স্ট্রিম ডেস্ক
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের বিষয়ে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। শিগগিরই হয়তো ভোটের আয়োজনও করা হবে। গণভোট হলো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট, যা কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব, আইন বা রাজনৈতিক বিষয়ে নেওয়া হয়। এতে নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিবর্তে নাগরিকরাই সরাসরি সিদ্ধান্ত দেন। এটি সরাসরি গণতন্ত্রের একটি উপায়। এর মাধ্যমে নাগরিকরা সংবিধান সংশোধন, নীতি পরিবর্তন বা কোনো নেতার প্রতি আস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত জানাতে পারেন।
গণভোট দুই ধরনের হতে পারে— বাধ্যতামূলক ও পরামর্শমূলক। বাধ্যতামূলক গণভোটে ফলাফল আইনগতভাবে কার্যকর হয়। সংবিধান সংশোধনের মতো বড় সিদ্ধান্তে আইনের ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই গণভোটের আয়োজন করা হয়।
পরামর্শমূলক গণভোটের ফল নীতিনির্ধারকদের জন্য নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে, অনেকটা বড় পরিসরের জনমত জরিপের মতো। সরকার, সংসদের উদ্যোগ বা জনগণের পিটিশনের ভিত্তিতে এর আয়োজন করা হতে পারে। জনগণ চাইলে নির্দিষ্ট সংখ্যক স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এ উদ্যোগ নিতে পারে।
নাগরিকদের উদ্যোগে সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মোট ভোটারের ৫–১০ শতাংশের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। গণভোট সাধারণ নির্বাচনের থেকে ভিন্ন। সাধারণ নির্বাচনে প্রতিনিধিদের নির্বাচন করা হয়, কিন্তু গণভোটে নির্দিষ্ট একটি প্রশ্নের ওপর সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়া হয়।
গণভোট আয়োজন একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে করা হয়। দেশভেদে সংবিধান, নির্বাচন আইন ও গণভোটের ধরন অনুযায়ী এর কিছু পার্থক্য থাকে। প্রক্রিয়াটি শুরু হয় কোনো উদ্যোগ বা প্রস্তাব থেকে। ভোটের বিষয় নির্ধারিত হলে পক্ষ-বিপক্ষ উভয়েই প্রচারণা চালায়। গণমাধ্যম, সমাবেশ ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে।
ভোটারদের সামনে একটি পরিষ্কার প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয়—সাধারণত ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ধরনের। নির্দিষ্ট তারিখে ভোট হয়। অনেক সময় সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গেও এটি অনুষ্ঠিত হয়, যাতে ভোটার উপস্থিতি বেশি হয়। ভোটদান হতে পারে কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে, ডাকযোগে বা ই-ভোটিং পদ্ধতিতে।
ভোট গণনা করে স্বতন্ত্র নির্বাচন কমিশন বা সংস্থা। সাধারণত ৫০ শতাংশের বেশি ভোটই সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে, তবে কিছু দেশে (যেমন সুইজারল্যান্ড বা ইতালি) ৬০ শতাংশ সমর্থন বা দ্বৈত শর্ত—অর্থাৎ ভোট ও অংশগ্রহণ উভয় ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা—প্রয়োজন হয়। ফলাফল কয়েক দিনের মধ্যেই ঘোষণা করা হয়। প্রয়োজনে পুনর্গণনা বা আইনি আপিলের সুযোগ থাকে।
গণভোট বাধ্যতামূলক হলে এর ফল তাৎক্ষণিকভাবে বা কিছু সময় পর আইনি প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। আদালত বৈধতা যাচাই করতে পারে। পরামর্শমূলক গণভোটের ক্ষেত্রে ফলাফল সরকারকে নির্দেশনা দেয়, বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না। গণভোটে কিছু চ্যালেঞ্জও থাকে—যেমন কম ভোটার উপস্থিতি, প্রশ্নের ভাষা নিয়ে বিভ্রান্তি, অথবা রাজনৈতিক বয়কট।
বাংলাদেশ খুব কম গণভোট আয়োজন করেছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসন ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে এই প্রক্রিয়া সীমিত ছিল। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধান সংশোধনের জন্য গণভোটের অনুমতি দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি জাতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে—১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে।
এই তিনটি গণভোট মূলত নেতৃত্বের বৈধতা বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার রূপ নির্ধারণে অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো সাধারণত সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন সময়ে পরিচালিত হয়েছিল, যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বৈধতা প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যায়।
১৯৯১ সালের পর আর কোনো জাতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ২০২৫ সালের জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কারের সম্ভাব্য প্রস্তাব নিয়ে নতুন করে গণভোট আয়োজনের আলোচনা শুরু হয়েছে।
১৯৭৭ সালের রাষ্ট্রপতি আস্থা গণভোট
গণভোটটি অনুষ্ঠিত হয় ৩০ মে ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসনের অধীনে। এটি ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি আস্থার ভোট। জিয়া ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা পরবর্তী বিশৃঙ্খলরা মধ্যে এক সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন।
প্রায় আড়াই বছরের পরিপূর্ণ সামরিক শাসনের পর, জিয়া জনগণের সমর্থন চাইতে গণভোট করেন। তার নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে ছিল অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা। ভোটারদের কাছে প্রশ্ন ছিল— ‘আপনার কি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তার নীতিমালা ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা আছে?’
৩ কোটি ৮৪ লাখ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে হ্যাঁ/না ভোট নেওয়া হয়। ভোটার উপস্থিতি ছিল চমকপ্রদভাবে ৮৮.১% এবং কোনো অবৈধ ভোট পড়েনি।
ভোটে জিয়াউর রহমান ব্যাপক সমর্থন অর্জন করেন—৯৮.৯% হ্যাঁ (৩৩.৪ মিলিয়ন ভোট) এবং মাত্র ১.১% না। এই ফলাফল জিয়ার ম্যান্ডেটকে শক্তিশালী করে। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয় লাভ করেন।
১৯৮৫ সালের সামরিক শাসন গণভোট
হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ১৯৮২ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে প্রতিবাদ দেখা দেয়। পরে ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ তিনি একটি গণভোটের আয়োজন করেন। ভোটের মূল প্রশ্ন ছিল—এরশাদের নেতৃত্ব ও সংস্কারের প্রতি সমর্থন আছে কি না।
সরকারি হিসাবে প্রায় ৫ কোটি যোগ্য ভোটারের মধ্যে ৯৪.৮% ভোটার অংশ নেন। সরকারি ফলাফলে ৯৪.১% হ্যাঁ ভোট আসে। এরপর এরশাদ ১৯৮৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তবে এরশাদ ভোটে কারচুপি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিরোধীরা ভোট বয়কট করে এবং ভোটকে প্রতারণা ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে পরিচালিত বলে অভিযোগ করে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন। সমালোচকরা এটিকে এরশাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন দীর্ঘায়িত করার একটি কৌশল হিসেবে দেখেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকেন।
১৯৯১ সালের সংবিধান সংশোধনী গণভোট
গণভোটটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অপসারণের পর। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তার সামরিক শাসন শেষ হয়। পরবর্তীতে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভ করে। তখন রাজনৈতিক বিতর্ক চলছিল— রাষ্ট্রপতি ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখা হবে নাকি সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হবে।
দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী বিল সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃস্থাপনের জন্য প্রণীত হয়, যাতে রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করবে এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যনির্বাহী ক্ষমতা রাখবেন। ভোটারদের কাছে প্রশ্ন ছিল—‘আপনি কি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ১৯৯১ সালের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধনী) বিল অনুমোদন দেওয়াকে সমর্থন করেন?’
৬ কোটি ২২ লাখ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ৩৫.২% অংশ নেন, অর্থাৎ ২ কোটি ১৯ লাখ ভোট পড়ে। এর মধ্যে ৯৯.১% ভোট বৈধ ছিল। প্রস্তাবের পক্ষে প্রচুর সমর্থন আসে—৮৩.৪% হ্যাঁ এবং ১৫.৬% না। এর ফলে সংশোধনী পাস হয় এবং সংসদীয় শাসনের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে কম ভোটার উপস্থিতি এবং বিএনপির সংসদীয় আধিপত্য বিতর্ক সৃষ্টি করে। গণভোটের পর সমালোচকরা উল্লেখ করেন যে, প্রণীত ব্যবস্থা এখনও নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার ও সংসদ এড়িয়ে সরকারি আদেশের সুযোগ রাখে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক মাইলফলক হলেও ক্ষমতার অসমতা পুরোপুরি সমাধান করতে পারেনি।
গণভোট সরাসরি গণতন্ত্রের একটি মাধ্যম, যেখানে নাগরিকরা নির্দিষ্ট বিষয়—যেমন সংবিধান সংশোধন বা নীতি পরিবর্তন ও নতুন নীতি গ্রহণ—নিয়ে সরাসরি ভোট দেন। এতে জনগণ সরাসরি মতামত জানানোর সুযোগ পান, তবে জটিল বিষয় সহজীকরণ বা প্রভাবিত করার ঝুঁকিও থাকে। গণভোট জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে পারে, তবে ভুল তথ্য, প্রভাব বা স্বার্থের সংঘাতে তা ব্যর্থও হতে পারে।
এর যেমন কিছু সুবিধা রয়েছে তেমনি অসুবিধাও রয়েছে। যেমন, বড় সিদ্ধান্তে জনগণের মতামত নেওয়া যায়, যা গণতন্ত্রে তাদের মালিকানা বোধ বাড়ায়। এর ফলাফল জনগণের সরাসরি রায় হিসেবে গণ্য হয়, যা সরকার ও সংসদকে জবাবদিহির মধ্যে রাখে।
অন্যদিকে, জটিল বিষয় বুঝতে না পারলে আবেগ বা অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে ভোট হতে পারে। ফলে অজ্ঞতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সরকার প্রশ্নপত্রের ভাষা, প্রচারে অর্থায়ন বা বিরোধীদের দমন করে ফলাফল প্রভাবিত করতে পারে। ভোটে অনীহা বা বর্জন ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে; আবার ‘হ্যাঁ/না’ ধাঁচের প্রশ্ন সমাজে বিভাজন বাড়ায়।
সফল গণভোট সাধারণত ঘটে তখনই, যখন ভোটাররা সচেতন, অংশগ্রহণ বেশি, এবং তদারক নিরপেক্ষ থাকে। বিপরীতে, জবরদস্তি, স্বল্প সচেতনতা বা ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রণে পড়লে তা ব্যর্থ হয়।
বাংলাদেশের গণভোটের ইতিহাস প্রমাণ করে যে এগুলো সংস্কারের হাতিয়ার হতে পারে, আবার কর্তৃত্ববাদী শাসনকেও বৈধতা দিতে পারে। ২০২৪ সালের ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই বিষয়টি নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ১৫ বছরের অভিযোগমুখর শাসন, ভোট কারচুপি ও দমননীতির পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এখন গণতন্ত্র পুনর্গঠনের পথে।
২০২৪ সালের আগস্টে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের (এনসিসি) মাধ্যমে সংস্কারে জোর দিচ্ছে। এর ফলাফল হলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’—যা নির্বাচনী, বিচারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা এবঃং একদলীয় আধিপত্য প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি।
এই সনদ নিয়ে একটি গণভোটের প্রস্তাব বর্তমানে আলোচনায় রয়েছে। এতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, গণঅধিকার পরিষদসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল সম্মত হয়েছে। লক্ষ্য হলো পরবর্তী নির্বাচনের (প্রস্তাবিত ফেব্রুয়ারি ২০২৬) আগে সংবিধানিকভাবে সংস্কারকে প্রতিষ্ঠা করা।
গণভোটের গুরুত্ব এখানেই— এটি রাজনৈতিক বৈধতা পুনরুদ্ধার, বিভক্ত রাজনীতি একীভূত করা এবং নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার (যেমন অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংসদ এড়িয়ে চলা) নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।
তবে কিছু জটিলতাও রয়েছে। জামায়াত নির্বাচনের আগেই নভেম্বরে গণভোট চায়। অপরদিকে বিএনপি নির্বাচন দিবসেই গণভোটের আয়োজনকে কার্যকর মনে করে।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো অংশগ্রহণ ও বিশ্বাসযোগ্যতা। ফলে গণভোট বর্জন বা রাজনৈতিক মেরুকরণও ঘটতে পারে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থির প্রেক্ষাপটে গণভোটকে একটি গণতান্ত্রিক সেতুবন্ধন হিসেবে দেখা হচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের (এনসিসি) আলোচনাভিত্তিক উদ্যোগ এটিকে দলীয় কৌশল থেকে জাতীয় প্রয়োজনীয়তায় উন্নীত করেছে।
বিএনপি একে ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন’ ও ‘নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা’ হিসেবে তুলে ধরছে। তবে গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করছে নিরপেক্ষতার ওপর। নির্বাচনের আগে আয়োজন করলে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠতে পারে, আর নির্বাচনের সঙ্গে একসাথে হলে ভোটারদের বিভ্রান্ত করার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজনৈতিক মেরুকরণ, ধর্মীয় মৌলবাদী প্রবণতা ও অর্থনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে এটি বিভাজন নিরসনেও ভূমিকা রাখতে পারে, আবার যদি কারচুপির আশঙ্কা তৈরি হয়, তবে বিক্ষোভও উসকে দিতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে জনআস্থা এখনও সীমিত হলেও উন্নতির ইঙ্গিত আছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে পিইপিএস জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ নাগরিক অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে আস্থা রাখছেন।
ভুয়া তথ্য রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারসহ কমিশনের নতুন উদ্যোগও প্রশংসিত হয়েছে। তবে অনেকেই সতর্ক করে বলেছেন, আস্থা পুনর্গঠন এখনো কঠিন কাজ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দিন নিজেই বলেছেন, ‘ন্যায্য নির্বাচনই এখন একমাত্র বিকল্প।’
বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি জনগণের মধ্যে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মে রাজনৈতিক সচেতনতা এখন অনেক বেশি। ২০২৪ সালের আন্দোলনের পর এই জাগরণ আরও গভীর হয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন স্বৈরাচারবিরোধী বিপ্লবে রূপ নেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে তরুণদের বিশাল অংশ এতে অংশ নেয়। এতে জবাবদিহির দাবি জোরদার হয়। তবে গ্রাম-শহরের বিভাজন, ৭৬ শতাংশ সাক্ষরতার হার, ও রাজনৈতিক সহিংসতা এখনো জনসচেতনতার পূর্ণ বিকাশে বাধা।
বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সন্দেহ বাড়লেও আন্দোলনের উত্তরাধিকার সাধারণ মানুষকেও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করেছে।
গণভোট জনগণের কণ্ঠকে শক্তিশালী করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সুরক্ষা ব্যবস্থা ও সচেতন অংশগ্রহণ ছাড়া তা ব্যর্থ হয়—বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতাও সেটিই দেখায়।
২০২৫ সালের এই সংবেদনশীল পরিবর্তনকালে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এর গণভোট একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এটি যদি স্বচ্ছভাবে ও অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে সম্পন্ন হয়, তবে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের ভিত্তি মজবুত হবে।
দলগুলোর ঐক্য, নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে মতপার্থক্য, এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা-অনাস্থা—সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি পরীক্ষার সময়। তরুণ প্রজন্মের তৎপরতা ও গণজাগরণ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারে।
কিন্তু ব্যর্থ বাস্তবায়ন আবারও হতাশা বাড়াতে পারে। শেষ পর্যন্ত, প্রকৃত শক্তি গণভোটে নয়—বরং সচেতন, তথ্যভিত্তিক ও ন্যায়সংগত আলোচনায় নিহিত। সরাসরি গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয় যখন তা দৃঢ় প্রতিষ্ঠান ও জনআস্থার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের বিষয়ে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। শিগগিরই হয়তো ভোটের আয়োজনও করা হবে। গণভোট হলো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট, যা কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব, আইন বা রাজনৈতিক বিষয়ে নেওয়া হয়। এতে নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিবর্তে নাগরিকরাই সরাসরি সিদ্ধান্ত দেন। এটি সরাসরি গণতন্ত্রের একটি উপায়। এর মাধ্যমে নাগরিকরা সংবিধান সংশোধন, নীতি পরিবর্তন বা কোনো নেতার প্রতি আস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত জানাতে পারেন।
গণভোট দুই ধরনের হতে পারে— বাধ্যতামূলক ও পরামর্শমূলক। বাধ্যতামূলক গণভোটে ফলাফল আইনগতভাবে কার্যকর হয়। সংবিধান সংশোধনের মতো বড় সিদ্ধান্তে আইনের ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই গণভোটের আয়োজন করা হয়।
পরামর্শমূলক গণভোটের ফল নীতিনির্ধারকদের জন্য নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে, অনেকটা বড় পরিসরের জনমত জরিপের মতো। সরকার, সংসদের উদ্যোগ বা জনগণের পিটিশনের ভিত্তিতে এর আয়োজন করা হতে পারে। জনগণ চাইলে নির্দিষ্ট সংখ্যক স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এ উদ্যোগ নিতে পারে।
নাগরিকদের উদ্যোগে সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মোট ভোটারের ৫–১০ শতাংশের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। গণভোট সাধারণ নির্বাচনের থেকে ভিন্ন। সাধারণ নির্বাচনে প্রতিনিধিদের নির্বাচন করা হয়, কিন্তু গণভোটে নির্দিষ্ট একটি প্রশ্নের ওপর সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়া হয়।
গণভোট আয়োজন একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে করা হয়। দেশভেদে সংবিধান, নির্বাচন আইন ও গণভোটের ধরন অনুযায়ী এর কিছু পার্থক্য থাকে। প্রক্রিয়াটি শুরু হয় কোনো উদ্যোগ বা প্রস্তাব থেকে। ভোটের বিষয় নির্ধারিত হলে পক্ষ-বিপক্ষ উভয়েই প্রচারণা চালায়। গণমাধ্যম, সমাবেশ ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে।
ভোটারদের সামনে একটি পরিষ্কার প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয়—সাধারণত ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ধরনের। নির্দিষ্ট তারিখে ভোট হয়। অনেক সময় সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গেও এটি অনুষ্ঠিত হয়, যাতে ভোটার উপস্থিতি বেশি হয়। ভোটদান হতে পারে কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে, ডাকযোগে বা ই-ভোটিং পদ্ধতিতে।
ভোট গণনা করে স্বতন্ত্র নির্বাচন কমিশন বা সংস্থা। সাধারণত ৫০ শতাংশের বেশি ভোটই সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে, তবে কিছু দেশে (যেমন সুইজারল্যান্ড বা ইতালি) ৬০ শতাংশ সমর্থন বা দ্বৈত শর্ত—অর্থাৎ ভোট ও অংশগ্রহণ উভয় ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা—প্রয়োজন হয়। ফলাফল কয়েক দিনের মধ্যেই ঘোষণা করা হয়। প্রয়োজনে পুনর্গণনা বা আইনি আপিলের সুযোগ থাকে।
গণভোট বাধ্যতামূলক হলে এর ফল তাৎক্ষণিকভাবে বা কিছু সময় পর আইনি প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। আদালত বৈধতা যাচাই করতে পারে। পরামর্শমূলক গণভোটের ক্ষেত্রে ফলাফল সরকারকে নির্দেশনা দেয়, বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না। গণভোটে কিছু চ্যালেঞ্জও থাকে—যেমন কম ভোটার উপস্থিতি, প্রশ্নের ভাষা নিয়ে বিভ্রান্তি, অথবা রাজনৈতিক বয়কট।
বাংলাদেশ খুব কম গণভোট আয়োজন করেছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসন ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে এই প্রক্রিয়া সীমিত ছিল। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধান সংশোধনের জন্য গণভোটের অনুমতি দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি জাতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে—১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে।
এই তিনটি গণভোট মূলত নেতৃত্বের বৈধতা বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার রূপ নির্ধারণে অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো সাধারণত সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন সময়ে পরিচালিত হয়েছিল, যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বৈধতা প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যায়।
১৯৯১ সালের পর আর কোনো জাতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ২০২৫ সালের জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কারের সম্ভাব্য প্রস্তাব নিয়ে নতুন করে গণভোট আয়োজনের আলোচনা শুরু হয়েছে।
১৯৭৭ সালের রাষ্ট্রপতি আস্থা গণভোট
গণভোটটি অনুষ্ঠিত হয় ৩০ মে ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসনের অধীনে। এটি ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি আস্থার ভোট। জিয়া ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা পরবর্তী বিশৃঙ্খলরা মধ্যে এক সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন।
প্রায় আড়াই বছরের পরিপূর্ণ সামরিক শাসনের পর, জিয়া জনগণের সমর্থন চাইতে গণভোট করেন। তার নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে ছিল অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা। ভোটারদের কাছে প্রশ্ন ছিল— ‘আপনার কি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তার নীতিমালা ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা আছে?’
৩ কোটি ৮৪ লাখ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে হ্যাঁ/না ভোট নেওয়া হয়। ভোটার উপস্থিতি ছিল চমকপ্রদভাবে ৮৮.১% এবং কোনো অবৈধ ভোট পড়েনি।
ভোটে জিয়াউর রহমান ব্যাপক সমর্থন অর্জন করেন—৯৮.৯% হ্যাঁ (৩৩.৪ মিলিয়ন ভোট) এবং মাত্র ১.১% না। এই ফলাফল জিয়ার ম্যান্ডেটকে শক্তিশালী করে। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয় লাভ করেন।
১৯৮৫ সালের সামরিক শাসন গণভোট
হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ১৯৮২ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে প্রতিবাদ দেখা দেয়। পরে ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ তিনি একটি গণভোটের আয়োজন করেন। ভোটের মূল প্রশ্ন ছিল—এরশাদের নেতৃত্ব ও সংস্কারের প্রতি সমর্থন আছে কি না।
সরকারি হিসাবে প্রায় ৫ কোটি যোগ্য ভোটারের মধ্যে ৯৪.৮% ভোটার অংশ নেন। সরকারি ফলাফলে ৯৪.১% হ্যাঁ ভোট আসে। এরপর এরশাদ ১৯৮৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তবে এরশাদ ভোটে কারচুপি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিরোধীরা ভোট বয়কট করে এবং ভোটকে প্রতারণা ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে পরিচালিত বলে অভিযোগ করে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন। সমালোচকরা এটিকে এরশাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন দীর্ঘায়িত করার একটি কৌশল হিসেবে দেখেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকেন।
১৯৯১ সালের সংবিধান সংশোধনী গণভোট
গণভোটটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অপসারণের পর। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তার সামরিক শাসন শেষ হয়। পরবর্তীতে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভ করে। তখন রাজনৈতিক বিতর্ক চলছিল— রাষ্ট্রপতি ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখা হবে নাকি সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হবে।
দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী বিল সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃস্থাপনের জন্য প্রণীত হয়, যাতে রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করবে এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যনির্বাহী ক্ষমতা রাখবেন। ভোটারদের কাছে প্রশ্ন ছিল—‘আপনি কি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ১৯৯১ সালের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধনী) বিল অনুমোদন দেওয়াকে সমর্থন করেন?’
৬ কোটি ২২ লাখ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ৩৫.২% অংশ নেন, অর্থাৎ ২ কোটি ১৯ লাখ ভোট পড়ে। এর মধ্যে ৯৯.১% ভোট বৈধ ছিল। প্রস্তাবের পক্ষে প্রচুর সমর্থন আসে—৮৩.৪% হ্যাঁ এবং ১৫.৬% না। এর ফলে সংশোধনী পাস হয় এবং সংসদীয় শাসনের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে কম ভোটার উপস্থিতি এবং বিএনপির সংসদীয় আধিপত্য বিতর্ক সৃষ্টি করে। গণভোটের পর সমালোচকরা উল্লেখ করেন যে, প্রণীত ব্যবস্থা এখনও নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার ও সংসদ এড়িয়ে সরকারি আদেশের সুযোগ রাখে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক মাইলফলক হলেও ক্ষমতার অসমতা পুরোপুরি সমাধান করতে পারেনি।
গণভোট সরাসরি গণতন্ত্রের একটি মাধ্যম, যেখানে নাগরিকরা নির্দিষ্ট বিষয়—যেমন সংবিধান সংশোধন বা নীতি পরিবর্তন ও নতুন নীতি গ্রহণ—নিয়ে সরাসরি ভোট দেন। এতে জনগণ সরাসরি মতামত জানানোর সুযোগ পান, তবে জটিল বিষয় সহজীকরণ বা প্রভাবিত করার ঝুঁকিও থাকে। গণভোট জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে পারে, তবে ভুল তথ্য, প্রভাব বা স্বার্থের সংঘাতে তা ব্যর্থও হতে পারে।
এর যেমন কিছু সুবিধা রয়েছে তেমনি অসুবিধাও রয়েছে। যেমন, বড় সিদ্ধান্তে জনগণের মতামত নেওয়া যায়, যা গণতন্ত্রে তাদের মালিকানা বোধ বাড়ায়। এর ফলাফল জনগণের সরাসরি রায় হিসেবে গণ্য হয়, যা সরকার ও সংসদকে জবাবদিহির মধ্যে রাখে।
অন্যদিকে, জটিল বিষয় বুঝতে না পারলে আবেগ বা অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে ভোট হতে পারে। ফলে অজ্ঞতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সরকার প্রশ্নপত্রের ভাষা, প্রচারে অর্থায়ন বা বিরোধীদের দমন করে ফলাফল প্রভাবিত করতে পারে। ভোটে অনীহা বা বর্জন ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে; আবার ‘হ্যাঁ/না’ ধাঁচের প্রশ্ন সমাজে বিভাজন বাড়ায়।
সফল গণভোট সাধারণত ঘটে তখনই, যখন ভোটাররা সচেতন, অংশগ্রহণ বেশি, এবং তদারক নিরপেক্ষ থাকে। বিপরীতে, জবরদস্তি, স্বল্প সচেতনতা বা ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রণে পড়লে তা ব্যর্থ হয়।
বাংলাদেশের গণভোটের ইতিহাস প্রমাণ করে যে এগুলো সংস্কারের হাতিয়ার হতে পারে, আবার কর্তৃত্ববাদী শাসনকেও বৈধতা দিতে পারে। ২০২৪ সালের ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই বিষয়টি নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ১৫ বছরের অভিযোগমুখর শাসন, ভোট কারচুপি ও দমননীতির পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এখন গণতন্ত্র পুনর্গঠনের পথে।
২০২৪ সালের আগস্টে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের (এনসিসি) মাধ্যমে সংস্কারে জোর দিচ্ছে। এর ফলাফল হলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’—যা নির্বাচনী, বিচারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা এবঃং একদলীয় আধিপত্য প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি।
এই সনদ নিয়ে একটি গণভোটের প্রস্তাব বর্তমানে আলোচনায় রয়েছে। এতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, গণঅধিকার পরিষদসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল সম্মত হয়েছে। লক্ষ্য হলো পরবর্তী নির্বাচনের (প্রস্তাবিত ফেব্রুয়ারি ২০২৬) আগে সংবিধানিকভাবে সংস্কারকে প্রতিষ্ঠা করা।
গণভোটের গুরুত্ব এখানেই— এটি রাজনৈতিক বৈধতা পুনরুদ্ধার, বিভক্ত রাজনীতি একীভূত করা এবং নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার (যেমন অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংসদ এড়িয়ে চলা) নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।
তবে কিছু জটিলতাও রয়েছে। জামায়াত নির্বাচনের আগেই নভেম্বরে গণভোট চায়। অপরদিকে বিএনপি নির্বাচন দিবসেই গণভোটের আয়োজনকে কার্যকর মনে করে।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো অংশগ্রহণ ও বিশ্বাসযোগ্যতা। ফলে গণভোট বর্জন বা রাজনৈতিক মেরুকরণও ঘটতে পারে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থির প্রেক্ষাপটে গণভোটকে একটি গণতান্ত্রিক সেতুবন্ধন হিসেবে দেখা হচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের (এনসিসি) আলোচনাভিত্তিক উদ্যোগ এটিকে দলীয় কৌশল থেকে জাতীয় প্রয়োজনীয়তায় উন্নীত করেছে।
বিএনপি একে ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন’ ও ‘নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা’ হিসেবে তুলে ধরছে। তবে গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করছে নিরপেক্ষতার ওপর। নির্বাচনের আগে আয়োজন করলে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠতে পারে, আর নির্বাচনের সঙ্গে একসাথে হলে ভোটারদের বিভ্রান্ত করার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজনৈতিক মেরুকরণ, ধর্মীয় মৌলবাদী প্রবণতা ও অর্থনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে এটি বিভাজন নিরসনেও ভূমিকা রাখতে পারে, আবার যদি কারচুপির আশঙ্কা তৈরি হয়, তবে বিক্ষোভও উসকে দিতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে জনআস্থা এখনও সীমিত হলেও উন্নতির ইঙ্গিত আছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে পিইপিএস জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ নাগরিক অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে আস্থা রাখছেন।
ভুয়া তথ্য রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারসহ কমিশনের নতুন উদ্যোগও প্রশংসিত হয়েছে। তবে অনেকেই সতর্ক করে বলেছেন, আস্থা পুনর্গঠন এখনো কঠিন কাজ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দিন নিজেই বলেছেন, ‘ন্যায্য নির্বাচনই এখন একমাত্র বিকল্প।’
বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি জনগণের মধ্যে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মে রাজনৈতিক সচেতনতা এখন অনেক বেশি। ২০২৪ সালের আন্দোলনের পর এই জাগরণ আরও গভীর হয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন স্বৈরাচারবিরোধী বিপ্লবে রূপ নেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে তরুণদের বিশাল অংশ এতে অংশ নেয়। এতে জবাবদিহির দাবি জোরদার হয়। তবে গ্রাম-শহরের বিভাজন, ৭৬ শতাংশ সাক্ষরতার হার, ও রাজনৈতিক সহিংসতা এখনো জনসচেতনতার পূর্ণ বিকাশে বাধা।
বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সন্দেহ বাড়লেও আন্দোলনের উত্তরাধিকার সাধারণ মানুষকেও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করেছে।
গণভোট জনগণের কণ্ঠকে শক্তিশালী করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সুরক্ষা ব্যবস্থা ও সচেতন অংশগ্রহণ ছাড়া তা ব্যর্থ হয়—বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতাও সেটিই দেখায়।
২০২৫ সালের এই সংবেদনশীল পরিবর্তনকালে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এর গণভোট একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এটি যদি স্বচ্ছভাবে ও অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে সম্পন্ন হয়, তবে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের ভিত্তি মজবুত হবে।
দলগুলোর ঐক্য, নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে মতপার্থক্য, এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা-অনাস্থা—সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি পরীক্ষার সময়। তরুণ প্রজন্মের তৎপরতা ও গণজাগরণ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারে।
কিন্তু ব্যর্থ বাস্তবায়ন আবারও হতাশা বাড়াতে পারে। শেষ পর্যন্ত, প্রকৃত শক্তি গণভোটে নয়—বরং সচেতন, তথ্যভিত্তিক ও ন্যায়সংগত আলোচনায় নিহিত। সরাসরি গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয় যখন তা দৃঢ় প্রতিষ্ঠান ও জনআস্থার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে গঠিত হয় জাতিসংঘ। আজকে তা এক মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি—যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে সংস্থাটির কী হবে? সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনামূলক বক্তব্য এই বিতর্ককে নতুন করে উসকে দিয়েছে।
১ দিন আগে‘রাজমহলে বহু বাঙালি পরিবার রয়েছে, যাঁদের পূর্বপুরুষ আফগানিস্তানের বলখসহ নানা অঞ্চল থেকে এসেছিলেন।’ ১৬২৬ সালে মন্তব্য করেছিলেন আফগান পর্যটক মাহমুদ বালখি। এমনকি ঔপনিবেশিক যুগে বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী শিক্ষক হিসেবে স্থায়ী হয়েছিলেন আফগানিস্তানে। কাবুল কৃষি কলেজে অধ্যাপনার অভিজ্ঞতার
২ দিন আগে২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের। শেখ হাসিনার এই শাসনামলকে দেশের মানুষ ফ্যাসিবাদী শাসন এবং তাঁকে ফ্যাসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে অনেকদিন ধরেই। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোতে এই ফ্যাসিবাদের শুরু হয়েছিল কীভাবে? আর কীইবা ছিল সেই ফ্যাসিবা
২ দিন আগেঢাকায় আজ (৭ অক্টোবর, মঙ্গলবার) চতুর্থ বাংলাদেশ-তুরস্ক ফরেইন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) বা পররাষ্ট্র দপ্তর পরামর্শ বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈঠকটি তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বেরিস একিনসি গতকাল সোমবার সকালে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন।
৩ দিন আগে