স্ট্রিম ডেস্ক
গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ কার্যকর হয়েছে ১১ অক্টোবর থেকে। এতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া টানা ২৪ মাসের সংঘাত আপাতত থেমেছে। এই চুক্তি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার অংশ। এর আওতায় ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে, বন্দি ও জিম্মি বিনিময়ের প্রস্তুতি চলছে এবং মানবিক সহায়তা পাঠানো বেড়েছে।
তবে গাজার মানবিক পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষে ভুগছে, সংক্রামক রোগ দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো মৃতদেহ উদ্ধার চলছে। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের বড় অংশ ঘরে ফিরলেও অবকাঠামো ধ্বংসের কারণে অনেক এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা প্রায় ৬৮ হাজার, আহতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার—যা যুদ্ধ-পূর্ব জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও বেশি। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় দেশগুলো যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানাচ্ছে, তবে ভূমি নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণ বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
সেনা প্রত্যাহার
ইসরায়েলি বাহিনী প্রাথমিকভাবে ‘ইয়েলো লাইন’ সীমারেখা পর্যন্ত সরে গেছে। এতে কিছু এলাকা ছেড়ে দিলেও গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা নিরাপত্তা বাফার জোন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেইত হানুন, রাফাহ ও ফিলাডেলফি করিডোরসহ কিছু এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। প্রায় ২০০ সদস্যের একটি বহুজাতিক পর্যবেক্ষক দল—যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কিন্তু মার্কিন সেনা ছাড়া—মিসর, কাতার, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবে।
১২ অক্টোবর দুপুর পর্যন্ত বড় কোনো লঙ্ঘনের খবর পাওয়া যায়নি। তবে দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু হয়; এতে একজন নিহত ও সাতজন আহত হয়, যা আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
হামাস তাৎক্ষণিক নিরস্ত্রীকরণ প্রত্যাখ্যান করেছে। সংগঠনের নেতা মুসা আবু মারজুক বলেন, ‘ইসরায়েলি দখলে থেকে ফিলিস্তিনিরা অস্ত্র ছাড়বে না।’
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘শক্ত সামরিক ও কূটনৈতিক চাপের ফলেই এ চুক্তি সম্ভব হয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ মন্তব্য করেন, যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয়ের মুখে হামাস এই সমঝোতায় রাজি হয়েছে।
পরবর্তী ধাপে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশ এবং পরে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। গাজাকে নিরস্ত্রীকরণ করা, সশস্ত্র অবকাঠামো ধ্বংস এবং একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠন করা হবে—যা ‘বোর্ড অব পিস’ নামে পরিচিত হবে। এটি ট্রাম্প ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। হামাস এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে না, তবে যারা সহিংসতায় জড়িত নয় তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা থাকবে।
চুক্তিতে জোর দেওয়া হয়েছে— কোনো জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি হবে না। পুনর্গঠন কার্যক্রম ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অধীনে পরিচালিত হবে।
মানবিক পরিস্থিতি
যুদ্ধবিরতির ফলে জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে, তবে গাজার সংকট এখনো ভয়াবহ অবস্থায় রয়ে গেছে। ইউনিসেফ এই পরিস্থিতিকে বলেছে ‘দুই বছরের বিভীষিকার পর বহুল প্রতীক্ষিত এক ক্ষীণ আশার আলো।’ ২০২৫ সালের আগস্টে গাজার কয়েকটি এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়। এতে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ ‘ক্ষুধা, নিঃস্বতা ও মৃত্যুর’ ঝুঁকিতে পড়ে।
খাদ্যভাণ্ডার ধ্বংস, সহায়তা অবরোধ ও অবকাঠামো ভেঙে পড়ায় পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও জনাকীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রের কারণে বিভিন্ন রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধবিরতির আগে প্রয়োজনীয় সহায়তার মাত্র ২০ শতাংশই গাজায় পৌঁছেছিল।
বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ ট্রাক খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও জরুরি সরঞ্জাম নিয়ে গাজায় প্রবেশ করছে। এসব সরবরাহ কেরেম শালোম ও রাফাহ সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে। রাফাহ ১৫ অক্টোবর থেকে পালাক্রমে যাতায়াতের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার জন্য তিন মাসের খাদ্য মজুত রেখেছে। তারা প্রথমে দুর্ভিক্ষপ্রবণ এলাকায় সরবরাহ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ইউনিসেফ ১৩ অক্টোবর থেকে পূর্ণ মাত্রায় সহায়তা বিতরণ শুরু করবে এবং সব সীমান্ত দ্রুত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থার মুখপাত্র টেস ইঙ্গ্রাম বলেন, ‘এখন দেরি করার সুযোগ নেই।’
যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ইসরায়েলি সংস্থা ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ সমালোচনার মুখে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই একে ‘মারাত্মক ফাঁদ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, কারণ সহায়তা নিতে আসা মানুষদের আইডিএফের গুলির ঝুঁকিতে পড়তে হতো। এখন থেকে জাতিসংঘের নেতৃত্বে নতুনভাবে সহায়তা কার্যক্রম চলবে।
যুদ্ধবিরতির পর পাঁচ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি উত্তর গাজা ও গাজা সিটিতে ফিরে এসেছে। হাজারো মানুষ উপকূলীয় সড়ক ধরে উত্তরমুখী হচ্ছে এবং নেতজারিম করিডোরের বাধা ভেঙে প্রবেশ করছে। খান ইউনুস ও গাজা সিটির ধ্বংসস্তূপে পরিবারগুলো হারানো ঘরবাড়ির সন্ধান করছে, বহু মাস পর বুলডোজার দিয়ে ধ্বংসাবশেষ সরানো হচ্ছে।
তবে এই প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গাজা সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, শুধু ১২ অক্টোবরই ধ্বংসস্তূপ থেকে ১০০টির বেশি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অনেক স্থানে অজানা বিস্ফোরক ও আইডিএফের উপস্থিতির কারণে উদ্ধারকর্মীরা যেতে পারছেন না। আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবু সালমিয়া বলেন, ‘অনেক এলাকায় জীবনের কোনো চিহ্ন নেই, সবকিছু মুছে গেছে।’
জাতিসংঘের হিসাবে, বর্তমানে গাজার মাত্র ২০ শতাংশ হাসপাতাল আংশিকভাবে কার্যকর। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও অক্সফাম যুদ্ধবিরতিকে ‘প্রাণ রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ’ বলে বর্ণনা করেছে, তবে তারা সতর্ক করেছে—নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার না থাকলে পরিস্থিতি আবারও বিপর্যস্ত হতে পারে।
যুদ্ধ গাজায় নজিরবিহীন ধ্বংস ডেকে এনেছে। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৬৮২ জন নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৩ জন আহত হয়েছেন। গাজার মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও বেশি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, যাদের মধ্যে ৬৪ হাজার শিশু আহত বা নিহত। ‘কস্টস অব ওয়ার’ প্রকল্পের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষ, রোগ ও অবকাঠামো ধসে পরোক্ষ মৃত্যু এই সংখ্যা দ্বিগুণ করতে পারে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলায় ইসরায়েলি পক্ষেও প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত ও কয়েক হাজার আহত হয়। শুরুতে ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল, এখনো ৪৮ জন বন্দি রয়েছেন।
ধ্বংসের মাত্রা প্রায় পূর্ণাঙ্গ। ইসরায়েলি বিমান ও স্থল অভিযানে গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে বলে জানায়, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর)। তবে আল-জাজিরার প্রতিবেদন মতে, গাজার ৯২ শতাংশ আবাসিক ভবন এবং ৮৮ শতাংশ বাণিজ্যিক ভবন ইসরায়েল ধ্বংস করেছে।
পানীয়জলের উৎস, হাসপাতাল ও কৃষিজমি ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। ইউএনআরডব্লিউএর ২৫ সেপ্টেম্বর–১ অক্টোবর এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রায় ৭২৩ দিনের সংঘাতে গাজার ৯০ শতাংশ মানুষ অন্তত একবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
পুনর্গঠনের সম্ভাব্য ব্যয় কয়েক শত বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াতে পারে, যদিও এখনো কোনো স্পষ্ট তহবিলের ঘোষণা নেই।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
যুদ্ধবিরতি এখনো টিকে আছে, তবে পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। হামাসের নিরস্ত্রীকরণে অস্বীকৃতি, ইসরায়েলের ৫৩ শতাংশ ভূমিতে দখল বজায় রাখা এবং সময়সূচির অস্পষ্টতা—সব মিলিয়ে চুক্তি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। আগের ব্যর্থ যুদ্ধবিরতির অভিজ্ঞতাও এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে সম্পৃক্ত না করার অবস্থান এবং লেবাননে ইসরায়েলি হামলার ঘটনা আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে। গাজার সাধারণ মানুষ এখনো সন্দেহে আচ্ছন্ন। স্থানীয় বাসিন্দা হানিন মুসার ভাষায়, ‘আমরা বেঁচে আছি, কিন্তু ন্যায়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই।’ তবু অনেকে আশা করছেন, এই যুদ্ধবিরতি পুনর্গঠনের নতুন পথ খুলে দিতে পারে।
ধারাবাহিক ত্রাণ সহায়তা ও যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের সফল আলোচনাই দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ এবং বাস্তুচ্যুতদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রধান শর্ত। তবে মূল রাজনৈতিক প্রশ্ন—রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও স্বাধীনতার সমাধান ছাড়া—এই সহিংসতার চক্র আবারও ফিরে আসতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায়, ‘সব পক্ষই এখন ক্লান্ত যুদ্ধ থেকে।’ কিন্তু গাজার ধ্বংসস্তূপে নতুন জীবন ফিরিয়ে আনতে হলে দ্রুত, ন্যায্য ও টেকসই উদ্যোগ জরুরি, যা এই সাময়িক বিরতিকে স্থায়ী শান্তিতে রূপ দিতে পারে।
সূত্র: আল-জাজিরা
গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ কার্যকর হয়েছে ১১ অক্টোবর থেকে। এতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া টানা ২৪ মাসের সংঘাত আপাতত থেমেছে। এই চুক্তি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার অংশ। এর আওতায় ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে, বন্দি ও জিম্মি বিনিময়ের প্রস্তুতি চলছে এবং মানবিক সহায়তা পাঠানো বেড়েছে।
তবে গাজার মানবিক পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষে ভুগছে, সংক্রামক রোগ দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো মৃতদেহ উদ্ধার চলছে। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের বড় অংশ ঘরে ফিরলেও অবকাঠামো ধ্বংসের কারণে অনেক এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা প্রায় ৬৮ হাজার, আহতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার—যা যুদ্ধ-পূর্ব জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও বেশি। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় দেশগুলো যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানাচ্ছে, তবে ভূমি নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণ বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
সেনা প্রত্যাহার
ইসরায়েলি বাহিনী প্রাথমিকভাবে ‘ইয়েলো লাইন’ সীমারেখা পর্যন্ত সরে গেছে। এতে কিছু এলাকা ছেড়ে দিলেও গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা নিরাপত্তা বাফার জোন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেইত হানুন, রাফাহ ও ফিলাডেলফি করিডোরসহ কিছু এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। প্রায় ২০০ সদস্যের একটি বহুজাতিক পর্যবেক্ষক দল—যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কিন্তু মার্কিন সেনা ছাড়া—মিসর, কাতার, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবে।
১২ অক্টোবর দুপুর পর্যন্ত বড় কোনো লঙ্ঘনের খবর পাওয়া যায়নি। তবে দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু হয়; এতে একজন নিহত ও সাতজন আহত হয়, যা আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
হামাস তাৎক্ষণিক নিরস্ত্রীকরণ প্রত্যাখ্যান করেছে। সংগঠনের নেতা মুসা আবু মারজুক বলেন, ‘ইসরায়েলি দখলে থেকে ফিলিস্তিনিরা অস্ত্র ছাড়বে না।’
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘শক্ত সামরিক ও কূটনৈতিক চাপের ফলেই এ চুক্তি সম্ভব হয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ মন্তব্য করেন, যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয়ের মুখে হামাস এই সমঝোতায় রাজি হয়েছে।
পরবর্তী ধাপে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশ এবং পরে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। গাজাকে নিরস্ত্রীকরণ করা, সশস্ত্র অবকাঠামো ধ্বংস এবং একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠন করা হবে—যা ‘বোর্ড অব পিস’ নামে পরিচিত হবে। এটি ট্রাম্প ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। হামাস এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে না, তবে যারা সহিংসতায় জড়িত নয় তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা থাকবে।
চুক্তিতে জোর দেওয়া হয়েছে— কোনো জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি হবে না। পুনর্গঠন কার্যক্রম ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অধীনে পরিচালিত হবে।
মানবিক পরিস্থিতি
যুদ্ধবিরতির ফলে জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে, তবে গাজার সংকট এখনো ভয়াবহ অবস্থায় রয়ে গেছে। ইউনিসেফ এই পরিস্থিতিকে বলেছে ‘দুই বছরের বিভীষিকার পর বহুল প্রতীক্ষিত এক ক্ষীণ আশার আলো।’ ২০২৫ সালের আগস্টে গাজার কয়েকটি এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়। এতে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ ‘ক্ষুধা, নিঃস্বতা ও মৃত্যুর’ ঝুঁকিতে পড়ে।
খাদ্যভাণ্ডার ধ্বংস, সহায়তা অবরোধ ও অবকাঠামো ভেঙে পড়ায় পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও জনাকীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রের কারণে বিভিন্ন রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধবিরতির আগে প্রয়োজনীয় সহায়তার মাত্র ২০ শতাংশই গাজায় পৌঁছেছিল।
বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ ট্রাক খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও জরুরি সরঞ্জাম নিয়ে গাজায় প্রবেশ করছে। এসব সরবরাহ কেরেম শালোম ও রাফাহ সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে। রাফাহ ১৫ অক্টোবর থেকে পালাক্রমে যাতায়াতের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার জন্য তিন মাসের খাদ্য মজুত রেখেছে। তারা প্রথমে দুর্ভিক্ষপ্রবণ এলাকায় সরবরাহ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ইউনিসেফ ১৩ অক্টোবর থেকে পূর্ণ মাত্রায় সহায়তা বিতরণ শুরু করবে এবং সব সীমান্ত দ্রুত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থার মুখপাত্র টেস ইঙ্গ্রাম বলেন, ‘এখন দেরি করার সুযোগ নেই।’
যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ইসরায়েলি সংস্থা ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ সমালোচনার মুখে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই একে ‘মারাত্মক ফাঁদ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, কারণ সহায়তা নিতে আসা মানুষদের আইডিএফের গুলির ঝুঁকিতে পড়তে হতো। এখন থেকে জাতিসংঘের নেতৃত্বে নতুনভাবে সহায়তা কার্যক্রম চলবে।
যুদ্ধবিরতির পর পাঁচ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি উত্তর গাজা ও গাজা সিটিতে ফিরে এসেছে। হাজারো মানুষ উপকূলীয় সড়ক ধরে উত্তরমুখী হচ্ছে এবং নেতজারিম করিডোরের বাধা ভেঙে প্রবেশ করছে। খান ইউনুস ও গাজা সিটির ধ্বংসস্তূপে পরিবারগুলো হারানো ঘরবাড়ির সন্ধান করছে, বহু মাস পর বুলডোজার দিয়ে ধ্বংসাবশেষ সরানো হচ্ছে।
তবে এই প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গাজা সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, শুধু ১২ অক্টোবরই ধ্বংসস্তূপ থেকে ১০০টির বেশি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অনেক স্থানে অজানা বিস্ফোরক ও আইডিএফের উপস্থিতির কারণে উদ্ধারকর্মীরা যেতে পারছেন না। আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবু সালমিয়া বলেন, ‘অনেক এলাকায় জীবনের কোনো চিহ্ন নেই, সবকিছু মুছে গেছে।’
জাতিসংঘের হিসাবে, বর্তমানে গাজার মাত্র ২০ শতাংশ হাসপাতাল আংশিকভাবে কার্যকর। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও অক্সফাম যুদ্ধবিরতিকে ‘প্রাণ রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ’ বলে বর্ণনা করেছে, তবে তারা সতর্ক করেছে—নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার না থাকলে পরিস্থিতি আবারও বিপর্যস্ত হতে পারে।
যুদ্ধ গাজায় নজিরবিহীন ধ্বংস ডেকে এনেছে। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৬৮২ জন নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৩ জন আহত হয়েছেন। গাজার মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও বেশি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, যাদের মধ্যে ৬৪ হাজার শিশু আহত বা নিহত। ‘কস্টস অব ওয়ার’ প্রকল্পের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষ, রোগ ও অবকাঠামো ধসে পরোক্ষ মৃত্যু এই সংখ্যা দ্বিগুণ করতে পারে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলায় ইসরায়েলি পক্ষেও প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত ও কয়েক হাজার আহত হয়। শুরুতে ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল, এখনো ৪৮ জন বন্দি রয়েছেন।
ধ্বংসের মাত্রা প্রায় পূর্ণাঙ্গ। ইসরায়েলি বিমান ও স্থল অভিযানে গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে বলে জানায়, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর)। তবে আল-জাজিরার প্রতিবেদন মতে, গাজার ৯২ শতাংশ আবাসিক ভবন এবং ৮৮ শতাংশ বাণিজ্যিক ভবন ইসরায়েল ধ্বংস করেছে।
পানীয়জলের উৎস, হাসপাতাল ও কৃষিজমি ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। ইউএনআরডব্লিউএর ২৫ সেপ্টেম্বর–১ অক্টোবর এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রায় ৭২৩ দিনের সংঘাতে গাজার ৯০ শতাংশ মানুষ অন্তত একবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
পুনর্গঠনের সম্ভাব্য ব্যয় কয়েক শত বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াতে পারে, যদিও এখনো কোনো স্পষ্ট তহবিলের ঘোষণা নেই।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
যুদ্ধবিরতি এখনো টিকে আছে, তবে পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। হামাসের নিরস্ত্রীকরণে অস্বীকৃতি, ইসরায়েলের ৫৩ শতাংশ ভূমিতে দখল বজায় রাখা এবং সময়সূচির অস্পষ্টতা—সব মিলিয়ে চুক্তি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। আগের ব্যর্থ যুদ্ধবিরতির অভিজ্ঞতাও এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে সম্পৃক্ত না করার অবস্থান এবং লেবাননে ইসরায়েলি হামলার ঘটনা আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে। গাজার সাধারণ মানুষ এখনো সন্দেহে আচ্ছন্ন। স্থানীয় বাসিন্দা হানিন মুসার ভাষায়, ‘আমরা বেঁচে আছি, কিন্তু ন্যায়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই।’ তবু অনেকে আশা করছেন, এই যুদ্ধবিরতি পুনর্গঠনের নতুন পথ খুলে দিতে পারে।
ধারাবাহিক ত্রাণ সহায়তা ও যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের সফল আলোচনাই দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ এবং বাস্তুচ্যুতদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রধান শর্ত। তবে মূল রাজনৈতিক প্রশ্ন—রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও স্বাধীনতার সমাধান ছাড়া—এই সহিংসতার চক্র আবারও ফিরে আসতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায়, ‘সব পক্ষই এখন ক্লান্ত যুদ্ধ থেকে।’ কিন্তু গাজার ধ্বংসস্তূপে নতুন জীবন ফিরিয়ে আনতে হলে দ্রুত, ন্যায্য ও টেকসই উদ্যোগ জরুরি, যা এই সাময়িক বিরতিকে স্থায়ী শান্তিতে রূপ দিতে পারে।
সূত্র: আল-জাজিরা
আফগান তালেবান সরকার স্বীকার করেছে যে তারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর একাধিক স্থানে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। এসব হামলা আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় ঘটে।
৫ ঘণ্টা আগেটানা ভারী বর্ষণের ফলে সৃষ্ট বন্যা ও ভূমিধসে মেক্সিকোতে অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরও অনেকে।
১৮ ঘণ্টা আগেএ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার (২০২৫) ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। ভেনেজুয়েলার বিরোধী নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো পুরস্কার পেয়েছেন ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে সাহসী অবস্থান’-এর জন্য। নিঃসন্দেহে নিকোলাস মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ।
২১ ঘণ্টা আগে১৯৪৮ সালের আল-নাকবার পর শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেওয়া এবং বড় হওয়া লাখ লাখ ফিলিস্তিনির মতো, আমার জীবনের কাহিনীতেও সংগ্রাম আর টিকে থাকার কয়েকটি অধ্যায় আছে। আমাদের প্রজন্ম একভাবে সৌভাগ্যবান ছিল। ফিলিস্তিনের সেই হারানো গ্রামগুলোতে যারা থাকত, তাদের গল্প শুনে বড় হয়েছি আমরা। তারা নিজের গ্রামের প্রতিটি গাছ, প্
২১ ঘণ্টা আগে