স্ট্রিম ডেস্ক

গত আট দশকে বিশ্বের কোনো বড় শক্তির মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ হয়নি। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এই কালপর্বকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ শান্তির সময় হিসেবে গণ্য করা হয়। এই শান্তি একদিনে আসেনি—দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার পর বিশ্ব নেতারা বাধ্য হয়েছিলেন শান্তির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে। যুদ্ধগুলো এতই ধ্বংসাত্মক ছিল যে ইতিহাসবিদরা এগুলোর জন্য আলাদা শ্রেণি বা ‘বিশ্বযুদ্ধ’ নামের ব্যবহার শুরু করেন। অনেকের ধারণা, যদি বিশ শতকও আগের দুই হাজার বছরের মতো সহিংসতায় ভরা থাকত, আজকের পৃথিবী, অর্থনীতি, জনসংখ্যা ও মানুষের জীবন সম্পূর্ণ আলাদা হতো।
১৯৪৫ সালের পর বড় শক্তির মধ্যে যুদ্ধ না হওয়ার পেছনে সৌভাগ্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল সচেতন উদ্যোগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়তে চেয়েছিল, যা দীর্ঘমেয়াদি শান্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম। আজ শান্তি ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন—এই অর্জনের অসাধারণত্ব উপলব্ধি করা, এর ভঙ্গুরতা বোঝা এবং ভবিষ্যতে শান্তি রক্ষার জন্য কী করা উচিত সে বিষয়ে গভীর চিন্তা করা।
এক বিস্ময়কর অর্জন
দীর্ঘ শান্তির সাফল্য বোঝাতে তিনটি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়—৮০, ৮০ ও ৯।
প্রথম ৮০ বোঝায়, গত ৮০ বছরে কোনো মহাশক্তির মধ্যে যুদ্ধ হয়নি। এর ফলে বিশ্ব জনসংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে, গড় আয়ু দ্বিগুণ হয়েছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি পনেরো গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্বের মতো সংঘাত চলত, তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় নিশ্চিত ছিল এবং তা হতো পারমাণবিক অস্ত্রে। সেই যুদ্ধ মানবসভ্যতাকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিতে পারত—এমনকি শেষ যুদ্ধও হতে পারত।
দ্বিতীয় ৮০ বোঝায়, ১৯৪৫ সালের পর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্র আর ব্যবহার হয়নি। যদিও বহুবার ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের সময় পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত ছিল।
২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর আবারও পারমাণবিক হুমকি সামনে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সতর্ক বার্তা ও যুক্তরাষ্ট্র-চীন কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে আসে। তবু এটা প্রমাণ করে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা এখনো খুবই ভঙ্গুর।
সংখ্যা ৯ বোঝায়, পৃথিবীতে মাত্র নয়টি দেশের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। ১৯৫০-৬০-এর দশকে ধারণা করা হয়েছিল, প্রযুক্তি পেলে বহু দেশই এমন অস্ত্র তৈরি করবে। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি মনে করেছিলেন, ১৯৭০-এর দশকের মধ্যে ২৫-৩০টি দেশ পারমাণবিক শক্তিধর হবে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এনপিটি (নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি) প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেয়। আজ ১৮৫টি দেশ স্বেচ্ছায় পারমাণবিক অস্ত্র না রাখার অঙ্গীকার করেছে।
তবে এই অর্জন স্থায়ী নয়, ঝুঁকিও বাড়ছে
যদিও পারমাণবিক বিস্তাররোধ নীতি এখনো কার্যকর, তবুও ১০০টিরও বেশি দেশ প্রযুক্তিগতভাবে অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম। তারা এখনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করছে, কিন্তু ইতিহাসে এটি এক অস্বাভাবিক অবস্থা।
২০২৫ সালের আসান ইনস্টিটিউটের জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার তিন-চতুর্থাংশ মানুষ নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র চায়—উত্তর কোরিয়ার হুমকির কারণে। যদি রাশিয়া ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে সফল হয়, অনেক দেশই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রভাণ্ডার গড়তে চাইবে। এতে দীর্ঘ শান্তির যুগ ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়বে।
ইতিহাসবিদ জন লুইস গাডিস ১৯৮৭ সালে ‘দ্য লং পিস’ প্রবন্ধে দেখান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে দীর্ঘ শান্তি আসে, তার ভিত্তি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের ভারসাম্য। আগের যুগে এমন পরিস্থিতি হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পারস্পরিক পারমাণবিক প্রতিশোধের ক্ষমতা ধরে রেখেছিল—যাকে বলা হয় মিউচুয়ালি অ্যাশিউর্ড ডেস্ট্রাকশন (এমএডি) তথা ‘পারস্পরিক নিশ্চিত ধ্বংস’। এর ফলে ভারসাম্য বজায় থাকে।
জাতিসংঘ, মানবাধিকার ঘোষণা, পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রূপ নেওয়া বহুপাক্ষিক কাঠামো, এবং যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত মতাদর্শিক প্রতিযোগিতা—সবকিছু মিলেই শান্তির ভিত গড়ে দেয়।
গাডিসের মতে, উভয় পক্ষই বুঝেছিল, অস্তিত্ব রক্ষা মতাদর্শের চেয়ে বড় বিষয়। তারা একে অপরের মতাদর্শ ঘৃণা করলেও জানত, সরাসরি যুদ্ধ মানেই দুই পক্ষেরই ধ্বংস।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নতুন যুগ
১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র মহাশক্তি হয়ে ওঠে। তখন অনেকে মনে করেছিলেন, এবার স্থায়ী শান্তি আসবে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বলেছিলেন যে আদর্শগত লড়াই শেষ—উদার গণতন্ত্রই মানবসভ্যতার চূড়ান্ত রাজনৈতিক রূপ।
থমাস ফ্রিডম্যান বলেছিলেন, যে দেশে ম্যাকডোনাল্ডস আছে, সেই দেশ আরেক দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করবে না—অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতা শান্তি নিশ্চিত করে।
এই বিশ্বাস থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধে নামে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ও ব্যয়সাপেক্ষ যুদ্ধ কোনো স্থায়ী সমাধান আনতে পারেনি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রায় ১২ হাজার ৬০০ পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার বাইরে রয়ে গিয়েছিল। এগুলো নতুন রাষ্ট্রগুলোর হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া মিলে নান-লুগার প্রোগ্রাম চালু করে। ১৯৯৬ সালের মধ্যে সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলের সব অস্ত্র সংগ্রহ করা হয় বা ধ্বংস করা হয়—শান্তির ইতিহাসে এক আশ্চর্য কূটনৈতিক সফলতা।
২০০০-এর দশকেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া ও চীনকে কৌশলগত অংশীদার ভাবত। কিন্তু ২০১৭ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে চিত্র বদলে যায়। চীন দ্রুত উত্থানশীল পরাশক্তিতে পরিণত হয়, আর রাশিয়া ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে ওঠে। ফলে আবার মহাশক্তি প্রতিযোগিতার যুগ ফিরে এসেছে।
সামনে কী কী বিপদ?
হেনরি কিসিঞ্জার মৃত্যুর আগে বারবার সতর্ক করেছিলেন—গত আট দশকের মহাশক্তিদের শান্তি শত বছর টিকবে বলে তিনি মনে করেন না। ইতিহাস বলছে, দীর্ঘ ভূ-রাজনৈতিক চক্রের শেষটা সাধারণত সহিংসভাবে ঘটে। পাঁচটি কারণ বিশেষভাবে উদ্বেগজনক:
১. বিস্মৃতি
মার্কিন সমাজের আজকের প্রজন্ম বড় শক্তির যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেনি। তাই তারা যুদ্ধের ঝুঁকি যথাযথভাবে বোঝে না। অনেকেই মনে করেন বড় শক্তির মধ্যে আর যুদ্ধ হবে না, যা বিপজ্জনক ভ্রান্ত ধারণা।
২. নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্থান
চীনের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে। থুসিডিডিসের মতে, প্রতিষ্ঠিত শক্তি ও উদীয়মান শক্তির প্রতিযোগিতা বহু সময় যুদ্ধের কারণ হয়েছে। চীন এখন বাণিজ্য, উৎপাদন ও প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিচ্ছে। একই সময়ে রাশিয়া সামরিক শক্তি দিয়ে তার প্রভাব বাড়াতে চাইছে। ন্যাটোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল সমর্থন ইউরোপেও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
৩. বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অর্ধেক জিডিপির মালিক ছিল। স্নায়ুযুদ্ধ শেষে এই হার এক-চতুর্থাংশে নেমে আসে। এখন সেই হার এক-সপ্তমাংশে নেমে এসেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে, আর অন্য দেশগুলো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেদের প্রভাব-ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছে।
৪. অতিরিক্ত সামরিক ভারবহন
সামরিকভাবে অতিরিক্ত ভার বহন করাও বিপজ্জনক। বিশেষ করে, যখন তা দেশের মৌলিক স্বার্থের বাইরে থাকা দীর্ঘ সংঘাতে ব্যয় হয়। চীন দার্শনিক সান-জু বলেছেন—দীর্ঘ যুদ্ধ রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধ তারই উদাহরণ। এসব সংঘাত সামরিক বাহিনীর দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয় এবং নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উন্নত করার কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া কংগ্রেস ও প্রতিরক্ষা শিল্পের চাপে সামরিক বাজেট বাড়লেও নতুন কৌশল উদ্ভাবন হচ্ছে না।
৫. অভ্যন্তরীণ বিভাজন
সবশেষে, সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো অভ্যন্তরীণ বিভাজন। রাজনৈতিক সংঘাত একটি রাষ্ট্রকে বৈদেশিক নীতি পরিচালনায় অক্ষম করে তোলে। নীতিনির্ধারকরা যখন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা রক্ষা বা পরিবর্তন করার বিষয়ে বিপরীত অবস্থানে দাঁড়ান, তখন রাষ্ট্র নীতিগত সামঞ্জস্য হারায়। বর্তমান মার্কিন প্রশাসন আগের বহু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া বদলে দিচ্ছে। এতে বিশ্বব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়ছে।
তাহলে ভবিষ্যৎ কী?
আজ যুক্তরাষ্ট্র ও তার বিভক্ত সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—তারা কি বর্তমান বিপদগুলো চিনতে পারবে? তারা কি প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দূরদর্শিতা ও ঐক্য অর্জন করতে পারবে? তারা কি পরবর্তী বৈশ্বিক বিপর্যয় ঠেকাতে সক্ষম হবে?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, হেগেল যেমন বলেছেন—ইতিহাস থেকে শেখার একমাত্র শিক্ষা হলো, আমরা ইতিহাস থেকে খুব কমই শিখি।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন কৌশলবিদরা প্রচলিত চিন্তার বাইরে গিয়ে যে কৌশল তৈরি করেছিলেন, তা দীর্ঘ শান্তির ভিত্তি গড়ে দেয়। আজও তেমনই নতুন ভাবনা, দূরদর্শিতা ও ঐক্য দরকার—যদি আমরা মহাশক্তির মধ্যে নতুন সংঘাত এড়াতে চাই।
(ফরেইন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত গ্রাহাম অ্যালিসন ও জেমস এ উইনেফেল্ড জুনিয়রের লেখা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মাহবুবুল আলম তারেক)

গত আট দশকে বিশ্বের কোনো বড় শক্তির মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ হয়নি। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এই কালপর্বকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ শান্তির সময় হিসেবে গণ্য করা হয়। এই শান্তি একদিনে আসেনি—দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার পর বিশ্ব নেতারা বাধ্য হয়েছিলেন শান্তির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে। যুদ্ধগুলো এতই ধ্বংসাত্মক ছিল যে ইতিহাসবিদরা এগুলোর জন্য আলাদা শ্রেণি বা ‘বিশ্বযুদ্ধ’ নামের ব্যবহার শুরু করেন। অনেকের ধারণা, যদি বিশ শতকও আগের দুই হাজার বছরের মতো সহিংসতায় ভরা থাকত, আজকের পৃথিবী, অর্থনীতি, জনসংখ্যা ও মানুষের জীবন সম্পূর্ণ আলাদা হতো।
১৯৪৫ সালের পর বড় শক্তির মধ্যে যুদ্ধ না হওয়ার পেছনে সৌভাগ্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল সচেতন উদ্যোগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়তে চেয়েছিল, যা দীর্ঘমেয়াদি শান্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম। আজ শান্তি ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন—এই অর্জনের অসাধারণত্ব উপলব্ধি করা, এর ভঙ্গুরতা বোঝা এবং ভবিষ্যতে শান্তি রক্ষার জন্য কী করা উচিত সে বিষয়ে গভীর চিন্তা করা।
এক বিস্ময়কর অর্জন
দীর্ঘ শান্তির সাফল্য বোঝাতে তিনটি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়—৮০, ৮০ ও ৯।
প্রথম ৮০ বোঝায়, গত ৮০ বছরে কোনো মহাশক্তির মধ্যে যুদ্ধ হয়নি। এর ফলে বিশ্ব জনসংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে, গড় আয়ু দ্বিগুণ হয়েছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি পনেরো গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্বের মতো সংঘাত চলত, তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় নিশ্চিত ছিল এবং তা হতো পারমাণবিক অস্ত্রে। সেই যুদ্ধ মানবসভ্যতাকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিতে পারত—এমনকি শেষ যুদ্ধও হতে পারত।
দ্বিতীয় ৮০ বোঝায়, ১৯৪৫ সালের পর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্র আর ব্যবহার হয়নি। যদিও বহুবার ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের সময় পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত ছিল।
২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর আবারও পারমাণবিক হুমকি সামনে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সতর্ক বার্তা ও যুক্তরাষ্ট্র-চীন কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে আসে। তবু এটা প্রমাণ করে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা এখনো খুবই ভঙ্গুর।
সংখ্যা ৯ বোঝায়, পৃথিবীতে মাত্র নয়টি দেশের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। ১৯৫০-৬০-এর দশকে ধারণা করা হয়েছিল, প্রযুক্তি পেলে বহু দেশই এমন অস্ত্র তৈরি করবে। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি মনে করেছিলেন, ১৯৭০-এর দশকের মধ্যে ২৫-৩০টি দেশ পারমাণবিক শক্তিধর হবে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এনপিটি (নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি) প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেয়। আজ ১৮৫টি দেশ স্বেচ্ছায় পারমাণবিক অস্ত্র না রাখার অঙ্গীকার করেছে।
তবে এই অর্জন স্থায়ী নয়, ঝুঁকিও বাড়ছে
যদিও পারমাণবিক বিস্তাররোধ নীতি এখনো কার্যকর, তবুও ১০০টিরও বেশি দেশ প্রযুক্তিগতভাবে অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম। তারা এখনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করছে, কিন্তু ইতিহাসে এটি এক অস্বাভাবিক অবস্থা।
২০২৫ সালের আসান ইনস্টিটিউটের জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার তিন-চতুর্থাংশ মানুষ নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র চায়—উত্তর কোরিয়ার হুমকির কারণে। যদি রাশিয়া ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে সফল হয়, অনেক দেশই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রভাণ্ডার গড়তে চাইবে। এতে দীর্ঘ শান্তির যুগ ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়বে।
ইতিহাসবিদ জন লুইস গাডিস ১৯৮৭ সালে ‘দ্য লং পিস’ প্রবন্ধে দেখান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে দীর্ঘ শান্তি আসে, তার ভিত্তি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের ভারসাম্য। আগের যুগে এমন পরিস্থিতি হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পারস্পরিক পারমাণবিক প্রতিশোধের ক্ষমতা ধরে রেখেছিল—যাকে বলা হয় মিউচুয়ালি অ্যাশিউর্ড ডেস্ট্রাকশন (এমএডি) তথা ‘পারস্পরিক নিশ্চিত ধ্বংস’। এর ফলে ভারসাম্য বজায় থাকে।
জাতিসংঘ, মানবাধিকার ঘোষণা, পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রূপ নেওয়া বহুপাক্ষিক কাঠামো, এবং যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত মতাদর্শিক প্রতিযোগিতা—সবকিছু মিলেই শান্তির ভিত গড়ে দেয়।
গাডিসের মতে, উভয় পক্ষই বুঝেছিল, অস্তিত্ব রক্ষা মতাদর্শের চেয়ে বড় বিষয়। তারা একে অপরের মতাদর্শ ঘৃণা করলেও জানত, সরাসরি যুদ্ধ মানেই দুই পক্ষেরই ধ্বংস।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নতুন যুগ
১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র মহাশক্তি হয়ে ওঠে। তখন অনেকে মনে করেছিলেন, এবার স্থায়ী শান্তি আসবে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বলেছিলেন যে আদর্শগত লড়াই শেষ—উদার গণতন্ত্রই মানবসভ্যতার চূড়ান্ত রাজনৈতিক রূপ।
থমাস ফ্রিডম্যান বলেছিলেন, যে দেশে ম্যাকডোনাল্ডস আছে, সেই দেশ আরেক দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করবে না—অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতা শান্তি নিশ্চিত করে।
এই বিশ্বাস থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধে নামে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ও ব্যয়সাপেক্ষ যুদ্ধ কোনো স্থায়ী সমাধান আনতে পারেনি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রায় ১২ হাজার ৬০০ পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার বাইরে রয়ে গিয়েছিল। এগুলো নতুন রাষ্ট্রগুলোর হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া মিলে নান-লুগার প্রোগ্রাম চালু করে। ১৯৯৬ সালের মধ্যে সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলের সব অস্ত্র সংগ্রহ করা হয় বা ধ্বংস করা হয়—শান্তির ইতিহাসে এক আশ্চর্য কূটনৈতিক সফলতা।
২০০০-এর দশকেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া ও চীনকে কৌশলগত অংশীদার ভাবত। কিন্তু ২০১৭ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে চিত্র বদলে যায়। চীন দ্রুত উত্থানশীল পরাশক্তিতে পরিণত হয়, আর রাশিয়া ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে ওঠে। ফলে আবার মহাশক্তি প্রতিযোগিতার যুগ ফিরে এসেছে।
সামনে কী কী বিপদ?
হেনরি কিসিঞ্জার মৃত্যুর আগে বারবার সতর্ক করেছিলেন—গত আট দশকের মহাশক্তিদের শান্তি শত বছর টিকবে বলে তিনি মনে করেন না। ইতিহাস বলছে, দীর্ঘ ভূ-রাজনৈতিক চক্রের শেষটা সাধারণত সহিংসভাবে ঘটে। পাঁচটি কারণ বিশেষভাবে উদ্বেগজনক:
১. বিস্মৃতি
মার্কিন সমাজের আজকের প্রজন্ম বড় শক্তির যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেনি। তাই তারা যুদ্ধের ঝুঁকি যথাযথভাবে বোঝে না। অনেকেই মনে করেন বড় শক্তির মধ্যে আর যুদ্ধ হবে না, যা বিপজ্জনক ভ্রান্ত ধারণা।
২. নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্থান
চীনের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে। থুসিডিডিসের মতে, প্রতিষ্ঠিত শক্তি ও উদীয়মান শক্তির প্রতিযোগিতা বহু সময় যুদ্ধের কারণ হয়েছে। চীন এখন বাণিজ্য, উৎপাদন ও প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিচ্ছে। একই সময়ে রাশিয়া সামরিক শক্তি দিয়ে তার প্রভাব বাড়াতে চাইছে। ন্যাটোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল সমর্থন ইউরোপেও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
৩. বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অর্ধেক জিডিপির মালিক ছিল। স্নায়ুযুদ্ধ শেষে এই হার এক-চতুর্থাংশে নেমে আসে। এখন সেই হার এক-সপ্তমাংশে নেমে এসেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে, আর অন্য দেশগুলো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেদের প্রভাব-ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছে।
৪. অতিরিক্ত সামরিক ভারবহন
সামরিকভাবে অতিরিক্ত ভার বহন করাও বিপজ্জনক। বিশেষ করে, যখন তা দেশের মৌলিক স্বার্থের বাইরে থাকা দীর্ঘ সংঘাতে ব্যয় হয়। চীন দার্শনিক সান-জু বলেছেন—দীর্ঘ যুদ্ধ রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধ তারই উদাহরণ। এসব সংঘাত সামরিক বাহিনীর দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয় এবং নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উন্নত করার কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া কংগ্রেস ও প্রতিরক্ষা শিল্পের চাপে সামরিক বাজেট বাড়লেও নতুন কৌশল উদ্ভাবন হচ্ছে না।
৫. অভ্যন্তরীণ বিভাজন
সবশেষে, সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো অভ্যন্তরীণ বিভাজন। রাজনৈতিক সংঘাত একটি রাষ্ট্রকে বৈদেশিক নীতি পরিচালনায় অক্ষম করে তোলে। নীতিনির্ধারকরা যখন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা রক্ষা বা পরিবর্তন করার বিষয়ে বিপরীত অবস্থানে দাঁড়ান, তখন রাষ্ট্র নীতিগত সামঞ্জস্য হারায়। বর্তমান মার্কিন প্রশাসন আগের বহু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া বদলে দিচ্ছে। এতে বিশ্বব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়ছে।
তাহলে ভবিষ্যৎ কী?
আজ যুক্তরাষ্ট্র ও তার বিভক্ত সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—তারা কি বর্তমান বিপদগুলো চিনতে পারবে? তারা কি প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দূরদর্শিতা ও ঐক্য অর্জন করতে পারবে? তারা কি পরবর্তী বৈশ্বিক বিপর্যয় ঠেকাতে সক্ষম হবে?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, হেগেল যেমন বলেছেন—ইতিহাস থেকে শেখার একমাত্র শিক্ষা হলো, আমরা ইতিহাস থেকে খুব কমই শিখি।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন কৌশলবিদরা প্রচলিত চিন্তার বাইরে গিয়ে যে কৌশল তৈরি করেছিলেন, তা দীর্ঘ শান্তির ভিত্তি গড়ে দেয়। আজও তেমনই নতুন ভাবনা, দূরদর্শিতা ও ঐক্য দরকার—যদি আমরা মহাশক্তির মধ্যে নতুন সংঘাত এড়াতে চাই।
(ফরেইন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত গ্রাহাম অ্যালিসন ও জেমস এ উইনেফেল্ড জুনিয়রের লেখা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মাহবুবুল আলম তারেক)

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গত বছর জুলাই-আগস্টের দমন-পীড়নের ঘটনায় হাসিনার অনুপস্থিতিতেই দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে...
১ দিন আগে
সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপ, যা নারিকেল জিঞ্জিরা নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এটি বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত। বহু বছর ধরে এটি অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দূষণ এবং প্রাণবৈচিত্র্য হারানোর কারণে পরিবেশগত ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
২ দিন আগে
আজ মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিকেল ৫টা ২২ মিনিটের দিকে রাজধানীর মহাখালী এলাকার কড়াইল বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে কড়াইল কেবল একটি বস্তি নয়, বরং ঢাকার রাজনৈতিক অর্থনীতির এক পরীক্ষাগার। সরকারি জমিতে জন্মানো এই জনপদ তিন দশকে একটি শক্তিশালী অনানুষ্ঠানিক আবাসনে পরিণত হয়েছে।
২ দিন আগে
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্থির দামের সঙ্গে লড়াই করে আসছে। বিশেষ করে চাল, পেঁয়াজ, ডিম ও ভোজ্যতেলের মতো পণ্যের দাম প্রায়শই ওঠানামা করে। ২৪ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত এক বৈঠকের পর অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেবল প্রশাসন
২ দিন আগে