leadT1ad

দক্ষিণ এশিয়ার স্বৈরশাসকদের প্রতি দিল্লির সমর্থনে যেভাবে লাভবান চীন

বহু বছর ধরে ভারত নিজেকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে তুলে ধরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রও তাকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গণতান্ত্রিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে দেখেছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের আচরণ ভিন্ন। কৌশলগত স্বার্থে ভারত অনেক সময় স্বৈরশাসকদের সমর্থন দিয়েছে এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে। মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তখন তুচ্ছ হয়ে গেছে।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

ভারতের অগণতান্ত্রিক আধিপত্যের বোকামি। স্ট্রিম গ্রাফিক

২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নেপালে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। হাজারো তরুণ রাস্তায় নেমে আসে এবং সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে। তারা দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও মতপ্রকাশের ওপর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বহু মানুষ মারা যায়। তবু গণআন্দোলনের চাপেই প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন। পরে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।

নেপাল এমন ধারাবাহিক প্রবণতার সবশেষ উদাহরণ। ২০২৪ সালে তরুণদের নেতৃত্বে হওয়া আন্দোলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন শেষ হয়। শ্রীলঙ্কায়ও ২০২২ সালে ধারাবাহিক বিক্ষোভে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার ক্ষমতা হারায়। মালদ্বীপেও দুর্নীতি, গণতন্ত্রের অবনতি এবং বিভাজনমূলক বৈদেশিক সম্পর্কের কারণে দফায় দফায় বিক্ষোভ হয়।

এই আন্দোলনগুলো মূলত দেশীয় সমস্যার ফল। তবে এখানেই গল্প শেষ নয়। বহু বছর ধরে ভারত নিজেকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে তুলে ধরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রও তাকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গণতান্ত্রিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে দেখেছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের আচরণ ভিন্ন। কৌশলগত স্বার্থে ভারত অনেক সময় স্বৈরশাসকদের সমর্থন দিয়েছে এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে। মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তখন তুচ্ছ হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছে। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার জানিয়ে দেন যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকেই প্রাধান্য দেবে। পরবর্তী সব মার্কিন প্রশাসন সেই নীতি অনুসরণ করে। ভারত কখনো আর্থিক সহায়তা, কখনো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আবার কখনো নিরাপত্তা সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিবেশী সরকারগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে। এর বিনিময়ে ওয়াশিংটনও অনেক সময় চুপ থেকেছে।

ফলে ছোট দেশগুলো ভারতকে এমন এক আঞ্চলিক কর্তৃত্বশীল শক্তি হিসেবে দেখে, যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে তাদের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। এতে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও আস্থা কমে যায়। নেপালের সাম্প্রতিক বিক্ষোভে ভারতীয় টেলিভিশন সংবাদিকদের প্রতি প্রতিবাদকারীদের আক্রমণাত্মক আচরণ সেই ক্ষোভেরই উদাহরণ। এই অবিশ্বাস চীনের প্রভাব বাড়ার সুযোগ তৈরি করে। জনগণ যখন ভারতের ঘনিষ্ঠ সরকারগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন বেইজিং বিভিন্ন ধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের কাছে এগিয়ে আসে।

এই প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগজনক। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো চীনের দিকে ঝুঁকলে ওয়াশিংটনের প্রভাব ও বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নতুনভাবে বিবেচনা করা। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোকে স্বাধীন অংশীদার হিসেবে দেখাও জরুরি।

এভাবে বাংলাদেশ ভারতের দিকে ঝুঁকে থাকা নীতি থেকে সরে এসে নতুন ভারসাম্য খুঁজতে শুরু করে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির এই সুযোগ তৈরি হয়েছে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে। ভারত যে স্বৈরাচারী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র তা চ্যালেঞ্জ না করায় চীনের জন্য পথ আরও সহজ হয়েছে।

‘ইন্ডিয়া আউট!’

ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে তার বাস্তব নীতির সবচেয়ে বড় বিরোধ দেখা যায় বাংলাদেশে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন সত্ত্বেও নয়াদিল্লি তার প্রতি আস্থা রেখেছে। এর ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়েছে, বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার হয়েছে এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো দমনমূলক আইন জারি থাকে।

হাসিনার সরকার ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ পূরণ করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে অবস্থান নেওয়া ভারতবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দুর্বল করেছে। বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামোকে শক্তিশালী করেছে এবং র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) কূটনৈতিক সুরক্ষা দিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানায়, হাসিনার শাসনামলে বিরোধী নেতা, কর্মী ও সাংবাদিকদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো হয়। ভারত এসব নিয়ে খুব কমই প্রকাশ্যে কথা বলেছে।

ফলে বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ বাড়তে থাকে। ২০২৪ সালের শুরুতে ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় পণ্যের বয়কট এবং অনলাইন প্রচারণা গতি পায়। একই বছরের মাঝামাঝি ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনে সরকারের দমন-পীড়নে বহু মানুষ মারা যায়। এতে জনরোষ আরও তীব্র হয় এবং শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী হাসিনার কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়। তাকে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। এতে দুদেশের সম্পর্ক আরও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।

হাসিনার পতনের আগে যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরাতে বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তারা সাধারণত ভারতের অবস্থানের সঙ্গেই চলেছে। ২০২১ সালে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ২০২৩ সালে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলেও বৃহত্তর চাপ প্রয়োগ থেকে বিরত ছিল। ২০২৪ এর নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ জানালেও কঠোর অবস্থান নেয়নি।

হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর চীন দ্রুত সক্রিয় হয়। ২০২৪ সালের অক্টোবরে চীনা যুদ্ধজাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এরপর উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক ও সামরিক যোগাযোগ বাড়ে। চীন বাংলাদেশকে সামরিক প্রযুক্তি, অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং নৌ-মহড়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য আলোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়।

এভাবে বাংলাদেশ ভারতের দিকে ঝুঁকে থাকা নীতি থেকে সরে এসে নতুন ভারসাম্য খুঁজতে শুরু করে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির এই সুযোগ তৈরি হয়েছে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে। ভারত যে স্বৈরাচারী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র তা চ্যালেঞ্জ না করায় চীনের জন্য পথ আরও সহজ হয়েছে।

মালদ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথের কাছে হলেও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন এটিকে ইন্দো-প্রশান্ত কৌশলে গুরুত্ব দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র মালদ্বীপকে মূলত ভারতের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেছে। গণতন্ত্রের অবনতির সময়ও ওয়াশিংটন কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। এই শূন্যস্থান কাজে লাগিয়ে চীন তার প্রভাব বাড়ায় এবং দেশটির ঋণের চাপ কমানোর উদ্যোগ নেয়।

অস্থির দ্বীপপুঞ্জ

মালদ্বীপেও একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভারতীয় প্রভাব নিয়ে দেশটিতে অসন্তোষ বাড়ে। এর ফলে সরকার পরিবর্তন হয় এবং পরে চীনের প্রভাব বাড়তে থাকে। এতে প্রমাণিত হয়—স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিলে গণতন্ত্র ও জবাবদিহি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে উল্টো ফল দেখা দেয়।

২০১৩ সালে আব্দুল্লাহ ইয়ামিন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট হলে ভারত তাকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। সামরিক সহযোগিতা ও নজরদারি চুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু একই সময়ে ইয়ামিন ক্রমে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। তিনি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেন, বিরোধী নেতাদের কারাবন্দি করেন এবং ২০১৫ ও ২০১৮ সালে জরুরি অবস্থা জারি করে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। ২০১৬ সালে কমনওয়েলথ মালদ্বীপকে শাস্তির মুখে ফেলতে চাইলে ভারত তাকে কূটনৈতিকভাবে রক্ষা করে। অনেক মালদ্বীপবাসীর কাছে এটি ছিল দমন-পীড়নের প্রতি ভারতের নীরব সমর্থন।

২০১৮ সালে ইয়ামিন ক্ষমতা হারান। এরপর তিনি নিজেই ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এতে ভারতকে নতুন ধরনের আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়। ২০২২ সালের দিকে এই আন্দোলন জোরদার হয় এবং দেশে অবস্থানরত ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের দাবি ওঠে। এই আবহে ২০২৩ সালে বিরোধী দলের মোহাম্মদ মুঈজ্জু নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন। তিনি সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের কথা বলে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করেন এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করেন। ফলে দুই দেশের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা সহযোগিতা ভেঙে যায়।

২০২৫ সালের জুলাইয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে উত্তেজনা কিছুটা কমে। দুপক্ষ বাণিজ্য আলোচনা শুরু করে এবং ৫৬৫ মিলিয়ন ডলারের ঋণসুবিধা ঘোষণা হয়। তবে দুই দেশের আস্থা এখনো দুর্বল এবং সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি।

মালদ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথের কাছে হলেও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন এটিকে ইন্দো-প্রশান্ত কৌশলে গুরুত্ব দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র মালদ্বীপকে মূলত ভারতের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেছে। গণতন্ত্রের অবনতির সময়ও ওয়াশিংটন কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। এই শূন্যস্থান কাজে লাগিয়ে চীন তার প্রভাব বাড়ায় এবং দেশটির ঋণের চাপ কমানোর উদ্যোগ নেয়। ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট মুঈজ্জুর বেইজিং সফরে অবকাঠামো, বাণিজ্য, মৎস্য ও ডিজিটাল সংযোগ নিয়ে চুক্তি হয়।

এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র দেরিতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করে। ২০২৪ সালের জুনে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটনে যান এবং নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রস্তাব পান। কিন্তু চীনের প্রস্তাব ছিল আরও বড়—সামরিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। মালদ্বীপবাসীর চোখে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল কৌশলগত প্রতিক্রিয়া, প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমর্থন নয়। স্বচ্ছ শাসন, জবাবদিহি ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রতি প্রকৃত প্রতিশ্রুতি না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগকে ভাসাভাসা মনে হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ জানালেও ভারতের নীতি অনুসরণ করে চলে। যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সাহায্য দিলেও শাসনব্যবস্থার সংস্কার বা দুর্নীতি দমন নিয়ে কঠোর অবস্থান নেয়নি। ফলে শ্রীলঙ্কার অনেক মানুষ, বিশেষত তরুণ বিক্ষোভকারীরা, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র—দুপক্ষকেই ব্যর্থ ও পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে দেখেছে।

শ্রীলঙ্কায় জবাবদিহির অভাব

বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মতো শ্রীলঙ্কাতেও একই ধরনের অসন্তোষ দেখা যায়। ভারতের হস্তক্ষেপ সেখানে চীনের লাভের সুযোগ তৈরি করেছে। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ২০০৯ সালে ভারত শ্রীলঙ্কার ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ওঠে। কিন্তু এই সহযোগিতা মানবাধিকার ও জবাবদিহির প্রশ্নকে উপেক্ষা করে গড়ে ওঠে। সেসময় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে ভারত একটি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়, যা যুদ্ধাপরাধ তদন্তের প্রচেষ্টা দুর্বল করে।

পরবর্তীকালে ভারত আন্তর্জাতিক চাপ থেকেও শ্রীলঙ্কাকে রক্ষা করে। তামিল জনগোষ্ঠীর অভিযোগগুলোকে ভারত গুরুত্ব দেয়নি। স্পষ্ট বার্তা ছিল—ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষা হলে অতীতের নৃশংসতা নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না।

২০১৯ সালে গোতাবায়া রাজাপাক্ষে ক্ষমতায় আসেন। তার দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ২০২২ সালে দেশ গভীর সংকটে পড়ে। ভারত তখন কোনো শর্ত ছাড়াই প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়। এতে শ্রীলঙ্কা ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, কিন্তু দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার মতো সমস্যাগুলো অমীমাংসিত থাকে। সাহায্য দেশকে সাময়িকভাবে টিকিয়ে রাখলেও শেষে বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রপতির দপ্তর দখল করে এবং গোতাবায়া দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। আন্দোলনকারীরা ভারতের সমর্থনকে দোষারোপ করে রাষ্ট্রপতি ভবনের দেয়ালে ‘ইন্ডিয়া আউট’ লিখে প্রতিবাদ জানায়।

নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে এরপর চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। চীন দুই বছরের ঋণ ছাড় দেয় এবং হাম্বানটোটায় ৪৫০ কোটি ডলারের তেল শোধনাগার প্রকল্প এগিয়ে নেয়। এটি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে অন্যতম বড় বিদেশি বিনিয়োগ। প্রকল্পটি চালু হলে ভারতের উপকূলের খুব কাছেই চীনের একটি বড় রসদ কেন্দ্র তৈরি হবে।

এই সময় যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ জানালেও ভারতের নীতি অনুসরণ করে চলে। যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সাহায্য দিলেও শাসনব্যবস্থার সংস্কার বা দুর্নীতি দমন নিয়ে কঠোর অবস্থান নেয়নি। ফলে শ্রীলঙ্কার অনেক মানুষ, বিশেষত তরুণ বিক্ষোভকারীরা, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র—দুপক্ষকেই ব্যর্থ ও পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে দেখেছে।

চীন নেপালকে শর্তহীন ঋণ দেয়। প্রধানমন্ত্রী অলি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগেই চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হন। তিনি ২০২৪ সালে প্রোটোকল ভেঙে প্রথমে বেইজিং সফর করেন। অন্তর্বর্তী সরকারও এখনো চীন-বান্ধব অবস্থান বজায় রেখেছে এবং দেশে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার দাবি ধীরে এগিয়ে নিচ্ছে।

নেপালে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পতাকায় আগুন

নেপাল বহু বছর ধরে দেখছে যে ভারত আঞ্চলিক প্রভাবকে গণতন্ত্রের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। গত ১৭ বছরে দেশটিতে ১৪টি সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এর পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন যেমন আছে, অনেক নেপালি মনে করেন ভারতের হস্তক্ষেপও সংকটকে আরও গভীর করেছে।

২০১৫ সালের শেষ থেকে ২০১৬ সালের শুরুর দিকে ভারত নেপালের ওপর অবরোধ আরোপ করে। নতুন সংবিধানের কারণে ভারতের সীমান্তবর্তী জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ভারত এই পদক্ষেপ নেয়। অবরোধে পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং হাসপাতালগুলো সংকটে পড়ে। ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত দেশটিতে মানবিক সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়। দুই দেশের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়।

২০২০ সালে #BackOffIndia প্রচারণায় তরুণদের বিরক্তি প্রকাশ পায়। তারা মনে করত, ভারতের অযাচিত প্রভাব এবং নেপালি রাজনীতিতে রাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীর প্রতি ভারতের নরম অবস্থান সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলছে। ২০২৫ সালের বিক্ষোভেও মানুষ শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধেই নয়, বরং ভারতের দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকার বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্র নেপালকে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের প্রভাববলয়ের অংশ হিসেবে দেখেছে। তাই ওয়াশিংটন নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে উন্নয়ন সহায়তা ও দুর্যোগ ত্রাণে। রাজনৈতিকভাবে গভীর সম্পৃক্ততা এড়ানো হয়েছে যাতে ভারত অসন্তুষ্ট না হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র বড় উদ্যোগ ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলারের এমসিসি প্রকল্প, যা বিদ্যুৎ লাইন ও সড়ক উন্নয়নে সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু অনেক নেপালির কাছে এটি ভারতের প্রভাব বাড়ানোর যৌথ প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। ২০২২ সালে এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পতাকা পোড়ানো হয়।

এই পরিস্থিতি ও নেপালের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা চীনের জন্য সুযোগ তৈরি করে। ২০১৭ সালে নেপাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেয়। এরপর চীন-সমর্থিত কিছু প্রকল্প ধীরে ধীরে এগোতে থাকে—কাঠমান্ডু-কেরুং রেলপথ, দাইলেখে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এবং ট্রান্স-হিমালয়ান করিডোর। চীনের বাণিজ্যও দ্রুত বাড়ছে। চীন নেপালকে শর্তহীন ঋণ দেয়। প্রধানমন্ত্রী অলি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগেই চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হন। তিনি ২০২৪ সালে প্রোটোকল ভেঙে প্রথমে বেইজিং সফর করেন। অন্তর্বর্তী সরকারও এখনো চীন-বান্ধব অবস্থান বজায় রেখেছে এবং দেশে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার দাবি ধীরে এগিয়ে নিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারতের পছন্দ-অপছন্দের ওপর পুরো আঞ্চলিক নীতি দাঁড় করিয়ে রাখে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়া বেইজিংয়ের দিকে আরও ঝুঁকবে। বিশ্বের দুই বৃহত্তম গণতন্ত্র যদি কৌশলগত নীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সমন্বয় করতে না পারে, তাহলে চীন আরও লাভবান হতে থাকবে।

সীমা স্পষ্ট হলে সম্পর্কও সুস্থ থাকে

দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা পরিষ্কার। ভারত তার কৌশলগত স্বার্থকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বিরক্ত করতে না চেয়ে এসব বিষয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। জনগণ এটিকে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ভারতীয় আধিপত্য হিসেবে দেখে। এতে ক্ষোভ বাড়ে এবং চীনের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হয়।

এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; কাঠামোগত বাস্তবতা। দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্রগুলো এখন মহাশক্তির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। ভারত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করলে বা অজনপ্রিয় নেতাদের সমর্থন দিলে চীনের প্রভাব বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়।

আর যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারতের পছন্দ-অপছন্দের ওপর পুরো আঞ্চলিক নীতি দাঁড় করিয়ে রাখে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়া বেইজিংয়ের দিকে আরও ঝুঁকবে। বিশ্বের দুই বৃহত্তম গণতন্ত্র যদি কৌশলগত নীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সমন্বয় করতে না পারে, তাহলে চীন আরও লাভবান হতে থাকবে।

এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের উচিত দক্ষিণ এশিয়া নীতি পুনর্বিবেচনা করা। অঞ্চলটিকে কেবল ভারতের প্রভাববলয় নয়, স্বাধীন দেশগুলোর সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

স্থানীয় জনগণের কথা শোনা, স্বচ্ছতা ও মানবাধিকারের মান নির্ধারণ করা এবং এসবের লঙ্ঘনে দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখানো—এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লঙ্ঘনকারী যদি ভারতও হয়, তবুও একই নীতি প্রয়োগ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের প্রভাব রোধ করতে চায়, তবে ভারতকেন্দ্রিক নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করতে হবে।

(ফরেইন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পেরি ওয়ার্ল্ড হাউস-এর পোস্টডক্টরাল ফেলো মুহিব রহমানের লেখার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মাহবুবুল আলম তারেক)

Ad 300x250

সম্পর্কিত