.png)
১৯৭৪ সালের ২০ নভেম্বর। মিয়ামি সৈকতে যান স্টোনহাউস। তারপর উধাও। সৈকতে ফেলে যাওয়া পোশাক ছাড়া এই ব্রিটিশ এমপির আর কোনও চিহ্ন ছিল না। সবার প্রশ্ন, তাঁকে কি সমুদ্রের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? মিয়ামি সৈকতের কাছে পাওয়া একটি কংক্রিটের ব্লকের ভেতরে রেখে তাঁকে কি খুন করা হয়েছে? নাকি তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে?

স্ট্রিম ডেস্ক

১৯৭৪ সালের ২০ নভেম্বর। মিয়ামি সৈকতে পাওয়া গেল জন স্টোনহাউসের পোশাক। তখন অনেকে ধরে নিয়েছিল, যুক্তরাজ্যের এই সংসদ সদস্য সাঁতার কাটার সময় ডুবে গেছেন। কিন্তু এরপর ক্রিসমাসের আগের দিন তাঁকে অস্ট্রেলিয়ায় জীবিত এবং সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু কেন তিনি এভাবে উধাও হয়েছিলেন?
মূলত পুরোপুরি উধাও হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন জন স্টোনহাউস। কারণ, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন থমকে গিয়েছিল। সন্দেহজনক ব্যবসায়িক লেনদেনের কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। কমিউনিস্ট গুপ্তচর হিসেবে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সেক্রেটারির সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কেও জড়িয়েছিলেন।
তখন ফ্রেডেরিক ফরসাইথের উপন্যাস ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল’ থেকে ধারণা নিয়ে দুজন মৃত ব্যক্তির পরিচয় চুরি করেন স্টোনহাউস। ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে মিয়ামিতে একটি ব্যবসায়িক সফরে যান। আর সেখান থেকেই উধাও হন স্টোনহাউস। তারপর অন্য একটি বিমানে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়া। এই ছলনা মাত্র এক মাসের বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল। ওই সময়ের আরেকজন কুখ্যাত পলাতক লর্ড লুকান। তিনিও একই সময়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন। আর তাঁর কারণেই স্টোনহাউস অসাবধানবশত অস্ট্রেলিয়ায় ধরেন পড়েন।

স্টোনহাউস তাঁর কাজের কী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন? ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে এই ব্রিটিশ সংসদ সদস্য বিবিসিকে বলেছিলেন, তিনি ‘শুধু ভৌগোলিকভাবেই নয়, একজন রাজনীতিবিদের ভেতরের সত্তা বোঝার জন্য এভাবে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।’
এবারে ফিরে যাই ১৯৬০-এর দশকে। স্টোনহাউস সম্পর্কে ব্রিটিশ জনগণের উচ্চ ধারণা ছিল। তাঁরা মনে করতেন, স্টোনহাউসের সবকিছুই অসাধারণ। ৪৩ বছর বয়সেই পোস্টমাস্টার জেনারেল, একজন সুন্দরী স্ত্রী ও তিন সন্তানের জনক তিনি। আর কি চাই! এমনকি লেবার পার্টির ভবিষ্যৎ প্রধান হিসেবেও গণ্য করা হতো তাঁকে।
কিন্তু স্টোনহাউসের পতন শুরু হয় ১৯৬৯ সাল থেকে। তখন কমিউনিস্ট চেকোস্লোভাকিয়া থেকে দলত্যাগকারী একজন দাবি করেন, দেশটি তাঁকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলস তা বিশ্বাস করেন নি। স্নায়ুযুদ্ধের সময় এই ধরনের অভিযোগ প্রায়ই উঠত। তবে তখন স্টোনহাউসের রাজনৈতিক সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি হেরে যায়। পরে বিরোধী দলের সামনের সারিতে স্টোনহাউসের জন্য কোনো জায়গা ছিল না। হতাশ হয়ে লন্ডনের ব্যবসায়ে আরও বেশি সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭১ সালের কথা। বাংলাদেশে চলছে স্বাধীনতাযুদ্ধ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম স্টোনহাউসকে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করে। বাঙালিদের সংগ্রামের সঙ্গে আবেগগতভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এতটাই পরিচিত পান যে যুদ্ধ শেষে তাঁকে সম্মানসূচকভাবে নতুন রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এটি ছিল কেবল শুরু।
ব্রিটিশ-বাংলাদেশ ট্রাস্ট নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করতে বলা হয়েছিল স্টোনহাউসকে। এটি ব্রিটেনে বসবাসকারী বাঙালিদের পরিসেবা দেবে। কিন্তু ব্যাংকটি যেভাবে পরিচালিত হচ্ছিল, তা নিয়ে পরে সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে সমালোচনামূলক মন্তব্য করে। পরে তা লন্ডনের ‘ফ্রড স্কোয়াড’ ও বাণিজ্য ও শিল্প দপ্তরের তদন্তকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই নেতিবাচক প্রচার ও সরকারি তদন্ত ব্যাংকের বেশিরভাগ সমর্থনকে দূরে সরিয়ে দেয়। যা স্টোনহাউসকে গভীরভাবে বিষণ্ন করে তোলে। তিনি অনুভব করেন, তিনি সহকর্মী সংসদ সদস্যদের সম্মানও হারাচ্ছেন।
এই সবকিছু থেকে পালানোর জন্য তিনি একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। প্রথমে তাঁর নির্বাচনী এলাকা ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের ওয়ালসালের জোসেফ আর্থার মার্কহ্যাম নামে একজন সদ্যমৃত শ্রমিকের নামে একটি পাসপোর্টের আবেদন জাল করেন। এই নতুন পরিচয়ে নিজেকে একজন বিশ্ব ভ্রমণকারী রপ্তানি পরামর্শক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি লন্ডন, সুইজারল্যান্ড ও মেলবোর্নে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন। এরপর ডোনাল্ড ক্লাইভ মাইল্ডুন নামে আরেকটি জাল পরিচয় তৈরি করেন তিনি। এই লোক ছিলেন সদ্যমৃত। এই নতুন জীবনযাপনের জন্য অর্থ জোগাড় করতে স্টোনহাউস তাঁর ব্যবসা থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অথং একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন।

এরপরেই আসে সেই মুহূর্ত। ১৯৭৪ সালের ২০ নভেম্বর। মিয়ামিতে যান স্টোনহাউস। সেখানেই সাঁতার কাটার সময় উধাও হন তিনি। সৈকতে ফেলে যাওয়া পোশাকের স্তূপ ছাড়া ৪৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তির আর কোনো চিহ্ন ছিল না। সবার প্রশ্ন, তাঁকে কি সমুদ্রের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? মিয়ামি সৈকতের কাছে পাওয়া একটি কংক্রিটের ব্লকের ভেতরে রেখে তাঁকে কি খুন করা হয়েছে? নাকি তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে?
তখন স্টোনহাউসের স্ত্রীর মতে, এটি একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কিছু অদ্ভুত গুজব শুনেছি, সেগুলো আমার স্বামীর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এতটাই বেমানান যে সেগুলোর উত্তর দেওয়া বা চিন্তা করারও যোগ্য নয়। মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, এটি একটি ডুবে যাওয়ার দুর্ঘটনা। আমাদের কাছে থাকা সমস্ত প্রমাণ এটাই নির্দেশ করে যে তিনি ডুবে গিয়েছিলেন।’
তবে লন্ডনের পুলিশে ছিল সন্দেহ। স্টোনহাউসের ২৮ বছর বয়সী সেক্রেটারি ও গোপন প্রেমিকা শিলা বাকলি বন্ধুদের কাছে জোর দিয়ে বলতে থাকেন, তিনি মারা গেছেন। তবে আসল ঘটনাটি তিনি জানতেন। কারণ তাঁর কিছু পোশাক এক মাস আগে একটি ট্রাঙ্কে ভরে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। তাঁর কাছ থেকে আটলান্টিকের ওপার থেকে ফোন কলও পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর দুটি অস্ট্রেলিয়ান ব্যাংকের একটির মাধ্যম তাঁকে আধা-সাংকেতিক চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। মার্কহ্যাম ও মাইল্ডুন নামে দুটি ভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকায় অবশেষে মেলবোর্ন পুলিশ তাঁর সন্ধানে নামে।
সেই সময়ে, তাঁরা লর্ড লুকান নামের নিখোঁজ আরেকজনকে খুঁজছিল। প্রাথমিকভাবে, পুলিশ ভেবেছিল যে সন্দেহজনক চেক সই করা এই ব্যক্তিই হয়তো লুকান। লুকানের অন্তর্ধান পুলিশকে ৫০ বছর ধরে রহস্যের মধ্যে রাখলেও, স্টোনহাউসের রহস্য মাত্র এক মাসের কিছু বেশি সময় ধরে চলেছিল।
ক্রিসমাসের আগের দিনের কথা। স্টোনহাউসকে তাঁর আসল পরিচয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। পরে মেলবোর্ন পুলিশ সদর দপ্তরে তিনি যুক্তরাজ্যে তাঁর স্ত্রীকে ফোন করার অনুমতি চান। যদিও তিনি তখন বুঝতে পারেননি, যে ফোন কলে তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছিলেন, তা আসলে রেকর্ড করা হয়েছিল।
ফোনে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যালো প্রিয়তমা। ওরা এখানে আমার মিথ্যা পরিচয় ধরে ফেলেছে। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে, আমি তোমাকে ঠকিয়েছি। আমি তার জন্য দুঃখিত। কিন্তু একদিক থেকে আমি খুশি যে সব শেষ হয়েছে।’ কয়েকদিন স্টোনহাউসকে আটকে রাখা হয়েছিল। পরে তাঁর পরিবার ও তাঁর প্রেমিকা অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়।
এরই মধ্যে কেটে যায় এক মাস। সবাই জেনে যায় তাঁর আসল ঘটনা। বিবিসির অস্ট্রেলিয়া সংবাদদাত বব ফ্রেন্ডের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে বসেন তিনি। তাঁর কাজের জন্য ‘দ্বৈত চরিত্র’ তৈরি হওয়াকেই দায়ী করেন তিনি। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, তিনি কীভাবে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারকে এমন যন্ত্রণার মধ্যে ফেলতে পারলেন, উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি অদৃশ্য হয়ে তাঁদের জীবনকে সহজ করার চেষ্টা করছিলাম… আমার পুরোনো ব্যক্তিত্ব থেকে তাঁদের যে টেনশন দিতাম, তা সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।’
সাত মাস ধরে অস্ট্রেলিয়ায় থাকার চেষ্টা করেন স্টোনহাউস। শেষ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদের পাহারায় দেশে ফেরত পাঠানো হয় তাঁকে। ১৯৭৬ সালের আগস্ট। তাঁর ব্যবসা সম্পর্কিত অভিযোগে ৬৮ দিনের দীর্ঘ বিচার শেষে তাঁকে চুরি, জালিয়াতি ও প্রতারণার অপরাধে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারে তিনবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। পরে ওপেনহার্ট সার্জারি করা হয়। সুস্থ হওয়ার তিন বছর পরে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।
১৯৭৮ সালে স্টোনহাউসকে স্ত্রী তাঁকে তালাক দেন। এর তিন বছর পর প্রাক্তন সেক্রেটারি বাকলিকে বিয়ে করেন স্টোনহাউস। ১৯৮৮ সালে দ্বিতীয়বারের মত মারা যান তিনি। আর এবার সত্যি সত্যি। নিখোঁজ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি টেলিভিশন শোতে উপস্থিত হওয়ার ঠিক তিনি সপ্তাহ আগে ৬২ বছর বয়সী এই ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
কিন্তু সেই গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগগুলোর কী হলো, যা তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে এতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল? অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসার পরে এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, চেকোস্লাভাকিয়ার গুপ্তচর হওয়ার ধারণাটি ‘হাস্যকর’ ছাড়া কিছু নয়। আজও তাঁর মেয়ে জুলিয়ার তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশী শক্তির কাছে তথ্য পাচারের যেকোনো দাবি প্রত্যাখ্যান করে। ২০২১ সালে তাঁর বাবার সমর্থনে একটি লেখেন তিনি। কেমব্রিজের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ক্রিস্টোফার অ্যান্ড্রু অল্প কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে একজন, যিনি স্টোনহাউসের ওপর এমআই৫-এর ফাইল দেখেছেন; ব্রিটিশ গোয়েন্দাসংস্থার ২০০৯ সালের অনুমোদিত ইতিহাসে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে স্টোনহাউস সত্যিই চেকদের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন।
বিবিসিতে গ্রেগ ম্যাককেভিটের লেখা অবলম্বনে হুমায়ূন শফিক

১৯৭৪ সালের ২০ নভেম্বর। মিয়ামি সৈকতে পাওয়া গেল জন স্টোনহাউসের পোশাক। তখন অনেকে ধরে নিয়েছিল, যুক্তরাজ্যের এই সংসদ সদস্য সাঁতার কাটার সময় ডুবে গেছেন। কিন্তু এরপর ক্রিসমাসের আগের দিন তাঁকে অস্ট্রেলিয়ায় জীবিত এবং সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু কেন তিনি এভাবে উধাও হয়েছিলেন?
মূলত পুরোপুরি উধাও হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন জন স্টোনহাউস। কারণ, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন থমকে গিয়েছিল। সন্দেহজনক ব্যবসায়িক লেনদেনের কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। কমিউনিস্ট গুপ্তচর হিসেবে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সেক্রেটারির সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কেও জড়িয়েছিলেন।
তখন ফ্রেডেরিক ফরসাইথের উপন্যাস ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল’ থেকে ধারণা নিয়ে দুজন মৃত ব্যক্তির পরিচয় চুরি করেন স্টোনহাউস। ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে মিয়ামিতে একটি ব্যবসায়িক সফরে যান। আর সেখান থেকেই উধাও হন স্টোনহাউস। তারপর অন্য একটি বিমানে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়া। এই ছলনা মাত্র এক মাসের বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল। ওই সময়ের আরেকজন কুখ্যাত পলাতক লর্ড লুকান। তিনিও একই সময়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন। আর তাঁর কারণেই স্টোনহাউস অসাবধানবশত অস্ট্রেলিয়ায় ধরেন পড়েন।

স্টোনহাউস তাঁর কাজের কী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন? ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে এই ব্রিটিশ সংসদ সদস্য বিবিসিকে বলেছিলেন, তিনি ‘শুধু ভৌগোলিকভাবেই নয়, একজন রাজনীতিবিদের ভেতরের সত্তা বোঝার জন্য এভাবে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।’
এবারে ফিরে যাই ১৯৬০-এর দশকে। স্টোনহাউস সম্পর্কে ব্রিটিশ জনগণের উচ্চ ধারণা ছিল। তাঁরা মনে করতেন, স্টোনহাউসের সবকিছুই অসাধারণ। ৪৩ বছর বয়সেই পোস্টমাস্টার জেনারেল, একজন সুন্দরী স্ত্রী ও তিন সন্তানের জনক তিনি। আর কি চাই! এমনকি লেবার পার্টির ভবিষ্যৎ প্রধান হিসেবেও গণ্য করা হতো তাঁকে।
কিন্তু স্টোনহাউসের পতন শুরু হয় ১৯৬৯ সাল থেকে। তখন কমিউনিস্ট চেকোস্লোভাকিয়া থেকে দলত্যাগকারী একজন দাবি করেন, দেশটি তাঁকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলস তা বিশ্বাস করেন নি। স্নায়ুযুদ্ধের সময় এই ধরনের অভিযোগ প্রায়ই উঠত। তবে তখন স্টোনহাউসের রাজনৈতিক সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি হেরে যায়। পরে বিরোধী দলের সামনের সারিতে স্টোনহাউসের জন্য কোনো জায়গা ছিল না। হতাশ হয়ে লন্ডনের ব্যবসায়ে আরও বেশি সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭১ সালের কথা। বাংলাদেশে চলছে স্বাধীনতাযুদ্ধ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম স্টোনহাউসকে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করে। বাঙালিদের সংগ্রামের সঙ্গে আবেগগতভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এতটাই পরিচিত পান যে যুদ্ধ শেষে তাঁকে সম্মানসূচকভাবে নতুন রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এটি ছিল কেবল শুরু।
ব্রিটিশ-বাংলাদেশ ট্রাস্ট নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করতে বলা হয়েছিল স্টোনহাউসকে। এটি ব্রিটেনে বসবাসকারী বাঙালিদের পরিসেবা দেবে। কিন্তু ব্যাংকটি যেভাবে পরিচালিত হচ্ছিল, তা নিয়ে পরে সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে সমালোচনামূলক মন্তব্য করে। পরে তা লন্ডনের ‘ফ্রড স্কোয়াড’ ও বাণিজ্য ও শিল্প দপ্তরের তদন্তকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই নেতিবাচক প্রচার ও সরকারি তদন্ত ব্যাংকের বেশিরভাগ সমর্থনকে দূরে সরিয়ে দেয়। যা স্টোনহাউসকে গভীরভাবে বিষণ্ন করে তোলে। তিনি অনুভব করেন, তিনি সহকর্মী সংসদ সদস্যদের সম্মানও হারাচ্ছেন।
এই সবকিছু থেকে পালানোর জন্য তিনি একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। প্রথমে তাঁর নির্বাচনী এলাকা ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের ওয়ালসালের জোসেফ আর্থার মার্কহ্যাম নামে একজন সদ্যমৃত শ্রমিকের নামে একটি পাসপোর্টের আবেদন জাল করেন। এই নতুন পরিচয়ে নিজেকে একজন বিশ্ব ভ্রমণকারী রপ্তানি পরামর্শক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি লন্ডন, সুইজারল্যান্ড ও মেলবোর্নে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন। এরপর ডোনাল্ড ক্লাইভ মাইল্ডুন নামে আরেকটি জাল পরিচয় তৈরি করেন তিনি। এই লোক ছিলেন সদ্যমৃত। এই নতুন জীবনযাপনের জন্য অর্থ জোগাড় করতে স্টোনহাউস তাঁর ব্যবসা থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অথং একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন।

এরপরেই আসে সেই মুহূর্ত। ১৯৭৪ সালের ২০ নভেম্বর। মিয়ামিতে যান স্টোনহাউস। সেখানেই সাঁতার কাটার সময় উধাও হন তিনি। সৈকতে ফেলে যাওয়া পোশাকের স্তূপ ছাড়া ৪৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তির আর কোনো চিহ্ন ছিল না। সবার প্রশ্ন, তাঁকে কি সমুদ্রের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? মিয়ামি সৈকতের কাছে পাওয়া একটি কংক্রিটের ব্লকের ভেতরে রেখে তাঁকে কি খুন করা হয়েছে? নাকি তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে?
তখন স্টোনহাউসের স্ত্রীর মতে, এটি একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কিছু অদ্ভুত গুজব শুনেছি, সেগুলো আমার স্বামীর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এতটাই বেমানান যে সেগুলোর উত্তর দেওয়া বা চিন্তা করারও যোগ্য নয়। মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, এটি একটি ডুবে যাওয়ার দুর্ঘটনা। আমাদের কাছে থাকা সমস্ত প্রমাণ এটাই নির্দেশ করে যে তিনি ডুবে গিয়েছিলেন।’
তবে লন্ডনের পুলিশে ছিল সন্দেহ। স্টোনহাউসের ২৮ বছর বয়সী সেক্রেটারি ও গোপন প্রেমিকা শিলা বাকলি বন্ধুদের কাছে জোর দিয়ে বলতে থাকেন, তিনি মারা গেছেন। তবে আসল ঘটনাটি তিনি জানতেন। কারণ তাঁর কিছু পোশাক এক মাস আগে একটি ট্রাঙ্কে ভরে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। তাঁর কাছ থেকে আটলান্টিকের ওপার থেকে ফোন কলও পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর দুটি অস্ট্রেলিয়ান ব্যাংকের একটির মাধ্যম তাঁকে আধা-সাংকেতিক চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। মার্কহ্যাম ও মাইল্ডুন নামে দুটি ভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকায় অবশেষে মেলবোর্ন পুলিশ তাঁর সন্ধানে নামে।
সেই সময়ে, তাঁরা লর্ড লুকান নামের নিখোঁজ আরেকজনকে খুঁজছিল। প্রাথমিকভাবে, পুলিশ ভেবেছিল যে সন্দেহজনক চেক সই করা এই ব্যক্তিই হয়তো লুকান। লুকানের অন্তর্ধান পুলিশকে ৫০ বছর ধরে রহস্যের মধ্যে রাখলেও, স্টোনহাউসের রহস্য মাত্র এক মাসের কিছু বেশি সময় ধরে চলেছিল।
ক্রিসমাসের আগের দিনের কথা। স্টোনহাউসকে তাঁর আসল পরিচয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। পরে মেলবোর্ন পুলিশ সদর দপ্তরে তিনি যুক্তরাজ্যে তাঁর স্ত্রীকে ফোন করার অনুমতি চান। যদিও তিনি তখন বুঝতে পারেননি, যে ফোন কলে তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছিলেন, তা আসলে রেকর্ড করা হয়েছিল।
ফোনে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যালো প্রিয়তমা। ওরা এখানে আমার মিথ্যা পরিচয় ধরে ফেলেছে। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে, আমি তোমাকে ঠকিয়েছি। আমি তার জন্য দুঃখিত। কিন্তু একদিক থেকে আমি খুশি যে সব শেষ হয়েছে।’ কয়েকদিন স্টোনহাউসকে আটকে রাখা হয়েছিল। পরে তাঁর পরিবার ও তাঁর প্রেমিকা অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়।
এরই মধ্যে কেটে যায় এক মাস। সবাই জেনে যায় তাঁর আসল ঘটনা। বিবিসির অস্ট্রেলিয়া সংবাদদাত বব ফ্রেন্ডের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে বসেন তিনি। তাঁর কাজের জন্য ‘দ্বৈত চরিত্র’ তৈরি হওয়াকেই দায়ী করেন তিনি। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, তিনি কীভাবে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারকে এমন যন্ত্রণার মধ্যে ফেলতে পারলেন, উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি অদৃশ্য হয়ে তাঁদের জীবনকে সহজ করার চেষ্টা করছিলাম… আমার পুরোনো ব্যক্তিত্ব থেকে তাঁদের যে টেনশন দিতাম, তা সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।’
সাত মাস ধরে অস্ট্রেলিয়ায় থাকার চেষ্টা করেন স্টোনহাউস। শেষ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদের পাহারায় দেশে ফেরত পাঠানো হয় তাঁকে। ১৯৭৬ সালের আগস্ট। তাঁর ব্যবসা সম্পর্কিত অভিযোগে ৬৮ দিনের দীর্ঘ বিচার শেষে তাঁকে চুরি, জালিয়াতি ও প্রতারণার অপরাধে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারে তিনবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। পরে ওপেনহার্ট সার্জারি করা হয়। সুস্থ হওয়ার তিন বছর পরে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।
১৯৭৮ সালে স্টোনহাউসকে স্ত্রী তাঁকে তালাক দেন। এর তিন বছর পর প্রাক্তন সেক্রেটারি বাকলিকে বিয়ে করেন স্টোনহাউস। ১৯৮৮ সালে দ্বিতীয়বারের মত মারা যান তিনি। আর এবার সত্যি সত্যি। নিখোঁজ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি টেলিভিশন শোতে উপস্থিত হওয়ার ঠিক তিনি সপ্তাহ আগে ৬২ বছর বয়সী এই ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
কিন্তু সেই গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগগুলোর কী হলো, যা তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে এতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল? অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসার পরে এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, চেকোস্লাভাকিয়ার গুপ্তচর হওয়ার ধারণাটি ‘হাস্যকর’ ছাড়া কিছু নয়। আজও তাঁর মেয়ে জুলিয়ার তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশী শক্তির কাছে তথ্য পাচারের যেকোনো দাবি প্রত্যাখ্যান করে। ২০২১ সালে তাঁর বাবার সমর্থনে একটি লেখেন তিনি। কেমব্রিজের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ক্রিস্টোফার অ্যান্ড্রু অল্প কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে একজন, যিনি স্টোনহাউসের ওপর এমআই৫-এর ফাইল দেখেছেন; ব্রিটিশ গোয়েন্দাসংস্থার ২০০৯ সালের অনুমোদিত ইতিহাসে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে স্টোনহাউস সত্যিই চেকদের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন।
বিবিসিতে গ্রেগ ম্যাককেভিটের লেখা অবলম্বনে হুমায়ূন শফিক
.png)

আজ মুন্ডা বিদ্রোহের নেতা বিরসা মুন্ডার জন্মদিন। তাঁর হাত ধরে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে আদিবাসী জাগরণ সূচিত হয়েছিল। বিরসা মুন্ডা তাঁর অনুসারীদের কাছে ছিলেন ‘ধরতি আবা’ অর্থাৎ ভগবান।
১ ঘণ্টা আগে
জেনে অবাক হবেন যে কয়েক শত বছর আগে ঢাকা ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল। সেখানে বন্যপ্রাণীরা বাস করত। কিন্তু কোন কোন বন্যপ্রাণী সেখানে ছিল? ১৯১২ সালে প্রকাশিত বি সি অ্যালান-এর ইস্টার্ন বাংলা ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার থেকে অনুবাদ করেছেন ভূ-পর্যটক তারেক অণু।
১ দিন আগে
একসময় বাংলাদেশে ডায়াবেটিসকে ভাবা হতো বড়লোকের রোগ। কিন্তু সেই ধারণা এখন অতীত। নগরায়ণ, পরিবর্তিত জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের ফলে ডায়াবেটিস এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এক নীরব মহামারির রূপ নিয়েছে।
১ দিন আগে
ভালো ছবি তুলতে হলে যে দামী ক্যামেরা লাগবেই এমন কোনো কথা নেই। মোটামুটি মানের একটা স্মার্টফোন হলেই সুন্দর ছবি তোলা সম্ভব। সেক্ষেত্রে ছবি তোলার ‘ব্যাসিক’ কিছু কায়দাকানুন আয়ত্ত করতে হবে। কী সেগুলো? আর কেন মোবাইল ফটোগ্রাফি এত জনপ্রিয়?
১ দিন আগে