leadT1ad

কিছু মানুষ কেন কাঁদতে পারে না

এমনও অনেক মানুষ আছেন যারা গভীর দুঃখ, কষ্ট বা মানসিক আঘাতে চাইলেও কাঁদতে পারেন না। কিন্তু কেন এমন হয়? এই বিষয়টিকে শারীরবৃত্তীয়, মানসিক ও সামাজিক নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ রয়েছে।

অমিত বাপি বিশ্বাস
অমিত বাপি বিশ্বাস

স্ট্রিম গ্রাফিক

ছোটবেলার কথা। বাবার নতুন কেনা নকিয়া ১১০০ মডেলের মোবাইলে বিশ্বখ্যাত সেই ‘স্নেক’ গেম খেলছিলাম। খেলতে খেলতে হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল। ব্যাপক টেকসই মোবাইলটির অবশ্য তেমন কিছু হলো না। কিন্তু আমার ওপর দিয়ে রীতিমতো তাণ্ডব চলল। ঘটনার আকস্মিকতায় এমন হতভম্ব হয়েছিলাম যে অন্যসময় মৃদু বকাঝকাতেও কেঁদে ভাসালেও, এবারে বেদম প্রহারেও কান্না পেল না। একটু বড় হয়ে মনে প্রশ্ন তৈরি হলো, ঘটনাটি কি গোলমেলে ছিল? কেন কাঁদতে পারিনি তখন? কিন্তু এখন বুঝি, এভাবে ‘কান্না করতে না পারা’ অস্বাভাবিক নয়।

মা-বাবার বকাঝকা বা মার, বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ, সফলতা বা ব্যর্থতায়, প্রেম কিংবা বিচ্ছেদে কাঁদেননি এমন মানুষ হয়ত খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কান্না একটি মানবিক প্রতিফলন। শুধু মানুষ নয়, অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও এই প্রবৃত্তি লক্ষ্যণীয়।

তবে এমনও অনেক মানুষ আছেন যারা গভীর দুঃখ, কষ্ট বা মানসিক আঘাতে চাইলেও কাঁদতে পারেন না। কিন্তু কেন? এই বিষয়টিকে শারীরবৃত্তীয়, মানসিক ও সামাজিক নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ রয়েছে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও কাঁদতে না পারা মূলত শরীর, স্নায়ু বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতার ফল। যদি কেউ দীর্ঘদিন ধরে অনুভব করেন যে তাঁর কান্না আসে না অথচ ভেতরে কষ্ট জমে আছে, তবে এটি শারীরিক বা মানসিক অসামঞ্জস্যের ইঙ্গিত।

মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় কাঁদতে না পারা

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অনেক সময় মানুষ কাঁদতে না পারার পেছনে কাজ করে মানসিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (সাইকোলজিক্যাল ডিফেন্স মেকানিজম)। অনেক ক্ষেত্রে, শৈশব থেকেই আমাদের শেখানো হয়, কান্না মানে দুর্বলতা। পুরুষদের ক্ষেত্রে পরিবার বা সমাজের বার্তা, ‘ছেলেরা কাঁদে না’। আর ‘বড় মানুষের কাঁদা মানায় না’ এটা তো প্রচলিত সার্বজনীন বার্তা। এসব অনেকের মনের গভীরে গেঁথে যায়।

ফলে কিছু মানুষের মস্তিষ্ক এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে যায় যে আবেগ এলেও তা প্রকাশের আগেই থেমে যায়। মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে এভাবে দমন করার অভ্যাস অনেক সময় কান্না বন্ধ করে দিতে পারে।

এছাড়াও ‘অ্যালেক্সিথিমিয়া’ নামক মানসিক অবস্থার কারণে মানুষ নিজের অনুভূতিগুলো ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। এমন অবস্থা হলে মানুষ বুঝতে পারে যে কিছু একটা হচ্ছে তাঁর ভেতরে, কিন্তু সেটা দুঃখ, রাগ, না ভয়--সেটা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে কান্নার মতো আবেগপ্রকাশ ঘটে না, কারণ মস্তিষ্কই সঠিকভাবে অনুভূতিটা চিহ্নিত করতে পারে না।

আবার ট্রমা বা মানসিক আঘাতের প্রভাবও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। যারা জীবনে বড় ধরনের ট্রমা বা ক্ষতির মধ্যে দিয়ে গেছেন, যেমন হঠাৎ প্রিয়জন হারানো, নির্যাতন বা দীর্ঘকালীন মানসিক যন্ত্রণা। তাঁদের অনেকের মস্তিষ্ক প্রায়শই ‘নাম্ব’ বা অসাড় হয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় ‘ইমোশনাল নাম্বলিং’। এটি মস্তিষ্কের একটি আত্মরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া। ব্যক্তি যাতে আরও বেশি কষ্ট অনুভব না করে তাই এমনটা হয়।

কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ডিপ্রেশন বা উদ্বেগজনিত সমস্যা থাকলেও অনেকের কান্না আসেনা। প্রচলিত ধারণায় অনেকে মনে করেন যে ডিপ্রেশনে মানুষ সারাক্ষণ কাঁদে। কিন্তু বাস্তবে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে বিপরীত হয়। তাঁরা শূন্যতা, অচেতনতা অথবা ভেতরে ক্লান্তি অনুভব করে, যা কান্নাকে অবরুদ্ধ করে দেয়।

তবে হরমোন আর স্নায়ুতন্ত্রের ভূমিকাও উপেক্ষা করা যায় না। ‘অশ্রুগ্রন্থি’ (ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ডস) এবং মস্তিষ্কের 'লিম্বিক সিস্টেম' আবেগনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত। কর্টিসল বা সেরোটোনিনের মতো হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে আবেগপ্রকাশ প্রভাবিত হতে পারে। ।

অনেক ক্ষেত্রে, শৈশব থেকেই আমাদের শেখানো হয়, কান্না মানে দুর্বলতা। পুরুষদের ক্ষেত্রে পরিবার বা সমাজের বার্তা, ‘ছেলেরা কাঁদে না’। আর ‘বড় মানুষের কাঁদা মানায় না’ এটা তো প্রচলিত সার্বজনীন বার্তা। এসব অনেকের মনের গভীরে গেঁথে যায়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় কান্না করতে না পারা

চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, ‘কাঁদতে না পারা’ শুধুমাত্র মানসিক নয়, এটি শারীরবৃত্তীয়, স্নায়বিক ও হরমোনজনিত কারণেও হতে পারে। কান্না এক ধরনের জটিল জৈবিক প্রতিক্রিয়া (বায়োলজিক্যাল রেসপন্স), যেখানে মস্তিষ্ক, স্নায়ু, হরমোন এবং অশ্রুগ্রন্থি একসাথে কাজ করে। এই প্রক্রিয়ার যেকোনো স্থানে সমস্যা তৈরি হলে, মানুষ মানসিকভাবে দুঃখ পেলেও শারীরিকভাবে কাঁদতে পারে না।

অশ্রুগ্রন্থির (ল্যাক্রিমাল গ্লান্ড) সমস্যা

মানব চোখে অশ্রু উৎপন্ন করে যে গ্রন্থি, তাকে বলা হয় ল্যাক্রিমাল গ্লান্ড। এটি চোখের ওপরের দিকে থাকে এবং আবেগজনিত বা প্রতিক্রিয়াজনিত অশ্রু তৈরি করে। যদি এই গ্রন্থি প্রদাহ, সংক্রমণ বা জন্মগত ত্রুটির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে চোখে অশ্রু তৈরি হয় না বা খুব কম হয়। এই অবস্থা ‘একুইস টিয়ার ডিফিসিয়েন্সি’ নামে পরিচিত।

স্ট্রিম গ্রাফিক
স্ট্রিম গ্রাফিক

স্নায়ুতন্ত্রের (নার্ভাস সিস্টেম) অস্বাভাবিকতা

কান্না নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম, বিশেষ করে অ্যাসিগডালা, হাইপোথ্যালামাস, এবং ব্রেইনস্টেম। এগুলো আবেগ অনুভব ও প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত। যদি স্নায়ুতন্ত্রে কোনো ক্ষতি হয়—যেমন মাথায় আঘাত, স্ট্রোক, পারকিনসনস ডিজিজ বা মাল্টিপল স্ক্লোরোসিস, তাহলে মস্তিষ্ক আবেগের সংকেত চোখে পাঠাতে পারে না, ফলে অশ্রু নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়।

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা

হরমোন, বিশেষ করে প্রোল্যাক্টিন, অক্সিটোসিন, ও সেরোটোনিন, আবেগজনিত কান্নায় বড় ভূমিকা রাখে। প্রোল্যাক্টিনের মাত্রা বেশি থাকলে মানুষ সহজে কাঁদে, কম থাকলে আবেগ প্রকাশ কঠিন হয়। সেরোটোনিনের অভাব (যা সাধারণত ডিপ্রেশনে দেখা যায়) আবেগপ্রবণতা কমিয়ে দেয়। আবার কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) দীর্ঘমেয়াদে বেশি থাকলে মস্তিষ্ক ‘শীতল’ প্রতিক্রিয়া দেখায়—যা এক ধরনের মানসিক অসাড়তা। এটি কান্না করার সক্ষমতা বন্ধ করে দেয়।

ওষুধের প্রভাব

কিছু ওষুধ, বিশেষত অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট (এসএসআরআই), বেটা-ব্লকার, বা ট্র্যাঙ্কুইলাইজার শ্রেণির ওষুধ, আবেগীয় প্রতিক্রিয়া কমিয়ে দেয়। এগুলো মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার (যেমন সেরোটোনিন, ডোপামিন) এর ভারসাম্য বদলে ফেলে। এর ফলে মানুষ আবেগ অনুভব করলেও কাঁদার তাগিদ পায় না।

মানব চোখে অশ্রু উৎপন্ন করে যে গ্রন্থি, তাকে বলা হয় ল্যাক্রিমাল গ্লান্ড। এটি চোখের ওপরের দিকে থাকে এবং আবেগজনিত বা প্রতিক্রিয়াজনিত অশ্রু তৈরি করে। যদি এই গ্রন্থি প্রদাহ, সংক্রমণ বা জন্মগত ত্রুটির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে চোখে অশ্রু তৈরি হয় না বা খুব কম হয়। এই অবস্থা ‘একুইস টিয়ার ডিফিসিয়েন্সি’ নামে পরিচিত।

বয়স এবং শারীরিক পরিবর্তন

বয়স বাড়লে অশ্রুগ্রন্থির কার্যক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে মেনোপজ-পরবর্তী নারীদের হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ‘ড্রাই আই সিনড্রোম’ দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় আবেগ থাকলেও চোখে জল আসে না।

অবচেতন স্নায়বিক দমন (নিউরোলজিক্যাল ইনহিবিশন)

মস্তিষ্ক কখনো দুঃখজনিত অতিরিক্ত চাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ‘ইমোশন সাপ্রেশন’ মোডে চলে যায়। এটি স্বয়ংক্রিয়, স্নায়বিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ফলে দুঃখ অনুভূত হলেও মস্তিষ্ক অশ্রুগ্রন্থিকে সক্রিয় করে না। এটি একপ্রকার জৈবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা, যা দীর্ঘ মানসিক চাপের ফল হতে পারে।

অর্থাৎ চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও কাঁদতে না পারা মূলত শরীর, স্নায়ু বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতার ফল। যদি কেউ দীর্ঘদিন ধরে অনুভব করেন যে তাঁর কান্না আসে না অথচ ভেতরে কষ্ট জমে আছে, তবে এটি শারীরিক বা মানসিক অসামঞ্জস্যের ইঙ্গিত।

তাহলে কাঁদতে না পারা মানুষের কী হবে?

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কান্না আসলে একটি স্বাস্থ্যকর মুক্তি (ইমোশনাল রিলিজ), যা মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। কিন্তু যারা কাঁদতে পারেন না, তাঁদের জন্য বিকল্প প্রকাশের পথ জরুরি। যেমন নিজের অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া, সেগুলো ভাষায় বা সৃষ্টিশীল উপায়ে প্রকাশ করা। নিজেকে সময় দেওয়া আর নিজের অনুভূতিকে স্বীকার করাই হতে পারে সমাধান।

এর উপায় হতে পারে লেখা, চিত্রাঙ্কন, গান বা কাউকে মনের কথা বলা। যদি দীর্ঘদিন ধরে মনে হয় আবেগ জমে আছে কিন্তু প্রকাশ পাচ্ছে না, তাহলে একজন মনোবিশ্লেষক বা থেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বলা উচিত।

আবার অনেক সময় কাঁদতে না পারাকে খারাপ চোখে দেখা হয়। এমনটা করা উচিত নয়। যদি কেউ কাঁদতে না পারে, তার মানে এই নয় যে সে অনুভব করে না; বরং হিতে পারে তাঁর অনুভূতি এত গভীর বা চাপা যে প্রকাশের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত