দেশে প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে চারজনের রক্তেই উদ্বেগজনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি মিলেছে নতুন জরিপে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফ প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারের ওপর এ জরিপ করেছে।
রোববার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এক সেমিনারে ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে-২০২৫ (এমআইসিএস বা মিক্স)’ শীর্ষক ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
জরিপে শিশুদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সুরক্ষা ও বিকাশে বিদ্যমান অগ্রগতি এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে। জরিপে বৈশ্বিক ১৭২ মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ২৭টি এসডিজি সূচক উঠে এসেছে। ইউনিসেফ বলছে, সিসা দূষণ শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে হুমকি সৃষ্টি করে এবং এর প্রভাব সব আর্থ-সামাজিক শ্রেণির ওপর পড়ছে।
জরিপে বলা হয়, ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ৩৮ শতাংশের (অর্থ্যাৎ প্রতি ১০ জনে চার শিশু) এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রায় আট শতাংশের রক্তে সিসা ‘নিরাপদ সীমার চেয়ে বেশি’। দেশে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ঢাকায়, ৬৫ শতাংশ। আক্রান্তদের অর্ধেকের বেশি ধনী পরিবারের। আর ৩০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুর রক্তে নিরাপদ সীমার চেয়ে বেশি সিসা রয়েছে।
জরিপের প্রাথমিক ফলাফল থেকে দেশের সব বিভাগ, জেলা এবং তিনটি সিটি করপোরেশন এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে, যা নীতিনির্ধারকদের বৈষম্যের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে মনে জানিয়েছেন আয়োজকেরা।
সেমিনারে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার, ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স প্রমুখ।
শিশুশ্রমের হার বেড়ে ৯.২ শতাংশ
প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে শিশুশ্রমের হার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে শিশুশ্রমের হার এখন ৯.২ শতাংশ; যা ২০১৯ সালের একই জরিপে ছিল ৬.৮। অর্থাৎ শিশুশ্রমের হার ছয় বছরের মাথায় ২.৪ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে, যার বেশি উত্তরাঞ্চলে।
রাজশাহী বিভাগে শিশুশ্রমের হার ১২.৪ শতাংশ এবং রংপুরে এ হার ১১.৮। ফলে দেশে আরও ১২ লাখ শিশু ‘ঝুঁকিতে পড়েছে’ বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশু সুরক্ষায় প্রতি এক ডলার বিনিয়োগ করলে ৯ গুণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক লাভ পাওয়া যায়।
কমেছে বাল্যবিয়ের হার
শিশু মৃত্যুর হার এবং বাল্যবিয়ের মতো সূচকে কিছুটা ইতিবাচক সাফল্যের দেখা মিলেছে জরিপে। বাল্যবিয়ের হার ২০১৯ সালে যেখানে ছিল ৫১.৪ শতাংশ। বর্তমানে তা কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এখনো প্ৰায় অর্ধেক মেয়ের ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়।
এছাড়া নবজাতকের ক্ষেত্রে প্রতি হাজারে মারা যায় ২২ জন, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর (৩৩ শিশু) ৬৭ শতাংশ। পূর্বের জরিপে এটি ছিল ২৪।
চলতি বছরের শুরুতে জরিপের সময়ে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে সিলেটে (২৯) এবং ঢাকায় (২৫)। সবচেয়ে কম মিলেছে খুলনা (১৫) ও ময়মনসিংহ (১৮) বিভাগে।
ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ’বাল্যবিয়ে ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস প্রমাণ করে অগ্রগতি সম্ভব। কিন্তু সিসা দূষণ এবং শিশুশ্রমের মতো সংকট লাখ লাখ শিশুকে তাদের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করছে।’ তিনি বলেন, ‘যখন প্রতিটি শিশুর বেঁচে থাকা, বিকশিত হওয়া ও শেখার অধিকারকে সম্মান করা হবে, তখন এটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশের মাধ্যমে পরিমাপ করা যাবে।’
জরিপে শিশুর শিক্ষা বিষয়ে বলা হয়, শিক্ষা ও শেখার দক্ষতায় উপস্থিতি ভালো। কিন্তু মৌলিক দক্ষতা দুর্বল। প্রাথমিক স্তরে উপস্থিতি ৮৪ শতাংশ এবং নিম্ন মাধ্যমিকে প্রায় ৬০ শতাংশ হলেও উচ্চ মাধ্যমিকে তা প্রায় ৫০ শতাংশে আটকে আছে।
জরিপের এসব ফলাফল ধরে সরকারের নীতি গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ‘এসব তথ্যকে সুনির্দিষ্ট কাজে পরিণত করতে এবং কোনো শিশু যাতে বাদ না পড়ে সেই লক্ষ্যে পরিবর্তন আনতে সরকারকে সহায়তা করতে ইউনিসেফ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বেড়েছে সিজার
প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগের জরিপে যেখানে সিজারের (সিজারিয়ান সেকশন বা সি-সেকশন) হার ছিল ৯ শতাংশের মতো। নতুন জরিপে এটি বেড়ে ৫২ শতাংশ হয়েছে। এখানে দেখা যায়, দরিদ্রের মধ্যে এ হার ৩৪ এবং ধনীদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ।
ইউনিসেফের ভাষ্য, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে ৭৫ শতাংশ প্রসবের ক্ষেত্রে সি-সেকশনের হার বৃদ্ধি ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক চাপ’ উভয় বাড়িয়ে তুলছে।
৮০ শতাংশের বেশি পানিতে কলেরার জীবাণু
প্রতিবেদনে খাবার পানি, পয়ঃব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে উন্নতির তথ্য উঠে এসেছে। তবে পানির গুণগত মান এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। উন্নত পানির উৎস ব্যবহারের হার প্রায় ৯৯ শতাংশ এবং উন্নত স্যানিটেশন কাভারেজ ৯২ শতাংশ। তবে পরিবারের ৮০ শতাংশের বেশি পানিতেই কলেরার (কোলাই) জীবাণু পাওয়া গেছে, যা পানিবাহিত রোগের গুরুতর ঝুঁকি নির্দেশ করে।
উৎস পর্যায়ে পানি দূষণ প্রায় ৪৭ শতাংশ। প্রায় ৬৯ শতাংশ পরিবারের হাত ধোয়ার সুবিধা থাকলেও তা পূর্বের তুলনায় কমেছে। নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিশেষত পল্লি এলাকায় এখনো দুর্বল।
ফলাফল উপস্থাপনার পর সেমিনারে বিবিএসের উপপরিচালক আলমগীর হোসেনের সঞ্চালনায় উন্মুক্ত আলোচনা হয়। এতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, একাডেমিয়া, উন্নয়ন সংস্থা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি অংশ নেন। তারা পুষ্টি, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, পানির নিরাপত্তা ও ভারী ধাতুর ঝুঁকি মোকাবেলায় জরুরি আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
পরে প্যানেল আলোচনা পরিচালনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। আলোচক ছিলেন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জাঁ পেসমে, ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ড. খায়রুল ইসলাম, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সাবেক সচিব ডা. সরওয়ার বারী, আইসিডিডিআর-বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মাহীন সুলতান প্রমুখ।
প্যানেল আলোচকেরা শিশুর অপুষ্টি বৃদ্ধি, পানির নিরাপত্তাহীনতা এবং সিসা দূষণকে জাতীয় উন্নয়নের জন্য ’রেড ফ্ল্যাগ’ উল্লেখ করেন এবং তাৎক্ষণিক ও সমন্বিত নীতি হস্তক্ষেপের গুরুত্ব আরোপ করেন।