বাংলাদেশের আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একটি গণভোটও অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটটি হলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সাংবিধানিক সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’-এর অনুমোদন বিষয়ে একটি গণভোট। এটি সংবিধান সংস্কারের একটি কাঠামোগত নথি, যা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে।
সনদটি দীর্ঘদিনের কিছু রাজনৈতিক সমস্যা—স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা, ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানগত ভারসাম্যহীনতা—সমাধানের উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান থেকেই মানুষের এই আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে।
ব্যালটপেপারে একটি মাত্র ‘হ্যাঁ/না’ প্রশ্ন থাকবে। এর মাধ্যমে চারটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত সংস্কার প্রস্তাব একত্রে অনুমোদনের জন্য ভোট নেওয়া হবে। প্রস্তাবগুলো আলাদা করে নয়; সামগ্রিকভাবে ভোটের জন্য উপস্থাপন করা হবে। কেউ যদি ‘হ্যাঁ’ ভোট দেয় তাহলে ধরে নেওয়া হবে তিনি চারটি প্রস্তাবেই একমত।
ভোটাররা সংসদীয় নির্বাচনের ব্যালটের পাশাপাশি এই গণভোটেও ভোট দেবেন। নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ফল নির্ধারণ করবে। এই ভোট সংবিধান সরাসরি বদলে দেবে না; বরং ভবিষ্যৎ সংস্কারের জন্য একটি জনসমর্থিত নির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।
এতে প্রশ্ন থাকবে—
“আপনি কি ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সাংবিধানিক সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ এবং জুলাই জাতীয় সনদের অন্তর্ভুক্ত নিম্নলিখিত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর সাথে একমত?”
১. নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থা জুলাই সনদের বর্ণিত প্রক্রিয়ায়র আলোকে গঠন করা হবে।
২. আগামী জাতীয় সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা হবে ১০০। জাতীয় নির্বাচনে দলগুলো যে পরিমাণ ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। সংবিধান সংশোধনের জন্য উচ্চকক্ষের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুমোদন বাধ্যতামূলক হবে।
৩. রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদের ৩০ দফা সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো, মৌলিক অধিকার বাড়ানো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করাসহ বিভিন্ন বিষয়। আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো এসব সংস্কার বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবে।
৪. জুলাই সনদের বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে।
যদি ‘হ্যাঁ’ জয়ী হয়
ভোটে যদি ‘হ্যাঁ’ জয়ী হয় তাহলে বিজয়ী নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা জুলাই জাতীয় সনদের একমত হওয়া প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বাধ্য হবেন। নব নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। অর্থাৎ, নতুন সংসদ সদস্যরা ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ এর সদস্য হিসেবে গণ্য হবেন। তাঁরা সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবেন। জুলাই সনদে একমত হওয়া বিষয়গুলোর আলোকে তারা সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনবেন।
সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন হবার পর ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। এর মেয়াদ হবে নিম্নকক্ষের শেষ কার্যদিবস পর্যন্ত।
সংস্কার প্রক্রিয়া সনদের রূপরেখা অনুসারে এগোবে। সংস্কারের পর একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করা হবে। এটি দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ধারণা সৃষ্টি করতে পারে, যদিও ১৯৭২ সালের সংবিধান পুরোপুরি বাতিল হবে না।
জুলই সনদ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন আসবে। যেমন দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিত হবে।
নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা হবেন নিম্নকক্ষের সদস্য। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে বা পিআর পদ্ধতিতে সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। উচ্চকক্ষের সদস্য হবেন ১০০ জন।
আনুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। যেমন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি ভোট পড়ে ১০ কোটি এবং এর মধ্যে বিএনপি পায় ৫ কোটি বা ৫০ শতাংশ, তাহলে উচ্চকক্ষে বিএনপির প্রতিনিধি সংখ্যা হবে ৫০। কোনও দল যদি ১ শতাংশ ভোট পায় তাহলে উচ্চকক্ষে তাদেরও একজন প্রতিনিধি থাকবেন। ১ শতাংশের কম ভোট পেলে সেই দলের প্রতিনিধি উচ্চকক্ষে থাকবে না।
উচ্চকক্ষের হাতে আইন প্রণয়নের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। তবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিম্নকক্ষের কাছে আইন প্রণয়নের জন্য প্রস্তাব দিতে পারবে। নিম্নকক্ষে পাস হওয়া সব ধরনের বিল (অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে) অনুমোদনের জন্য উচ্চকক্ষে পাঠানো হবে। উচ্চকক্ষ সেটি দুই মাসের বেশি আটকে রাখলে ধরে নেওয়া হবে বিলটি পাস হয়েছে। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত যেকোনো বিল উচ্চকক্ষে পাস করতে হবে।
বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী পদে মেয়াদের নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। গণভোটে হ্যাঁ ভোট জয়ী হলে সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে। তখন সেখানে যুক্ত করা হবে ‘একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে যত মেয়াদ বা যত বারই হোক, সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন।’
এ ছাড়া বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা আরও জোরদার হতে পারে। নির্বাহী ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ কমবে। একদলীয় আধিপত্য রোধে মেয়াদসীমা বা বিকেন্দ্রীকরণের মতো পদক্ষেপ দ্রুত এগোতে পারে। জরুরি ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকাতে সুরক্ষা-বলয় তৈরি হতে পারে।
যদি ‘না’ জয়ী হয়
ভোটে যদি ‘না’ জয়ী হয় তাহলে জুলাই সনদ আর বাস্তবায়ন হবে না। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে না এবং নতুন সংসদ সদস্যরা ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে গণ্য হবেন না। নব নির্বাচিত সংসদ আর জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবে না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘গণভোটে পাস না হলে জুলাই সনদ পাস হবে না। তার মানে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।’ অর্থ্যাৎ, এই প্রক্রিয়ার সেখানেই ইতি ঘটবে।
তখন সংবিধান সংশোধনের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী (বর্তমান সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ) পরিবর্তন করতে হবে। এতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হবে, যা ধীর এবং রাজনৈতিকভাবে বেশি বিতর্কিত হতে পারে।
সংসদ সদস্যরা সনদের প্রস্তাবগুলো বদলে দিতে পারেন, উপেক্ষা করতে পারেন বা বিকল্প সংস্কার উদ্যোগ নিতে পারেন। সমালোচকেরা মনে করেন, এতে নির্বাচিত সরকার অন্তর্বর্তী সরকারের আরোপিত সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকবে। তারা নির্বাচনী জনাদেশ অনুযায়ী নিজেদের মতো সমাধান খুঁজতে পারবে।
সনদের নির্ধারিত সুরক্ষা-ব্যবস্থা না থাকলে সংস্কার প্রক্রিয়াও আটকে যেতে পারে। সংসদে বিভাজন দেখা দিলে জটিলতা বাড়তে পারে। এতে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর দখলদারির ঝুঁকি বাড়তে পারে। অন্যদিকে, এতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন।
উল্লেখ্য, গণভোটে ‘না’ এলে কোনো তাৎক্ষণিক সংকট তৈরি হবে না; যথারীতি সংসদ গঠিত হবে।
এ প্রসঙ্গে লাতিন আমেরিকার দেশ চিলির উদাহরণ দেওয়া যায়। সম্প্রতি দেশটিতে সংবিধান সংক্রান্ত দুটি গণভোট ব্যর্থ হয়। প্রথমবার একটি সংবিধান তৈরি করে গণভোট আয়োজন করা হয়। কিন্তু হ্যাঁ ভোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কারণ, অনেকে সেই সংবিধানের বেশি বামপন্থী হয়ে ওঠার কথা বলেছিল। প্রায় ৬২ শতাংশ ভোটার ‘না’ ভোট দেন। পরে সংশোধন ও সংযোজন করে আবার গণভোট করা হয়। কিন্তু সেবারও ‘না’ ভোট জয়ী হয়।
চিলিতে গণভোটের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় জনগণের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে। ২০১৯ সালে মানুষ স্বৈরশাসক আগুস্তো পিনোশের শাসনামলে (১৯৮০) তৈরি সংবিধান বাতিলের জন্য বিক্ষোভ শুরু করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম গণভোটের আয়োজন করা হয়। সেটি ব্যর্থ হওয়ার ১৬ মাসের মাথায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় গণভোটের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সেবারও ৫৬ শতাংশ ‘না’ ভোট পড়ে। ফলে আর নতুন সংবিধান গৃহীত হয়নি।
গণভোটের সময়কালীন চিলির বামপন্থী প্রেসিডেন্টে গ্যাব্রিয়েল বোরিচ এখনো ক্ষমতায় আছেন। দেশটির ১৯৮০ সালের পুরোনো সংবিধানটিও বহাল আছে। বরিচ বলেছেন, তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে (২০২৬ সাল) আর কোনো নতুন সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে না।
বাংলাদেশে এর আগে যে তিনটি গণভোট হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটিতে ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দুটি ছিল ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ও তাদের কর্মসূচির প্রতি আস্থা সংক্রান্ত। তৃতীয়টি হয় রাষ্ট্রপতি থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় রূপান্তরের প্রস্তাব নিয়ে। এবার চতুর্থ গণভোট আয়োজন করা হবে। এবারের গণভোট হবে জুলাই জাতীয় সনদে প্রস্তাবিত গণতান্ত্রিক সংস্কার অনুমোদনে।
সামগ্রিকভবে বাংলাদেশের এই গণভোট মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে জনগণের আস্থার একটি পরীক্ষা হবে। ‘হ্যাঁ’ ভোট সংস্কার কার্যক্রমকে সহজ ও সম্মিলিত কাঠামোর মধ্যে এগিয়ে নেবে। ‘না’ ভোট নির্বাচিত সংসদের হাতে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে, তবে এতে আলোচনার জটিলতা বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে। অংশগ্রহণ কম হওয়া বা প্রশ্নে চারটি বিষয় একত্রে থাকার কারণে ভোটার বিভ্রান্তির আশঙ্কাও রয়েছে। ফলাফল যাই হোক, এটি বাংলাদেশের স্থায়ী গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।