leadT1ad

ভারত ও আফগানিস্তান: সম্পর্কের সূত্র কী

আদর্শ বনাম বাস্তবতার সংঘাতের মধ্যেই ভারত-আফগানিস্তানের সম্পর্কের নতুন গল্প লেখা হচ্ছে। পাকিস্তানের কৌশল ভেস্তে দেওয়া, বিনিয়োগ রক্ষা ও আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখার হিসাবেই নয়াদিল্লি এখন কাবুলের দরজায় বাস্তববাদী রাজনীতির পতাকা উড়াচ্ছে।

নরেন্দ্র মোদি ও আমির খান মুত্তাকি। স্ট্রিম কোলাজ

জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ব্যক্তিকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হবে, নয়াদিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু সেটাই ঘটেছে চলতি বছরের অক্টোবরে যখন তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ছয় দিনের এক সফরে ভারতে এসে পৌঁছান। তালেবানের কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতার এটাই ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক ভারত সফর।

এই সফর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ভারতের দীর্ঘ ও সতর্ক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতি। ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা দখলের পর থেকেই ভারত অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করে চলেছে। ভারতের এমন কার্যক্রমের পেছনে রয়েছে জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে চাপে রাখার সুচিন্তিত কৌশল।

যদিও নয়াদিল্লি তালেবান প্রশাসনকে এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, কিন্তু মুত্তাকির সফরের সময়েই কাবুলে নিজেদের দূতাবাস পুনরায় পুরোপুরি চালু করার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার ও ‘উগ্রপন্থী’ তালেবান সরকারের এমন সম্পর্ক হওয়াটাই স্বাভাবিক, তবুও প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার কেন তালেবানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করছে? এই প্রশ্নের উত্তর কোনো সরল পথে মিলবে না। এর গভীরে লুকিয়ে আছে আদর্শের চেয়ে বাস্তবতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এক কঠিন কিন্তু অনিবার্য কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা।

২০২১ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন বাহিনীর প্রত্যাহারের পর যখন প্রায় বিনা বাধায় কাবুলের পতন ঘটল, তখন ভারত এক রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদন মতে, আফগানিস্তান থেকে নিজেদের কূটনৈতিকদের দ্রুত ফিরিয়ে আনা ও দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া নয়াদিল্লির সামনে তখন আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু ভারত খুব দ্রুতই উপলব্ধি করে, আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকাটা কৌশলগতভাবে আত্মঘাতী হবে।

অতীতের বৈরিতা থেকে বর্তমান বাস্তবতায়

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের প্রথম শাসনামলে ভারত ছিল তাদের ঘোর বিরোধী। নয়াদিল্লি তখন আফগানিস্তানের স্বীকৃত সরকার বুরহানউদ্দিন রব্বানির পক্ষে ছিল এবং তালেবান-বিরোধী ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে অর্থ, অস্ত্র ও কূটনৈতিক সমর্থন জুগিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট আইসি-৮১৪ ছিনতাই হওয়ার পর কান্দাহারে অবতরণ করে। এরপর বন্দিদের বিনিময়ে হাইজ্যাকাররা ভারতের জেল থেকে মাসুদ আজহারের মতো জঙ্গিদের মুক্তি দাবি করে। বন্দী নাগরিকদের নিরাপত্তার চিন্তা করে ভারত সরকার বাধ্য হয়েছিল ছিনতাইকারীদের দাবি মানতে। ভারত সরকার অভিযোগ করে, এই ঘটনায় তালেবান সরকার হাইজ্যাকারদের সাহায্য করছে। সেই সময় তালেবানকে পাকিস্তানের প্রক্সি বা ছায়া সংগঠন হিসেবেই আখ্যায়িত করেছিল ভারত।

কিন্তু ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন বাহিনীর প্রত্যাহারের পর যখন প্রায় বিনা বাধায় কাবুলের পতন ঘটল, তখন ভারত এক রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদন মতে, আফগানিস্তান থেকে নিজেদের কূটনৈতিকদের দ্রুত ফিরিয়ে আনা ও দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া নয়াদিল্লির সামনে তখন আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু ভারত খুব দ্রুতই উপলব্ধি করে, আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকাটা কৌশলগতভাবে আত্মঘাতী হবে। তাই প্রাথমিক দ্বিধা ও সতর্কতার পর নয়াদিল্লি কাবুলের নতুন শাসকদের সঙ্গে বাস্তবমুখী যোগাযোগ শুরু করেছে।

ভারতের কূটনীতি এক নতুন সুযোগ খুঁজে পেয়েছে। তালেবানের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে ভারত পাকিস্তানকে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে, আফগানিস্তান আর ইসলামাবাদের একচ্ছত্র প্রভাবের ক্ষেত্র নয়। ভারত তালেবানকে অর্থনৈতিক সাহায্য, মানবিক সহায়তা ও পরিকাঠামো পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়ে নিজেদের একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে তুলে ধরছে।

কৌশলগত বাধ্যবাধকতা: পাকিস্তানকে তার নিজের জালেই আবদ্ধ করার খেলা

ভারতের আফগান নীতির মূল চালিকাশক্তি হলো তার জাতীয় নিরাপত্তা, তবে এর গভীরে রয়েছে পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে কোণঠাসা করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। দ্য ডিপ্লোম্যাটের বিশ্লেষণ বলছে, নয়াদিল্লির প্রধান ভয় ছিল আফগানিস্তানের মাটি যেন ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল না হয়ে ওঠে। কিন্তু এর চেয়েও গভীর কৌশলগত খেলা এখানে চলছে: পাকিস্তানকে তার নিজের পাতা ফাঁদেই ব্যতিব্যস্ত রাখা।

দশকের পর দশক ধরে পাকিস্তান আফগানিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে ‘কৌশলগত গভীরতা’ (স্ট্রেটেজিক ডেপথ) হিসেবে ব্যবহার করার নীতি নিয়ে চলেছে। দ্য ডিপ্লোম্যাটের বিশ্লেষকরা দাবি করছেন, পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা ভেবেছেন কাবুলে পাকিস্তান-পন্থী সরকার থাকলে ভারতের সঙ্গে সংঘাতের সময় তারা আফগানিস্তানের সাহায্য নিতে পারবে। পাকিস্তান ভেবেছিল, কাবুলে তালেবান ক্ষমতায় এলে এই নীতি সফল হবে, কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার ঠিক উল্টো। তালেবান সরকার পাকিস্তানের কথায় চলার পরিবর্তে আফগান জাতীয়তাবাদকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ঐতিহাসিক ডুরান্ড লাইনকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে মানতে তাদের অস্বীকৃতি ও তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) নিজেদের মাটিতে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক এখন তলানিতে।

ঠিক এখানেই ভারতের কূটনীতি এক নতুন সুযোগ খুঁজে পেয়েছে। তালেবানের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে ভারত পাকিস্তানকে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে, আফগানিস্তান আর ইসলামাবাদের একচ্ছত্র প্রভাবের ক্ষেত্র নয়। ভারত তালেবানকে অর্থনৈতিক সাহায্য, মানবিক সহায়তা ও পরিকাঠামো পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়ে নিজেদের একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে তুলে ধরছে। এর ফলে তালেবানের পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীলতা কমছে ও ইসলামাবাদকে পাশ কাটিয়ে চলার আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, পাকিস্তানকে তার পশ্চিম সীমান্তে এতটাই ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন রাখা, যাতে তারা পূর্ব সীমান্তে অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরির আগে দুবার ভাবতে বাধ্য হয়।

অর্থনৈতিক ও মানবিক বিনিয়োগ রক্ষা

নিরাপত্তার পাশাপাশি ভারতের আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ হলো আফগানিস্তানে তার বিপুল বিনিয়োগ। গত দুই দশকে ভারত আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। এই অর্থে তৈরি হয়েছে ‘ইন্দো-আফগান ফ্রেন্ডশিপ ড্যাম’ খ্যাত সালমা বাঁধ, কাবুলে আফগান সংসদ ভবন, জারাঞ্জ-দেলারাম মহাসড়কের মতো কয়েক ডজন গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোকে আফগান জনগণের মধ্যে ভারতের সদ্ভাব ও ‘সফট পাওয়ার’-এর প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তালেবান ক্ষমতা দখলের পর এই বিপুল বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অর্থ হলো, এই সমস্ত ক্ষেত্রে চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া। তাই নিজেদের বিনিয়োগ রক্ষা ও প্রভাব বজায় রাখার জন্য হলেও তালেবানের সঙ্গে কাজ করা ভারতের জন্য জরুরি। এই মানবিক কূটনীতি আফগান জনগণের মন জয়ের পাশাপাশি তালেবান নেতৃত্বকে বার্তা দেয়, পাকিস্তানের বাইরেও তাদের নির্ভরযোগ্য বন্ধু থাকতে পারে। ফলে তালেবানের হাতে এখন ইসলামাবাদের সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

দিল্লিতে আফগান দূতাবাসে এখনো পূর্বতন আশরাফ গনি সরকারের নিযুক্ত কূটনৈতিকরাই কাজ করছেন ও সেখানে তালেবানের সাদা পতাকার বদলে পুরোনো আফগান প্রজাতন্ত্রের সবুজ-কালো-লাল পতাকাই ওড়ে। এই প্রতীকী বিষয়টিই হয়তো ভারতের বর্তমান নীতির সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দেয় –তালেবান সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়া, কিন্তু তাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো না করা।

বদলে যাওয়া ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকস্মিক বিদায় নেওয়ার পর ওই অঞ্চলে বিশাল ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে চীন ও রাশিয়া দ্রুত এগিয়ে এসেছে। সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর বিশ্লেষণ বলছে, এই পরিস্থিতিতে ভারত যদি নিষ্ক্রিয় বসে থাকে, তাহলে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির এই ‘নতুন গ্রেট গেম’ থেকে তারা সম্পূর্ণ ছিটকে যেত। আন্তর্জাতিক সংকট গোষ্ঠীর (আইসিজি) বিশ্লেষকদের মতে, নয়াদিল্লি কাবুলে নিজেদের উপস্থিতি ও প্রভাব বাড়াতে চায়, যাতে তারা চীন ও পাকিস্তানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে পিছিয়ে না পড়ে। তাই ভারতের এই পদক্ষেপকে তালেবানের প্রতি কোনো আদর্শগত সমর্থন হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি আসলে বাস্তববাদী, হিসেবি ও স্বার্থকেন্দ্রিক বিদেশনীতির প্রতিফলন।

আমির খান মুত্তাকির ভারত সফর ও তার ফল হিসেবে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসের কার্যক্রম আবার পূর্ণমাত্রায় চালু হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, ভারত আফগানিস্তানকে তার প্রতিবেশী নীতির কেন্দ্রেই রাখছে। তালেবানের নারী-বিরোধী নীতি বা তাদের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে ভারতের অস্বস্তি থাকলেও, নয়াদিল্লি বুঝতে পারছে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা ভারতের জাতীয় স্বার্থের জন্য অপরিহার্য। ভারত একদিকে যেমন চাচ্ছে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে, তেমনই অন্যদিকে পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে কোণঠাসা করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাও মাথায় রাখছে।

দিল্লিতে আফগান দূতাবাসে এখনো পূর্বতন আশরাফ গনি সরকারের নিযুক্ত কূটনৈতিকরাই কাজ করছেন ও সেখানে তালেবানের সাদা পতাকার বদলে পুরোনো আফগান প্রজাতন্ত্রের সবুজ-কালো-লাল পতাকাই ওড়ে। এই প্রতীকী বিষয়টিই হয়তো ভারতের বর্তমান নীতির সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দেয় –তালেবান সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়া, কিন্তু তাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো না করা।

কূটনৈতিক স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক তকমা মিলুক বা না মিলুক, কাবুলের ক্ষমতার নতুন সমীকরণে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখা ও সেই সূত্রে পাকিস্তানকে চাপে রাখাই হয়তো মোদি সরকারের মূল লক্ষ্য। আদর্শ ও কঠোর বাস্তবতার এই টানাপোড়েনের মধ্যেই লেখা হচ্ছে ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কের এক নতুন, অনিশ্চিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’-এর বিশ্লেষণ অবলম্বনে

Ad 300x250

সম্পর্কিত