বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে এক নাটকীয় মোড় এনেছে আওয়ামী লীগের ডাকা সাম্প্রতিক হরতাল ও অবরোধ (লকডাউন)। গত পাঁচ আগস্টের পর থেকে দলটি কার্যত মাঠের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন। সরকারের নির্বাহী আদেশে দলের সব কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। কিন্তু দলের সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলার রায়ের দিন ঘোষণার প্রেক্ষাপটে আকস্মিকভাবে এই কর্মসূচির ডাক রাজনৈতিকভাবে একটি বড় ঘটনা হিসেবে উঠে এসেছে। এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা কয়েকটি প্রশ্নও সামনে এনেছে: দীর্ঘদিন পর আওয়ামী লীগ কীভাবে এমন কর্মসূচি পালনের সুযোগ পেল? সরকারের ভূমিকা কি যথেষ্ট কঠোর ছিল? এবং এই সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথই বা কী?
দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমন একটি সর্বাত্মক কর্মসূচি নিঃসন্দেহে বড় চমক। দলের শীর্ষ নেতৃত্বই এই ঘোষণা দেয়। ঢাকা শহর ও আশপাশের এলাকায়, বিশেষত গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা দেখা গেছে, তাতে কর্মসূচি অনেকটাই সফল। এখন প্রশ্ন—মানুষ কি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছে, নাকি ভয়ের কারণে ঘরে থাকতে বাধ্য হয়েছে? বড় রাজনৈতিক দল রাজপথে সহিংস কর্মসূচির হুমকি দিলে সাধারণ মানুষ নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাইরে বের হতে চায় না। তবে কারণ যাই হোক, আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে এটি এক ধরনের অর্জন।
কর্মসূচির সমান্তরালে দেশজুড়ে সংঘাত ও নাশকতার চিত্রও স্পষ্ট। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ঝটিকা মিছিল দেখা গেছে। পাশাপাশি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণের মতো নাশকতার অভিযোগ সরাসরি আওয়ামী লীগের দিকেই উঠেছে। যেহেতু কর্মসূচিটি তাদের, তাই দায়ও তাদের ওপর বর্তায়। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে বিব্রত করতে অরাজনৈতিক উপাদান দিয়ে নাশকতা চালানোর ঘটনাও নতুন নয়। কিন্তু কারণ যাই হোক, ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ, আর রাজনৈতিক দায় কর্মসূচি আহ্বানকারী দল এড়াতে পারে না। গ্রামীণ ব্যাংক বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো জনমনে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
অনেকে মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর হয়নি, সে কারণেই তারা আবার মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছে। এই ধারণা পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়। বর্তমান সরকার শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে আছে। ঢাকায় বিজিবি মোতায়েন হয়েছে, সেনাবাহিনী সতর্ক অবস্থানে। কয়েক মাস ধরেই ধরপাকড় ও তল্লাশি চলছে। আওয়ামী লীগের বহু শীর্ষ নেতা কারাগারে অথবা দেশের বাইরে। দেশে থাকা নেতাদের বড় অংশই পালাতক। অর্থাৎ, সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। এর চেয়ে বেশি কঠোরতা প্রয়োগ করলে মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠত, যা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে সরকারকে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয়। এই বাস্তবতা বিবেচনায় না এনে কেবল সরকারের ওপর দায় চাপানো বাস্তবতাকে সরলীকরণ।
বুঝতে হবে, আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়; দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা একটি বৃহৎ সংগঠন। তাদের বিশাল কর্মীবাহিনী ও বিস্তৃত সাংগঠনিক কাঠামো আছে। বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে সমাজের নানা স্তরে সমর্থক ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে তাদের ঐতিহাসিক পরিচয়ও দৃঢ়। ফলে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও তাদের পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করা কঠিন। এই কারণেই কঠোরতার মধ্যেও তারা ঝটিকা মিছিল বা অবরোধের মতো কর্মসূচি বাস্তবায়নের সাহস পেয়েছে।
এখন মূল প্রশ্ন—এই চক্রাকার সংঘাত ও সহিংসতার রাজনীতি থেকে মুক্তির উপায় কী? সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয়ই বা কী? বাসে আগুন দিয়ে ঘুমন্ত চালককে হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা দেখিয়েছে, রাজনৈতিক সংঘাতের সবচেয়ে বড় শিকার সাধারণ মানুষ। সহিংসতা, ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে আগুন—এই সব চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতি ও জননিরাপত্তা ভয়াবহ হুমকিতে পড়বে।
সমাধান একটাই—সংলাপ। একপক্ষ অন্যপক্ষকে দায়ী করলে সংকট আরও বাড়বে। যদি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হয়ও, তবু কি দেশে স্থিতি ফেরত আসবে? নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও দলটি নবনির্বাচিত সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে একই ধরনের আন্দোলন চালাতে পারে। তখন জ্বালাও–পোড়াওয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, আর সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে।
রাষ্ট্রকে টেকসই সমাধানের পথে নিতে হবে। এর জন্য যেমন সরকারের দায়িত্ব আছে, তেমনই সক্রিয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও দায়িত্ব আছে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সহিংসতা চলতে থাকলে অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে যাচ্ছে, যা অস্থিরতা বাড়াবে। দারিদ্র্য ও হতাশা মানুষকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। সবকিছুর সমাধান একটি অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই। হুমকি, গণগ্রেপ্তার বা পাল্টা সহিংসতা নয়—অর্থবহ সংলাপই পারে স্থায়ী সমাধান দিতে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে আলোচনার পথে হাঁটতে হবে।
লেখক:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক