যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে রেকর্ড ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন স্বঘোষিত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী জোহরান মামদানি। মামদানি শহরের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র, প্রথম ভারতীয়-উগান্ডান বংশোদ্ভূত এবং সবচেয়ে তরুণ মেয়র। এই বিজয় ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতরেও একটি নতুন ধারা সূচিত করেছে।
ইসরায়েলের বাইরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইহুদি জনসংখ্যা বসবাস করে নিউইয়র্ক সিটিতে। গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মামদানির জয় ঐতিহাসিক ঘটনা। তাই তাঁর বিজয়কে সমর্থকদের অনেকে দেখছেন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ধারণার পুনর্জাগরণ হিসেবে, যা তথাকথিত ‘ইসরায়েল ফার্স্ট’ রাজনীতির প্রতিবাদ।
নির্বাচন চলাকালে ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলো কুয়োমোকে সমর্থন দেয় এবং মামদানিকে ‘হামাস সমর্থক’বলে প্রচারণা চালায়। কিন্তু এসব আক্রমণ উল্টো তাঁর পক্ষে কাজ করে। ফিলিস্তিনের প্রতি তাঁর স্পষ্ট সমর্থন তরুণ, অভিবাসী, মুসলিম ও অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। অভিবাসী, তরুণ ও প্রগতিশীলদের ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছাশক্তি নিউইয়র্কের রাজনীতিতে নতুন মাত্রার সূচনা করে।
৯/১১, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ও কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে নিউইয়র্ক এখন এমন এক মেয়রের হাতে ভবিষ্যৎ অর্পণ করেছে, যিনি বৈষম্য দূর করে আর্থ-সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক শহর গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মামদানির বিজয়ের পটভূমি
মামদানির জয় ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীল অংশের জন্য বড় সাফল্য। তাঁর সমাজতান্ত্রিক নীতি—ভাড়া স্থির রাখা, গণপরিবহন বিনামূল্যে করা এবং ধনীদের ওপর কর আরোপ করে সার্বজনীন শিশু যত্ন সুবিধা—এসব ভোটারদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। অনেক ভোটার ‘পরিচয়ের রাজনীতি’ থেকে সরে এসে নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃঢ় অবস্থানকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।
মামদানির মূল বার্তা ছিল—‘জীবন এত কঠিন হওয়ার কথা নয়’—সরকারের দায়িত্ব নাগরিকদের জীবন সহজ করা।’ এই স্পষ্ট বার্তা এবং সামাজিক মাধ্যমে উদ্ভাবনী প্রচারণা ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি আকর্ষণ করেছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, শ্রমজীবী নিউইয়র্কবাসীর জীবনযাত্রার ব্যয় কমাবেন।
মামদানি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমর্থন পান। তিনি ব্রুকলিন ও কুইন্সের মধ্যবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত শ্বেত ভোটারদের বিপুল সমর্থন পান। পাশাপাশি এশীয় ও মুসলিম ভোটারদের মধ্যেও গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। চীনা ভোটার ও হিস্পানিক ভোটারদের আস্থা অর্জন করেন।
প্রতিদ্বন্দ্বী কুয়োমো নিজের দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাকে বড় করে দেখিয়েছেন যে মামদানির রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা কম। কিন্তু মামদানি সেটিকেই শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির চ্যালেঞ্জার হিসেবে উপস্থাপন করেন। এই ‘বিকল্পধারার’ আবেদন প্রচলিত রাজনীতিতে ক্লান্ত ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলে।
মামদানি সাংবাদিকদের পরিবর্তে কনটেন্ট নির্মাতা ও সোশ্যাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্সারদের নিয়ে বিশেষ প্রেস কনফারেন্স আয়োজন করেন। এতে লাখো দর্শক যুক্ত হন লাইভ সম্প্রচারে। হঠাৎ করে এলজিবিটিকিউ বারে হাজির হন, ডিজে বুথ থেকে বক্তব্য দেন। এমনকি ফক্স নিউজেও বিজ্ঞাপন চালান। তার টিম সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে অবিরাম ভিডিও তৈরি করে। এর মধ্যে ছিল জীবনযাত্রার ব্যয়ে হতাশ হয়ে ট্রাম্পকে সমর্থন দেওয়া ভোটারদের সাক্ষাৎকার। ভিডিওগুলো অনূদিত হয় বাংলা, স্প্যানিশ ও আরবি ভাষায়।
মামদানি সচেতনভাবে আগে নিষ্ক্রিয় থাকা বাংলাদেশি ও ভারতীয় এলাকা, মুসলিম ভোটার, এবং বহুভাষিক অভিবাসী সম্প্রদায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতি, বলিউডের রেফারেন্স, হিন্দি-বাংলা কনটেন্ট ও সাংস্কৃতিক প্রতীক ব্যবহার করে তিনি এই সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে এক মানবিক সংযোগ তৈরি করেন। মামদানির প্রচারণা প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে শক্তিশালী উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে স্পষ্টভাবে কুয়োমোকে সমর্থন দিয়ে মামদানিকে আক্রমণ করেন। তাকে ‘পাগল কমিউনিস্ট’ এবং ‘বিপর্যয়ের পূর্বাভাস’ বলে অভিহিত করেন। ট্রাম্প হুমকি দেন, মামদানি জয়ী হলে তিনি নিউইয়র্কে ফেডারেল তহবিল বন্ধ করে দেবেন।
কিন্তু মামদানি একটুও পিছু হটেননি। তিনি ট্রাম্পের বক্তব্যকে কাজে লাগিয়ে বলেন, তিনি সাধারণ নিউইয়র্কবাসীর পক্ষে লড়ছেন, ক্ষমতাবানদের পক্ষে নয়। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বনাম ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ আন্দোলনের মধ্যে এই লড়াই ভবিষ্যতেও জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।
শুধু প্রগতিশীল এলাকাতেই নয়, মামদানি জয় পেয়েছেন মধ্যপন্থী ও মিশ্র জনপদেও। এসব জায়গায় সাধারণত প্রগতিশীল প্রার্থীরা জনপ্রিয় নন। ইহুদি-অধ্যুষিত এলাকা, দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়, তরুণ পেশাজীবী ও শ্রমজীবী পরিবার—সবখানেই তিনি বিশ্বাসযোগ্য পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। মামদানি তরুণ ভোটারদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছেন। এই জয় নতুন আদর্শিক সংগ্রামের সূচনা করেছে। এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবল ট্রাম্পের সঙ্গেই নয়, পুরনো ব্যবস্থার সঙ্গেও।
ফিলিস্তিন ইস্যু কি তাঁর জয়ে ভূমিকা রেখেছে?
মামদানি গাজায় ইসরায়েলের অভিযানকে ‘গণহত্যা’ বলে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। আইএমইইউ/ডেটা ফর প্রগ্রেস জরিপে দেখা গেছে, নিউইয়র্কের ৭৮ শতাংশ ভোটার গাজায় ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে দেখেছেন। মামদানির ৬৮ শতাংশ সমর্থক বলেছেন—ফিলিস্তিন ইস্যু তাঁদের ভোটের প্রধান প্রেরণা। এতে অন্তত ১৫ শতাংশ দ্বিধাগ্রস্ত ভোটার তাঁর পক্ষে যায়।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক মউইন রব্বানি বলেন, ‘একসময় ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী মনে করা হতো। এখন বাস্তবতা উল্টো। যদি আপনি ফিলিস্তিনের পক্ষে না থাকেন, সফলতা পাওয়া কঠিন।’
তাঁর অবস্থান যুদ্ধবিরোধী বহুজাতিক ও বহু ধর্মের জোটকে উদ্দীপ্ত করেছে। জুইশ ভয়েস ফর পিস-এর মতো প্রগতিশীল ইহুদি সংগঠনগুলো তাঁকে ‘জায়নবাদবিরোধী কিন্তু ইহুদি বিদ্বেষী নয়’ বলে ব্যাখ্যা করে।
তবে বুথ ফেরত জরিপে দেখা যায়, ইহুদি ভোটারদের ৬০ শতাংশ কুওমোকে ভোট দিয়েছেন, মূলত ইহুদিবিদ্বেষ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। সিএনএন মন্তব্য করে, ‘মামদানির অবস্থান ডেমোক্র্যাটদের দীর্ঘদিনের ইসরায়েলনীতি পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করছে।’
মামদানির বিজয় কি জায়নবাদী লবির পরাজয়
প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুয়োমো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর আইসিসি প্রতিরক্ষা দলে যুক্ত ছিলেন। ওপেনসিক্রেটস-এর তথ্যমতে আইপ্যাক ও সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে ২৫ লাখ ডলার অনুদান পান। মামদানির চাইতে তিনি পাঁচ গুন বেশি ব্যয় করেছেন।
মামদানির বিজয় দেখাচ্ছে যে বৈচিত্র্যময় শহুরে ভোটারদের মধ্যে ইসরায়েলপন্থী লবির প্রভাব কমছে। মামদানিকে ‘হামাস-সমর্থক’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার প্রচারণা উল্টো তরুণ ও সংখ্যালঘু ভোটারদের বিরূপ করে তোলে। জ্যাকোবিন পত্রিকা মন্তব্য করেছে, ‘ইসরায়েলি লবি বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। মামদানির জয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহুবার দেখা একই ধরণের পরাজয়েরই পুনরাবৃত্তি।’
ট্র্যাক আইপ্যাক ব্লগ লিখেছে, ‘কুয়োমো হেরেছেন—কিন্তু মামদানির বিরুদ্ধে প্রচারণা এখনো চলছে।’ মিলিয়ন ডলারের বিজ্ঞাপন প্রচারণা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ ভোটাররা বিদেশনীতি নয়, স্থানীয় সমস্যাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। টাইমস অব ইসরায়েল লিখেছে, ‘বামপন্থী, ইসরায়েল-বিরোধী প্রার্থী মামদানি জিতেছেন, ইহুদি সংগঠনগুলো পাল্টা লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে।’
ফরওয়ার্ড জানায়, কুয়োমো দাবি করেছিলেন মামদানির প্রচারণা জায়নবাদীদের মধ্যে ‘ভয় সৃষ্টি করেছে’। তাতেও কাজ হয়নি। মামদানি অর্থনৈতিক ইস্যুতে জোর দিয়ে ব্রুকলিনের গোড়া ইহুদি এলাকাতেও ৪৮–৪২ শতাংশ ভোটে এগিয়ে ছিলেন।
নাগরিক অধিকার আইনজীবী হাসান শিবলি এক্স-এ লিখেছেন, ‘মামদানির বিজয় প্রমাণ করে যে, এখন আর ইসরায়েলকে সমর্থন করা যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। সময় বদলাচ্ছে।’ জেরুজালেম পোস্ট জানিয়েছে, আরবী গণমাধ্যম এ ঘটনাকে ‘ফিলিস্তিনের পক্ষে জনসমর্থন বৃদ্ধির প্রমাণ’ হিসেবে উদযাপন করেছে।
বিশ্লেষক রুথ বেন-গিয়াত সতর্ক করেছেন, এই ফলাফল জায়নবাদী লবির দুর্বলতাকে উন্মোচিত করছে। এর ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের ওপরও ইসরায়েলকে সহায়তা কমানোর চাপ তৈরি হতে পারে। তবে ডানপন্থী মহল হাল ছাড়েনি। আইপ্যাক ঘোষণা দিয়েছে যে তারা ২০২৬ সালের নির্বাচনে প্রগতিশীল প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ১০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে।
এল্ডার স্পিচ-এর এক্স পোস্টে বলা হয়েছে, ‘মামদানির বিজয় দেখায় যে, ফিলিস্তিনের ন্যায় ও অধিকার ইস্যুতে জনসমর্থন ক্রমে বাড়ছে। সময় বদলাচ্ছে।’
মামদানির এই সাফল্য প্রমাণ করেছে যে, ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশ এখন আর রাজনৈতিক ঝুঁকি নয়। বরং তা হতে পারে সাফল্যের চালিকা শক্তি।
তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, আল-জাজিরা, বিবিসি, পিবিএস ডটওআরজি, সিএনএন, এনবিসি নিউজ, টাইমস অব ইসরায়েল, জেরুজালেম পোস্ট, দ্য নিউ আরব, ফারোয়ার্ড ডটকম