.png)

মারুফ ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধের একজন কিংবদন্তী সেক্টর কমান্ডার হয়েও ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই সামরিক আদালতে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছিল তাঁকে। তিনি কর্নেল তাহের। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নিঃসঙ্কচিত্তের বীর, বিপ্লবী ও ট্র্যাজিক হিরো।
কর্নেল তাহেরের জীবন, আদর্শ ও দুর্ভাগ্যজনক পরিণতিকে কেন্দ্র করে লেখক শাহাদুজ্জামান লিখেছেন তাঁর জনপ্রিয় আখ্যান ‘ক্রাচের কর্নেল’। এই উপন্যাসটি নিছক জীবনী নয়; এটি ইতিহাস, মিথ এবং ব্যক্তিগত স্বপ্নভঙ্গের এক জটিল দার্শনিক বিশ্লেষণ। উপন্যাসের পাতায় পাতায় উঠে এসেছে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী চিন্তা, ৭ নভেম্বরের অস্পষ্টতা এবং তাঁর পরিবারের ওপর নেমে আসা অমোঘ নিয়তির ছায়া।
ক্রাচের কর্নেলকে বলা হচ্ছে বায়োফিকশন। অর্থাৎ এটি পুরোপুরি ফিকশন নয়, পুরোপুরি বায়োগ্রাফিও নয়, আবার পুরোপুরি নন-ফিকশনও নয়। যাইহোক, বইটিতে লেখক অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিক ও গবেষণামূলক ভঙ্গিতে কর্নেল তাহেরের জীবন, রাজনীতি এবং মৃত্যু বিশ্লেষণ করেছেন।
উপন্যাসটি শুরু হয় লুৎফা নামের এক নারীর দাঁড়িয়ে থাকা দিয়ে, যাঁর স্বামীর নাম আবু তাহের। সেই তাহের, যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা সত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্ব দেন এবং এক ভয়াবহ যুদ্ধে তাঁর বাম পা হারান। পরে সেই আহত পা-ই তাঁকে এনে দেয় ‘ক্রাচের কর্নেল’ উপাধি। ক্রাচটি যেন হয়ে ওঠে তাঁর ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং বিপ্লবী আদর্শের প্রতীক।
মুক্তিযুদ্ধের পর তাহের সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে এসে সেনাবাহিনীর ভেতরের শ্রেণী বৈষম্য ও ঔপনিবেশিক কাঠামো দেখে হতাশ হন তাহের। তিনি প্রচলিত সামরিক ব্যবস্থা ভেঙে ‘শ্রেণী-সংগ্রামের সেনাবাহিনী’ বা ‘পিপলস আর্মি’ গড়ার বিপ্লবী ডাক দেন। শুরু হয় আদর্শগত দ্বন্দ্ব।
এই আদর্শগত দ্বন্দ্বই তাঁকে শেষে পর্যন্ত সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর নিতে বাধ্য করে। এরপর তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর গণবাহিনী শাখার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ‘শ্রেণী-শত্রু’ খতমের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সশস্ত্র সংগ্রামে নামেন।
এরপর উপন্যাসের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক ডামাডোল। ওই বছরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতার বিপ্লব বা পাল্টা অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী ভূমিকা এবং তাঁর চরম পরিণতি—সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার ও ফাঁসি। এসবই এই উপন্যাসের মূল ক্যানভাস।
এই ক্যানভাসে আমরা দেখতে পাই, ৭ই নভেম্বরের ঘটনা কর্নেল তাহেরের জীবনে এক অনিবার্য নিয়তি নিয়ে আসে। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতা নিলে তাহের ও জাসদের গণবাহিনী সুযোগটি কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার হাতবদল ঘটিয়ে একটি বৈপ্লবিক ভিত্তি স্থাপন করা। শাহাদুজ্জামান লিখেছেন—‘তাহের ভেবেছিলেন, খালেদ মোশাররফের ক্যুর পর যে ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়েছে, সেই ফাঁকা মাঠকে তিনি ব্যবহার করবেন বৈপ্লবিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি সেনাবাহিনীকে তার শ্রেণী-চরিত্র বদলানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে থাকবে না কোনো অফিসার-সিপাহীর ভেদাভেদ। সিপাহীদের বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গকেই তিনি চেয়েছিলেন বৈপ্লবিক আগুনে রূপান্তরিত করতে।’
৭ নভেম্বর তাহেরের নির্দেশেই সিপাহীরা বিদ্রোহ করে এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। জিয়ার মুক্তিতে তাহেরের ভূমিকা ছিল এক রাজনৈতিক জুয়া খেলা। তাহের মনে করেছিলেন, জিয়ার জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে এবং সিপাহী বিদ্রোহকে পুঁজি করে তিনি পিপলস আর্মির স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন। শাহাদুজ্জামান ক্রাচের কার্নেলে লিখছেন, তাহের এই সময়ে আবেগপ্রবণ ও কিছুটা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন—‘আসলে ৭ নভেম্বর তাহেরের জন্য ছিল এক ‘‘উন্মোচনের রাত’’। কিন্তু তিনি বুঝতেই পারেননি যে, যে সিপাহীদের তিনি আদর্শের কথা বলে জাগিয়ে তুলেছেন, তারা আসলে সাম্যবাদ চায়নি, তারা চেয়েছিল বকেয়া বেতন, ভালো খাবার আর অফিসারদের অত্যাচার থেকে মুক্তি।’
অন্যদিকে জিয়া সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন নিষ্ঠাবান অফিসার ছিলেন মেজর জিয়া। বিশেষ সন্ধিক্ষণে পক্ষ ত্যাগ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাহেরের নেতৃত্বে সংঘটিত ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর তাহের জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করলে ঘটনাচক্রে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চের একজন প্রধান কুশীলব হিসেবে আভির্ভূত হন। বলা বাহুল্য, পঁচাত্তরের ওই নাটকীয় ঘটনা পর্বের আগে সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে জিয়ার জীবনে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নজির নেই।
যাইহোক, জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পরই বুঝতে পারেন, তাহেরের উদ্দেশ্য নিছক ক্ষমতা হস্তান্তর নয়, বরং সেনাবাহিনীর কাঠামো ভেঙে দেওয়া। তাই জিয়াউর রহমান দ্রুত তাহেরকে পাশ কাটিয়ে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। তারপর তো ইতিহাসের মোড়ই ঘুরে গেল।
কর্নেল তাহেরের আদর্শের প্রতি তাঁর পরিবারের যে অবিচল সমর্থন ছিল, তা এই উপন্যাসের একটি মর্মস্পর্শী দিক। তাঁর স্ত্রী লুৎফা তাহের, তাঁর ভাই-বোন এবং আত্মীয়স্বজন সকলেই তাহেরের বিপ্লবী স্বপ্ন ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপের নীরব সাক্ষী ছিলেন। ছোটবেলায় ১০ ভাইবোনের সংসারে বড় হয়েছেন তাহের। মা আশরাফুন্নেসা প্রতিটি সন্তানকে আগলে আগলে বড় করেছেন। বাবা মহিউদ্দিন আহমেদের ছিল রেলের চাকরি। স্টেশনে স্টেশনে বদলি হতেন তিনি। কে ভেবেছিল, এমন এক আটপৌড়ে পরিবারের সন্তানই একদিন ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাবেন?
তাহেরের ফাঁসির পর তাই এই পরিবারটি শুধু একজন স্বজনকে হারায়নি, তারা একটি বিপ্লবী স্বপ্ন হারিয়েছে। তারা রাষ্ট্রের চোখে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ কলঙ্ক বহন করেছে। লুৎফা তাহের এবং তাঁর ভাই-বোনেরা পরবর্তীকালে তাহেরের বিচারকে ‘ঠান্ডা মাথার খুন’ আখ্যা দিয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন।
শাহাদুজ্জামানের উপন্যাসে পরিবারটির যন্ত্রণা এবং তাহেরের প্রতি তাদের গভীর বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন—‘তাহেরের পরিবার জানতো, এই মানুষটি আদর্শের জন্য বাঁচেন, আদর্শের জন্যই মরবেন। কিন্তু তারা প্রস্তুত ছিলেন না রাষ্ট্রের এমন নির্মম ঔপনিবেশিক বিচারের জন্য। তাহেরের ক্রাচটা হয়তো ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু তাঁর আদর্শের ক্রাচটি পরিবারের সদস্যরা ধরে রেখেছিলেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।’
আজ গোটা বাংলাদেশ জানে, ৭ নভেম্বরে তাহের এক ঐতিহাসিক ঝুঁকিপূর্ণ বাজি ধরেছিলেন। সেই বাজিতে তিনি হেরে গেছেন। আর তাঁর হারের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক প্রভাব আরও সুদৃঢ় হয়েছিল, যদিও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সামরিক প্রভাব দূর করা। তাঁর হারের মাধ্যমে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, যারা তাহেরের সমাজতান্ত্রিক ও সামরিক কাঠামোর সংস্কারের ঘোর বিরোধী ছিল, তারাই জয়ী হয়েছে।
কর্নেল তাহেরের জীবন এক গভীর প্রশ্ন রেখে যায়—একটি আদর্শিক বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা কি কখনো রাষ্ট্রের ক্ষমতাকেন্দ্রিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে জিততে পারে? ক্রাচের কর্নেল আবু তাহেরের জীবন তাই বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই অন্ধকার সন্ধিক্ষণকে তুলে ধরে, যেখানে বিপ্লবী স্বপ্ন এবং কঠোর সামরিক বাস্তবতা একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত স্বপ্নই পরাজিত হয়েছিল।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

মুক্তিযুদ্ধের একজন কিংবদন্তী সেক্টর কমান্ডার হয়েও ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই সামরিক আদালতে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছিল তাঁকে। তিনি কর্নেল তাহের। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নিঃসঙ্কচিত্তের বীর, বিপ্লবী ও ট্র্যাজিক হিরো।
কর্নেল তাহেরের জীবন, আদর্শ ও দুর্ভাগ্যজনক পরিণতিকে কেন্দ্র করে লেখক শাহাদুজ্জামান লিখেছেন তাঁর জনপ্রিয় আখ্যান ‘ক্রাচের কর্নেল’। এই উপন্যাসটি নিছক জীবনী নয়; এটি ইতিহাস, মিথ এবং ব্যক্তিগত স্বপ্নভঙ্গের এক জটিল দার্শনিক বিশ্লেষণ। উপন্যাসের পাতায় পাতায় উঠে এসেছে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী চিন্তা, ৭ নভেম্বরের অস্পষ্টতা এবং তাঁর পরিবারের ওপর নেমে আসা অমোঘ নিয়তির ছায়া।
ক্রাচের কর্নেলকে বলা হচ্ছে বায়োফিকশন। অর্থাৎ এটি পুরোপুরি ফিকশন নয়, পুরোপুরি বায়োগ্রাফিও নয়, আবার পুরোপুরি নন-ফিকশনও নয়। যাইহোক, বইটিতে লেখক অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিক ও গবেষণামূলক ভঙ্গিতে কর্নেল তাহেরের জীবন, রাজনীতি এবং মৃত্যু বিশ্লেষণ করেছেন।
উপন্যাসটি শুরু হয় লুৎফা নামের এক নারীর দাঁড়িয়ে থাকা দিয়ে, যাঁর স্বামীর নাম আবু তাহের। সেই তাহের, যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা সত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্ব দেন এবং এক ভয়াবহ যুদ্ধে তাঁর বাম পা হারান। পরে সেই আহত পা-ই তাঁকে এনে দেয় ‘ক্রাচের কর্নেল’ উপাধি। ক্রাচটি যেন হয়ে ওঠে তাঁর ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং বিপ্লবী আদর্শের প্রতীক।
মুক্তিযুদ্ধের পর তাহের সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে এসে সেনাবাহিনীর ভেতরের শ্রেণী বৈষম্য ও ঔপনিবেশিক কাঠামো দেখে হতাশ হন তাহের। তিনি প্রচলিত সামরিক ব্যবস্থা ভেঙে ‘শ্রেণী-সংগ্রামের সেনাবাহিনী’ বা ‘পিপলস আর্মি’ গড়ার বিপ্লবী ডাক দেন। শুরু হয় আদর্শগত দ্বন্দ্ব।
এই আদর্শগত দ্বন্দ্বই তাঁকে শেষে পর্যন্ত সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর নিতে বাধ্য করে। এরপর তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর গণবাহিনী শাখার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ‘শ্রেণী-শত্রু’ খতমের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সশস্ত্র সংগ্রামে নামেন।
এরপর উপন্যাসের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক ডামাডোল। ওই বছরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতার বিপ্লব বা পাল্টা অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী ভূমিকা এবং তাঁর চরম পরিণতি—সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার ও ফাঁসি। এসবই এই উপন্যাসের মূল ক্যানভাস।
এই ক্যানভাসে আমরা দেখতে পাই, ৭ই নভেম্বরের ঘটনা কর্নেল তাহেরের জীবনে এক অনিবার্য নিয়তি নিয়ে আসে। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতা নিলে তাহের ও জাসদের গণবাহিনী সুযোগটি কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার হাতবদল ঘটিয়ে একটি বৈপ্লবিক ভিত্তি স্থাপন করা। শাহাদুজ্জামান লিখেছেন—‘তাহের ভেবেছিলেন, খালেদ মোশাররফের ক্যুর পর যে ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়েছে, সেই ফাঁকা মাঠকে তিনি ব্যবহার করবেন বৈপ্লবিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি সেনাবাহিনীকে তার শ্রেণী-চরিত্র বদলানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে থাকবে না কোনো অফিসার-সিপাহীর ভেদাভেদ। সিপাহীদের বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গকেই তিনি চেয়েছিলেন বৈপ্লবিক আগুনে রূপান্তরিত করতে।’
৭ নভেম্বর তাহেরের নির্দেশেই সিপাহীরা বিদ্রোহ করে এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। জিয়ার মুক্তিতে তাহেরের ভূমিকা ছিল এক রাজনৈতিক জুয়া খেলা। তাহের মনে করেছিলেন, জিয়ার জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে এবং সিপাহী বিদ্রোহকে পুঁজি করে তিনি পিপলস আর্মির স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন। শাহাদুজ্জামান ক্রাচের কার্নেলে লিখছেন, তাহের এই সময়ে আবেগপ্রবণ ও কিছুটা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন—‘আসলে ৭ নভেম্বর তাহেরের জন্য ছিল এক ‘‘উন্মোচনের রাত’’। কিন্তু তিনি বুঝতেই পারেননি যে, যে সিপাহীদের তিনি আদর্শের কথা বলে জাগিয়ে তুলেছেন, তারা আসলে সাম্যবাদ চায়নি, তারা চেয়েছিল বকেয়া বেতন, ভালো খাবার আর অফিসারদের অত্যাচার থেকে মুক্তি।’
অন্যদিকে জিয়া সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন নিষ্ঠাবান অফিসার ছিলেন মেজর জিয়া। বিশেষ সন্ধিক্ষণে পক্ষ ত্যাগ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাহেরের নেতৃত্বে সংঘটিত ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর তাহের জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করলে ঘটনাচক্রে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চের একজন প্রধান কুশীলব হিসেবে আভির্ভূত হন। বলা বাহুল্য, পঁচাত্তরের ওই নাটকীয় ঘটনা পর্বের আগে সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে জিয়ার জীবনে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নজির নেই।
যাইহোক, জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পরই বুঝতে পারেন, তাহেরের উদ্দেশ্য নিছক ক্ষমতা হস্তান্তর নয়, বরং সেনাবাহিনীর কাঠামো ভেঙে দেওয়া। তাই জিয়াউর রহমান দ্রুত তাহেরকে পাশ কাটিয়ে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। তারপর তো ইতিহাসের মোড়ই ঘুরে গেল।
কর্নেল তাহেরের আদর্শের প্রতি তাঁর পরিবারের যে অবিচল সমর্থন ছিল, তা এই উপন্যাসের একটি মর্মস্পর্শী দিক। তাঁর স্ত্রী লুৎফা তাহের, তাঁর ভাই-বোন এবং আত্মীয়স্বজন সকলেই তাহেরের বিপ্লবী স্বপ্ন ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপের নীরব সাক্ষী ছিলেন। ছোটবেলায় ১০ ভাইবোনের সংসারে বড় হয়েছেন তাহের। মা আশরাফুন্নেসা প্রতিটি সন্তানকে আগলে আগলে বড় করেছেন। বাবা মহিউদ্দিন আহমেদের ছিল রেলের চাকরি। স্টেশনে স্টেশনে বদলি হতেন তিনি। কে ভেবেছিল, এমন এক আটপৌড়ে পরিবারের সন্তানই একদিন ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাবেন?
তাহেরের ফাঁসির পর তাই এই পরিবারটি শুধু একজন স্বজনকে হারায়নি, তারা একটি বিপ্লবী স্বপ্ন হারিয়েছে। তারা রাষ্ট্রের চোখে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ কলঙ্ক বহন করেছে। লুৎফা তাহের এবং তাঁর ভাই-বোনেরা পরবর্তীকালে তাহেরের বিচারকে ‘ঠান্ডা মাথার খুন’ আখ্যা দিয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন।
শাহাদুজ্জামানের উপন্যাসে পরিবারটির যন্ত্রণা এবং তাহেরের প্রতি তাদের গভীর বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন—‘তাহেরের পরিবার জানতো, এই মানুষটি আদর্শের জন্য বাঁচেন, আদর্শের জন্যই মরবেন। কিন্তু তারা প্রস্তুত ছিলেন না রাষ্ট্রের এমন নির্মম ঔপনিবেশিক বিচারের জন্য। তাহেরের ক্রাচটা হয়তো ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু তাঁর আদর্শের ক্রাচটি পরিবারের সদস্যরা ধরে রেখেছিলেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।’
আজ গোটা বাংলাদেশ জানে, ৭ নভেম্বরে তাহের এক ঐতিহাসিক ঝুঁকিপূর্ণ বাজি ধরেছিলেন। সেই বাজিতে তিনি হেরে গেছেন। আর তাঁর হারের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক প্রভাব আরও সুদৃঢ় হয়েছিল, যদিও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সামরিক প্রভাব দূর করা। তাঁর হারের মাধ্যমে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, যারা তাহেরের সমাজতান্ত্রিক ও সামরিক কাঠামোর সংস্কারের ঘোর বিরোধী ছিল, তারাই জয়ী হয়েছে।
কর্নেল তাহেরের জীবন এক গভীর প্রশ্ন রেখে যায়—একটি আদর্শিক বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা কি কখনো রাষ্ট্রের ক্ষমতাকেন্দ্রিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে জিততে পারে? ক্রাচের কর্নেল আবু তাহেরের জীবন তাই বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই অন্ধকার সন্ধিক্ষণকে তুলে ধরে, যেখানে বিপ্লবী স্বপ্ন এবং কঠোর সামরিক বাস্তবতা একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত স্বপ্নই পরাজিত হয়েছিল।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
.png)

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গতিপথ নির্ধারণী দিন। এ দিন সিপাহী-জনতার বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। সেই সময়ে ৮ নভেম্বরের সংবাদপত্রের সব খবর ছিল তাঁকে ঘিরেই।
৭ ঘণ্টা আগে
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গতিপথ নির্ধারণী দিন। এ দিন সিপাহী-জনতার বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন, নিহত হন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ। ঘটনাপ্রবাহের অন্যতম নায়ক কর্নেল আবু তাহেরের জন্য অপেক্ষা করছিল এক করুণ পরিণতি।
১০ ঘণ্টা আগে
গভীর রাতে ঘুমিয়ে আছেন গ্রিক পুরাণের চরিত্র তরুণ মেলাম্পাস। তাঁর পাশে রাখা একটি পুরোনো লাঠি। আর বিছানার নিচে কিছু ভেষজপাতা। হঠাৎ করে ঘরের ঢুকে দুটি সাপ। মেলাম্পাস ঘুমন্ত, কিছুই টের পাননি। সাপ দুটি নিঃশব্দে এসে তাঁর কানে লালা ঘষে দেয়, যেন সাপ তার সন্তানদের আদর করছেন।
১ দিন আগে
আজ অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের জন্মদিন। ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি পেয়েছিলেন ‘মুকুটহীন নবাব’ উপাধি। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রায় ৩৫০ ছবিতে অভিনয় করেছেন। আমরা কি তাঁকে মনে রেখেছি?
১ দিন আগে