leadT1ad

নন পার্টিজান মুভমেন্ট ও অ্যাটাক অন টাইটান্স: জেন-জির সহিংসতা নাকি মুক্তি

জেন-জি বা ‘জেনারেশন জুমার্স’। অধুনা দুনিয়ায় বহুল আলোচিত একটি প্রজন্ম-পরিভাষা। জন্ম থেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসা এরা প্রথম প্রজন্ম। উন্নত দেশ হোক বা উন্নয়নশীল সমাজ, জেন-জিরা নানা উপায়ে নাড়িয়ে দিচ্ছে প্রচলিত শাসন, সংস্কৃতি ও চিন্তার কাঠামো। তাঁদের ভাষা, অভিব্যক্তি আর প্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা। জেন-জি পরিচয়ে আসলে কারা অন্তর্ভুক্ত? শুধু তুলনামূলক সুবিধাপ্রাপ্ত তরুণেরা, নাকি এর ভেতরে আছেন সুবিধাবঞ্চিতরাও? এ প্রজন্ম সত্যিই কি শুধু প্রশংসাযোগ্য কাজ করছে, নাকি তাদের আছে সীমাবদ্ধতাও? এ আয়োজনে রয়েছে এসবের অনুসন্ধান।

নন পার্টিজান মুভমেন্ট ও অ্যাটাক অন টাইটান্স: জেন-জির সহিংসতা নাকি মুক্তি। স্ট্রিম গ্রাফিক

শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও নেপালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠিত আন্দোলনে তরুণদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে একদম নতুন কিন্তু ‘অদ্ভুত সাংস্কৃতিক’ এক প্রবণতা। আন্দোলনগুলোতে পপ-কালচার, এনিমে ও কমিক চরিত্র হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের প্রতীক। চল্লিশোর্ধ নাগরিকদের কাছে তা একদমই নতুন।
জেন-জি প্রজন্মের মনোজগতের সঙ্গে জিমি ইসামায়া’র এ্যাটাক অন টাইটান কিংবা ইচিরো ওদার ওয়ান পিস-এর মতো সিরিজগুলো প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠেছে। এই চরিত্রগুলো কীভাবে জেন-জি’র মুক্তির প্রতিক হয়ে ওঠে?

বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন, ইন্দোনেশিয়ার অগাস্ট বিক্ষোভ কিংবা নেপালে সেপ্টেম্বরের ‘জেন-জি প্রটেস্ট’-এ ইগার ইরেনের ছবি, সার্ভে কর্পসের প্রতীক এবং ফ্রিডম প্যানেল ব্যবহার হয়েছে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। এটি শুধুমাত্র একটি ভিজ্যুয়াল স্টাইল ছিলো না। ছিলো একটি নৈতিক অবস্থান—যেখানে তরুণেরা দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে নিজেদের অবস্থান বোঝাতে চায়। দলীয় প্রতীকের ক্লাসিক্যাল দাসত্বের বাইরে এসে নতুন এক প্যারাডাইম নির্মানে তারা বিশ্বাস করে। তারা দেখিয়েছে প্রথাগত সিস্টেম ভাঙতে হলে সাহসী, এমনকি সহিংস পদক্ষেপ দরকার। সেই সঙ্গে দরকার মেসায়াহ নামক এক উদ্ধারকর্তা, যে কল্পিত জগত থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবে রূপ নিয়ে প্রত্যেক তরুণের মধ্যে প্রবেশ করে তৈরি করে ইন্ডিভিজ্যুয়াল কর্তাসত্ত্বা তথা রেভ্যুল্যুশনারি। এরকম অসংখ্য মেসায়াহ তথা ইগার ইরেনকে কলম্বো, ঢাকা, জাকার্তা কিংবা কাঠমুন্ডুর রাজপথে দেখা যাচ্ছে বিগত আন্দোলনগুলোতে।

নিজ জাতিকে বাঁচাতে কিংবা আপন আইডেন্টিটি রক্ষার এই সংগ্রাম ইরেন ইগারের মধ্যে ‘ধ্বংসাত্বক’ তথা সহিংস প্রবণতা তৈরি করে। এই প্রবণতা আজাদির উদ্দেশ্য নির্মিত। ইরেনের ভাবনা ফরাসী তাত্ত্বিক ফ্রান্স ফানোর বয়ানের সাথে তাঁকে যুক্ত করে দেয়। তিনি দ্য রেচেড অফ দি আর্থ– গ্রন্থে বলেন, উপনিবেশিত মানুষকে মুক্ত করতে হলে সহিংসতা অপরিহার্য।

আজাদি না ধ্বংস?

ইরেন ইগারের ফ্রিডম বা আজাদির ধারণা কি ধ্বংসাত্মক? এ্যাটাক অন টাইটান-এর মূলচরিত্র ইরেন ইগার। সে এলদিয়ান জাতিসত্তার। ছোটবেলায় টাইটানদের হাতে তার মা খুন হওয়ার পর ইরেনের ভেতরে জন্ম নেয় প্রতিশোধের তীব্র আগুন। কিন্তু সিরিজের অগ্রগতিতে দেখা যায়, টাইটানরা আসলে দানব নয়। তারা একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। ইরেন বুঝতে পারে তার জাতি তথা এলদিয়ানরা দীর্ঘদিন ধরে মারলেয়ান জাতিগোষ্ঠী দ্বারা নিপীড়িত।

এ্যাটাক অন টাইটান সিরিজের কেন্দ্রে রয়েছে একটি জটিল জাতিগত ও ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের শুরু টাইটান শক্তি অর্জনের মাধ্যম দিয়ে। এর সাথে যুক্ত ইমির ফ্রিটজ নামের একজন নারী। এই নারী প্রায় ১৮০০ বছর আগে টাইটান শক্তি অর্জন করেন। তার মৃত্যুর পর তার তিন কন্যা তার দেহকে খেয়ে সেই শক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জন করে। এই তিন কন্যার মাধ্যমে গড়ে ওঠে এলদিয়ান জাতি। এই জাতি উত্তরাধিকারসূত্রে টাইটানে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। এরাই ‘সাবজেক্ট অফ ইমির’ নামে পরিচিত। এলদিয়ানেরা টাইটান শক্তি ব্যবহার করে একসময় পুরো বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করে গড়ে তোলে এলদিয়ান এম্পায়ার। এই সময় তারা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে, বিশেষ করে মারলেয়ানদের নিপীড়ন করে।

এ্যাটাক অন টাইটান–এর পোস্টার। ছবি: রটেন টমেটো
এ্যাটাক অন টাইটান–এর পোস্টার। ছবি: রটেন টমেটো

পরবর্তীতে মারলেয়ানরা ক্ষমতায় এসে এলদিয়ানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ও প্রতিরোধমূলক শাসন শুরু করে। তারা এলদিয়ানদের ‘শয়তানের বাচ্চা’ বলে অভিহিত করে এবং টাইটান শক্তিকে নিজেদের সামরিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। কিছু এলদিয়ানকে নির্দিষ্ট স্থানে বন্দি করে রাখা হয়, তাদের মধ্যে থেকে বিশেষভাবে নির্বাচিতদের টাইটান সৈন্য হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কেননা টাইটান শক্তি অর্জন করার ক্ষমতা শুধু এলদিয়ানদের। এই ক্ষমতা মারলেয়ানদের নেই। এই হিপনোটাইজড টাইটান সৈন্যরাই ছোটবেলায় ইরেনের মাকে খুন করে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে ইরেনের মাকে খুন করা টাইটানরা মারলেয়ান জাতিসত্তার অংশ কিন্তু আসলে তা নয়। বরং এই খুনি টাইটানেরা হলো বন্দী এলদিয়ান, যারা উত্তরাধিকার সূত্রে টাইটান হওয়ার ক্ষমতা রাখে।

এই দ্বন্দ্ব শুধু ক্ষমতার নয় বরং ইতিহাস, ভয় এবং জাতিগত পরিচয়ের। ইমির-এর শক্তি এলদিয়ানদের আশীর্বাদ এবং অভিশাপ দুটোই। মারলেয়ানদের শাসন সেই অভিশাপকে আরও গভীর করে তোলে। সিরিজটি এই দ্বন্দ্বের মাধ্যমে প্রশ্ন তোলে—ক্ষমতা কি জন্মগত, নাকি রাজনৈতিক? আর মুক্তি কি অতীতের দায় মুছে ফেলতে পারে? কিন্তু ইরেন অতীত নিয়ে পড়ে থাকেনা। সে বর্তমানের সন্তান, মুহূর্তের সন্তান এবং তার জাতিগোষ্ঠীর উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধ স্বরের প্রতীক সে। এই উপলব্ধি তাকে ধীরে ধীরে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। সে বিশ্বাস করে, ‘শত্রুদের ধ্বংস না করলে, এলদিয়ানরা কখনোই মুক্ত হবে না’। তার ‘র‍্যাম্বলিং’ পরিকল্পনা—পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকে ধ্বংস করতে চায়—যা একধরনের মুক্তির চূড়ান্ত রূপ, যদিও আপাত তা নৈতিকভাবে বিতর্কিত বলে মনে হয়।

১৯১৭ সালে সোভিয়েত বিপ্লবের সময়ে ইউক্রেনের কৃষকেরা লেনিনকে দেখেছিলেন যিশুখ্রিস্টের পুনরাবির্ভাবের মতো করে। তারা চিন্তা করতেন লেনিন তাদের উদ্ধার করতে আসবেন, সাদা রঙের ডানায় ভর করে, পবিত্র সাদা সফেদ এক পাখির মতো তিনি তাদের মাঝে এসে নামবেন, উদ্ধার করবেন। ইউক্রেনীয় জনগণের কাছে তিনি ছিলেন মেসায়াহ। মেসায়াকে ব্যক্তি হিসেবে দেখার প্রবণতা সেমেটিক ঐতিহ্যে বহু পুরোনো।

বিতর্কিত ও জটিল অংশ

‘র‍্যাম্বলিং’ পরিকল্পনা এ্যাটাক অন টাইটানের সবচেয়ে বিতর্কিত ও দার্শনিকভাবে জটিল একটি অংশ। গণহত্যামূলক এই পরিকল্পনায়, ইরেন ‘ওয়াল টাইটান’দের ব্যবহার করে পৃথিবীর অধিকাংশ জনসংখ্যাকে ধ্বংস করতে চায়, যাতে এলদিয়ান জাতি ভবিষ্যতে নিরাপদ থাকে। ইরেনের যুক্তি হলো, ‘আমরা যদি ধ্বংস না করি, তবে আমাদের ধ্বংস করা হবে’।

নিজ জাতিকে বাঁচাতে কিংবা আপন আইডেন্টিটি রক্ষার এই সংগ্রাম ইরেন ইগারের মধ্যে ‘ধ্বংসাত্বক’ তথা সহিংস প্রবণতা তৈরি করে। এই প্রবণতা আজাদির উদ্দেশ্য নির্মিত। ইরেনের ভাবনা ফরাসী তাত্ত্বিক ফ্রান্স ফানোর বয়ানের সাথে তাঁকে যুক্ত করে দেয়। তিনি দ্য রেচেড অফ দি আর্থ– গ্রন্থে বলেন, উপনিবেশিত মানুষকে মুক্ত করতে হলে সহিংসতা অপরিহার্য। তাঁর মতে, সহিংসতা শুধু প্রতিরোধ নয় বরং এটি একটি পুনর্গঠনমূলক শক্তি, যা মানুষের আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার করে। তিনি সেই সব মানুষের কথা বলেন যারা ‘বঞ্চিত’, মার্ক্সের ভাষায় প্রলেতারিয়েত। এ সব বঞ্চিত মানুষদেরকে তিনি মার্ক্সের প্রোলেতারিয়েত ধারণার সাথে ‘লাঞ্ছিত’ বলেও মনে করেন। ফানো এ জনগোষ্ঠীকে আজাদির জন্য সহিংস হতে আহবান করেন। ইরেন হলো ‘বঞ্চিত’, ‘লাঞ্ছিত’ জনগণের মুক্তির প্রতীক। এ কারণে সে বিশ্বাস করে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে মুক্তি সম্ভব নয়। তার সহিংসতা একধরনের পুনর্গঠনমূলক ধ্বংস—যেখানে সে নিজেকে দানব বানিয়ে নিজের জাতিকে মুক্ত করতে চায়। ফানোর মতে, সহিংসতা ‘অপ্রেসড’ মানুষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ। ইরেনের ‘রাম্বলিং’ হলো সেই অপ্রেসড মানুষদের বিস্ফোরণ—যা দীর্ঘদিনের নিপীড়নের কারণে প্রতিক্রিয়া হিসেবে তৈরি হয়েছে। ইরেনের সহিংস প্রবণতা হলো ধ্বংসের মাধ্যমে আজাদি- যা আমাদের তরুণেরা প্রতিষ্ঠিত শোষকদের বিরুদ্ধে রাজপথগুলোতে দেখিয়ে যাচ্ছে।

মারলেয়ানরা এদেরকে সিভিলাইজেশনের একটি ‘অপর’ জাতিসত্তা বলে প্রমাণ করে। তাদের কাছে এরা এমনই এক জাতিসত্তা যাদের কোন নাগরিক অধিকার নেই কিন্তু আইনি প্রয়োগ আছে। গিওর্গিও আগামবেন এই ‘অপর’ জনগোষ্ঠীর নাম দিয়েছেন ‘হোমো সাকের’—যারা শুধুমাত্র ‘প্রাণ’ আছে হিসেবে প্রাণী কিন্তু মানুষ নয়। এসব হোমোসাকেরদের দিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা চালানো যায়, ধ্বংসাত্বক সৈন্য হিসেবে নির্মান করা যায়, যেমন- মারলেয়ানরা নির্মান করেছিলো টাইটানদের। বাস্তবের দুনিয়ায় এই জনগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গা, বিহারী, ‘ড্যান্ডিখোর’ পথশিশু, কিংবা ভ্রাম্যমাণ পতিতা ইত্যাদি। এরাই হোমোসাকের ফলে এদের দিয়ে রাজনীতিবিদেরা মাদকের ব্যবসা করে, অস্ত্রের চোরাকারবারিসহ নানা অপরাধ করিয়ে নেয়। উৎপাদন করে অর্থ ও উন্নয়ন নামক এক ইউটোপীয় সমাজ, যা দিয়ে এক ভীতির রাজত্ব কায়েম হয়। ‘উন্নয়নের’ চশমায় সাধারণ জনগণ ধরে নেয় এরাই নষ্টের মূল, ফলে জনগণের কাছে এরা হয়ে ওঠে হয় ‘বিহারি’ নইলে ‘রোহিঙ্গা’ কিংবা ‘ডান্ডিখোর’ অপর জনগোষ্ঠী। এদেরকেই মারলেয়ানরা বলতো ‘শয়তানের বাচ্চা’। শিক্ষিত আরবান এলিট মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের কাছে বিহারি, রোহিঙ্গা, ডান্ডিখোরেরা মূলত ‘শয়তানের বাচ্চা’। কিন্তু আমাদের তরুণেরা তথা জেন-জি’রা সমাজের উপরিতল দেখেই থেমে থাকেন না, সমাজের ‘হোয়াইট মাস্ক’ দেখেই থেমে যান না। তারা আরও গভীরে যান, বুঝতে পারেন ভেতরের সমস্যাটা কোথায়, ফলে তাদের কাছে রাষ্ট্রযন্ত্র ও তথাকথিত শিক্ষিত-সিভিল সোসাইটির বলা সর্বনাম কোন অর্থ উৎপাদন করে না। তারা এই ‘অপর’ হয়ে ওঠা হোমো সাকেরদের জন্য সহিংস লড়াইয়ে নামে। তাদের সামনে সিম্বোলিক চরিত্র হিসেবে হাজিরা দেয় ইরেন নামক এক কমিক চরিত্র অথবা ওয়ান পিস –এর মাঙ্কি ডি-লুফি। এই কমিক চরিত্র আমাদের অপরিচিত ফলে আমরা এই তরুণদের যে কোন মুভমেন্টকে তাচ্ছিল্য করি।

জেন-জি জেনারেশনের উদ্ভব সমকালীন। ফলে এদেরকে নিয়ে দুনিয়াজুড়ে খুব বেশি পর্যবেক্ষন, বয়ান, তত্ত্ব কিংবা গবেষণা লক্ষ করা যায় না। চল্লিশোর্ধ কোন ব্যক্তির পক্ষে এই তরুণদের ভাষা, আচরণ, ইত্যাদিকে বোঝা আসলেই কঠিন। ব্যক্তিগত একটি নমুনা জরিপের উপর ভিত্তি করে আমার মনে হয়েছে সমস্যাটা ব্যক্তির নয় বরং ভাষা সংক্রান্ত।

জেন-জির আজাদি আন্দোলন

জেন-জির মুভমেন্ট আজদির মুভমেন্ট—এ কথা হাল জমানার বৈশ্বিক আন্দোলনগুলোর দিকে পর্যবেক্ষন করলে সহজেই অনুমেয়। কিন্তু একথা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, এসব মুভমেন্টে সহিংস উপাদানের হাজিরা রয়েছে। জেন-জি’র এই চরিত্র বিশ্লেষণে ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব কাজে লাগবে। ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মধ্যে দুটি মৌলিক প্রবৃত্তি থাকে—ইরস (জীবন) এবং থানাতোস (মৃত্যু)। ‘থানাতোস’ হলো ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি, যা মানুষকে সহিংসতা, আত্মধ্বংস এবং আগ্রাসনের দিকে ঠেলে দেয়। জেন-জি’রা ‘জীবনকে’ বাদ দিয়ে ধ্বংসাত্মক প্রবনতা গ্রহণ করে চলেছেন। এর পেছনের কারণ খুঁজতে এই প্রজন্মের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে বোঝা দরকার। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু বিপর্যয়, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও পার্টিজান রাজনৈতিক দলগুলোর মুনাফেকি আচরণ—তাদের মধ্যে একধরনের অসন্তোষ ও হতাশা তৈরি করেছে। তারা খেয়াল করেছে, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে পরিবর্তন আসে না বরং প্রতিষ্ঠিত সিস্টেম নিজেই অপরায়ন, কাল্টভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে সহিংস ও ধ্বংসাত্মক। ফলে এরা ইরেনের মতো চরিত্রকে ধারণ করে নিজের ভেতরের দানবকে গ্রহণ করে এবং ‘আজাদির’ জন্য সহিংস পথে হেটে যায়। ইরেন হয়ে ওঠে প্রতীকী মুক্তিদাতা। এই সহিংসতা জেন-জি’র কাছে আত্মরক্ষার ভাষা। তারা ইরেনকে দেখে এমন একটি চরিত্র হিসেবে যে নিজের নিয়তি নিজের হাতে নেয়, যাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ হলো ‘অটনমি’র আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা জেন-জি’র নিজস্ব রাজনৈতিক ভাষায় প্রতিফলিত হয় যেখানে তারা দলীয় প্রতীক নয় বরং ‘কালচারাল’ আইকন ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়।

তাছাড়া এই ‘সহিংসতা’ শুধু বাহ্যিক নয় বরং অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। এই অন্তর্দ্বন্দ্বে সে কখনো কখনো নিজের মানবিকতা হারিয়ে ফেলে ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাস করে যে, সে আপাত ‘আজাদি’ অর্জন করছে। এই দ্বন্দ্বকে সে এড্রেস করতে পারে ফলে সে নৈতিক দ্বিধা, আত্মপরিচয়ের সংকট এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা অনুভব করে। ফ্রয়েড উল্লেখিত থানাতোস-প্রবণতা জেন-জি’র কাছে একধরনের সাংস্কৃতিক ক্যাথারসিস অথবা একধরনের এস্থেটিক প্রবণতা— যেখানে সহিংসতা হয়ে ওঠে মুক্তির প্রক্রিয়া এবং দানবত্ব হয়ে ওঠে আত্মনিয়ন্ত্রণের ভাষা। ইরেন তাদের সেই মুখ, যে বলে- ‘আমি যা করছি, তা হয়তো ভুল, কিন্তু আমি নিজেই আমার পথ ঠিক করছি’। এই বাক্যটাই জেন-জি’র বিদ্রোহী মনোজগতের সারাংশ।

এই প্রজন্মের আন্দোলন, ভাষা ও সাংস্কৃতিক প্রতীক—সব মিলিয়ে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যাকরণ নির্মাণ করছে। এই ব্যাকরণকে বুঝতে হলে আমাদের প্রবেশ করতে হবে তাদের নির্মিত বাস্তবতায়, তাদের ডিজিটাল ছন্দে এবং তাদের মনোজাগতিক প্রতীকতত্ত্বে।

মনোজগতের ‘থানাতোস’ প্রবণতার ফ্রয়েডিয় ব্যাখ্যার ভিন্ন ব্যাখ্যাও রয়েছে। ফ্রয়েডের ছাত্র কার্লস ইয়ুং এই তত্ত্বকে সরাসরি গ্রহণ করেননি। তিনি মানুষের ধ্বংসাত্মক প্রবণতাকে ‘শ্যাডো’ ধারণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, মানুষের অবচেতনে এমন সব প্রবৃত্তি থাকে যা সমাজ-স্বীকৃত নয়, যেমন- সহিংসতা, লোভ, হিংসা, ঈর্ষা, ইত্যাদি। এগুলোকে সমাজের ‘অস্বীকৃত’ হিসেবে দমন করতে গেলে তা আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। সুতরাং একে চিহ্নিত করতে হবে, গ্রহণ করে স্বীকৃতি দিতে হবে। শুধু তাই নয়, ব্যাক্তির ব্যাক্তিত্ত্ব উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে রূপান্তর করতে হবে। ইয়ুং-এর চোখে সহিংস প্রবণতা অস্বীকার না করে আত্ম-উন্নয়নের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। বর্তমান সময়ের আন্দোলনগুলোতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ‘সহিংসতার’ অজুহাতে তরুণদের উপর অধিক বল প্রয়োগ করে, ফলে আন্দোলনগুলো অধিকতর ধ্বংসাত্মক রূপ পায়। বলপ্রয়োগ না করে জেন-জি’র ‘সহিংস’ ভাষাকে চিনে নেয়ার প্রয়োজন ছিলো, তাকে এড্রেস করার জরুরত ছিলো। কিন্তু রেজিমগুলো নিজেই যেহেতু অসৎ, লম্পট, লুটপাটকারী মানসিকতার, ফলে সে জেন-জির সাধারণ মুভমেন্টকেও সহিংস হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে দমন করতে চায়। এরকম দমনের উদাহরণ শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, নেপালে বিগত সময়গুলোতে ঘটেছে। জেন-জিও তার মতো করে ইগার ইরেনের ‘র‍্যাম্বলিং’ প্রক্রিয়ায় অধিকতর ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ায় রেজিমগুলোকে পালাতে বাধ্য করেছে।

জেনজি’র এই প্রবণতা ফ্রয়েডিয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু ইয়ুং এর মতে এই প্রবণতা তাঁকে বরং আত্মউন্নয়নের সুযোগ দেয়। অর্থাৎ ইরেনের প্যারাডক্সিকাল ভাবনা তরুণকে যেমন সহিংস হতে অনুপ্রাণিত করে তেমনি আজাদির মাধ্যমে আত্মউন্নয়নের দিকেও ধাবিত করে। আরো বড় পরিসরে বললে জেন-জিদের ‘র‍্যাম্বলিং’ প্রক্রিয়া একটি রাষ্ট্রকে বা সিস্টেমকে রি-ফর্মের জন্য তাগিদ দেয়। রি-ফর্মেশন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়ার পথে জেন-জিদের সামনে উদ্ধারকর্তা হিসেবে মেসায়াহরূপে হাজির হয় ইরেন কিংবা লুফির মতো চরিত্ররা।

জেন-জি হলো আগামবেনের উল্লেখ করা সেই ‘অনাগত মানুষ’। এরা রাজপথ, ফুটপাত, গলি, টঙদোকানসহ প্রত্যেকটি ইন্ডিভিজুয়ালের ‘কালেক্টিভ কনসাসনেস’। তারা প্রতীক, মিথ, সিম্বল কিংবা ‘অজানা’ ঐশী আওয়াজ থেকে ইলহাম প্রাপ্ত হয়।

ইরেনের মধ্যে জেন-জি’র মেসায়াহ তথা সুপারম্যান

‘তোমার নিজের আগুনে নিজেকে পোড়াও; তুমি নতুন হয়ে উঠবে না, যদি আগে ছাই না হও’- জার্মানীর দার্শনিক নিৎসের একটি বয়ান। এ্যাটাক অন টাইটান–এর মূল চরিত্র ইরেন ইয়েগারের চরিত্রের সঙ্গে বয়ানটি গভীরভাবে যুক্ত। নিৎসে এখানে নৈতিকতার প্রচলিত কাঠামো, রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং তথাকথিত ‘পবিত্রতা’র ধারণাকে প্রশ্ন করছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, সত্যিকারের রূপান্তর আসে আত্মবিনাশের মধ্য দিয়ে, যেখানে ব্যক্তি নিজের ভেতরের আগুনে নিজেকে পোড়ায়, ছাই হয়, তারপর নতুন হয়ে ওঠে। ‘নতুন হয়ে উঠতে হলে আগে ছাই হতে হবে’- ইরেন এ পথেই হাঁটে। সে নিজের মানবিকতার ধারণা, নিও-লিবারাল সম্পর্ক, এমনকি নৈতিকতার তথাকথিত ধারণাকে বিসর্জন দেয়। ‘রাম্বলিং’-এর মাধ্যমে নিজেকে দানব সত্তায় হাজির করে এলদিয়ানদের মুক্তি দিতে চায়। সে জানে, সে ঘৃণিত হবে, কিন্তু সে বলে—‘আ’ল কিপ মুভিং ফরোয়ার্ড… আন্টিল অল মাই এনিমিজ আর ডেস্ট্রয়েড’। এই ‘ফরোয়ার্ড’ মানে শুধু শত্রুদের ধ্বংস নয় বরং নিজের পুরনো সত্তাকে ছাই করে নতুন সত্তা নির্মাণ। তথাকথিত ‘সাধু ও ন্যায়নিষ্ঠ’-দের ব্যাপারে নিৎসে সতর্ক করেন, কেননা এসব বুদ্ধিজীবীরা সহজ নয় এমন কিছু পবিত্র বলে মানতে চায় না। জেন-জির ইরেন রাষ্ট্র, ধর্ম, ইতিহাস—সব কাঠামোকে প্রশ্ন করে। দ্য ফাউন্ডিং টাইটান–এর ক্ষমতা ব্যবহার করে বুদ্ধিজীবীদের নির্মিত ঐতিহাসিক স্মৃতি, জাতিবাদি গিল্ট এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শকে ভেঙে দেয়। রাষ্ট্র তথা কাঠামোবাদী আদর্শ- যা একসময় ইরেন ধারণ করতো- সেই আদর্শকেই সে পুনর্পাঠ করে ধ্বংস করে এবং পুনর্নির্মান করে। নিৎসের ‘নিজের আগুনে পোড়াও’ বয়ানের মতো ইরেন নিজেকে ধ্বংস করে আত্মনিয়ন্ত্রণ করে। সে টাইটান হয়ে ওঠে, নিজের বন্ধুদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং নিজের মৃত্যুর পথ নিজেই তৈরি করে। সে নিজের নিয়তি নিজের হাতে নেয়, যা নিৎসের ‘Übermensch’ বা ‘সুপারম্যান’ ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

১৯১৭ সালে সোভিয়েত বিপ্লবের সময়ে ইউক্রেনের কৃষকেরা লেনিনকে দেখেছিলেন যিশুখ্রিস্টের পুনরাবির্ভাবের মতো করে। তারা চিন্তা করতেন লেনিন তাদের উদ্ধার করতে আসবেন, সাদা রঙের ডানায় ভর করে, পবিত্র সাদা সফেদ এক পাখির মতো তিনি তাদের মাঝে এসে নামবেন, উদ্ধার করবেন। ইউক্রেনীয় জনগণের কাছে তিনি ছিলেন মেসায়াহ। মেসায়াকে ব্যক্তি হিসেবে দেখার প্রবণতা সেমেটিক ঐতিহ্যে বহু পুরোনো। ইসলামী ঐতিহ্যের মাহদিয়াত ধারণাও সেমেটিক মেসাইয়ানিক ধারণার ইসলামী প্রকাশ। মুসলিম ঐতিহ্যে মাহদিয়াত প্রবণতাকে ব্যক্তি ইমাম মেহেদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

বিগত ৫-৭ বছরে তথ্যপ্রযুক্তির তীব্র প্রভাবের ফলে একটি নতুন ভাষার জন্ম হয়েছে, যা এখনো হোমোজিনিয়াস নয়। এই ভাষা—যা টিকটক, ডিসকর্ড, রেডিট, এনিমে, গেমিং কালচার এবং ক্রিপ্টো-স্ল্যাং দিয়ে গঠিত—একটি ভিন্ন ভাষা-বাস্তবতা তৈরি করেছে। এই ভাষা শুধু নতুন নয় বরং অভ্যন্তরীণভাবে ছিন্নভিন্ন।

প্রশ্ন হলো, মানুষ কখন মাহদিয়াত প্রবণতার আকাঙ্ক্ষা করে কিংবা নিজেই মেসায়াহ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়? পোস্টমর্ডান জমানায় উৎপাদিত হওয়া অস্তিত্বগত সংকট ও সামাজিক নিপীড়ন, সেইসাথে ধর্ম, রাষ্ট্রসহ কাঠামোগত জুলুমের কারণে মানুষের মনে ‘উদ্ধারকর্তার’ প্রত্যাশা জন্ম নেয়। আপাত এই ‘উদ্ধারকর্তা’ বাস্তব না, সে কাল্পনিক, প্রতীকী এবং মনস্তাত্ত্বিক—যা জনমানুষের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ভাষা। মানুষের মনোজাগতিক এ প্রবণতা ধীরে ধীরে পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরেও জায়গা নিতে শুরু করে। গত শতকের মাঝামাঝিতে ইহুদী বংশোদ্ভূত তাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেনিয়ামিন ‘মেসায়ানিক টাইম’ ধারণার পুনরুৎপাদন ঘটান। তিনি মনে করেন, ইতিহাস সরল রৈখিক নয়, কোন নির্দিষ্ট ন্যারেটিভের তৈরি জড়বস্তুও নয়। তার মতে, মজলুম জনগণ ইতিহাসের প্রতিটি ক্ষণেই, প্রতিটি মুহুর্তেই মুক্তির সম্ভাবনা দেখে। এই ‘মূহুর্তই’ বেনিয়ামিনের কাছে মুক্তির ক্ষণ, এই ক্ষণেই প্রত্যেকটি মুক্তিকামী মানুষ হয়ে ওঠেন ‘মেসায়াহ’ তথা ‘মেহেদি’। সুফিদের ভাষায় একজন ব্যক্তিমানুষও এই ‘ক্ষণেই’ মুক্তিপ্রাপ্ত হন কেননা সুফিরা নিজেদেরকে ‘ইবনুল ওয়াক্ত’ বা মুহূর্তের সন্তান বলে মনে করেন। সুফিদের ‘মুক্তি’র ধারণা শুধুমাত্র ‘নফসে আম্মারা’ তথা কু-প্রবৃত্তির নফস থেকে মুক্তি নয় বরং সব জুলুম, শোষণ, আধিপত্য, দুর্নীতি নামক কু-প্রবৃত্তির নফস থেকেও মুক্তি। ফলে সুফি দৃষ্টিকোণ থেকে জুলুম, শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী প্রত্যেকটি মানুষই এক অর্থে সুফি।

উপরের আলোচনা থেকে এটা বুঝতে সমস্যা হয় না যে, মিসাইয়ানিক তথা মাহদীয় প্রবণতা শুধু ধর্মীয় নয় বরং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক। জনগণ যখন দেখে, প্রচলিত কাঠামো তাদের মুক্তি দিতে ব্যর্থ, তখন তারা এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তির আগমনের আশায় থাকে—যে সবকিছু বদলে দেবে। অথবা এই ‘অপ্রেসড’ জনগণ এমন এক নতুন প্যারাডাইম চায় যেখানে প্রত্যেক ইন্ডিভিজ্যুয়াল তথা প্রত্যেকটি মানুষই একেকজন খোদায়ী কর্তাসত্তা হয়ে উঠবেন।

পশ্চিমা তাত্ত্বিক আগামবেনের ভাষায় এই ‘খোদায়ী’ কর্তাসত্তা সম্পন্ন মানুষ হলো ‘অনাগত মানুষ’। নব্বই দশকের সোভিয়েত পতনের সাক্ষী হয়ে ফ্রান্সিস ফুকুহামা ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘোষণা করেছিলেন, পুঁজির বিজয় ঘোষণা করেছিলেন। পারভেজ আলমের ভাষায় তিনি ‘লিবারাল পুঁজিবাদী দুনিয়াকে ইতিহাস পরবর্তী বেহেশত বানিয়ে ফেলেছিলেন’। কিন্তু ইতিহাস চলমান, গতিশীল—ফলে ইতিহাসের নানা বাঁকে বসত করা ‘অনাগত মানুষ’দের পর্দাকে তিনি উন্মোচন করতে পারেননি। আরও বৃহৎ পরিসরে বললে তিনি এই ‘অনাগত মানুষ’দের চিহ্নিত করতে সক্ষম হননি। কিন্তু বারো শ সালের দিকে স্পেনের একজন সুফি এই অনাগত মানুষদের উল্লেখ করে ‘ইনসানুল কামিল’ ধারণা হাজির করেছিলেন। এই ধারণায় তিনি সেই মানুষদের কথা বলেছিলেন যারা মানুষের পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষার কথা বলে। তিনি দেখিয়েছেন ইনসানুল কামিল হলো গনের ভেতরকার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, এটি ব্যক্তি নয় বরং কালেকটিভ কনসাসনেস, যা জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ ও আত্মোপলব্ধি।

জেন-জির মুভমেন্ট আজদির মুভমেন্ট—এ কথা হাল জমানার বৈশ্বিক আন্দোলনগুলোর দিকে পর্যবেক্ষন করলে সহজেই অনুমেয়। কিন্তু একথা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, এসব মুভমেন্টে সহিংস উপাদানের হাজিরা রয়েছে। জেন-জি’র এই চরিত্র বিশ্লেষণে ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব কাজে লাগবে।

জেন-জি হলো আগামবেনের উল্লেখ করা সেই ‘অনাগত মানুষ’। এরা রাজপথ, ফুটপাত, গলি, টঙদোকানসহ প্রত্যেকটি ইন্ডিভিজুয়ালের ‘কালেক্টিভ কনসাসনেস’। তারা প্রতীক, মিথ, সিম্বল কিংবা ‘অজানা’ ঐশী আওয়াজ থেকে ইলহাম প্রাপ্ত হয়। যেমনটি দেখেছি ঢাকার রাজপথে, দেখেছি নেপালের রাস্তায়- সেখানে ‘ড্রামস অফ ফ্রিডমের’ ছন্দে ছন্দে এরা মিছিল করেছে, খালি হাতে শোষকের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় প্রতীক—যাকে প্রায় ‘ধর্মীয় সিম্বল’ হিসেবে একটি রাষ্ট্র জনগণকে চিন্তা করাতে শেখায়, সেই সব সিম্বলকে সরিয়ে ইরেন, নারিতো কিংবা লুফির মতো চরিত্রকে প্রতিস্থাপন করেছে। এই প্রবণতা আপাত দেশ-জাতি বিরোধী মনেহতে পারে, কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার যে, এই তরুণেরা দেশ, জাতি, ধর্ম তথা যে কোন আইডেন্টিটিক্যাল ডিসকোর্সকে অস্বীকার করে। ফলে তাদেরকে তথাকথিত ‘জাতিবাদি’, ‘ধর্মবাদী’, ‘চেতনাবাদী’ কাঠামোতে ফেলে ব্যাখ্যা করা যাবে না। জেন-জিদের বুঝতে হবে তাদের নির্মিত ছন্দে এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত ভাষায়।

জেন-জি ও প্রথাগত ভাষার শিফটিং

জেন-জি জেনারেশনের উদ্ভব সমকালীন। ফলে এদেরকে নিয়ে দুনিয়াজুড়ে খুব বেশি পর্যবেক্ষন, বয়ান, তত্ত্ব কিংবা গবেষণা লক্ষ করা যায় না। চল্লিশোর্ধ কোন ব্যক্তির পক্ষে এই তরুণদের ভাষা, আচরণ, ইত্যাদিকে বোঝা আসলেই কঠিন। ব্যক্তিগত একটি নমুনা জরিপের উপর ভিত্তি করে আমার মনে হয়েছে সমস্যাটা ব্যক্তির নয় বরং ভাষা সংক্রান্ত।
আমার জরিপে বয়সভিত্তিক তিনটি শ্রেণীকে নমুনা হিসেবে নিয়েছি, যথা— ১. পয়তাল্লিশোর্ধ তিনজন, ২. ২৭-৩৮ বয়সসীমার মধ্যে চারজন এবং ৩. ১৫-২৩ বছর বয়স সীমার মধ্যে সাতজন।

তৃতীয় শ্রেণীকে আমি জেন-জি’র নমুনা হিসেবে নিয়েছি। এই জরিপ শেষে আমার মনে হয়েছে, ২৭ বছরের ঊর্ধ্বে একটি জনগোষ্ঠী ভাষার মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু ১৫–২৩ বছর বয়সী জেন-জি প্রজন্ম সেই ভাষা কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা নিছক ভাষাগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক। তারা যে ভাষা ব্যবহার করে, যেমন— মিম, এনিমে রেফারেন্স, শর্ট ফর্ম ভিডিও, ইমোজি, গ্লিচ-ভিজ্যুয়াল কিংবা ডিজিটাল স্ল্যাং—তা পুরোনো প্রজন্ম তথা সাতাশোর্ধ ব্যক্তিবর্গের কাছে প্রায় দুর্বোধ্য। ফলে জেন-জির রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ বা প্রতিবাদ ভাষাগতভাবে অনুবাদযোগ্য নয় এবং তারা যাদের ক্ষমতায় আনে, তারাও সেই ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নেয় আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে ফাটল, যা পরিণত হয় সহিংসতায়। মিশেল ফুকোর ‘ডিস্কোর্স এন্ড পাওয়ার’ তত্ত্ব অনুযায়ী, ভাষা শুধু যোগাযোগ নয় বরং ক্ষমতার কাঠামো। জেন-জি যখন নতুন ভাষা নির্মাণ করে, তারা আসলে নতুন ক্ষমতার কাঠামো তৈরি করে। কিন্তু রাষ্ট্র বা মধ্যবয়সী নেতৃত্ব সেই ভাষা না বুঝে পুরোনো কাঠামো বজায় রাখতে চায়, ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই সংঘর্ষকে বলা যায় ‘বিপ্লব-পরবর্তী ভাষা সঙ্কট’—যেখানে বিপ্লবের ভাষা ও শাসনের ভাষা এক নয়। তাই জেন-জি’র সহিংসতা কোনো লক্ষ্যহীনতা নয়, বরং ভাষাগত অক্ষমতার প্রতিক্রিয়া। তারা যাদের ক্ষমতায় আনে, তারা যদি সেই ভাষা না বোঝে তবে নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয় আন্দোলন পরিণত হয় হতাশায় যা সহিংসতার জন্ম দেয়।

এই নতুন ভাষা, নতুন প্রতীক এবং নতুন ক্ষমতা কাঠামো—সব মিলিয়ে জেন-জি প্রজন্ম একটি নতুন প্যারাডাইম নির্মাণ করছে। তারা দলীয় রাজনীতির বাইরে, প্রথাগত আদর্শের বাইরে, এমনকি রাষ্ট্রনির্ধারিত নৈতিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মুক্তির ভাষা তৈরি করছে। এই ভাষা এখনো হোমোজিনিয়াস নয়, ফলে তাদের আন্দোলন শক্তিশালী হলেও নেতৃত্ব দুর্বল হয়।

বিগত ৫-৭ বছরে তথ্যপ্রযুক্তির তীব্র প্রভাবের ফলে একটি নতুন ভাষার জন্ম হয়েছে, যা এখনো হোমোজিনিয়াস নয়। এই ভাষা—যা টিকটক, ডিসকর্ড, রেডিট, এনিমে, গেমিং কালচার এবং ক্রিপ্টো-স্ল্যাং দিয়ে গঠিত—একটি ভিন্ন ভাষা-বাস্তবতা তৈরি করেছে। এই ভাষা শুধু নতুন নয় বরং অভ্যন্তরীণভাবে ছিন্নভিন্ন। এখানে প্রতিটি সাব-কালচার নিজের ভাষা তৈরি করেছে। ফলে ঐক্য ও সংহতির ভিত্তিতে চলা রাষ্ট্র, এই ভাষার ভেতরকার বিভাজনকে শাসন করতে ব্যর্থ হয়। আর্নেস্ট লাকলাউ-এর ‘পপুলিস্ট রিজন’ তত্ত্ব অনুযায়ী, জনগণের আকাঙ্ক্ষা যদি ভাষাগতভাবে একত্রিত না হয়, তবে কোনো রাজনৈতিক কাঠামো স্থায়ী হতে পারে না। আমার পর্যবেক্ষন মতে, জেন-জি’র ভাষা এখনো হোমোজিনিয়াস নয়, ফলে তাদের আন্দোলন শক্তিশালী হলেও, নেতৃত্ব দুর্বল হয়। তারা যাদের ক্ষমতায় আনে, তারা সেই ভাষা না বুঝে পুরোনো কাঠামো প্রয়োগ করে, ফলে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় না। এই অসম্পূর্ণতা থেকেই জন্ম নেয় সহিংস প্রতিক্রিয়া। রাষ্ট্রগুলো এই ভাষাগত ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে—যেখানে পুরোনো কাঠামো ভেঙে পড়ে, নতুন ভাষা উঠে আসে, কিন্তু তা স্থায়ী কাঠামো তৈরি করতে পারে না। এই চক্র চলতে থাকবে, যতদিন না একটি নতুন ভাষা-সংহতি গড়ে ওঠে, যা নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে পারে। তাই জেন-জির সহিংসতা কোনো বিচ্যুতি নয়, বরং ভাষার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া।

উপসংহার

জেন-জি প্রজন্মের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বোঝার জন্য আমাদের শুধু তাদের দাবিগুলো শুনলেই হবে না। আমাদেরকে প্রবেশ করতে হবে তাদের নির্মিত ভাষার ভেতরে, তাদের প্রতীকতত্ত্বে, এবং তাদের মনোজাগতিক ছন্দে। এই প্রজন্মের আন্দোলন কোনো দলীয় ব্যানারে বাঁধা নয় বরং এটি একধরনের নন-পার্টিজান, কালচারাল ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ। তারা রাষ্ট্রের ক্লাসিক্যাল প্রতীক, ধর্মীয় ভাষা এবং ঐতিহ্যিক আদর্শকে অস্বীকার করে নতুন এক ভাষা নির্মাণ করেছে। এই ভাষা টিকটক, ডিসকর্ড, রেডিট, এনিমে, গেমিং কালচার, ক্রিপ্টো-স্ল্যাং, মিম ও ইমোজির মতো ডিজিটাল উপাদানে গঠিত। এই ভাষা শুধু নতুন নয় বরং এটি ছিন্নভিন্ন, বহুমাত্রিক এবং সাব-কালচার ভিত্তিক। ফলে রাষ্ট্র, নেতৃত্ব এবং মধ্যবয়সী সমাজ এই ভাষাকে অনুবাদ করতে ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নেয় আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে ফাটল—যা পরিণত হয় সহিংসতায়।

এই সহিংসতা নিছক লক্ষ্যহীন নয় বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ক্যাথারসিস, একটি আত্মনিয়ন্ত্রণের ভাষা এবং একটি নতুন ক্ষমতার কাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়া। ফ্রয়েডের তানাতোস তত্ত্ব অনুযায়ী, এটি মানুষের ধ্বংসাত্মক প্রবণতা, যা হতাশা ও নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভব হয়। কিন্তু ইয়ুং-এর শ্যাডো তত্ত্বে এই সহিংসতা হয়ে ওঠে আত্মউন্নয়নের সম্ভাবনা—যেখানে ব্যক্তি নিজের অস্বীকৃত প্রবৃত্তিকে চিহ্নিত করে, গ্রহণ করে এবং রূপান্তর ঘটায়। জেন-জি প্রজন্ম এই রূপান্তরের পথে হাঁটে, যেখানে তারা নিজের ভেতরের দানবকে গ্রহণ করে এবং ইরেন ইগার, লুফি কিংবা নারিতোর মতো চরিত্রকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে। এই চরিত্রগুলো তাদের কাছে শুধু কমিক বা এনিমে নয়, বরং তারা একেকজন মেসিয়া—যারা রাষ্ট্র, ধর্ম, ইতিহাস ও নৈতিকতার প্রচলিত কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে।

১৯১৭ সালে সোভিয়েত বিপ্লবের সময়ে ইউক্রেনের কৃষকেরা লেনিনকে দেখেছিলেন যিশুখ্রিস্টের পুনরাবির্ভাবের মতো করে। তারা চিন্তা করতেন লেনিন তাদের উদ্ধার করতে আসবেন, সাদা রঙের ডানায় ভর করে, পবিত্র সাদা সফেদ এক পাখির মতো তিনি তাদের মাঝে এসে নামবেন, উদ্ধার করবেন। ইউক্রেনীয় জনগণের কাছে তিনি ছিলেন মেসায়াহ।

ইরেন ইগারের ‘আ’ল মুভিং ফরোয়ার্ড… আনটিল অল মাই এনিমিজ আরে ডেস্ট্রয়েড’ বাক্যটি জেন-জির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক। এটি শুধু প্রতিশোধ নয় বরং নিজের পুরোনো সত্তাকে ছাই করে নতুন সত্তা নির্মাণের ঘোষণা। নিৎসের ‘নিজের আগুনে নিজেকে পোড়াও, তুমি নতুন হয়ে উঠবে না যদি আগে ছাই না হও’ বয়ানটি ইরেনের চরিত্রে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। এই বয়ান জেন-জি তরুণদের কাছে হয়ে ওঠে একধরনের নৈতিক বিপ্লব—যেখানে তারা নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব, হতাশা এবং শোষণের অভিজ্ঞতাকে রূপান্তর করে মুক্তির ভাষায়। তারা জানে, এই পথ সহজ নয়, এই পথ ঘৃণিত হতে পারে, কিন্তু তারা বিশ্বাস করে, সত্যিকারের রূপান্তর আসে আত্মবিনাশের মধ্য দিয়ে।

এই মেসিয়ানিক আকাঙ্ক্ষা কোনো ধর্মীয় পুনরাবৃত্তি নয় বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির ভাষা। বেনিয়ামিনের ‘মিসাইয়ানিক টাইম’, আগামবেনের ‘অনাগত মানুষ’ এবং সুফিদের ‘ইনসানুল কামিল’ ধারণা—সব মিলিয়ে জেন-জি হয়ে উঠেছে একধরনের কালেক্টিভ কনসাসনেস, যারা শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় নিজেদের ভাষায়, নিজেদের ছন্দে, নিজেদের মুক্তি দাবি করে। তারা রাষ্ট্রের ‘ধর্মীয়’ প্রতীককে সরিয়ে ইরেন, নারিতো কিংবা লুফির মতো চরিত্রকে প্রতিস্থাপন করে। এই প্রবণতা আপাত দেশ-জাতি বিরোধী মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এটি একটি নতুন রাজনৈতিক ভাষার নির্মাণ—যেখানে আইডেন্টিটিক্যাল ডিসকোর্সকে অস্বীকার করে ব্যক্তি নিজেই হয়ে ওঠে কর্তাসত্তা।

এই নতুন ভাষা, নতুন প্রতীক এবং নতুন ক্ষমতা কাঠামো—সব মিলিয়ে জেন-জি প্রজন্ম একটি নতুন প্যারাডাইম নির্মাণ করছে। তারা দলীয় রাজনীতির বাইরে, প্রথাগত আদর্শের বাইরে, এমনকি রাষ্ট্রনির্ধারিত নৈতিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মুক্তির ভাষা তৈরি করছে। এই ভাষা এখনো হোমোজিনিয়াস নয়, ফলে তাদের আন্দোলন শক্তিশালী হলেও নেতৃত্ব দুর্বল হয়। তারা যাদের ক্ষমতায় আনে, তারা সেই ভাষা না বুঝে পুরোনো কাঠামো প্রয়োগ করে, ফলে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় না। এই অসম্পূর্ণতা থেকেই জন্ম নেয় সহিংস প্রতিক্রিয়া। তাই জেন-জি’র সহিংসতা কোনো বিচ্যুতি নয় বরং এটি ভাষার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া।

এই প্রজন্মের আন্দোলন, ভাষা ও সাংস্কৃতিক প্রতীক—সব মিলিয়ে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যাকরণ নির্মাণ করছে। এই ব্যাকরণকে বুঝতে হলে আমাদের প্রবেশ করতে হবে তাদের নির্মিত বাস্তবতায়, তাদের ডিজিটাল ছন্দে এবং তাদের মনোজাগতিক প্রতীকতত্ত্বে। অন্যথায়, আমরা শুধু তাদের সহিংসতা দেখব, কিন্তু তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারব না। জেন-জি হলো সেই অনাগত মানুষ, যারা ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তে মুক্তির সম্ভাবনা দেখে এবং সেই সম্ভাবনাকে বাস্তব করে তুলতে চায়—নিজের ভাষায়, নিজের আগুনে, নিজের ছাই থেকে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত