leadT1ad

৭ নভেম্বরের নায়কেরা কে কোথায়?

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১১: ৪৬
৭ নভেম্বরের মূল চরিত্র তিনজন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান, জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের এবং সাবেক ক্ষণস্থায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল খালেদ মোশাররফ। স্ট্রিম গ্রাফিক

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গতিপথ নির্ধারণী দিন। এ দিন সিপাহী-জনতার বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন, নিহত হন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ। ঘটনাপ্রবাহের অন্যতম নায়ক কর্নেল আবু তাহেরের জন্য অপেক্ষা করছিল এক করুণ পরিণতি। এই দিনের কুশীলব বা নায়কেরা আজ কে কোথায়—সেই বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায়, সময় ও রাজনীতির স্রোতে তাঁদের অবস্থান ও আদর্শের ঘটেছে আমূল পরিবর্তন। কেউ হারিয়ে গেছেন কালের গর্ভে, আর কেউ কেউ বৈপ্লবিক চেতনা বিসর্জন দিয়ে মিশে গেছেন প্রচলিত ক্ষমতার রাজনীতিতে।

কেন্দ্রীয় চরিত্রদের পরিণতি

৭ নভেম্বরের প্রধান তিন চরিত্রের দুজন—জিয়াউর রহমান এবং কর্নেল আবু তাহের আজ বেঁচে নেই। আরেক চরিত্র খালেদ মোশাররফ বিপ্লবের দিনই নিহত হন। জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দীদশা থেকে মুক্ত করার মূল কারিগর ছিলেন জাসদ নেতা ও গণবাহিনীর প্রধান কর্নেল আবু তাহের। জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতাকে ব্যবহার করে জাসদ একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন দ্রুতই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র সদস্যরা যখন ‘সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ স্লোগান তুলে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে, তখন জিয়াউর রহমান এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং নিজের ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য তিনি জাসদ ও কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন।

এর ফলশ্রুতিতে, যে তাহের জিয়াকে মুক্ত করেছিলেন, সেই তিনিই জিয়ার শাসনামলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই গোপন সামরিক আদালতে বিচারের মাধ্যমে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যদিও ২০১১ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্ট এই বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং তাহেরকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল বলে রায় দেয়। অন্যদিকে, জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আদর্শের অবক্ষয় ও রাজনৈতিক মেরুকরণ

৭ নভেম্বরের বিপ্লবের পেছনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) যে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল, তা সময়ের ব্যবধানে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। দলটির তৎকালীন নেতারা, যারা ছিলেন এই বিপ্লবের অগ্রসেনানী, তারা পরবর্তীকালে নিজেদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন।

জাসদের অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান। ছবি: উইকিপিডিয়া
জাসদের অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান। ছবি: উইকিপিডিয়া

জাসদের অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান, যিনি ‘দাদাভাই’ নামে পরিচিত এবং জাসদ গঠনের নেপথ্যের কারিগর ছিলেন, তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতির রহস্য পুরুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে কারাভোগের পর তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন এবং ২০২৩ সালের ৯ জুন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু যেন জাসদের বৈপ্লবিক রাজনীতির একটি অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটায়।

যারা একসময় কর্নেল তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং ‘তাহের হত্যাকারী’ হিসেবে জিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাদের একটি বড় অংশ পরবর্তীতে ক্ষমতার হিস্যা পেতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এই দুই শিবিরে আশ্রয় নেন। এই বিভাজন ৭ নভেম্বরের আদর্শিক মৃত্যুকে স্পষ্ট করে তোলে।

আওয়ামী লীগ শিবিরে যাঁরা: ৭ নভেম্বরের অন্যতম কুশীলব এবং জাসদের তৎকালীন নেতা হাসানুল হক ইনু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গণবাহিনীর আরেক নেতা শাজাহান খানও আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এমনকি কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল আওয়ামী লীগের সাংসদ নির্বাচিত হন। এই ঘটনা ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের চেতনার সঙ্গে এক চরম পরিহাস। যারা একসময় আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করে জাসদ গঠন করেছিলেন এবং একে প্রতিবিপ্লবী শক্তি মনে করতেন, তারাই পরবর্তীতে সেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদার হন।

জাসদের তৎকালীন নেতা হাসানুল হক ইনু। ছবি: ইউকিপিডিয়া
জাসদের তৎকালীন নেতা হাসানুল হক ইনু। ছবি: ইউকিপিডিয়া

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর গ্রেপ্তার হন ইনু। তাঁর বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে। একইভাবে শাজাহান খানও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি। জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী থানার সাজেদুর রহমান ওমর হত্যা মামলায় আসামী হিসেবে তার বিচার চলছে।

বিএনপি ও বিরোধী শিবিরে যাঁরা: জাসদের আরেক প্রভাবশালী নেতা আ স ম আবদুর রব প্রথমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী হলেও পরবর্তীতে বিএনপি-ঘনিষ্ঠ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতায় পরিণত হন। জাসদের ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পর দল থেকে বেরিয়ে ভিন্ন ধারার রাজনীতিতে যুক্ত হন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং আবদুস সালামও একসময় জাসদের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

গণবাহিনীর নেতা ছিলেন শাজাহান খান। ছবি: বাসসের সৌজন্যে
গণবাহিনীর নেতা ছিলেন শাজাহান খান। ছবি: বাসসের সৌজন্যে

জাসদের বহুধাবিভক্তি ও বর্তমান অবস্থা

সময়ের পরিক্রমায় জাসদ নিজেও তার ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি। আদর্শিক দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের সংঘাত এবং ক্ষমতার রাজনীতির নানা সমীকরণে দলটি বর্তমানে একাধিক খণ্ডে বিভক্ত। মূল ধারার জাসদ (ইনু), জেএসডি (রব) এবং বাংলাদেশ জাসদ (আম্বিয়া) নামে দলটির বিভিন্ন অংশ এখন সক্রিয়। একসময়ের বিপ্লবী দলটি পরে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ছোট শরিকে পরিণত হয়েছে, যার আদর্শিক ভিত্তি প্রায় বিলুপ্ত।

জাসদের আরেক প্রভাবশালী নেতা আ স ম আবদুর রব। ছবি: উইকিপিডিয়া
জাসদের আরেক প্রভাবশালী নেতা আ স ম আবদুর রব। ছবি: উইকিপিডিয়া

৭ নভেম্বরের নায়কদের বর্তমান অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের বিপ্লবী আগুন বহু আগেই নিভে গেছে। ক্ষমতার লড়াইয়ে জিয়াউর রহমান বিজয়ী হলেও তাকেও জীবন দিতে হয়েছে। কর্নেল তাহের জীবন দিয়ে বিপ্লবের প্রতি তার অবিচল আস্থার প্রমাণ রেখেছেন, কিন্তু তার সহযোদ্ধারা সেই আদর্শকে ধরে রাখতে পারেননি। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়ে যে নেতারা সেদিন তরুণদের রাজপথে নামিয়েছিলেন, তারা পরে সুবিধাজনকভাবে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ৭ নভেম্বর তাই এখন আর কোনো একক দলের ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ বা ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান’ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনীতির আদর্শহীনতা, বিভেদ ও ক্ষমতার পালাবদলের এক জটিল আখ্যান হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে।

নায়কেরা হারিয়ে গেছেন, বদলে গেছেন, কিন্তু তাদের তৈরি করা অধ্যায় রয়ে গেছে অমীমাংসিত এবং বিতর্কিত।

Ad 300x250

সম্পর্কিত