leadT1ad

মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’: ব্যক্তি থেকে সমষ্টির আত্মপরিচয়ের রূপ

আজ বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের জন্মদিন। তাঁর বহুল পঠিত উপন্যাস 'জীবন আমার বোন'। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও ব্যক্তিজীবনে তাঁর প্রভাব নিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনি ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

স্ট্রিম গ্রাফিক

ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও ব্যক্তিজীবনে তাঁর প্রভাব নিয়ে মাহমুদুল হক রচনা করেন ‘জীবন আমার বোন’ (১৯৭৬) উপন্যাস। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি। ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৬০টি আসন পাওয়ার পরেও তাদের হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসির ফলে আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান পিপল্স পার্টি ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে সৃষ্ট ত্রিমুখী দ্বন্দ্বময় দিনগুলোতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১৫ মার্চ ঢাকা আসেন এবং ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করেন। রাজনীতি-বিক্ষুদ্ধ এ সময়ে খোকা ও তার বোন রঞ্জুর জীবনে ২৫ মার্চ রাতে নেমে আসা বিপর্যয়পূর্ণ পরিণতি হলো ‘জীবন আমার বোন’ আখ্যানের বিষয়বস্তু।

সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জয়লাভ করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বাঙালির আধিপত্য প্রমাণিত হয়, যা ছিল বায়ান্ন পরবর্তী সময়ে বাংলার জনগণের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার নয়া বন্দোবস্ত। ফলে বাংলাভাষী জনগণ এই আত্মপরিচয়ের জন্য যেমন উদ্গ্রীব হয়, তেমনি উর্দুভাষী শাসক ও রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধিতা করে। ফলে বাংলার জনগণের মধ্যে সংকট ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু ‘জীবন আমার বোন’ আখ্যানে এই উন্মত্ততা, রাজনৈতিক সংকট ও উত্তাপ প্রধান চরিত্র জাহেদুল কবির ওরফে খোকাকে স্পর্শ করে না। খোকার এই রাজনীতিবিমুখ সত্তা সম্পর্কে উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এভাবে:

আজ চারদিন পর ঘর থেকে বের হয়েছে সে। হয়তো বহু কিছুই ঘটে গিয়েছে সারাদেশে। রাজনৈতিক সঙ্কট তো আছে তার ওপর চতুর্দিকে হাজার রকমের ঢামাঢোল। জাহাজ বোঝাই সৈন্য চট্টগ্রামের দিকে ছুটে আসছে, বেলুচিস্তানে ঈদের জামাতের ওপর বোমা দাগানো কসাই টিক্কা খান আসছে নতুন লাট-বাহাদুর হয়ে; দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার, ছবি, তবু এসবের কোনো গুরুত্ব খোকার কাছে নেই। রাজনীতির ব্যাপারটাই আগাপাস্তলা একটা জমকালো ছেনালি; একজন শিক্ষিত নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে তার পুরোপুরি ধারণা থাকলেও ভোটার লিস্টে সে তার নাম তোলেনি। রাজনীতি ব্যাপারটাই তার কাছে শিকার ফসকাতে না দেওয়া হুবহু সেই মাদামোয়াজেল ব্লাশের মতো।

মার্চ মাসের বিক্ষুদ্ধ সময়ে খোকা একজন দর্শক। সে সবকিছু অবলোকন করে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও তার স্বচ্ছ ধারণা কিন্তু সে কোনোকিছুর মধ্যে নেই—যেন একজন ‘আউটসাইডার’। এর কারণ কী? কেন সে ভোটের লিস্টেও নাম তোলেনি? বলা যায়, খোকা আসলে ব্যক্তিবিচ্ছিন্ন সত্তা হয়ে চারপাশ অবলোকন করতো।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে তার এখন চাকরির বয়স চলছে। এমন সময়ে তার বন্ধুরা চাকরি সন্ধান যেমন করছে তেমনি দেশের এই রাজনৈতিক সংকট নিয়ে পর্যালোচনা করছে। কিন্তু খোকার এসবে আগ্রহ নেই। তাই সে বলতে পারে,

না, রেক্সে যাওয়া চলবে না। ইদানীং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন, ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র, আইনগত কাঠামো, চীনের দাবি ভুট্টোর খেল-তামাশা, এইসব নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠছে ওখানে।

এসবের চেয়ে নীলাভাবীর সঙ্গ তার কাছে উপভোগ্য মনে হয়। ‘দেশ, দেশের কল্যাণ, দেশের ভবিষ্যৎ, দেশপ্রেম, এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই তার মগজে ঢোকে না।’ তাহলে কি খোকার চেতনায় দেশ নির্মিত হয়নি? এজন্যেই কি সে দেশপ্রেম বিষয়টিকে উপলব্ধি করতে পারে না? নাকি অন্যকিছু? কেন দেশের এমন একটি পরিস্থিতিতে খোকার মধ্যে জাতীয় চেতনা কাজ করে না? জাতীয় চেতনা তো দেশপ্রেমের জন্য উদ্ভূত আবেগ থেকে জন্ম লাভ করে এবং দেশের সংকটময় মুহূর্তে ব্যক্তির মনে তা অধিকতর ক্রিয়াশীল হয়। কিন্তু খোকার ক্ষেত্রে তেমনটি লক্ষ্য করা গেল না।

কারণ হিসেবে বলা যায়, সে দেশপ্রেম আর রাজনীতি ধারণা দুটোকে একত্রিত করেছে এবং রাজনৈতিক সংকট ও দেশের সংকটকে গুলিয়ে ফেলেছে। দেশপ্রেম নিয়ে সে খুব সহজভাবে বলে: ‘পয়ষট্টি সালের যুদ্ধের সময় চোর-ছ্যাঁচড়া গাঁটকাটারাও ফৌত হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসেছিলো, দেশপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল ব্যাটারা; কেউ কারো পকেট কাটে নি, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি বিলকুল বন্ধ ছিলো, সময় গিয়েছে একটা। রাজনৈতিক সঙ্কট কি নতুন কোনো ব্যাপার ...!’

রাজনৈতিক সংকট পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশ জুড়ে বিদ্যমান থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানিদের সংকট ছিল একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যেরও। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানিদের মনে দেশপ্রেমের যে চেতনা জন্ম নেয় তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। কিন্তু খোকার ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের চেতনার রূপটি দৃশ্যমান হয়নি। ১ মার্চে সংসদ অধিবেশন স্থগিতের বিপরীতে চলমান তুমুল আন্দোলনও খোকাকে প্রভাবিত করে না। ঔপন্যাসিকের বর্ণনায় সেই সময়ের পরিস্থিতি:

মোড়ে মোড়ে জটলা, প্রায় সর্বক্ষণ প্রতিটি রাস্তাতেই বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিটি ময়দানেই জনসভা। সর্বত্র একই কানাকানি, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার উদ্দেশ্য কি, নাকি আসলে সবটাই আগাগোড়া একটা ধাপ্পা; আবার সেই বুটজুতো আর রাইফেলের বাঁটের গুঁতো।

খোকা ছাড়া আখ্যানের প্রায় সব চরিত্রই রাজনৈতিক এই বিক্ষুব্ধ সময় সম্পর্কে প্রভাবিত থাকে। এমনকি তার বাসার গৃহকর্মী ময়নার বাবা বলে: ‘লোকে যা বলাবলি করছে তাতে শহরে থাকা চলে না। পারলে কিছুদিনের জন্য আপনারাও একদিকে চলে যান। আল্লা করুক, জয়বাংলা যদি হয়েই যায় তাহলে আর মেয়েটাকে ঝিগিরি করায় কে।’

ময়নার বাবার ‘জয়বাংলা যদি হয়েই যায়’ উক্তিটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এই অর্থে যে ততদিনে জনসাধারণের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরিত রূপ লক্ষ করা যায়। ‘জয় বাংলা’ তাদের কাছে বাংলাভাষী একটি স্বাধীন ভূখণ্ডে জাতীয়তাবাদী স্লোগান হিসেবে চেতনাকে জাগ্রত করেছে। কিন্তু খোকার কাছে এসব কোনো আবেদন তৈরি করেনি। খোকাকে আড্ডায় কয়েকদিন অনুপস্থিত দেখে তার বন্ধু মুরাদ বলে:

আমি তো ভাবলাম নির্ঘাৎ অসুখ-বিসুখ একটা কিছু বাধিয়ে বসে আছিস, তা না হলে এই সময় কোনো পাগলেও ঘরে বসে থাকে বলে আমার মনে হয় না। এই তো সময় চুটিয়ে আড্ডা মারার। গরম বাজার, অফুরন্ত সময়, স্রেফ চা মারো আর গুলতানি।
[খোকা:] ব্যাস্, তাতেই দেশ স্বাধীন?
আলবৎ তাই! স্রেফ চায়ের কাপে চুমুক মেরে আর গুলতানি ঝেড়ে স্বাধীনতা নিয়ে আসবো এবার, দেখে নিস। এবারে শালার স্বাধীনতা রোখে কে?
...এখানে-ওখানে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ উড়তে দেখা যাচ্ছে, এখন পিছনে ফেরার আর কোনো পথ নেই চাঁদ।

মুরাদের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে খোকা তার কাছে জানতে চায়, ‘এইসব হৈহুল্লা দা-কুড়াল-লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় পাঁয়তারা, এখানে-ওখানে লুটতরাজ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এসব ভালো লাগছে তোর?’ মুরাদ প্রতি-উত্তরে বলে, ‘এটা ঠিক ব্যক্তিগত ভালো লাগালাগির ব্যাপার নয়, তুই ছোট করে দেখছিস বলে তোর কাছে অমন মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা সমগ্র দেশকে নিয়ে, একটা গোটা জাতিকে নিয়ে।’

খোকা ও মুরাদের কথোপকথনে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। মুরাদের মধ্যে দেশকেন্দ্রিক ভাবনায় পুরো জাতি এসে যুক্ত হয়েছে। জাতি হিসেবে পরিচিত হওয়ার জন্য জনগণের মনে সার্বভৌম ভাবনার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের যে-আকাঙ্খা থাকতে হয় তা ‘জীবন আমার বোন’ উপন্যাসের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে মুরাদ খোকাকে বলে: ‘সবাই কানাঘুষো করছে কালকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে।’

‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ বলতে মূলত পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে এমন ইঙ্গিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের জনসভার পূর্বে জনগণের মনে এই ধারণাটি বদ্ধমূল হয়েছিল যে, সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে। এই স্বাধীনতার অর্থ নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র—যার ভিত্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সাতচল্লিশে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে পূর্ব বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনমান সববিছুই পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়া সত্তে¡ ও ধর্মের অভিন্নতার কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। আর এবার ধর্মকেন্দ্রিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতার আকাঙ্খা সৃষ্টি হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে এবং সেক্ষেত্রে জাতীয় চেতনা উজ্জীবিত হয়েছে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে।

মাহমুদুল হক। সংগৃহীত ছবি
মাহমুদুল হক। সংগৃহীত ছবি

এতে জাতীয়তাবাদের ধর্মীয় উপাদান থেকে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বের হয়ে ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র অর্থাৎ নতুন আত্মপরিচয় নির্মাণের প্রকল্প লক্ষ করা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে উপন্যাসে দেখা যায়, রাস্তায়, রাস্তায় মিছিল আর স্লোগান থেকে রক্ত দেয়ার আহ্বান। আরও শোনা যায়: ‘সব কথার শেষ কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, এইসব কানে আসে। একটা বিক্ষুব্ধ মিছিল দারুণ চিৎকারে দিগ্বিদিক তোলপাড় করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দেবো দেবো দেবো দেবো রক্ত রক্ত রক্ত দেবো, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরাও প্রস্তুত; দ্রত চেহারা বদলে যাচ্ছে স্লোগানের।’

মিছিল ও স্লোগানে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা থেকে। জনগণের এই মনোভাব সম্পর্কে রাজীব বলে, ‘এখন মানুষজনের আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি, তারা জেনে গেছে ইচ্ছে করলেই, ঐক্যবদ্ধ হলেই, তারা দেশের শাসনযন্ত্রকে একেবারে বিকল করে দিতে পারে...।’

কিন্তু খোকা এসবের ভেতর দিয়ে যায় না। তার চেতনায় দেশ নেই, রাষ্ট্রও নেই। দেশের মানুষের মুক্তি ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে রাজীবকে সে বলে:

মুক্তিটুক্তির কথা যে বলছেন, এ সম্পর্কে তাদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা আছে, কোনো প্রোগ্রাম আছে? অর্থনৈতিক মুক্তি ছেলের হাতের মোয়া নয়। লেখাকথা আর কি, বোবা-ব্যাঁকা-হাবা-কালা বেঁড়েদের ঐক্য আবার ঐক্য!

খোকা জনসাধারণের এই ঐক্যবদ্ধতার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেনি ফলে ঐক্যবদ্ধ জনতার শক্তি সম্পর্কে সে সংশয় প্রকাশ করে। অথচ জনগণের মধ্যে সংগ্রামের পথে যুক্ত হওয়ার আহ্বান লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে একজন বক্তৃতায় বলে:

ভাইসব, সময় নষ্ট করবেন না, আপনারা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েন, আজ আপনাদের সম্মুখে কেবল একটি পথই খোলা, সশস্ত্র সংগ্রামের পথ। কালবিলম্ব না করে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে আপনাদের, আঘাত হানতে হবে শত্রুকে। এতোদিন যে বিপ্লবকে মনে হয়েছিলো পর্বতের মতো ভারি, আজ তা পালকের চেয়েও হালকা, মুক্তির একমাত্র পথই হলো সশস্ত্র বিপ্লব, এই পথই বেছে নিতে হবে আপনাদের।

বলা যায়, খোকার বিচ্ছিন্ন সত্তা আসলে সময়কে বুঝতে পারেনি। প্রথমত, পরিচিত সবাই যখন তাকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে যেতে বলেছে, সে তাতে সায় দেয়নি; দ্বিতীয়ত, চারপাশে সবাই যখন স্বাধীনতার কথা বলেছে, তখনও সে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। ২৫ মার্চ রাতে সে নীলাভাবীর বাসায় আটকা পড়ে এবং ‘আর্মি ক্র্যাকডাউনের’ দুই রাত একদিন পর তার ধানমন্ডির বাসায় যায়। রঞ্জু সে রাতে বাকশক্তি হারায় এবং অসুস্থ রঞ্জুকে নিয়ে সে বুড়িগঙ্গার ওপারে আশ্রয় নেয়। ভোর হওয়ার পূর্বেই পলায়নরত ভীতসন্ত্রস্ত অসংখ্য নরনারীর উপর পাকিস্তানি সৈন্যদল মেশিনগান ও মর্টারসজ্জিত হয়ে হামলা করে। এ সময় অচৈতন্যপ্রায় রঞ্জু একটি গাছতলায় শতরঞ্চিতে শোয়া ছিল। তাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে অসংখ্য নরনারী ছুটে পালাতে থাকে। রঞ্জুর পরিণতি প্রসঙ্গে খোকা ভাবে:

একলক্ষ চল্লিশ হাজার পায়ের তলায় পড়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিলো কি নিরঞ্জন রঞ্জু?দেশ তাহলে একটা পুকুর। অঞ্জু মঞ্জুর মতো এর নিস্তরঙ্গ নিথর তলদেশে চিরকালের জন্যে হারিয়ে গিয়েছে রঞ্জু।

উপন্যাসজুড়ে খোকা দেশের সন্ধান করেছে ঠিকই কিন্তু দেশ সম্পর্কে সঠিক ধারণা সে নির্ণয় করতে পারেনি। দেশের স্বাধীনতার জন্য যখন রক্ত দেওয়া, জীবন দেওয়ার মতো বিষয়গুলো স্লোগানে, মিছিলে, বক্তৃতায় উঠে এসেছে তখনও সে দেশ খুঁজে পায়নি। বলা যায়, দেশ মূলত মানুষের চৈতন্যের সঙ্গে মানবিক সম্পর্কগুলো জড়িয়ে থাকে, আর এজন্য দেশকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়। রঞ্জুর মৃত্যুর পর খোকার মধ্যে এই উপলব্ধি হয়েছিল।

সে শুধু চেয়েছিল রঞ্জু বেঁচে থাকুক। সে জানতো না এটা তার ভুল। একা বেঁচে থাকার অধিকার তার বিষণ্ণ দেশ কিছুতেই দিতে পারে না রঞ্জুকে, খোকা পরে বুঝেছিল।

দেশ হলো জনগণের সামষ্টিক চেতনার অংশ যার ফলে একক ব্যক্তি রঞ্জুকে ঘিরে খোকা সে অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। দেশের সংকটে রঞ্জুর মৃত্যু অনেকের সঙ্গে তাকে সমষ্টিতে রূপান্তরিত করেছে। জীবিত খোকা যেখানে বিচ্ছিন্ন মৃত রঞ্জু সেখানে সামষ্টিক। এই সামষ্টিকতার ভেতরেই খোকা তার মৃত বোন রঞ্জুকে ঘিরে দেশকেন্দ্রিক আত্মপরিচয়ের সন্ধান পেয়েছে।

লেখক:
কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Ad 300x250

সম্পর্কিত