বাংলাদেশে পুলিশ হেফাজতে থাকা কোনো আসামির বক্তব্য প্রচার বা প্রকাশ বহুদিন ধরে বিতর্কের বিষয়। বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা রক্ষা, আসামির অধিকার নিশ্চিত করা এবং জনমতকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে এমন ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ ঠেকাতে এ ধরনের প্রচার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ বা সীমিত। সম্প্রতি রাজশাহীতে এক বিচারকের ছেলেকে হত্যার ঘটনায় বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে।
গত ১৫ নভেম্বর রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ানকে আদালতে তলব করা হয়। হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন লিমন মিয়া বিচারাধীন অবস্থায় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এতে চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। হেফাজতে থাকা আসামির বক্তব্য প্রকাশের ঘটনাটিকে পুলিশের কর্তব্যে অবহেলা হিসেবে দেখা হয়।
এই বিধিনিষেধের কারণ কী এবং সংবিধান, আইন, আদালতের নির্দেশনা ও বিধিমালায় এ বিষয়ে কী বলা আছে?
মিডিয়া ট্রায়াল কী এবং কেন তা সমস্যাজনক
মিডিয়া ট্রায়াল বলতে সেই পরিস্থিতিকে বোঝায়, যখন সংবাদমাধ্যম— যেমন পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম— কোনো আসামিকে আদালতের রায় দেওয়ার আগেই অপরাধী বা নির্দোষ হিসেবে জনমতের সামনে উপস্থাপন করে। এ প্রক্রিয়ায় হেফাজতে থাকা ব্যক্তির বক্তব্য প্রচার, স্বীকারোক্তি প্রকাশ, ছবি দেখানো, অতীত অপরাধের তথ্য তুলে ধরা বা আত্মদোষ স্বীকার করার মতো উপাদান থাকে।
সংবাদমাধ্যম জনগণকে তথ্য জানানোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত প্রচার নানা ঝুঁকি তৈরি করে। যেমন—
এতে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। প্রচুর প্রচার আদালতের স্বাধীনতায় বাধা দেয়। বিচারক জনমত বা প্রচারের চাপে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যা নিরপেক্ষতার মূল নীতিকে লঙ্ঘন করে।
আসামির নির্দোষ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। আদালতে অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত আসামি নির্দোষ। কিন্তু গণমাধ্যমের প্রচার জনমনে পূর্বধারণা তৈরি করে এবং বিচারক বা সাক্ষীও এতে প্রভাবিত হতে পারেন।
গোপনীয়তা ও মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হেফাজতে থাকা ব্যক্তিরও গোপনীয়তার অধিকার রয়েছে। ভুল তথ্য বা জোরপূর্বক আদায় করা বক্তব্য প্রচার হলে তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে পারে।
তদন্তে ব্যাঘাত ঘটে। তদন্তাধীন তথ্য প্রকাশিত হলে আসামির সহযোগীরা সতর্ক হতে পারে, প্রমাণ নষ্ট হতে পারে বা সংবেদনশীল তথ্য ফাঁস হতে পারে।
জবানবন্দির স্বেচ্ছাস্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। হেফাজতে দেওয়া বক্তব্য স্বেচ্ছায় নাও হতে পারে। গণমাধ্যমে তা প্রচার পুলিশি প্রভাব বা অনৈতিক আচরণের ইঙ্গিত দিতে পারে।
বাংলাদেশের আইন কী বলে
বাংলাদেশে এ বিষয়ে কোনো একক আইন নেই যা সব ধরনের প্রচার নিষিদ্ধ করে। তবে সংবিধান, বিভিন্ন আইন, বিধি ও আদালতের নির্দেশনা মিলিয়ে কঠোর সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বিচারাধীন মামলা বা পুলিশ হেফাজতের ক্ষেত্রে এসব বিধান কার্যকর থাকে।
১. সংবিধান
অনুচ্ছেদ ৩৫(৩):
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতে দ্রুত বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে। মিডিয়া ট্রায়াল এ নীতিকে ব্যাহত করে।
অনুচ্ছেদ ৩৯:
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা, আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধে প্ররোচনার ক্ষেত্রে যৌক্তিক সীমাবদ্ধতা আরোপ করা যায়। বিচারাধীন বিষয়ে পূর্বধারণা তৈরি করা এ সীমাবদ্ধতার আওতায় পড়ে।
অনুচ্ছেদ ৩২:
জীবনের অধিকার নিশ্চিত করে, যার মধ্যে মর্যাদা ও নিরাপদ জীবনের অধিকার রয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত প্রচার এই অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
অনুচ্ছেদ ২৭ ও ৩১:
আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করে। মিডিয়া ট্রায়াল কোনো ব্যক্তিকে অন্যায্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
২. সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২
ধারা ২৫: পুলিশ হেফাজতে দেওয়া কোনো বক্তব্য আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে হেফাজতের বক্তব্য প্রচার করা আইনের চোখে অবৈধ এবং বিভ্রান্তিকর।
৩. ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি), ১৮৯৮
ধারা ১৬৪: স্বীকারোক্তি শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নেওয়া যায় এবং তা স্বেচ্ছাস্বীকৃত কি না, তা নিশ্চিত করতে কঠোর নিয়ম রয়েছে। পুলিশ হেফাজতের বক্তব্য এসব সুরক্ষার আওতায় পড়ে না। গণমাধ্যমে তা প্রচার করা আইনগত প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে যায়।
ধারা ১৬৭–১৬৯: হেফাজতে থাকা ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশের। অননুমোদিত গণমাধ্যম যোগাযোগ এ দায়িত্বের লঙ্ঘন।
৪. গণমাধ্যম-সংক্রান্ত আইন
প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪:
ধারা ১২ অনুযায়ী নৈতিকতা ভঙ্গের অভিযোগে সাংবাদিক বা পত্রিকাকে সতর্ক বা নিন্দা জানানো যায়।
আচরণবিধি, ১৯৯৩:
বাংলাদেশের সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকদের জন্য অনুসরণীয় আচরণবিধি, ১৯৯৩ (২০০২ সালে সংশোধিত) এর ধারা ১৬ অনুযায়ী রায় না হওয়া পর্যন্ত এমন মন্তব্য বা প্রতিবেদন প্রকাশ করা যায় না যা বিচারকে প্রভাবিত করতে পারে। লঙ্ঘন করলে আদালত অবমাননার অভিযোগ হতে পারে। যদিও এটি সরাসরি ব্রডকাস্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ), ২০১৮:
সংবেদনশীল বা মানহানিকর তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। যদিও আসামির বক্তব্য প্রচার নিষিদ্ধ করার সরাসরি বিধান নেই, তবুও ডিজিটাল মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
প্রস্তাবিত ব্রডকাস্ট আইন, ২০১৮:
মিথ্যা বা বিচার প্রভাবিতকারী তথ্য প্রচার করলে কঠোর দণ্ডের প্রস্তাব রয়েছে। তবে আইনটি এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
নারী ও শিশু সুরক্ষা আইন:
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (ধারা ১৪(১)) এবং শিশু আইন, ২০১৩ (ধারা ২৮) অনুযায়ী ভুক্তভোগী নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ নিষিদ্ধ। লঙ্ঘন করলে কারাদণ্ডসহ শাস্তির বিধান রয়েছে।
৫. দণ্ডবিধি, ১৮৬০
ধারা ৫০০:
মানহানি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। প্রচারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আসামি বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন।
হাইকোর্টের নির্দেশনা ও পূর্ববর্তী দৃষ্টান্ত
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট, বিশেষত হাইকোর্ট বিভাগ, এই ধরনের সীমাবদ্ধতা বহুবার পুনর্ব্যক্ত করেছে। ২০২০ সালে হাইকোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ আদেশে গণমাধ্যমে পলাতক আসামি ও বিচারাধীন অভিযুক্তদের বক্তব্য, সাক্ষাৎকার বা কথোপকথন প্রচার নিষিদ্ধ করে। আদালত বলেছিল, এটি বিদ্যমান আদেশ লঙ্ঘন করে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যুক্তিসঙ্গত সীমাবদ্ধতার মধ্যে পড়ে। এই আদেশ আসে পলাতক পি কে হালদারের ঘটনায়।
আরও বিস্তৃত নির্দেশনায় গ্রেফতার ও আটক প্রক্রিয়ায় কয়েকটি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বলা হয়। যেমন—আটকের ১২ ঘণ্টার মধ্যে পরিবার বা আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দিতে হবে। এতে পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমের হস্তক্ষেপও সীমিত হয়।
২০১২ সালের প্রথম আলো সংক্রান্ত প্রেস কাউন্সিল মামলায় নৈতিক ত্রুটির জন্য সতর্কবার্তাও প্রদান করা হয়।
আন্তর্জাতিক উদাহরণও বিশ্লেষণে উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের শেপার্ড বনাম ম্যাক্সওয়েল (১৯৬৬) মামলায় গণমাধ্যম পক্ষপাতের যে নীতি নির্ধারিত হয়েছিল, তা বাংলাদেশেও আলোচনায় উল্লেখ করা হয়।
বাস্তব প্রয়োগ সাধারণত সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদনের মাধ্যমে বা প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করে পরিচালিত হয়। তবে সমালোচকেরা বলেন, কার্যকর প্রয়োগব্যবস্থা এখনো শক্তিশালী নয়।
ব্যতিক্রম
এই নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ নয়। রায় ঘোষণার পর কোনো বক্তব্য বা হেফাজতের বাইরে স্বেচ্ছায় দেওয়া মন্তব্য প্রচারযোগ্য হতে পারে—যদি তা মানহানি বা উসকানি সৃষ্টি না করে।
গণমাধ্যমের স্ব-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও আছে। জাতীয় সম্প্রচার নীতি ২০১৪ নৈতিক ও দায়িত্বশীল প্রতিবেদনকে উৎসাহিত করে।
তবে ডিজিটাল মাধ্যমে দ্রুত বিস্তারের কারণে নতুন আইনপ্রণয়নের দাবি বাড়ছে। একটি পূর্ণাঙ্গ ব্রডকাস্টিং অ্যাক্ট এবং শক্তিশালী বাস্তবায়ন কাঠামো তৈরির আহ্বান জোরালো হচ্ছে।
এক্ষেত্রে ভারসাম্যই মূল বিষয়— মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বজায় রেখে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। তাই যেকোনো সীমাবদ্ধতা হতে হবে আইনগত, প্রয়োজনীয় এবং আনুপাতিক।
বাংলাদেশে কোনো বিশেষ কোনও আইনে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ নিষিদ্ধ না করা হলেও, আদালতকে প্রভাবিত করার মতো প্রচার আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। সাম্প্রতিক রাজশাহী ঘটনার পর পুলিশের চার সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা এবং আরএমপি কমিশনারকে তলব করা দেখায়—ন্যায্য বিচারের স্বার্থে এসব বিধিনিষেধ কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে।