leadT1ad

রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্বের জেরে গিনি বিসাউতে আবারও সেনা অভ্যুত্থান

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১১: ৫৭
গিনি-বিসাউ প্রেসিডেন্সির সামরিক অফিসের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডেনিস কানহা বুধবার ক্ষমতা নেওয়ার ঘোষণা দেন। ছবি: এএফপি।

পশ্চিম আফ্রিকার ছোট দেশ গিনি-বিসাউ আবারও সামরিক অভ্যুত্থানের কবলে। দেশটি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মাদক পাচারের সমস্যায় জর্জরিত। গত ২৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট উমারো সিসোকো এমবালো ও বিরোধী প্রার্থী ফার্নান্দো দিয়াস—দুজনেই আগেভাগে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেন। এর পরপরই সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থান ঘটায়। তারা প্রেসিডেন্ট ও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে। নির্বাচন স্থগিত করা হয় এবং সীমান্ত ও চলাচলের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।

পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হলেও শান্ত রয়েছে এবং এখনো কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। গিনি-বিসাউয়ের দীর্ঘ অভ্যুত্থানের ইতিহাসে এটি আরেকটি নতুন অধ্যায়, যা সরকারব্যবস্থার দুর্বলতা, দুর্নীতি এবং বহিরাগত প্রভাবের সমস্যাকে আবার সামনে এনেছে।

প্রায় ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশ গিনি-বিসাউকে জাতিসংঘ বহুবার ‘নার্কো-স্টেট’ বা ‘মাদক রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। লাতিন আমেরিকা থেকে ইউরোপে যাওয়া কোকেন পাচারের প্রধান রুটগুলোর একটি হলো এই দেশ। ২৩ নভেম্বরের নির্বাচন এমবালোকে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে পারত, যা দেশটির ইতিহাসে বিরল ঘটনা। তবে আনুষ্ঠানিক ফল প্রকাশের আগেই দুপক্ষ নিজেদের বিজয় দাবি করায় উত্তেজনা বাড়ে।

বুধবার (২৬ নভেম্বর) হঠাৎ অভ্যুত্থান ঘটে যায়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জানায় যে তারা ‘সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ গ্রহণ করেছে। রাজধানী বিসাউয়ের সরকারি ভবনের কাছে গুলির শব্দ শোনা যায়, কিন্তু অভ্যুত্থানটি দ্রুত সম্পন্ন হয় এবং সামান্য প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

২৬ নভেম্বর দুপুররে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের কাছে টানা গুলির শব্দ শোনা যায়। মানুষ আতঙ্কে আশপাশ এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডেনিস এন’কানহা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হাজির হন। সশস্ত্র সদস্যদের পরিবেষ্টনে তিনি ‘হাই মিলিটারি কমান্ড ফর দ্য রিস্টোরেশন অব অর্ডার’ বা ‘শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের উচ্চ সামরিক কমান্ড’ গঠনের ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্ট এমবালোকে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয়।

এরপর দ্রুত সীমান্ত বন্ধ করা হয়। সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি হয়। রাজধানীজুড়ে চেকপোস্ট বসানো হয়। গণমাধ্যম বন্ধের চেষ্টা করা হয় এবং ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করা হয়। এমবালো এক ফোন সাক্ষাৎকারে তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়া নিশ্চিত করেন। পরে সেনাবাহিনী আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে। কারফিউ চলাকালে রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে এবং সেনারা টহল দিতে থাকে।

মূল খেলোয়াড় ও উদ্দেশ্য

অভ্যুত্থানটি পরিচালনা করে সেনাবাহিনীর ভিন্নমতাবলম্বী অংশ, যার নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল এন’কানহা। তিনি বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার ‘চলমান ষড়যন্ত্র’ প্রতিরোধ করতেই অভ্যুত্থান করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে রাজনীতিবিদ, দেশীয় ও বিদেশি মাদককারবারী এবং নির্বাচনী কারচুপির পরিকল্পনা জড়িত।

২০২০ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট এমবালোকে তার বিরোধীরা স্বৈরাচারী প্রবণতার অভিযোগ করে আসছিলেন। বিরোধী পক্ষ দাবি করে, তার মেয়াদ ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ফার্নান্দো দিয়াস এবং পিএআইজিসি দলের নেতা ডোমিঙ্গোস সিমোয়েস পেরেরাও এই সংকটের কেন্দ্রে ছিলেন।

অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য মূলত নির্বাচনী জালিয়াতি ঠেকানো এবং মাদক-দুর্নীতি মোকাবেলা—এমনটি বলা হলেও অনেকে সন্দেহ করছেন এটি প্রেসিডেন্ট এমবালোর নিজেরই ‘পরিকল্পিত অভ্যুত্থান’ হতে পারে।

অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন স্থগিত, ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব এবং সীমান্ত বন্ধ হওয়ার কারণে মানুষ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। তবুও এখন পর্যন্ত কোনো বড় ধরনের সহিংসতা বা মৃত্যু ঘটেনি। উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের কারণে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ইকোওয়াস ও আফ্রিকান ইউনিয়নের পর্যবেক্ষকদের অনেকেই সীমান্ত বন্ধ থাকায় দেশে আটকা পড়েছেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জ

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি সংযম ও আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ইকোওয়াস, আফ্রিকান ইউনিয়ন, পর্তুগাল ও কাতার—সবাই অভ্যুত্থানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বন্দিদের মুক্তি এবং নির্বাচন পুনরায় চালুর দাবি উঠেছে।

দেশটির অর্থনীতি অনুন্নত, এবং জনগণের বেশিরভাগ দিনে ২ ডলারের কম আয়ে জীবনযাপন করে। সীমান্ত বন্ধ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মানবিক সহায়তা এবং মাদকবিরোধী কার্যক্রমকেও ব্যাহত করতে পারে।

১৯৭৪ সালে স্বাধীনতার পর থেকে গিনি-বিসাউতে অন্তত নয়বার অভ্যুত্থান বা অভ্যুত্থান-চেষ্টা হয়েছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর চার মাস ধরে বিরোধী পক্ষ ও এমবালো দুজনেই নিজেদের বিজয় দাবি করেছিলেন। মাত্র এক মাস আগেও একটি অভ্যুত্থান-চেষ্টা হয়েছিল।

মাদক পাচারের কারণে রাজনীতি ও সেনাবাহিনী প্রায়ই প্রভাবিত হয়। গত ৩০ বছরে কোনো প্রেসিডেন্ট পরপর দুই মেয়াদ সম্পন্ন করতে পারেননি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এই অভ্যুত্থানকে ‘ভুয়া’ বা মাদকচক্রের স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে বর্ণনা করছেন। ইকোওয়াস দ্রুত বৈঠক ডাকতে পারে। আন্তর্জাতিক মহল গণতান্ত্রিক স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাচ্ছে।

তথসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা, বিবিসি

Ad 300x250

সম্পর্কিত