leadT1ad

জাতীয়তাবাদের বাইরে অন্য কোনো শামসুর রাহমান কি আছেন

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ২০: ৪০
আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ২১: ১৬
জাতীয়তাবাদের বাইরে অন্য কোনো শামসুর রাহমান কি আছেন। স্ট্রিম গ্রাফিক

আমাদের ছোট্ট একটা শহর; হেঁটে চক্কর দিতে আধ ঘণ্টাও লাগত কিনা সন্দেহ। ঘুরেফিরে জড়ো হতাম পাবলিক লাইব্রেরিতে। কালো একটা আলমারিতে সাজানো ছিল ধূলিধূসর বই। কাচের ওপাশে ছিল সারি সারি নাম—ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, ফরহাদ মজহার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ...।

আলমারির তাকগুলোতে ছিল অদ্ভুত সব নামের বই ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘পৃথক পালঙ্ক’, ‘খোকন ও তার প্রতিপুরুষ’। একটি বইয়ের নাম ‘টেবিলের আপেলগুলো হেসে ওঠে’। বইটি দেখে আমি নিজেও খুব হেসে উঠলাম। উল্টাতে উল্টাতে ভাবলাম, এসবও কবিতা! কবিতা হিসেবে ‘স্বাধীনতা তুমি’ পর্যন্ত মানতে পেরেছিলাম, টেবিলের আপেলগুলোর হেসে ওঠাকে কোনোমতেই মানা গেলো না। শামসুর রাহমানের ওপর খুবই বিরক্ত হলাম। আলমারির বই রেখে এলাম আলমারির তাকেই। পরে জানলাম এমনই নাকি কবিতা লেখার নতুন রীতি, যদিও অন্ত্যমিলযুক্ত ‘ছন্দোবদ্ধ কবিতা’ই কেবল আমাদের কাছে কবিতা হিসেবে উত্তীর্ণ হতে পারত।

আল মাহমুদের ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’ আর ফরহাদ মজহারের ‘খোকন ও তার প্রতিপুরুষ’ পড়তে গিয়ে দেখি একই কাণ্ড! শামসুর রাহমানের ওপর থেকে বিরক্তি কমে গেলো। এক সময় টানা পড়ে গেলাম তাঁর কবিতা। পাবলিক লাইব্রেরিতে শ্রেষ্ঠ কবিতার একটা সংকলন ছিল। সেখান থেকে পড়লাম ‘ইকারুসের আকাশ’, ‘টেলেমেকাস’, ‘ইলেকট্রার গান’। কিছু বুঝি, কিছু অধরা থেকে যায়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এভাবেই আমাদের হাতে উঠে এসেছিল শামসুর রাহমানের বই।

নিজগৃহে কবি শামসুর রাহমান। সংগৃহীত ছবি
নিজগৃহে কবি শামসুর রাহমান। সংগৃহীত ছবি

তখন একটা তর্কের ভেতর পড়ে গিয়েছিলাম, কে বড় কবি? শামসুর রাহমান, নাকি আল মাহমুদ? ষোল-সতের বছরের অনতি-তরুণের পক্ষে এই প্রশ্নের মীমাংসা করা সম্ভব ছিল না। তবু এই প্রশ্নটির মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতে হয়েছিল। আরও কিছু শব্দ ও প্রসঙ্গের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ঘটেছিল ‘‘মৌলবাদ’’ ও ‘‘প্রগতিশীলতা’’, ‘‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’’ ও ‘‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’’। শামসুর রাহমান পক্ষীয়দের কাছে আল মাহমুদ ছিলেন ‘‘মৌলবাদী’’, ‘‘জামাতি’’। আল মাহমুদ পক্ষীয়দের কাছে শামসুর রাহমান ছিলেন ‘‘নাস্তিক’’, ‘‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’’।

স্বপ্নের রঙিন কুয়াশা চোখেমুখে মেখে আমরা যারা কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম, তাদের সামনে সাহিত্য ও রাজনীতির এই হঠাৎ বাহাসকে মনে হয়েছিল দুঃস্বপ্নের মতো ভারী। কেননা বুদ্ধদেব বসুর কল্যাণে আমাদের অধিকাংশের মন তখন কবিতাকে কেবল ‘কবিতা’ হিসেবে মানতেই অভ্যস্ত ছিল।

কবিতার দিক থেকে ভাবলে বলতে হয়, কত বড় দুর্ভাগ্য শামসুর রাহমানের! তাঁর কবিতার কবিতাগত মূল্য এতোই ঠুনকো হয়ে গেলো যে, একটি দল আর তার এককালের আদর্শের মাপকাঠিতেই বিচার করা হলো তাঁকে। মূলত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অস্বচ্ছতা সাহিত্যের সীমানায়ও ছড়িয়ে দিয়েছিল ধোঁয়াশার আবরণ। আমরা তাই বুঝে উঠতে পারিনি শামসুর রাহমানের ভিন্ন কোনো পাঠ তৈরি করা সম্ভব।

লক্ষ করলাম, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, জাতীয়তাবাদ, আধুনিকতা, প্রগতিশীলতার প্রশ্নে আমাদের শহরের কবিদের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা ভেদরেখা আছে। এই ভেদরেখায় আমরা হাঁসফাঁস করতাম; কিন্তু যুক্তিতর্ক করার মতো কোনো বিশেষ যুক্তি তখনও তৈরি হয় নি আমাদের মনে। সত্যিকার অর্থে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক বিকাশটিই তখন পর্যন্ত আমাদের কাছে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে নি। আর তাই কবিতার মখমলি জগতে বিচরণ করতেই আমাদের ভালো লাগত।

প্রকাশ্যে আমরা কখনো বলতে পারতাম না—সত্যিই কে আমাদের প্রিয়! কেননা ‘‘মৌলবাদী’’, ‘‘প্রগতিশীল’’, ‘‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’’, ‘‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী’’ কিংবা অন্য কোনো রাজনীতির তিলক আমরা গ্রহণ করতে চাইনি। মনে পড়ে, মৌলবাদ, রাজাকার ও ধর্মান্ধতাকে প্রায় এককাতারেই ফেলেছিলাম আমরা। বিপরীতে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতা। শামসুর রাহমানকে মনে হতো আধুনিক, প্রগতিশীল, মৌলবাদবিরোধী। কিছু সাক্ষাৎকার ও লেখায় আমরা তাঁকে তেমন রূপেই পেয়েছিলাম। আবার সংশয়-দীর্ণ এক জিজ্ঞাসাও ছিল, শামসুর রাহমানেরা এতো পশ্চিমমুগ্ধ কেন?

কবি শামসুর রাহমানের বাসায় তাঁর আলোকচিত্র সম্বলিত দেয়াল। ছবি: আশরাফুল আলম
কবি শামসুর রাহমানের বাসায় তাঁর আলোকচিত্র সম্বলিত দেয়াল। ছবি: আশরাফুল আলম

আজ নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি, বড় কবি কে—এই তর্কে হাবুডুবু খেয়ে মনে মনে একবার জিতিয়ে দিতাম আল মাহমুদকে, অন্যবার জিতিয়ে দিতাম শামসুর রাহমানকে। আমাদের ছিল দুই দিকে টান; আল মাহমুদ আপন হয়ে উঠেছিলেন তাঁর গ্রামীণতার গুণে। অন্য দিকে, শামসুর রাহমানকে মনে হতো শহুরে আধুনিকতার এক ঝা-চকচকে রূপ–মফস্সলের জায়গা-জমিনে বসে আমরা যা চিনি নি, দেখিনি; অথচ শহরকে জানার ও দেখার এক গোপন ব্যাকুলতা ছিল আমাদের।

তখন জেনেছিলাম আল মাহমুদের দুটো ভাগ—ইসলামপূর্ব ও ইসলামপরবর্তী। শামসুর রাহমান আদ্যন্ত জাতীয়তাবাদী, কিন্তু আওয়ামী লীগ-ঘেঁষা ইত্যাদি। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে দেখার প্রবণতা ছিল। আর সেই প্রবণতার নন্দনতাত্ত্বিক প্রয়োগ হিসেবে রচিত কবিতা হয়ে উঠেছিল ‘‘আওয়ামী লীগ-ঘেঁষা’’ সাহিত্য। এই ধারায় যুক্ত করা হতো সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণের নাম।

কারণ, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে বিকশিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি ক্লাসিক মহিমা তৈরি করতে পেরেছিল – যার সঙ্গে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন। শামসুর রাহমান-আল মাহমুদেরা মূলত এই মহিমারই সন্তান।

কবিতার দিক থেকে ভাবলে বলতে হয়, কত বড় দুর্ভাগ্য শামসুর রাহমানের! তাঁর কবিতার কবিতাগত মূল্য এতোই ঠুনকো হয়ে গেলো যে, একটি দল আর তাঁর এককালের আদর্শের মাপকাঠিতেই বিচার করা হলো তাঁকে। মূলত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অস্বচ্ছতা সাহিত্যের সীমানায়ও ছড়িয়ে দিয়েছিল ধোঁয়াশার আবরণ। আমরা তাই বুঝে উঠতে পারিনি শামসুর রাহমানের ভিন্ন কোনো পাঠ তৈরি করা সম্ভব।

একালে আমাদের স্পষ্টভাবেই বোঝা দরকার, পূর্ববাংলায় গড়ে ওঠা বাঙালির জাতীয়তাবাদ আওয়ামী লীগের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এই জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়েছিল এ অঞ্চলের মানুষের স্বাধিকার চেতনার সক্রিয়তার প্রবল প্রতাপের ভেতর। ভাষা আন্দোলন, ভাষাচেতনা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক নির্মিতি–এর কোনোটিই আওয়ামী লীগের তৈরিকৃত বাস্তবতা নয়।

কবি শামসুর রাহমান। ছবি: সংগৃহীত
কবি শামসুর রাহমান। ছবি: সংগৃহীত

আদতে কোনো দল, সংগঠন চাইলেই কোনো একটি সংস্কৃতিকে আকস্মিকভাবে সংগঠিত করতে পারে না। এর পেছনে থাকতে হয় জনমানুষের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা। অন্তত একটি শ্রেণি বা গোষ্ঠীর প্রয়োজন পড়ে, যারা জন-আকাঙ্ক্ষাকে বুঝতে ও ভিত্তি দিতে পারে। রবীন্দ্রবিরোধিতা, নজরুল-সাহিত্যের ইসলামিকরণ, রোমান হরফে বাংলা লিখনের উদ্যোগ—এইসব পরিপ্রেক্ষিতে ষাটের দশকজুড়ে গড়ে উঠেছিল বাঙালিকেন্দ্রিকতার আবহ। শামসুর রাহমান এই জাতীয়তাবাদের প্রতি সাড়া দিয়েই লিখেছিলেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’-এর মতো কবিতা। আর এই জাতীয়তাবাদই রাষ্ট্রনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধপূর্বকালে এই জাতীয়তাবাদ একটি মান্য কাঠামো পেয়ে গিয়েছিল। এর তীব্র প্রতিফলন ঘটেছে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধে। এই জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণী সমালোচনা শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর—সংবিধান প্রণয়নের কালে। সে সময় একটি পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থেকে। অন্য একটি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে প্রধানত ভারতবিরোধিতার সূত্র ধরে—পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির সঙ্গে তুলনামূলকতার জায়গা থেকে। বিরোধিতাগুলো দরকারি তাত্ত্বিক ভিত্তির জোগান দিতে সক্ষম হলেও জাতিচেতনা, জাতীয় ঐক্য, জাতীয়তাবাদের পরিসর বাঙালিকেন্দ্রিকেই থেকে গেছে। এমনকি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে’র প্রচার সত্ত্বেও।

একালে যখন ইতিহাসের বহুরৈখিকতার কথা বলা হচ্ছে, উত্তর-আধুনিক ও বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে মান্যতা দেয়া হচ্ছে তখন শামসুর রাহমানের পাঠই-বা কেন জাতীয়তাবাদী ছকে আবর্তিত হবে?

কারণ, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে বিকশিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি ক্লাসিক মহিমা তৈরি করতে পেরেছিল—যার সঙ্গে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন। শামসুর রাহমান-আল মাহমুদেরা মূলত এই মহিমারই সন্তান। শামসুর রাহমান এই মহিমার সদর দরোজা পেরিয়ে অন্দরে প্রবেশ করেছেন, যেহেতু তিনি উপহার দিতে পেরেছিলেন জাতীয়তাবাদী অনুভূতি-আশ্রিত কবিতা। সত্তর-আশির দশকে জাতীয়তাবাদ বিষয়ক বিতর্কের কালে তিনি সেই পুরোনো গরিমাকেই বারবার স্মরণ করেছেন।

আর এ কারণে নিয়ত আস্থায় শামসুর রাহমান বরণ করে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। জাতীয় প্রতীক হিসেবে তিনি বরাবরই তাঁকে মান্য মনে করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শামসুর রাহমান ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন; সে কালের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সমকাল’-এ প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতিবাদ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোড়ানো হয়েছিল পত্রিকাটির বেশ কিছু সংখ্যা। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতি সম্পর্কে শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘এ ধরনের ফ্যাসিবাদী পরিবেশে শিল্প-সাহিত্য বিকশিত হওয়ার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।’

কবি শামসুর রাহমানের লেখার টেবিল, তাঁর ব্যবহার করা ঘড়ি ও চশমা। ছবি: আশরাফুল আলম
কবি শামসুর রাহমানের লেখার টেবিল, তাঁর ব্যবহার করা ঘড়ি ও চশমা। ছবি: আশরাফুল আলম

প্রশ্ন জাগে, বিগত দেড় দশকের শাসনকালকে শামসুর রাহমান কী বলে অভিহিত করতেন? আবারও কি গাইতেন জাতীয়তাবাদী গান? নাকি বিগত সময়কেও বলতেন ‘‘ফ্যাসিবাদ’’? এসব প্রশ্নের জবাব আমরা পাবো না। কিন্তু অনুমান করা যায়, শামসুর রাহমান হয়তো জাতীয়তাবাদের ধ্রুপদি ধারণাকে খারিজ করতেন না। কেননা, তাঁর জাতীয়তাবাদী অনুভূতি কোনোকালেই বিশ্লেষণী চেহারা গ্রহণ করতে পারে নি। কিন্তু তাতে করে শূন্যতায় পর্যবসিত হয় না তাঁর সমুদয় সাহিত্য।

মনে রাখা দরকার, সময়ের চিহ্ন ধারণ করেই শামসুর রাহমানের কবিতা ‘কবিতা’ হয়ে উঠেছে। তাঁর কালের কবি-লেখকদের বড় অংশের মতো করে ‘আধুনিকতা’ বলতে তিনিও বুঝতেন পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারতাবাদ, নাগরিকতাকে। এই সব কিছুই মূলত একটি সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের যোগফল। বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে এই আধুনিকতা মতাদর্শিক অবস্থান গড়ে তুলেছে।

আর তাই হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ পরস্পরের কাছ থেকে খুব বেশি দূরের অধিবাসী নন। মুখ্যত তাঁরা সবাই একই উদারতাবাদী ডিসকোর্সের অধীন। কেউ হয়তো একটু বেশি ধর্মে ঝুঁকেছেন, কেউ হয়তোবা টলে গেছেন ক্ষণকালীন বিশ্বাসহীনতায়; আবার কেউ কেউ হয়তোবা ধর্মবোধকে খোদাই করেছেন বিশ্বাসের পাথরে, কেউ হয়তোবা ধর্ম আর ধর্মান্ধতাকে গুলিয়ে ফেলেছেন।

শামসুর রাহমান হয়তো জাতীয়তাবাদের ধ্রুপদি ধারণাকে খারিজ করতেন না। কেননা, তাঁর জাতীয়তাবাদী অনুভূতি কোনোকালেই বিশ্লেষণী চেহারা গ্রহণ করতে পারে নি। কিন্তু তাতে করে শূন্যতায় পর্যবসিত হয় না তাঁর সমুদয় সাহিত্য।

আমাদের ইতিহাস বিকাশের পথেই আছে এই বিরোধ ও সম্মিলন। আমরা তাই ইতিহাসের একরৈখিক পাঠ হাজির করতে পারি না। তাছাড়া একালে যখন ইতিহাসের বহুরৈখিকতার কথা বলা হচ্ছে, উত্তর-আধুনিক ও বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে মান্যতা দেয়া হচ্ছে তখন শামসুর রাহমানের পাঠই-বা কেন জাতীয়তাবাদী ছকে আবর্তিত হবে?

আমরা সম্ভবত জাতীয়তাবাদী শামসুর রাহমানের ভিন্ন পাঠ প্রস্তুত করতে পারি। ভাবা যেতে পারে অন্য এক শামসুর রাহমানের কথা—যে শামসুর রহমান আধুনিক কবিতার অভিযানে মগ্ন; ধর্ম ও ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে যাঁর কোনো বিরোধ নেই; গ্রেকো-রোমান, ভারতীয় সংস্কৃতি ও পুরাণের সমান্তরালে যিনি ব্যবহার করেন আরব-পারস্যের পুরাণ ও ইতিহাস; শহুরে জীবনকে যিনি দেখেন নিবিড় অনুপুঙ্খতায়। জাতীয়তাবাদী কবিতার অনিবার্য প্রভাবে প্রশ্ন জাগতে পারে, কোথায় পাবো এইসব চিহ্ন? নাকি সবই স্বকপোলকল্পিত আরোপনমাত্র? এর জবাব মিলবে শামসুর রাহমানের সাহিত্যে।

এই সাহিত্যে যেমন লেখা হয় ‘অ্যাপোলোর জন্য’, ‘ইলেকট্রার গান’, ‘টেলেমেকাস’, তেমনি লেখা হয় ‘নূহের জনৈক প্রতিবেশী’, ‘রাত্রির তৃতীয় যামে’, ‘এক রাতে হযরত ওসমান’, ‘আবার মুষলপর্ব’, ‘কবর-খোঁড়ার গান’, ‘পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ’, ‘টানেলে একাকী’, ‘সায়োনারা’, ‘চাঁদ সদাগর’-এর মতো কবিতা। শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতার তালিকায় যুক্ত হতে পারে আরও অনেক নাম। এইসব কবিতায় অবস্থান করেন অন্য এক শামসুর রাহমান, যিনি মনে করেন কবিতা হলো একটি ‘উৎকৃষ্ট আশ্রয়’, যাঁর কাছে ভালো কবিতা হলো সেই কবিতা, ‘যে কবিতা জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, সত্য এবং মহত্ত্বের সন্ধান দেয়, নান্দনিক তৃষ্ণা মেটায়…।’

প্রকৃতপক্ষে, জাতীয়তাবাদের বাইরে অন্য এক শামসুর রাহমান অপেক্ষমাণ।

লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।

Ad 300x250

সম্পর্কিত