গত ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় দিল্লির ঐতিহাসিক লাল কেল্লার ছয় নম্বর গেটের কাছে একটি গাড়ি বিস্ফোরিত হয়। এই ঘটনায় অন্তত ১৩ জন নিহত ও ২০ জনেরও বেশি আহত হন। ভারত সরকার প্রাথমিকভাবে সতর্কতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানালেও প্রমাণ হাতে আসার পর, এই বিস্ফোরণকে ‘সন্ত্রাসী ঘটনা’ হিসেবে ঘোষণা করে ও কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগ করে।
তদন্তকারীরা এখন বিশ্বাস করছেন, এই বিস্ফোরণ কোনো আত্মঘাতী বোমা হামলা নয়, বরং সদ্য নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া একটি বড় সন্ত্রাসী চক্রের কাজ।
এর ২৪ ঘণ্টা পার হতে না হতেই ১১ নভেম্বর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের একটি জেলা আদালত চত্বরের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় ১২ জন নিহত ও কয়েক ডজন মানুষ আহত হন। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা এই হামলাকে প্রায় এক দশকের মধ্যে শহরের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা বলে অভিহিত করছেন। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। ইসলামাবাদ তাৎক্ষণিকভাবে আফগানিস্তানভিত্তিক জঙ্গি ও ‘ভারত-সমর্থিত শক্তিদের’ দিকে আঙুল তুলেছে।
দিল্লি ও ইসলামাবাদে প্রায় একই সময়ে এই দুই হামলা কোনোভাবেই কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হামলা দুটি দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচয়, ভূখণ্ড ও প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্বে থাকা দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পারমাণবিক শক্তিধর দেশের রাজধানীতে ঘটেছে। উভয় বিস্ফোরণের লক্ষ্যবস্তু ও পদ্ধতি শুধুই সন্ত্রাসী কার্যকলাপের চেয়েও বেশি কিছু ইঙ্গিত করে। এই ধরনের হামলার অর্থ সম্ভবত সহনশীলতার পরীক্ষা নেওয়া এবং আন্তঃসীমান্ত দোষারোপ, উত্তেজনা ও প্রতিশোধের আগুনকে নতুন করে উসকে দেওয়া। সর্বোপরি, এই ঘটনা দুটি দেশকেই অত্যন্ত জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
এই জোড়া হামলা উভয় দেশের জন্যই, বিশেষ করে ভারতের জন্য গভীর সংকট তৈরি করেছে। নয়াদিল্লির জন্য লাল কেল্লার বিস্ফোরণকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে, তা তাৎক্ষণিকভাবে চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রাথমিকভাবে, কর্মকর্তারা দুর্ঘটনা হিসেবে দেখানোর সম্ভাবনাটিকেই জিইয়ে রাখতে চাইছিলেন কিন্তু ক্রমবর্ধমান প্রমাণের চাপে স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হন, এটি সন্ত্রাসী হামলা।
প্রথমদিকে, ভারতের রাজনীতিতে লাভজনক ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’-এর তকমা দেওয়ার সুযোগ ছিল ভারত সরকারের। বিহারের রাজ্য নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ঠিক এক দিন আগে এই বিস্ফোরণ রাজনৈতিকভাবে এর চেয়ে বেশি সংবেদনশীল হতে পারত না। এক্ষেত্রে খুবই পরিচিত ধাঁচ নজরে আসার মতো, যখনই ভারত সন্ত্রাসবাদের মুখোমুখি হয়, তখনই ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নির্বাচনীভাবে লাভবান হয়। কারণ ভোটাররা ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব বা দারিদ্র্যের মতো প্রশাসনিক ব্যর্থতাগুলোকে উপেক্ষা করে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে একত্রিত হয়। পাকিস্তান-সম্পর্কিত সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্রের বয়ান গণমাধ্যমকে দিয়ে চালানোর প্রলোভন ছিল সুস্পষ্ট।
কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আরও অনেক বেশি জটিল। ভারত যদি দিল্লির বিস্ফোরণকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে চিহ্নিত করে ও এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে, তবে এটি কার্যকরভাবে ‘অপারেশন সিঁদুর’ পুনরায় শুরু করতে বাধ্য করবে। কেননা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অপারেশন কেবল ‘বিরতিতে’ আছে বলে দাবি করেছিলেন। পেহেলগাম হামলার পর, মোদি সরকারের আস্ফালন ভবিষ্যৎ যেকোনো হামলার ঘটনায় সংযম প্রদর্শনের তেমন কোনো সুযোগই রাখেনি। ভারত সরকার ঘোষণা করেছিল, যেকোনো সন্ত্রাসী হামলায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামরিক প্রতিশোধ নেওয়া হবে। সেই প্রতিশ্রুতি এখন ভারতের হাত-পা বেঁধে ফেলেছে।
সীমান্তের ওপারে নতুন করে অভিযান শুরু হলে তা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাধ্যমে মধ্যস্থতাকেও পুনরায় আমন্ত্রণ জানাবে, যা ভারতের জন্য বেশ অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। উপরন্তু, ভারতকে সৌদি আরবের অনিশ্চিত অবস্থান নিয়েও ভাবতে হবে। সৌদির সঙ্গে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ও পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে। ভারত যদি আবার হামলা করে, তবে কি রিয়াদ ইসলামাবাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে? সেই প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত এবং অকাট্য প্রমাণ ছাড়া ভারতের এমন পদক্ষেপের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক ধারণা মারাত্মক কূটনৈতিক মাশুল বয়ে আনতে পারে।
অন্যদিকে, ভারত যদি এই বিস্ফোরণকে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে, তবে অন্য আরেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এই বয়ান সরকারের নিজস্ব বিবৃতির সঙ্গেই সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। মোদি সরকার বারবার বলে আসছিল, ২০১৯ সালে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিলের পর কাশ্মীর ‘স্বাভাবিক’ হয়ে গেছে, সন্ত্রাসবাদ পরাজিত হয়েছে ও একীভূতকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, দিল্লির বিস্ফোরণ ‘অপারেশন সিঁদুর’ বা পেহেলগাম-পরবর্তী কাশ্মীরে ভারতের নিরাপত্তা অভিযানের প্রতিশোধ হতে পারে। যেভাবেই দেখা হোক না কেন, এই বিস্ফোরণ শান্তি পুনরুদ্ধারের দাবির পেছনের অন্তঃসারশূন্যতা উন্মোচিত করেছে।
মোদি সরকারের জন্য উভয়সংকট হলো রাজনৈতিক জবাবদিহিতা। ভারতের পোষ মানা গণমাধ্যম (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাদের ‘গোদি মিডিয়া’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়) যদি জেগে ওঠে ও প্রশ্ন করতে শুরু করে, তাহলে কী হবে? দিল্লির প্রশাসন ও কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ করে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার। তবুও, গোয়েন্দা ব্যর্থতার ফলে পরপর দুটি বড় হামলা ঘটেছে। সন্দেহভাজন চক্রের সদস্যদের ইতিমধ্যেই আটক করা সত্ত্বেও লাল কেল্লার বিস্ফোরণ প্রতিরোধ করতে না পারার জন্য মোদি-অজিত দোভাল-অমিত শাহ নিরাপত্তা ত্রয়ী অনেক প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পারবেন না।
পাকিস্তানের উভয়সংকটও কোনো অংশেই কম গুরুতর নয়। নয়াদিল্লি যদি ‘অপারেশন সিঁদুর’ পুনরায় শুরু করে, তবে নতুন করে সামরিক সংঘাত বহন করার মতো সামর্থ্য তাদের আছে কি না, তা এখন ইসলামাবাদকে বিবেচনা করতে হবে। প্রথম অভিযানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারত সম্ভবত আরও ভালোভাবে প্রস্তুত থাকবে, যেখানে রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পাকিস্তান গতবারের মতো নৈতিক বা কূটনৈতিক ভালো অবস্থানে নেই।
এদিকে, ইসলামাবাদে বিস্ফোরণ প্রমাণ করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকট আরও গভীর হচ্ছে। কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় ছাড়াই ব্যর্থ অবস্থাতেই আফগান তালেবানদের সঙ্গে তাদের আলোচনা শেষ হয়েছে। অন্যদিকে, দেশটির রাজধানীতে এমন ভয়াবহ হামলা চালানো টিটিপিকে দমনেও ব্যর্থ হয়েছে।
আফগানিস্তানের বার্তা একেবারেই স্পষ্ট মনে হচ্ছে, তারা ভীত নয় এবং তালেবানের হাতে এখনো দর-কষাকষির সুযোগ রয়েছে। এই ঘটনা ঘটেছে তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ভারত সফরের মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই। ইসলামাবাদের দৃষ্টিতে, এই সফর কাবুলকে আরও সাহসী করে তুলেছে ও পাকিস্তানের আঞ্চলিক সমীকরণকে জটিল করে তুলেছে।
সর্বোপরি, দক্ষিণ এশিয়া এখন এক খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, উভয়ই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আঘাতে জর্জরিত এবং উভয় দেশের জনগণই নিরাপত্তা ও জবাবদিহিতা দাবি করছে। এর সঙ্গে পাকিস্তানের চলমান সাংবিধানিক অস্থিরতা ও ভারতের নির্বাচনী মৌসুমের রাজনীতি যোগ করলে এই অঞ্চল ক্রমবর্ধমানভাবে বারুদের স্তূপের মতো হয়ে উঠছে, যা একটি স্ফুলিঙ্গেই মহাবিপর্যয়ের রূপ নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ