চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। এর মধ্য দিয়ে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের বাণিজ্য যুদ্ধের নতুন ও তীব্রতর অধ্যায়ের সূচনা হয়। এরপর থেকে এই দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি উভয় পক্ষই একে অপরের ওপর পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ করতে থাকে।
তবে গত বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) দক্ষিণ কোরিয়ায় চীনের নেতা শি জিনপিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকের পর পরিস্থিতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসে। বৈঠকে ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক ১০ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এর বিনিময়ে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিলের (সিন্থেটিক মাদক) প্রবাহ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেয়। যদিও ট্রাম্পের ১০ শতাংশ শুল্ক কমানোর পরেও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী চীনা পণ্যের ওপর কার্যকর শুল্কের হার প্রায় ৪৭ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে।
এই প্রেক্ষাপটে মূল প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের এই বাণিজ্য যুদ্ধে আসলে কারা জয়ী হচ্ছে?
তথ্য-উপাত্ত কী বলছে
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যে দফায় দফায় শুল্ক বৃদ্ধি করে। এপ্রিলের মধ্যে কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক ১২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। জবাবে চীন মার্কিন পণ্যের ওপর ১৪৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে, যা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও অনেক বিশেষজ্ঞকে অবাক করে চীনের অর্থনীতি এক প্রকার স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করেছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, সেপ্টেম্বরের ডেটা অনুযায়ী যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ২৭ শতাংশ কম। কিন্তু সামগ্রিকভাবে চীনের মোট রপ্তানি এই বছর ৬ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেপ্টেম্বরে এই বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৩%। বিভিন্ন স্বাধীন বিশ্লেষণ দাবি করছে, এর মূল কারণ হলো চীনের বাণিজ্য বহুমুখীকরণ নীতি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারানোর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চীন অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান), ইউরোপীয় ইউনিয়ন, লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে মনোযোগ দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে আসিয়ান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনের রপ্তানি যথাক্রমে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (সিএফআর) আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয়ক ফেলো জংইউয়ান জো লিউয়ের মতে, এই বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে চীন তার রপ্তানি বাজারকে সফলভাবে বহুমুখী করেছে। ফলে ওয়াশিংটনের শুল্ক আরোপের ক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। চীন এই লড়াইয়ে নিজেদের স্থিতিশীল অবস্থান ধরে রেখেছে, এমনকি জয়ের পথেও থাকতে পারে।
পণ্যের লড়াই: সয়াবিন ও গরুর মাংসের রণাঙ্গন
বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা গেছে কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সয়াবিন ও গরুর মাংসের বাণিজ্যে। একটা সময় চীন ছিল মার্কিন সয়াবিনের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। কিন্তু শুল্ক আরোপের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বাণিজ্য আলোচনার আগে, সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক টনও সয়াবিন আমদানি করেনি চীন। এর পরিবর্তে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার দিকে ঝোঁকেছে দেশটি।
একইভাবে, গরুর মাংসের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয় চীন। এই বছরের প্রথম সাত মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গরুর মাংসের আমদানি গত বছরের তুলনায় ৪৭ শতাংশ কমে গেছে। এর বিকল্প হিসেবে অস্ট্রেলিয়া এবং আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলো থেকে আমদানি বাড়িয়েছে চীন।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্রাম্প ও শি জিনপিংয়ের বৈঠকের পর এই চিত্রে পরিবর্তন এসেছে। বৈঠকের পর মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট জানান, চীন এই মৌসুমে ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং আগামী তিন বছরের জন্য প্রতি বছর ২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন মার্কিন সয়াবিন তেল কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞরা এই চুক্তিকে একটি ‘অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি’ হিসেবে অভিহিত করে বলছেন, এটি দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধানের ইঙ্গিত দেয় না।
গত বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) দক্ষিণ কোরিয়ায় চীনের নেতা শি জিনপিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকের পর বাণিজ্য যুদ্ধ কিছুটা প্রশমিত হয়। ছবি: সংগৃহীত।
বিশেষজ্ঞের চোখে বাণিজ্য যুদ্ধে কে জিতছে
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধে কোনো দেশ এগিয়ে? এমন প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই। চীনের অভ্যন্তরে এবং বাইরে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই যুদ্ধে চীন কৌশলগতভাবে এগিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করেন, এই বাণিজ্য যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়ী হচ্ছে না, বরং উভয়ই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সাংহাই-এর ফুদান ইউনিভার্সিটির চায়না ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর অধ্যাপক ঝাং ওয়েওয়ের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এই বাণিজ্য যুদ্ধে ‘শোচনীয়ভাবে পরাজিত’ হচ্ছে। তার যুক্তি হলো, মার্কিন অর্থনীতি চীনের সাপ্লাই চেইনের ওপর বেশি নির্ভরশীল, চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ততটা নয়। ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত শুল্কের ৯০ শতাংশেরও বেশি ভার চীনা রপ্তানিকারকদের নয়, বরং বহন করতে হয়েছে মার্কিন ভোক্তা ও সংস্থাগুলোকে।
সাংবাদিক মাইকেল শেরিডান তাঁর এক বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, চীনের অর্থনীতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় ও এর রপ্তানি বাজার শতাধিক দেশে বিস্তৃত। তাই কেবল মার্কিন বাজারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চীনকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। চীনের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি যেকোনো বাহ্যিক চাপ মোকাবিলায় পশ্চিমা মুক্তবাজার অর্থনীতির চেয়ে বেশি সহনশীল।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) সিনিয়র অ্যাডভাইজর স্কট কেনেডি মনে করেন, এই শুল্ক যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে নতুন করে সাজানোর বিশৃঙ্খল প্রচেষ্টা, তবে তা উভয় দেশের জন্যই ক্ষতিকর। কেনেডির মতে, সাম্প্রতিক চুক্তি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও এটি আসলে ‘অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি’ মাত্র। তার আশঙ্কা, উভয় পক্ষই খুব শীঘ্রই এই চুক্তির সীমানা পরীক্ষা করার চেষ্টা করবে এবং যা নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।
গোল্ডম্যান স্যাকস ও ইউবিএস-এর মতো সংস্থাগুলোর অর্থনৈতিক মডেলিং অনুযায়ী, মার্কিন শুল্ক চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে যেমন বাধাগ্রস্ত করছে, তেমনই পাল্টা শুল্ক এবং সাপ্লাই চেইনের অস্থিরতা মার্কিন অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অন্যদিকে জ্যাকোবিন ম্যাগাজিনের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড্যানিয়েল চেংয়ের দাবি, সাম্প্রতিক শুল্ক হ্রাস সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ‘ডি-লিংকিং’ বা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ, উভয় দেশই কৌশলগত শিল্পগুলোতে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে, যা বিশ্ব বাণিজ্যের মানচিত্রকে স্থায়ীভাবে বদলে দিতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় উভয় দেশই স্বল্পমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দীর্ঘমেয়াদে তারা নিজেদের স্বনির্ভর করার চেষ্টা করছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে শুরু হওয়া এই বাণিজ্য যুদ্ধ এখনো কোনো চূড়ান্ত ফলাফলের দিকে এগোয়নি। একদিকে, চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র শুল্কের চাপ সত্ত্বেও তার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রেখেছে এবং সফলভাবে নতুন রপ্তানি বাজার খুঁজে নিয়েছে। অন্যদিকে, সয়াবিন কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চীন আলোচনার টেবিলে তার নমনীয়তারও পরিচয় দিয়েছে।
সাপ্লাই চেইনে মারাত্মক অস্থিরতা সৃষ্টি হলেও যুক্তরাষ্ট্র কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার ফিরে পেয়েছে এবং ফেন্টানিল ইস্যুতে চীনের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে।
সুতরাং, বাণিজ্য যুদ্ধে কোন দেশ জয়ী হচ্ছে?— এই প্রশ্নের উত্তর হলো, পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ও বহুমাত্রিক আর কোনো সন্দেহ ছাড়াই এই যুদ্ধ উভয় অর্থনীতির জন্যই ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন, আল-জাজিরা, পলিটিকো, দ্য সাউথ মর্নিং পোস্ট ও প্রজেক্ট সিন্ডিকেট