পরিধি সীমিত করার প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। যদিও ইইউ ঐতিহাসিকভাবে গ্রিনহাউস গ্যাসের বড় দূষণকারী এবং জাতিসংঘের জলবায়ু আলোচনায় শক্ত অবস্থানের দাবিদার, গত দুই বছরে প্রতিযোগিতামূলকতার অজুহাতে তারা অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী নীতি “সরলীকরণ” করতে শুরু করেছে।

অপরদিকে, বেলেমে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধের জন্য বৈশ্বিক চুক্তির দাবি জোরদার করেছে। ইতোমধ্যে ১৭টি দেশ ‘ফসিল ফুয়েল ট্রিটি’ উদ্যোগকে সমর্থন করেছে, এবং জলবায়ু কর্মীরা ব্রাজিলের কপ৩০ সভাপতিত্বকে কয়লা, তেল ও গ্যাসের যুগের সমাপ্তির জন্য দেশগুলোকে শক্তভাবে উৎসাহিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। যদিও কপ২৮ (দুবাই, ২০২৩)–এ দেশগুলো জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশনের প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে বাস্তবে এই প্রক্রিয়াটি খুব ধীর গতিতে চলছে।

প্যারিস চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ক্রিশ্চিয়ানা ফিগারেস ট্রাম্প প্রশাসনকে ছোট বাচ্চাদের সাথে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব মঞ্চে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র ডেমোক্র্যাট এবং প্রাক্তন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি কপ৩০-তে আমেরিকার অনুপস্থিতির বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি আমেরিকান উপস্থিতির অভাব কেবল সরকারী অচলাবস্থার কারণে নয়, বরং ব্রাজিলে দ্বিদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠাতে সহযোগিতা না করার জন্য রিপাবলিকানদেরও দায়ী করেছেন। রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী জলবায়ু কূটনীতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন, কিন্তু তার প্রশাসন অন্যান্য বিশ্বব্যাপী মঞ্চে দূষণ মোকাবেলায় পদক্ষেপের সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা করেছে।

কপ৩০–কে সামনে রেখে “জেন্ডার বা লিংঙ্গ” শব্দটির সংজ্ঞা নিয়ে তীব্র বিতর্ক জলবায়ু আলোচনাকে জটিল করে তুলছে। নারী অধিকারকর্মী ও বহু দেশ বলছে, এটি জাতিসংঘ ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের স্বীকৃত ভাষাকে পিছিয়ে দেবে এবং আলোচনার অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নারীর অভিজ্ঞতা ও লিঙ্গ সমতা জলবায়ু নীতিতে আরও অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি নতুন ‘জেন্ডার একশন প্লান’ গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, সৌদি আরব, রাশিয়া, ইরানসহ বহু দেশ “লিঙ্গ” শব্দটি সংকীর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছে। বিপরীতে ইইউ, নরওয়ে, কানাডা প্রভৃতি দেশ “ইন্টারসেকশনালিটি” এবং বহুবৈচিত্র্যময় লিঙ্গপরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত ভাষার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন নারীদের ওপর অসম প্রভাব ফেলে, যার কারণে যত্নশীলতার দায়িত্ব, ক্ষমতার অভাব, খাদ্য ও পানি সংগ্রহে বাড়তি চাপ এবং লিঙ্গ–ভিত্তিক সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ুর ফলে ২৩ কোটি ৬০ লক্ষ নারী ও মেয়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়তে পারে।

জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমন রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, তবুও অনেক দেশ মারাত্মক বৈশ্বিক তাপপ্রবাহ রোধে খুব কম পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার আপডেট অনুসারে, ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত কপ৩০ জলবায়ু আলোচনার জন্য সরকার কর্তৃক জমা দেওয়া নতুন এনডিসিগুলোও বিশ্বকে আগের মতোই শতাব্দীর শেষে প্রায় ২.৬°C উষ্ণায়নের বিপর্যয়কর পথে রাখছে, যেটি প্যারিস চুক্তির সীমা স্পষ্টভাবে অতিক্রম করে। মাত্র ১০০টি দেশ এখন পর্যন্ত তাদের এনডিসি হালনাগাদ করেছে। গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গমন আরও প্রায় ১% বাড়বে। যদিও গত দশকে নির্গমন বৃদ্ধির হার কমেছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার দ্রুত হয়েছে, তবুও তা এখনো বৈশ্বিক জ্বালানি চাহিদার বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। পৃথিবীর তাপমাত্রা ইতোমধ্যেই প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৩°C বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে ঝড়, দাবানল, খরা ও চরম আবহাওয়া আরও তীব্র হচ্ছে। প্যারিস চুক্তির পর প্রত্যাশিত তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও বর্তমানে এর বৃদ্ধির গতিপথ এখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের পদক্ষেপ দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। কপ৩০-এর জন্য আলোচকরা ব্রাজিলে জড়ো হওয়ার সাথে সাথে ইউরোপের জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় নেতৃত্বের ঝুঁকি হ্রাস পাচ্ছে। এক দশক আগে যখন কপ২১-এ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫°C-তে সীমাবদ্ধ রাখার একটি যুগান্তকারী চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল, তখন প্যারিসে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন ছিল। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ২০১৯ সালে ইউরোপীয় গ্রীন ডিল পথ প্রশস্ত করে, এবং এই চুক্তি ২০৫০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু নিরপেক্ষতার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আইনের অন্তর্ভুক্ত করে এবং এটি অর্জনের জন্য বিশ্বের প্রথম ব্যাপক পরিকল্পনা প্রবর্তন করে, যার মধ্যে মূল্য নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রক এবং তহবিল ব্যবস্থার একটি শক্তিশালী সেট রয়েছে।

কপ৩০-এ বেলেম হেলথ অ্যাকশন প্ল্যান উদ্বোধন করা হয়েছে, যা বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য-কেন্দ্রিক জলবায়ু অভিযোজন কাঠামো। এটি ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ, নীতি নির্ধারণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রযুক্তি উন্নয়নে জোর দেয়। কপ৩০ সম্মেলনে আয়োজিত একটি সাইড ইভেন্টে বক্তারা জানান যে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্বল এবং তীব্র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানব জীবন আজ বিপন্ন। আন্তর্জাতিক তহবিল ন্যায্য, স্বচ্ছ ও সহজলভ্য হওয়া জরুরি। ক্লাইমেট অ্যান্ড হেলথ ফান্ডার্স কোলিশন প্রাথমিকভাবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের জন্য ৬৪৩ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, এবং বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অভিযোজন তহবিল এখনও অপর্যাপ্ত। কপ৩০-এর বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে অনুষ্ঠিত অপর একটি সাইড ইভেন্টে বিশেষজ্ঞরা স্থানীয় নেতৃত্বাধীন প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, বিজ্ঞান, স্থানীয় জ্ঞান ও নীতি একত্রিত করলে ইকোসিস্টেম-ভিত্তিক অভিযোজন বড় পরিসরে সম্প্রসারিত করা সম্ভব। আলোচনায় সুন্দরবন ও হাকালুকি হাওরের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা দীর্ঘমেয়াদি সহনশীলতা গড়ে তুলতে ন্যায়সঙ্গত ও পূর্বানুমানযোগ্য অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার উপর জোর দেন। বক্তারা মনে করেন, স্থানীয় উদ্যোগই বৈশ্বিক জলবায়ু সমাধানে পথপ্রদর্শক হতে পারে।

কপ৩০-এর পঞ্চম দিনেও বৈশ্বিক জলবায়ু নীতি ও নেতৃত্ব এখনও জটিল ও দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের প্রভাব, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, নীতি-পিছুটান এবং লিঙ্গ সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের কারণে বাস্তবায়ন ধীরগতিতে হচ্ছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্বকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫°C–এর সীমার মধ্যে রাখতে হলে এখনই দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অর্থায়ন, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি প্রয়োজন। কপ৩০ সম্মেলনটি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সময় ফুরিয়ে আসছে, এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বকে বাস্তবে পরিণত করার এখনই সুযোগ।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।

Ad 300x250

সম্পর্কিত