leadT1ad

জোহরান মামদানি: ‘কমিউনিস্ট’ না ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট

রাতুল আল আহমেদ
রাতুল আল আহমেদ

প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ২৩: ৪৮
স্ট্রিম গ্রাফিক

নিউইয়র্কের মেয়র পদে জিতেছেন জোহরান মামদানি। এর পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে চায়ের টং, সবখানেই তাঁকে নিয়ে কথা হচ্ছে। আধুনিক সময়ে নিউইয়র্কের সবচেয়ে কম বয়সী মেয়র হওয়ার পাশাপাশি মামদানি প্রথম মুসলমান ও দক্ষিণ এশীয় মেয়রও বটে।

তবে, এসবের পাশাপাশি আলোচনার শিরোনামে উঠে আসছে মামদানির রাজনৈতিক চিন্তাধারাও। নিজেকে ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট’ হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকেন মামদানি। অনেকের কাছেই এই মতাদর্শ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। বিপত্তি আরও বেড়েছে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্রমাগত মামদানিকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে গেছেন।

এছাড়াও, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজমের পাশাপাশি ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ প্রত্যয়টি নিয়েও অনেকের মধ্যে তৈরি হয়েছে অস্পষ্টতা।

তবে রাজনৈতিক ইতিহাস, সংগঠনের বৈশিষ্ট্য, মতাদর্শের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও অর্থনীতিবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ও ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম প্রত্যয় দুটি কেবল শব্দের খেলা নয়। এই দুটো একই রকম মতাদর্শ থেকে জন্ম নিয়েও সময়ের সঙ্গে ভিন্ন পথে বিকশিত হয়েছে।

এই দুই মতই গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা ও শ্রমিকশ্রেণির সুরক্ষা, এগুলোর পক্ষে। তবে ঠিক কী পরিবর্তন করতে চায়, কীভাবে তা অর্জন করতে চায়, এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা কার হাতে ন্যস্ত হওয়া উচিত, এ প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে আলাদা অবস্থান গ্রহণ করে সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ও ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম।

ঐতিহাসিক বিবর্তন

উনবিংশ শতকের ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে জন্ম নেয় সোশ্যাল ডেমোক্রেসি। প্রথম দিকে এই শব্দটি মূলত বিপ্লবী থেকে সংস্কারবাদী ‘সমাজতন্ত্রের সব ধারা’কে বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। তখন সোশ্যাল ডেমোক্র‍্যাট এবং সোশ্যালিস্ট, এ দুইটি শব্দ প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হতো। সেই সময়কার সোশ্যাল ডেমোক্রেট দলগুলো, যেমন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জার্মানি সুস্পষ্টভাবেই একটি মার্ক্সীয় আর্দশের একটি দল ছিল। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রাখত।

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব এই ধারার ভেতরে বড় বিভাজন তৈরি করে। একদিকে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লবী পথ, অন্যদিকে পশ্চিম ইউরোপের সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে সংস্কারবাদী ও গণতন্ত্রকেন্দ্রিক পথ। এই সময় থেকেই সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ধীরে ধীরে বিপ্লবপন্থী না হয়ে ভোটের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক ধারা হিসেবে গড়ে ওঠে। এ মতাদর্শ সমাজতন্ত্র চায় গণতান্ত্রিকভাবে ও ধীরে ধীরে সংস্কারের মাধ্যমে।

বলা চলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়টি সোশ্যাল ডেমোক্রেসির জন্য একটি ক্লান্তি লগ্ন। পশ্চিম ইউরোপে ওয়েলফেয়ার স্টেট, বা কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের সময় সোশ্যাল ডেমোক্রেট দলগুলো সেখানকার মূল রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বেকারভাতা, পেনশন, শ্রমিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় মালিকানা, ইত্যাদি নীতির মাধ্যমে তারা পুঁজিবাদের ওপর সুস্পষ্ট নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু এই সময়েও সোশ্যাল ডেমোক্রেসির চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে ‘পুঁজিবাদের অবসান’ নীতিবাক্যটি লেখা থাকত।

১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ভেতর আবার পরিবর্তন আসে। এই সময় থেকেই তারা ‘পুঁজিবাদ প্রতিস্থাপন নয়, বরং মানবিক সংস্কার’—এ নীতি বেছে নেয়। ১৯৯০-এর পরের সোশ্যাল ডেমোক্রেসি তাই আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে না। তাদের লক্ষ্য এখন ‘সামাজিক ন্যায়ের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ’। টনি ব্লেয়ারের থার্ড ওয়ে, বা জার্মান এসপিডির ‘ন্যুয়ে মিত’ এর রাজনৈতিক রূপ এটিই।

ফলে আজ সোশ্যাল ডেমোক্রেসি বলতে বোঝায়—মুক্তবাজার অর্থনীতি+শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ+কল্যাণমূলক ব্যবস্থা+ব্যক্তিমালিকানা।

অপর দিকে ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজম কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে না। তারা গণতান্ত্রিক উপায়ে পুঁজিবাদকে প্রতিস্থাপন করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

ফ্যাবিয়ান সোসাইটি, এডুয়ার্ড বার্নস্টাইন, কার্ল কাউৎসকি, জ্যঁ জোরেসের মতো সংস্কারপন্থী থেকে শুরু করে রোজা লুক্সেমবার্গের মতন বিপ্লবপন্থী, নানা ধারার সমাজতন্ত্রী এ ধারণার বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও একটি বিষয়ে ঐকমত্য ছিল স্পষ্ট। আর তা হলো — সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র দুটোই অপরিহার্য।

ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজম সোভিয়েত ধরনের একদলীয় রাষ্ট্র ও ‘রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাজতন্ত্র’কে শুরু থেকেই খারিজ করেছে। একইসঙ্গে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির মতো ‘মানবিক পুঁজিবাদ’ এও বিশ্বাস করতে রাজি নয় তারা। ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজমের কেন্দ্রে আছে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র। অর্থাৎ শুধু ভোট বা রাজনৈতিক গণতন্ত্র নয়, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও মালিকানা জনগণের হাতে দেওয়া। তাই ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজমে যেসব ধারণা দেখা যায়— তা হলো শ্রমিক সমবায়, শ্রমিকদের পরিচালনা, সামাজিক মালিকানা, অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি।

পুঁজিবাদ নিয়ে মতাদর্শিক পার্থক্য

সোশ্যাল ডেমোক্রেসি পুঁজিবাদকে অত্যাবশকীয়ভাবে খারাপ বলে মনে করে না। এর মতে, সমস্যা হলো এর ‘বেআইনি, অশাসিত, অনৈতিক’ দিকগুলো। তাই সমাধান হিসেব সোশ্যাল ডেমোক্রেসির দেখানো পথ হলো—ট্যাক্স বৃদ্ধি, কল্যাণনীতি, নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক অধিকার, জনসেবার মতন ব্যবস্থার মাধ্যমে পুঁজিবাদকে ‘মানবিক’ করা।

পরদিকে, ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজমর মতে, পুঁজিবাদ কেবল অন্যায্য নয় বরং এটি গণতন্ত্রবিরোধীও। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত উৎপাদন, সম্পদ, এবং কর্মসংস্থান নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় একটি ক্ষুদ্র মালিকশ্রেণি, ততক্ষণ ‘রাজনৈতিক গণতন্ত্র’ বাস্তবে অসম্পূর্ণ। তাই ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজম চায় শুধু ভোটাধিকার নয়, অর্থনৈতিক ক্ষমতার গণতন্ত্রও।

অর্থাৎ মোদ্দাকথা : সোশ্যাল ডেমোক্রেসি বলে পুঁজিবাদ রাখো, কিন্তু নিয়ন্ত্রিতভাবে। ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজম বলে পুঁজিবাদ হটিয়ে গণতান্ত্রিক মালিকানা গড়ো।

রাষ্ট্র, বাজার, এবং মালিকানা কার হাতে

সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ব্যক্তিমালিকানা ও মুক্তবাজারব্যবস্থা মেনে নেয়। তবে তা আইন, ট্যাক্স, নিয়ন্ত্রণ ও কল্যাণনীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত রাখে। তবে ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজম বাজার বা প্রতিযোগিতা পুরোপুরি বাতিল করবে কি না, এ নিয়ে বিভিন্ন মত আছে, কিন্তু তারা একমত যে উৎপাদনের উপায় ব্যক্তিমালিকানা নয়, সামাজিক মালিকানায় থাকা উচিত।

সোশ্যাল ডেমোক্রেসিতে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। অপরদিকে ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজমে রাষ্ট্র কখনো ‘রূপান্তরকারী, কখনো ‘সহায়ক’। তারা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাজতন্ত্রও পছন্দ করে না।

ব্যবহারিক উদাহরণ বনাম আদর্শিক লক্ষ্য

আজকের উত্তর ইউরোপের নর্ডিক দেশগুলো সোশ্যাল ডেমোক্রেসির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তারা পুঁজিবাদী, কিন্তু কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিক থেকে শক্তিশালী। তবে ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজমের পূর্ণ রাষ্ট্রীয় উদাহরণ আজ নেই। কিন্তু স্থানীয় ও আন্দোলনের পর্যায়ে আছে। যেমন সিরিয়ার রোজাভার সামাজিক অর্থনীতি। কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিএসএ আন্দোলন, জোহরান মামদানি যার একটি সক্রিয় সদস্য।

কেন গুলিয়ে ফেলা হয়?

কারণ দুটোই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, দুটোই জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা সমর্থন করে, দুটোই ডানপন্থী মুক্তবাজারপন্থার বিরোধী। এই কারনে অনেকের কাছে তাদের লক্ষ্য এক মনে হয়। কিন্তু সোশ্যাল ডেমোক্রেসি পুঁজিবাদে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ যোগ করতে চায়। আর ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজম ‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঘাড় থেকে পুজিবাদের ভূত তাড়াতে চায়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত