leadT1ad

ভারত কেন শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ প্রশ্নটি শুধু আইনি নয়—বরং রাজনৈতিক, কৌশলগত, কূটনৈতিক এবং নৈতিক জটিলতায় জড়িত একটি বহুমাত্রিক বিষয়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিধান মেনে অনুরোধ জানালেও ভারত এখনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেনি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক প্রভাব, নিরাপত্তা-স্বার্থ, গোয়েন্দা সংযোগ, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং মানবিক বিবেচনা—সবকিছু মিলিয়ে দিল্লি অত্যন্ত সতর্ক ও ধীর পদক্ষেপে এগোচ্ছে।

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৮: ২৯
স্ট্রিম গ্রাফিক

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গত বছর জুলাই-আগস্টের দমন-পীড়নের ঘটনায় হাসিনার অনুপস্থিতিতেই দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায় ঘোষণার পাঁচ দিন পর ঢাকার পক্ষ থেকে এই আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণ আবেদন পাঠানো হয়।

গত ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার পরপরই অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, দুই দেশের প্রত্যর্পণ চুক্তির কারণে ভারত এই প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য। তারা আরও বলে, মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থী এবং বন্ধুত্বপূর্ণ নয়।

গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। তিনি সেখান থেকে মাঝেমধ্যেই বিবৃতি দিচ্ছেন এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে সাক্ষাৎকারও দিয়ে আসছেন। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের অসন্তোষ আরও বেড়েছে। গত এক বছরে বাংলাদেশ বারবার তার প্রত্যর্পণ চেয়েছে। কিন্তু ভারত কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ করে। ভারত কেবল নথি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে। সম্প্রতি পাঠানো দ্বিতীয় ‘নোট ভারবাল’-এরও এখনো কোনো জবাব দেয়নি। ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু জানায় যে তারা রায়টি সম্পর্কে অবগত আছে এবং তারা বাংলাদেশে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে কাজ করবে।

তবে প্রত্যর্পণের বিষয়টি স্পষ্টভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং ভারত এখনো নীরব রয়েছে। তারা প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যানও করছে না, আবার সম্মতিও জানাচ্ছে না। বিভিন্ন বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আইনগত ফাঁকফোকর, কৌশলগত স্বার্থ, কূটনৈতিক সতর্কতা, ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং মানবিক বিবেচনা—এই সব কারণ মিলেই শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করার সম্ভাবনা খুবই কম বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

‘অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক অনেক স্বার্থ আছে। তাই ভারতের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব নয়। এটি নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন সরকার দায়িত্ব নিলে বিষয়টি পুনঃপর্যালোচনা করা হবে।’

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

নিরাপত্তা ও সামরিক বিশ্লেষক খালেদ আহমেদ বলেন, ‘এই দ্বিধার কারণ আইনগত বা প্রক্রিয়াগত নয়। এর মূল কারণ রাজনৈতিক ও কৌশলগত। ভারতের উদ্বেগ হলো, যদি শেখ হাসিনাকে ঢাকায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তিনি কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করে দিতে পারেন। এখন দিল্লির সামনে একটি জটিল দ্বন্দ্ব দাঁড়িয়েছে। চুক্তি মেনে চললে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের বিভিন্ন গোপন কর্মকাণ্ডের তথ্য প্রকাশ পাবে। আর চুক্তি অমান্য করলে দ্বিপাক্ষিক আস্থা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে সমীকরণ বদলে যেতে পারে।’

সম্প্রতি দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত সুধা রামচন্দ্রনের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভারতে এই প্রত্যর্পণের পক্ষে সমর্থন খুবই কম। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা আরও বেড়েছে।

সুধা রামচন্দ্রন বলেন, ‘এর প্রধান কারণ হলো আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন ভারতের আশ্রয় পেয়েছিলেন। সেখানে শেখ হাসিনা ছয় বছর ছিলেন।’

ভারতীয় এই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘কেবল আবেগগত সম্পর্কই নয়, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্ক শেখ হাসিনার শাসনকালে দৃঢ় হয়েছিল। বাংলাদেশে ইসলামী সংগঠন ও ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার কার্যক্রম দিল্লির কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। ভারতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তাঁর সহযোগিতা ভারতের সুদৃষ্টি অর্জন করেছিল। এই কারণে ভারত তাঁর স্বৈরাচারী শাসনের সময়ও শক্ত সমর্থন দেয়।’

দিল্লির প্রতিরক্ষাবিষয়ক গবেষক স্মৃতি এস পট্টনায়ক বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সীমিত ক্ষমতা ও ম্যান্ডেটের একটি প্রশাসন। তাই ভারত নির্বাচিত সরকার আসা পর্যন্ত বড় দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে না।’

‘বাংলাদেশে ভারতের অনেক স্বার্থ আছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক অনেক স্বার্থ আছে। তাই ভারতের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব নয়। এটি নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন সরকার দায়িত্ব নিলে বিষয়টি পুনঃপর্যালোচনা করা হবে।’

খালেদ আহমেদ বলেন, কেবল আইনি বাধার কারণে নয় বরং ভয়ও আছে ভারতের। হাসিনা বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের গোপন কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক ভূমিকা এবং গোয়েন্দা কার্যক্রম সম্পর্কে গভীরভাবে অবহিত। তিনি দেশে ফিরলে আদালত, ব্যক্তিগত পরিস্থিতি বা রাজনৈতিক প্রয়োজনের কারণে এসব তথ্য প্রকাশ করার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। ভারত মনে করে, এসব তথ্য প্রকাশিত হলে তা তাদের জন্য অস্বস্তিকর হবে।

আইনী বাধা: চুক্তির ব্যতিক্রম ও প্রক্রিয়াগত ঝামেলা

২০১৩ সালের ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তিতে প্রত্যাখ্যানের অনেক কারণ আছে। যদি অপরাধ রাজনৈতিক বলে মনে হয়, তবে ফেরত পাঠাতে বাধা তৈরি হতে পারে। এমনকি হত্যার মতো গুরুতর অপরাধও রাজনৈতিক প্রতিশোধের সঙ্গে যুক্ত হলে ব্যতিক্রম ধরা হয়।

ভারতের দৃষ্টিতে হাসিনার আইসিটি মামলাটি রাজনীতি প্রভাবিত। তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছে। সঠিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থেনের সুযোগ পাননি। তাই ভারত মনে করে বিচারটি ন্যায়সঙ্গত হয়নি।

চুক্তির ৮(১)(ক)(৩) ধারায় বলা আছে—যদি কোনো অনুরোধ অন্যায়, কঠোর বা অসৎ উদ্দেশ্যপূর্ণ মনে হয়, তবে তা নাকচ করা যেতে পারে। আরও একটি শর্ত আছে। হাসিনাকে আগে বাংলাদেশে সব আইনি ধাপ শেষ করতে হবে। এখনো তা হয়নি।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক প্রভু দয়াল বলেছেন, হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর আবেদন হলে তা ভারতের আদালতে উঠবে। হাসিনা সেখানে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন। এতে বিচার দীর্ঘ হতে পারে।

জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, ভারত মনে করে এটি বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনা।

তবে খালেদ আহমেদ বলেন, কেবল আইনি বাধার কারণে নয় বরং ভয়ও আছে ভারতের। হাসিনা বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের গোপন কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক ভূমিকা এবং গোয়েন্দা কার্যক্রম সম্পর্কে গভীরভাবে অবহিত। তিনি দেশে ফিরলে আদালত, ব্যক্তিগত পরিস্থিতি বা রাজনৈতিক প্রয়োজনের কারণে এসব তথ্য প্রকাশ করার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। ভারত মনে করে, এসব তথ্য প্রকাশিত হলে তা তাদের জন্য অস্বস্তিকর হবে।

সবচেয়ে সংবেদনশীল বিষয়গুলো হলো, বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্ভাব্য নেটওয়ার্ক, রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের কৌশল, এবং আওয়ামী লীগের একটি অংশের মাধ্যমে ভারতীয় স্বার্থ পূরণের অভিযোগ। তাঁর কাছে আরও গুরুতর অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যেমন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সীমান্ত–অভিযান, গুমের অভিযোগ। এ ধরনের তথ্য ফাঁস হলে ভারতের আঞ্চলিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম সম্পর্কেও আস্থা কমে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন উঠতে পারে।

মনোহর পাররিকর ইনস্টিটিউটের গবেষক স্মৃতি এস পট্টনায়ক সতর্ক করে বলেন, ভারত যদি একজন ঘনিষ্ঠ মিত্রকে দেশে ফিরিয়ে মৃত্যুদণ্ডের মুখে ঠেলে দেয়, তবে অন্য মিত্রদের কাছে বার্তা যাবে যে দিল্লি নির্ভরযোগ্য নয়। এ পরিস্থিতিতে ভারত তাৎক্ষণিক চাপ মেনে চলার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে নানা অভিযোগ রয়েছে। কিছু বিশ্লেষকের মতে, ভারতীয় সংস্থা, আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বাহিনীর কিছু সদস্য সেখানে ভূমিকা রেখেছিলেন। প্রমাণ যাই হোক, যদি হাসিনা এ বিষয়ে বক্তব্য দেন, তা দিল্লির জন্য বড় ভাবমূর্তিগত ঝুঁকি তৈরি করবে।

ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে, ভারতকে আঞ্চলিক বার্তাও বিবেচনা করতে হয়। একজন দীর্ঘদিনের মিত্র রাজনৈতিক নেতাকে চাপের মুখে ছেড়ে দিলে ভারতের প্রতি নির্ভরযোগ্যতার বার্তা দুর্বল হতে পারে। ভারত অতীতে বহু আঞ্চলিক রাজনীতিককে আশ্রয় দিয়েছে। হাসিনাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ সহযোগিতা কমে যেতে পারে।

বিষয়টি ভারতের ভেতরেও মতভেদ তৈরি করেছে। নীতিনির্ধারণী, গোয়েন্দা ও বাণিজ্যিক স্বার্থসম্পন্ন কিছু গোষ্ঠী এখনো হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে ধরা হয়। তাঁকে ফেরত পাঠানো হলে এই নেটওয়ার্কগুলোতে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে।

সব মিলিয়ে ভারতের বর্তমান নীরবতার একটি বড় কারণ দ্বিধা। দিল্লি বোঝে, হাসিনাকে ফেরত পাঠানো মানে শুধু দণ্ডিত নেত্রীকে দেশে ফেরানো নয়, বরং এমন একজনকে ফিরিয়ে দেওয়া, যিনি ভারতীয় ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকা ও গোপন কার্যক্রম প্রকাশ করতে পারেন বলে মনে করা হয়।

উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, হাসিনার ভারতে অবস্থান ভারতকে তার মিত্রদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিতে অটল দেখাতে সাহায্য করছে।

মনোহর পাররিকর ইনস্টিটিউটের গবেষক স্মৃতি এস পট্টনায়ক সতর্ক করে বলেন, ভারত যদি একজন ঘনিষ্ঠ মিত্রকে দেশে ফিরিয়ে মৃত্যুদণ্ডের মুখে ঠেলে দেয়, তবে অন্য মিত্রদের কাছে বার্তা যাবে যে দিল্লি নির্ভরযোগ্য নয়। এ পরিস্থিতিতে ভারত তাৎক্ষণিক চাপ মেনে চলার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

পরিস্থিতি কোন দিকে এগোয়, তা নির্ভর করবে আগামী কূটনৈতিক আলোচনাগুলো, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং ভারতের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত হিসাব-নিকাশের ওপর। এখন একমাত্র নিশ্চিত সত্য হলো—এই ইস্যু দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশ: স্থিতিশীলতার অপেক্ষা

বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চাপ তৈরি হতে পারে। তবে বাণিজ্য ও সীমান্ত–ইস্যুতে ভারতের প্রভাব থাকায়, এ চাপ ভারত সামলাতে সক্ষম।

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মন্তব্য করেন, বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হতে পারে না। ভারতের জন্য ঢাকায় একটি নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।

‘ইন্ডিয়া’স নিয়ার-ইস্ট’–এর লেখক অবিনাশ পলিওয়াল বলেন, ভারতের তাড়াহুড়া করা উচিত নয়। ঢাকার বিভিন্ন অংশীজন, বিশেষত সামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ধীর ও নীরব কূটনৈতিক যোগাযোগ চালিয়ে যেতে হবে।

জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ভারত অতীতে ঢাকার অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। এখন সেই বাস্তবতা বদলানো জরুরি।

ভারত এখন স্বার্থ ও নীতির মধ্যে সমতা রক্ষা করার চেষ্টা করছে। বিশ্লেষক ভরদ্বাজ ও পলিওয়াল মনে করেন, এ সংকটের দ্রুত সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা কম। ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা চলতে পারে।

প্রত্যর্পণ নাকচ হলে বাংলাদেশ ভারত থেকে আরও দূরে সরে যেতে পারে। এ পরিবর্তন আঞ্চলিক ভূরাজনীতির কৌশলগত ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় হাসিনা দিল্লিতে নিরাপদ অতিথি হিসেবেই অবস্থান করছেন।

মৃত্যুদণ্ড পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী প্রশ্ন তোলেন, ভারত কীভাবে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে? তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় হাসিনার বাংলাদেশের মাটিতে ফেরত যাওয়া কীভাবে সম্ভব, বিশেষ করে যখন তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত? চক্রবর্তীর মতে, ভারতকে এ ক্ষেত্রে একটি নৈতিক অবস্থান নিতে হবে। তার ভাষায়, হাসিনা ভারতের জন্য সবসময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন।

সব দিক বিবেচনায় দেখা যায়, শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ প্রশ্নটি শুধু আইনি নয়—বরং রাজনৈতিক, কৌশলগত, কূটনৈতিক এবং নৈতিক জটিলতায় জড়িত একটি বহুমাত্রিক বিষয়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিধান মেনে অনুরোধ জানালেও ভারত এখনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেনি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক প্রভাব, নিরাপত্তা-স্বার্থ, গোয়েন্দা সংযোগ, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং মানবিক বিবেচনা—সবকিছু মিলিয়ে দিল্লি অত্যন্ত সতর্ক ও ধীর পদক্ষেপে এগোচ্ছে।

ঢাকার দাবি জোরালো হলেও ভারতের নীরবতা ইঙ্গিত দেয় যে নির্বাচন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া ভারত ঝুঁকি নিতে চাইছে না। সব মিলিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করছে—যেখানে পুরনো সরল সমীকরণ বদলে গিয়ে পারস্পরিক সমঝোতা, স্বার্থ ও শক্তির ভারসাম্য নতুনভাবে পরীক্ষার মুখে পড়বে।

পরিস্থিতি কোন দিকে এগোয়, তা নির্ভর করবে আগামী কূটনৈতিক আলোচনাগুলো, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং ভারতের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত হিসাব-নিকাশের ওপর। এখন একমাত্র নিশ্চিত সত্য হলো—এই ইস্যু দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত