অধিকৃত পশ্চিম তীরে জলপাই সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে বেড়েছে ইসরায়েলি বসতিস্থাপনকারীদের হামলা। তারা নিয়মিতভাবে ফিলিস্তিনিদের ও তাদের গাছের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে।
এ বছরের প্রথম ছয় মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর ৭৫৭টি হামলার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এসব হামলায় মানুষ আহত হয়েছে, সম্পত্তি ও বাগান ধ্বংস হয়েছে। জলপাই গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ফসল। জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তারা এবং বিভিন্ন দেশ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
গাজায়, যেখানে একসময় নিজস্ব জলপাই শিল্প ছিল, ইসরায়েলের দুই বছরের সামরিক অভিযানে সেখানকার প্রায় সব কৃষিজমি ধ্বংস হয়েছে। নিহত হয়েছেন ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ।
এই সহিংসতা শুধু কৃষিকে নয়, ফিলিস্তিনিদের সংস্কৃতি ও অস্তিত্বকেও আঘাত করছে। জলপাই গাছ, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শান্তি, স্থিতি ও জীবিকার প্রতীক ছিল, এখন প্রতিরোধ ও ক্ষতির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ফিলিস্তিনিদের জন্য জলপাই চাষ কেন গুরুত্বপূর্ণ
ফিলিস্তিনে জলপাই চাষের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর সময় থেকেই এটি চাষ হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রিকরা জলপাই শাখাকে শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখত।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনিরা জলপাই ব্যবহার করেছে খাদ্য, ওষুধ, সাবান, প্রসাধনী এবং জ্বালানি হিসেবে। জলপাই কাঠ দিয়ে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়।
ওসমানীয় শাসনামলে (১৫১৭–১৯১৭) ফিলিস্তিনে জলপাই উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তখন এটি প্রধান রপ্তানি পণ্য হয়ে ওঠে।
বর্তমানে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূমির অর্ধেক কৃষিজমিতে জলপাই চাষ হয়। এটি তাদের সবচেয়ে অর্থকরী ফসল। ভালো মৌসুমে জলপাই রপ্তানি ফিলিস্তিনের অর্থনীতিতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার যোগ করে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, পশ্চিম তীরের প্রায় এক লাখ পরিবার জলপাই মৌসুমের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ নারী শ্রমিক।
কিন্তু জলপাই চাষ কেবল একটি কৃষিকাজ নয়—এটি ফিলিস্তিনিদের আত্মিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ।
জেনিনের কাছে জাবলুন গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আবু আল-রাব বলেন, ‘এটা শুধু একটি গাছ নয়। এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার। তাদের ইচ্ছা ছিল আমরা যেন এটি রক্ষা করি।’
ফিলিস্তিনিরা জলপাই গাছকে ‘সুমুদ’ বা ধৈর্য ও টিকে থাকার প্রতীক হিসেবে দেখে। এটি তাদের প্রতিদিনের সংগ্রামের চিহ্ন, যেমন সাম্প্রতিক গাজাগামী সমুদ্রবহরের নামেও ‘সুমুদ’ ব্যবহৃত হয়েছিল।
২৮ মার্চ ২০২৩ তারিখে ভূমি দিবসের ৪৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে ফিলিস্তিনিরা জলপাই গাছ রোপণ করছে। ছবি: এএফপি।
পশ্চিম তীরে জলপাই চাষিদের অবস্থা
ব্রিটিশ ম্যান্ডেট আমল থেকেই ফিলিস্তিনি কৃষি, বিশেষ করে জলপাই বাগান, জায়নবাদী বসতিস্থাপনকারীদের হামলার শিকার।
বর্তমানে পশ্চিম তীরে প্রায় ৭ লাখ ইসরায়েলি বাস করে। তারা ১৫০টি বসতি ও ২০০টি অবৈধ আউটপোস্ট স্থাপন করেছে। আন্তর্জাতিক আইনে এগুলো সবই অবৈধ। ইসরায়েলি আইনে অননুমোদিত আউটপোস্টও নিষিদ্ধ, কিন্তু কর্তৃপক্ষ প্রায়ই সেগুলোকে প্রশ্রয় দেয়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের আগের বছরগুলোতে পশ্চিম তীরে উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলপাই কৃষকদের ওপর হামলাও বেড়েছিল।
২০২০ সালে প্রায় ৪০ শতাংশ ফিলিস্তিনি কৃষক জানান, আগের বছর তাদের ফসল চুরি বা নষ্ট করা হয়েছে। অনেককে ফসল সংগ্রহের সময় হুমকি ও সহিংসতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
এই হামলাগুলোর সময় ইসরায়েলি সেনারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করেনি।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে যখন জলপাই সংগ্রহ শুরু হচ্ছিল, তখনই ইসরায়েলে হামাসের হামলা হয়। এরপর পশ্চিম তীরে সহিংসতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বহু জায়গায় কৃষকদের ওপর হামলা ও বাগান পোড়ানোর ঘটনা ঘটে।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক দপ্তর জানিয়েছে, অন্তত ৩৮টি ঘটনায় ইসরায়েলি সেনারা সরাসরি হামলাকারীদের সহায়তা করেছে।
অন্য অনেক ক্ষেত্রে সেনারা নিজেরাই গাছ উপড়ে ফেলেছে। ২০২৫ সালের আগস্টে আল-মুগাইয়ার গ্রামে তিন দিনের অভিযানে ১০ হাজারেরও বেশি জলপাই গাছ ধ্বংস করা হয়। এর কিছু গাছ ছিল এক শতাব্দীরও পুরোনো।
ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল আভি ব্লুথ বলেন, এসব গাছ কেটে ফেলা ‘শাস্তি হিসেবে’ করা হয়েছে, যেন কেউ ‘বসতিস্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে হাত না তোলে।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘যে গ্রাম হামলা চালাবে, তাকে বড় মূল্য দিতে হবে।’
৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের চলাচলে আরও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কৃষকদেরকে অনেক সময় মাত্র কয়েক দিনের অনুমতি দেওয়া হয়, যেখানে ফসল কাটতে লাগে কয়েক সপ্তাহ।
এর ফলে ২০২৩ সালে পশ্চিম তীরের প্রায় ২০ শতাংশ জলপাই ফসল সংগ্রহ করা যায়নি। জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের হিসাবে এতে কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার।
২০২৪ সালে হামলার সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। প্রায় ২০০টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়, যা আগের বছরের দ্বিগুণ।
এই হামলাগুলোর মধ্যে ছিল ৫৯ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি নারী হানান আবু সালামির হত্যাকাণ্ড। তিনি ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর জেনিনের কাছে নিজের পরিবারের বাগানে গিয়েছিলেন। ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে তিনি নিহত হন।
জাতিসংঘের তদন্তে নিশ্চিত করা হয়, তিনি কোনো হুমকি সৃষ্টি করেননি এবং কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই তাকে গুলি করা হয়।
২০২৫ সালের ২৫ মে অধিকৃত পশ্চিম তীরের নাবলুসের পূর্বে সালেম গ্রামে একটি জলপাই বাগানে আগুন লাগে, গ্রামবাসীরা বলেছেন ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা এই আগুন লাগায়। ছবি: এএফপি।
ইসরায়েলিরা কেন জলপাই গাছে আক্রমণ করছে
দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের জলপাই গাছে হামলা মূলত ফিলিস্তিনিদের জীবনের ওপর একটি বৃহত্তর আক্রমণের অংশ। এর লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিনিদের জীবিকা নষ্ট করা এবং ভয় দেখিয়ে তাদের জমি ছাড়তে বাধ্য করা।
ফিলিস্তিনি কৃষিকে ধ্বংসের অন্যান্য উপায়ও দেখা যাচ্ছে। কূপ ভরাট করে পানির উৎস বন্ধ করা, গবাদি পশু হত্যা, ও গ্রামীণ ঘরবাড়ি ভাঙচুর বা উচ্ছেদ করা তার উদাহরণ।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন লিকুদ জোট সরকারের অধীনে বসতি স্থাপন আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। সরকার প্রকাশ্যেই পশ্চিম তীর সংযুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই মাসেই সে জন্য একটি প্রাথমিক বিল পাস করা হয়েছে।
ইসরায়েলি আইন অনুযায়ী অবৈধ ঘোষিত কিছু বসতি ও আউটপোস্টকেও সরকার কার্যত উপেক্ষা করছে।
গাজায় জলপাই গাছের অবস্থা
ইসরায়েলের দুই বছরের সামরিক অভিযানে গাজার ১১ লাখেরও বেশি জলপাই গাছ ধ্বংস হয়েছে।
২০২৫ সালের আগস্টে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানায়, গাজার ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষিজমি বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বা চাষের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
সেই মাসেই জাতিসংঘ সমর্থিত ক্ষুধা পর্যবেক্ষণ সংস্থা (আইপিসি) ঘোষণা করে যে গাজার পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে।
যেসব জলপাই গাছ বেঁচে আছে, সেগুলো যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আর সেচ বা সার পায়নি। এফএও জানিয়েছে, ২০২৫ সালের জুলাই নাগাদ গাজার ৮৬ শতাংশ কৃষিজমিতে পানে সেচের কূয়া ধ্বংস হয়েছে।
এই ধ্বংসের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে। মানবাধিকার সংগঠন আল মিজান ইসরায়েলকে ‘ইকোসাইড’ বা পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিষাক্ত পদার্থ ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে কৃষিজমি, ভূগর্ভস্থ পানি ও খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। এতে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে।
জলপাই প্রক্রিয়াকরণ অবকাঠামো—যেমন জলপাই চূর্ণকারখানাও ধ্বংস করা হয়েছে।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে গাজার জলপাই পণ্যের রপ্তানি সীমিত করে রেখেছে, আর সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞের পর তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
ফলে ২০২৫ সালে গাজাবাসীরা টানা তৃতীয় বছরের মতো জলপাই ফসল তুলতে পারেনি। জ্বালানির অভাবে অনেকেই শুকিয়ে যাওয়া জলপাই গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে।
২০১১ সালের মার্চ মাসে পশ্চিম তীরের হেবরনের কাছে ওয়াদি আল-ঘরুসে অবস্থিত ফিলিস্তিনি কৃষি জমিতে সেচের জন্য ব্যবহৃত একটি পানির কূপ ভেঙে ফেলছে ইসরায়েলি বুলডোজার। ছবি: এএফপি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ফিলিস্তিনি জলপাই কৃষকদের ওপর বাড়তে থাকা হুমকি নিয়ে সতর্ক করেছে।
২০২৫ সালের মে মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গাজার খান ইউনিসের খুজা’য়া শহর ও তার কৃষিজমি ধ্বংসের নিন্দা জানায়।
তারা বলেছে, গাজার উর্বর কৃষিজমি ধ্বংসের এই ঘটনা ইসরায়েলের ‘খাদ্যকে যুদ্ধের অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহারের অংশ।
গণ বাস্তচ্যূতি, খাদ্য উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার বন্ধ ও ধ্বংসের মাধ্যমে ইসরায়েল এক নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, যা গাজায় গণহত্যার পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত।
জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের ফিলিস্তিন প্রধান আজিত সুংঘাইও পশ্চিম তীরে কৃষকদের ওপর বাড়তে থাকা সহিংসতার বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
২১ অক্টোবর তিনি বলেন, ‘২০২৫ সালের ফসল মৌসুমের প্রথম দুই সপ্তাহেই সশস্ত্র বসতি স্থাপনকারীরা নারী, পুরুষ, শিশু ও বিদেশি সহায়তাকর্মীদের ওপর ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে।’
তার মতে, এই সহিংসতা ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও নীরব সমর্থনে চলছে, এবং এর দায় কেউ নিচ্ছে না।
সাংস্কৃতিক দিক থেকেও জলপাই চাষ ফিলিস্তিনিদের জীবনের অংশ—এটি তাদের জীবিকা, ঐতিহ্য ও দৃঢ়তার প্রতীক।
সুংঘাই বলেন, ‘এই আক্রমণ কেবল গাছ নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা, দখল জোরদার করা ও অবৈধ বসতি সম্প্রসারণের কৌশল।’
তিনি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানান, যেন তারা ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের সুরক্ষা দিতে ও সংযুক্তিকরণ পরিকল্পনা প্রত্যাহার করতে চাপ দেয়।
তার বক্তব্যের শেষ লাইন ছিল, ‘হ্যাঁ, সবকিছুর শুরু সেই জলপাই গাছ থেকেই।’
(মিডলইস্ট আইয়ে প্রকাশিত ড্যানিয়েল টেস্টারের লেখা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ)