leadT1ad

শান্তির একটাই পথ: ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে হবে ইসরায়েলের

রাজা শেহাদেহ
রাজা শেহাদেহ
২০২৩ সালের নভেম্বরে পশ্চিম তীরের ওয়াদি তিরানে ইহুদী বসতি স্থাপনকারীদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি গাড়ি দেখছে এক ফিলিস্তিনি বালক। ছবি: সংগৃহীত

আমি সবসময়ই একজন আশাবাদী মানুষ। তাই ভেবেছিলাম, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলা ও গাজার অবরোধ ভাঙার ঘটনাটি হয়তো ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন নীতির পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করবে। আমি আরও আশা করেছিলাম, ইসরায়েলি নেতারা বুঝবেন—কাঁটাতারের বেড়া বা দেয়াল তুলে নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব নয়।

কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টোটা। ওই হামলার পর শুরু হলো ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের যুদ্ধ, যা দুই বছর পেরিয়ে তৃতীয় বছরে পড়েছে। এতে ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার প্রায় ৯২ শতাংশ আবাসিক ভবন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।

শুরুর দিকে এসব দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আরও ব্যথিত হয়েছিলাম গাজার মানুষকে অমানুষ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা দেখে। তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে বলেছিলেন, ‘আমরা মানব পশুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছি এবং সে অনুযায়ী কাজ করছি।’

তবে এই মনোভাব নতুন নয়। বহু বছর ধরে ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে একই ভাষা ও কৌশল ব্যবহার করছে। ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে সেনাপ্রধান রাফায়েল আইতান পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের তুলনা করেছিলেন ‘বোতলবন্দী নেশাগ্রস্ত তেলাপোকা’-র সঙ্গে।

ইসরায়েলি দখলদারিত্বের সময় ঘরবাড়ি ভাঙা ছিল এক ধরনের ভয় দেখানোর উপায়। সেনা অভিযানে নিরীহ মানুষকে গুলি করাও ছিল নিয়মিত ঘটনা। দেয়াল ও চেকপোস্ট দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে, ফলে পারস্পরিক ঘৃণা আরও বেড়েছে। গাজায় যে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলছে, তারও ঐতিহাসিক নজির আছে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের সময় ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া হয়েছিলেন এবং ইসরায়েলি সেনারা বহু হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।

তবে ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী যা করেছে এমন বর্বরতা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। পশ্চিম তীর থেকে আমরা প্রথমবার দেখছি—কীভাবে একটি রাষ্ট্র প্রকাশ্যে গণহত্যা চালাচ্ছে, আর তার কথিত সভ্য নাগরিকেরা তা সহ্য করছে। গাজায় যা ঘটছে, আমরা আতঙ্ক নিয়ে তা দেখছি এবং ভাবছি—পরবর্তী টার্গেট কি আমরা?

শত শত চেকপোস্ট ও গেটের মধ্যে আটকা রামাল্লায় আমরা ঘনঘন ইসরায়েলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের হামলার শিকার হচ্ছি। অথচ ১৯৯৫ সালের অসলো চুক্তি অনুযায়ী, এই শহর সম্পূর্ণভাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা ছিল।

নিজেদের জমি ক্রমশ দখল হওয়ার দৃশ্য দেখাটা আমাদের জন্য অনেক কষ্টদায়ক। রামাল্লার আশপাশের পাহাড়গুলো আরও সামরিকায়িত হচ্ছে। উঁচু জায়গায় ইহুদী বসতি স্থাপন করা হচ্ছে এবং মুখোশধারী বসতি স্থাপনকারীরা মেশিনগান হাতে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা হাঁটতে বের হয়, তাদের ওপর আক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে। তাই এই এলাকাগুলোতে যাওয়ার সময় বিপদের অনুভূতি আরও অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

২০২৫ সালের আগস্টে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডের প্রধান আভি ব্লুথ রামাল্লার আল-মুখাইর গ্রামে প্রায় ৩ হাজার জলপাই গাছ কেটে ফেলতে নির্দেশ দেন। এই গাছগুলো শরতে ফলনের অপেক্ষায় ছিল। কয়েক দশক ধরেই ইসরায়েলি সেনারা জলপাই গাছ উপড়ে ফেলছে। এগুলো ফিলিস্তিনিদের জন্য সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উভয়ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।

চলতি বছরের ২৪ আগস্ট অধিকৃত পশ্চিম তীরের আল-মুগাইয়ের গ্রামে ইসরায়েলি সৈন্যদের উপড়ে ফেলা জলপাই গাছগুলো পরিদর্শন করছেন এক ফিলিস্তিনি। ছবি: সংগৃহীত
চলতি বছরের ২৪ আগস্ট অধিকৃত পশ্চিম তীরের আল-মুগাইয়ের গ্রামে ইসরায়েলি সৈন্যদের উপড়ে ফেলা জলপাই গাছগুলো পরিদর্শন করছেন এক ফিলিস্তিনি। ছবি: সংগৃহীত

গাছ কাটার পেছনে যুক্তি দেওয়া হয়—এগুলো ইসরায়েলি সড়কের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই সড়ক গ্রামটির মধ্য দিয়েই গেছে। এই সপ্তাহে জলপাই কাটার মৌসুম শুরু হতেই ইহুদী বসতি স্থাপনকারীদের হামলা শুরু হয়েছে। গত শুক্রবার সালফিত শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ফারখা গ্রামে এমন ঘটনা ঘটেছে।

ইসরায়েলি সেনারা আল-মুখাইর গ্রামে অবরোধ চাপিয়ে বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে। ব্লুথ দাবি করেন, ‘প্রথম লক্ষ্য হলো আক্রমণকারীদের খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়ত, এখানে ব্যবস্থা নিয়ে সবাইকে ভয় দেখানো—শুধু এই গ্রাম নয়, সব গ্রাম; যারাই ইহুদী বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে চায়।’

পূর্বে এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের সময় আমরা আশা করতাম আল-হকের মাধ্যমে কিছু প্রতিকার পাওয়া যাবে। ৪৫ বছর আগে আমি এই মানবাধিকার সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করি। কিন্তু এখন এটি নিষিদ্ধ ও সেবা দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে এটি নিষিদ্ধ হবে এবং আমাদের সম্প্রদায়কে পরিষেবা প্রদানে বাধা দেওয়া হবে।

আমরা ফিলিস্তিনিরা সর্বদা জানতাম আমাদের অধিকার রক্ষার প্রচেষ্টায় অপ্রত্যাশিত দমন হবে। তবে এই বেপরোয়া পদক্ষেপ এবং এর প্রভাব বিশেষত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের সমর্থকদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করা উচিত।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ‘গাজা শান্তি পরিকল্পনা’র পর হামাস সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তির ঘোষণা দেয় এবং আলোচনায় বসার প্রস্তুতি জানায়। ট্রাম্পও ইসরায়েলকে গাজায় বোমা হামলা বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু ইসরায়েলে এখনো হামলা বন্ধ করেনি। যদি যুদ্ধ শেষ হয় এবং অবরোধ তুলে নেওয়া হয়, ফিলিস্তিনিরা নিজেরাই দেশ পুনর্গঠন করতে পারবে।

আমি কখনো কল্পনা করিনি যে মানবাধিকার রক্ষায় একসময়ের চ্যাম্পিয়ন দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এটি ধ্বংস করবে। আমার দীর্ঘদিনের আশা ছিল, এই সংগঠন ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতকে সহায়তা করাই এখন ইসরায়েলের কাছে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।

২০২৫ সালের আগস্টে ইসরায়েলি সরকার বিতর্কিত ই-ওয়ান বসতি সম্প্রসারণ প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এই প্রকল্প ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে খণ্ডিত করবে এবং দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের অবৈধ বসতিগুলোকে ইহুদীদের মা’আলে আদুমিম ব্লকের সঙ্গে যুক্ত করবে। এর ফলে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা কার্যত শেষ হয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া মিশ্র। ইউরোপের সাধারণ মানুষ বুঝতে শুরু করেছে—ইসরায়েল যদি বারবার আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেও পার পেয়ে যায়, তবে তা বিশ্বব্যবস্থার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। এ কারণেই বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদী গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের ফিলিস্তিন-বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। সম্প্রতি ৪৪টি দেশের শত শত অধিকার কর্মী গাজা অবরোধ ভাঙতে ও মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’য় যাত্রা করে, কিন্তু ইসরায়েল তাদের আটক করে।

কিন্তু সাধারণ নাগরিকরা সরব হলেও সরকারগুলো নিষ্ক্রিয়। সরকারগুলো সীমিত সমালোচনা করলেও ইসরায়েলের যুদ্ধের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে।

তথাপি গাজার যুদ্ধ ইসরায়েল সম্পর্কে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। এখন অনেকেই উপলব্ধি করছেন, ১৯৪৮ সালের নাকবার সময় ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করেই ইসরায়েলের জন্ম হয়। গত ৭৭ বছরে প্রচারিত বহু ভুল ধারণা এখন প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর এখন এমন অনেক জায়গায় শোনা যাচ্ছে, যা আগে তাদের জন্য বন্ধ ছিল।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ‘গাজা শান্তি পরিকল্পনা’র পর হামাস সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তির ঘোষণা দেয় এবং আলোচনায় বসার প্রস্তুতি জানায়। ট্রাম্পও ইসরায়েলকে গাজায় বোমা হামলা বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু ইসরায়েলে এখনো হামলা বন্ধ করেনি। যদি যুদ্ধ শেষ হয় এবং অবরোধ তুলে নেওয়া হয়, ফিলিস্তিনিরা নিজেরাই দেশ পুনর্গঠন করতে পারবে। তাদের কাছে দক্ষ প্রকৌশলী, শ্রমিক ও প্রযুক্তিবিদ রয়েছে, যারা অবরোধের মধ্যেও কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পেলে তারা বাইরের ঠিকাদারের চেয়েও দ্রুত পুনর্গঠন সম্পন্ন করতে পারবে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যুদ্ধকৌশলে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি সক্ষম। কিন্তু দেশটিকে এখন বেছে নিতে হবে— অবিরাম যুদ্ধ নাকি স্থায়ী শান্তি। আর শান্তি কেবল তখনই সম্ভব, যখন তারা ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করবে। অন্যথায়, এই যুদ্ধের শেষে ইসরায়েল হয়তো গাজাকে ধ্বংস করবে, কিন্তু তার সঙ্গে নিজেকেও ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে।

লেখক: ফিলিস্তিনি আইনজীবী এবং মানবাধিকার সংগঠন আল-হকের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ‘হোয়াট ডাজ ইসরায়েল ফিয়ার ফ্রম প্যালেস্টাইন?’ বইয়ের লেখক।

(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ইংরেজি লেখা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাহবুবুল আলম তারেক)

Ad 300x250

সম্পর্কিত