রাজধানী ঢাকার মানচিত্রের দিকে তাকালে গুলশান ও বনানীর মতো অভিজাত এলাকার ঠিক মাঝখানে লেকের ওপর অনেকটা দ্বীপের মতো ভেসে থাকা এক জনপদ চোখে পড়ে, যার নাম কড়াইল। প্রায় ৯০ একর সরকারি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই জনপদ কেবল ঢাকার সবচেয়ে বড় বস্তিই নয়, বরং বাংলাদেশের নগর উন্নয়ন, প্রকট সামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক অর্থনীতির এক জটিল গবেষণাগার।
গুলশানের আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর কড়াইলের টিনের চালের জরাজীর্ণ খুপড়ি ঘরের মাঝখানে ব্যবধান কেবল একটি লেকের। তবে এই সামান্য দূরত্বের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস, ক্ষমতার অশুভ আঁতাত ও বারবার জ্বলে ওঠা আগুনের রহস্য। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন, ঐতিহাসিক দলিল এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের বিশ্লেষণের আলোকে কড়াইল বস্তির জন্ম, টিকে থাকা এবং বারবার অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্য কারণগুলো খতিয়ে দেখলে বেরিয়ে আসে এক বিস্ময়কর আখ্যান।
জলাভূমি থেকে জনপদ: যেভাবে গড়ে উঠল কড়াইল
কড়াইল বস্তি যে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার ইতিহাস বেশ পুরনো। সরকারি নথিপত্র ও ভূমি রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৫০-এর দশকে এই পুরো এলাকাটি ছিল নিচু জলাভূমি ও ধানক্ষেত। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সাল নাগাদ মহাখালী ওয়ারলেস গেট এলাকায় টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো তৈরির জন্য সরকার এই জমি অধিগ্রহণ করে। জায়গার মালিকানা মূলত তিনটি সরকারি সংস্থার হাতে ন্যস্ত ছিল, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড বা বিটিসিএল, গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আশির দশক পর্যন্ত এই জায়গা ছিল মূলত ঝোপঝাড়ে পূর্ণ এবং পরিত্যক্ত। তবে এরশাদ সরকারের আমলে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এখানে ভাসমান মানুষের আনাগোনা শুরু হয়। গ্রাম থেকে নদীভাঙন বা দারিদ্র্যের কারণে শহরে আসা ছিন্নমূল মানুষরা প্রথমে এই ঝোপঝাড় ও জলাশয়ের ধারে ছোট ছোট আশ্রয় গড়তে শুরু করে।
নব্বইয়ের দশকে কড়াইলের চিত্র দ্রুত পাল্টাতে থাকে। বাংলাদেশে তখন দ্রুত নগরায়ন ঘটছে, আর কাজের সন্ধানে ঢাকায় মানুষের স্রোত বাড়ছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের থাকার মতো সস্তা জায়গার অভাব ছিল প্রকট। এই সুযোগ কাজে লাগায় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও রাজনৈতিক নেতারা। তারা সরকারি এই জমি অলিখিতভাবে দখল করে ছোট ছোট ঘর তুলে ভাড়া দেওয়া শুরু করেন।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলামের ‘ঢাকা: ফ্রম সিটি টু মেগাসিটি’ গবেষণা মতে, কড়াইল কোনো অপরিকল্পিত বসতি নয়, বরং এটি রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা একটি অনানুষ্ঠানিক আবাসন ব্যবস্থা। এটি একদিনে গড়ে ওঠেনি; বরং ধাপে ধাপে লেক ভরাট করে, মাটি ফেলে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এর পরিধি বাড়ানো হয়েছে। আজকের কড়াইল তাই কেবল অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল নয়, বরং ক্ষমতার এক বড় বাণিজ্যিক ক্ষেত্র।
দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, কড়াইল বস্তি প্রধানত দুটি অংশে বিভক্ত। এগুলো জামাইবাজার (ইউনিট ১) ও বউবাজার (ইউনিট ২) নামে পরিচিত। বউবাজারের মধ্যে আবার চারটি ভাগ রয়েছে, যথাক্রমে, ক, খ, গ ও ঘ নামে পরিচিত। কড়াইল বস্তির অধীনে রয়েছে বেলতলা বস্তি, টিঅ্যান্ডটি বস্তি, বাইদার বস্তি, এরশাদনগর ও গোডাউন বস্তি। ৯০ একরের বেশি জায়গা নিয়ে এই বস্তি অবস্থিত।
বণিক বার্তার ২০২২ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, কড়াইল বস্তির বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।
বস্তি বনাম বাণিজ্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি
এখন প্রশ্ন হলো, সরকারি জমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সত্ত্বেও গত তিন দশকে কেন কড়াইল উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে বস্তির বিশাল রাজনৈতিক অর্থনীতির ভেতরে, যাকে গবেষকরা ‘স্লাম পলিটিক্যাল ইকোনমি’ বলে থাকেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় দেখা গেছে, কড়াইল বস্তিতে বসবাসকারীরা জমির মালিক না হয়েও নিয়মিত ভাড়া দিয়ে থাকেন।
তবে এই ভাড়ার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয় না, বরং তা চলে যায় স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ও মাস্তানদের পকেটে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা বিআইজিডি-র জরিপ মতে, বস্তিবাসী তাদের আয়ের একটি বিশাল অংশ কেবল আবাসন ও ইউটিলিটি বিল বাবদ খরচ করেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের হিসেবে এই ভাড়া মূল শহরের বৈধ ভাড়ার হারের চেয়েও বেশি।
‘দ্য পলিটিক্স অফ শেল্টার: দ্য স্টেট অ্যান্ড দ্য স্লাম ডুয়েলার্স ইন ঢাকা’ শীর্ষক গবেষণা মতে, এই অবৈধ আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হলো ইউটিলিটি সংযোগ। কড়াইল বস্তিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বৈধ সংযোগ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেখানে হাজার হাজার ঘরে বাতি জ্বলে, ফ্যান চলে এবং চুলা জ্বলে। এই সংযোগগুলো দেওয়া হয় অবৈধভাবে, যা নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় সিন্ডিকেট।
বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় সিন্ডিকেট এবং তিতাস গ্যাস, ডেসকো ও ওয়াসার কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে চোরাই লাইন টেনে দেয়। মাস শেষে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এই বিশাল অর্থের ভাগবাটোয়ারা চলে পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের পকেট পর্যন্ত। ফলে বস্তিটি উচ্ছেদ করা মানে হলো এই বিশাল আয়ের উৎসটি বন্ধ করে দেওয়া, যা কোনো পক্ষই চায় না।
এছাড়া কড়াইল বস্তি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এটি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে একটি বিশাল ‘ভোটব্যাংক’। যেকোনো নির্বাচনে এই বিপুল সংখ্যক ভোটার ফলাফল উল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই নির্বাচনের আগে উচ্ছেদের কথা বলা হলেও, নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দলগুলোই নিজেদের স্বার্থে বস্তিটিকে টিকিয়ে রাখে।
বারবার আগুন: দুর্ঘটনা নাকি উচ্ছেদের কৌশল?
কড়াইলের এই টিকে থাকার লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম ‘আগুন’। গত এক দশকে কড়াইল বস্তিতে লাগাতার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যা এখন অনেকটা বাৎসরিক রুটিনে পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ভয়াবহ আগুনে প্রায় ৫০০ ঘর পুড়ে গিয়েছিল।
এর রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১৭ সালের মার্চে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের মার্চ মাসেও বড় ধরনের আগুনের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে সাধারণত শর্ট সার্কিট, মশার কয়েল বা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণকে আগুনের কারণ হিসেবে দেখানো হয়। বস্তির ঘরগুলো বাঁশ, কাঠ, পলিথিন ও প্লাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সরু রাস্তার কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে ঢুকতে পারে না, যা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
কিন্তু বস্তিবাসী এবং নগর গবেষকদের অনেকের মতে, এই আগুনের পেছনে কেবল কারিগরি ত্রুটি বা দুর্ঘটনা দায়ী নয়। এর পেছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র বা অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড।
মানবাধিকার কর্মী ও নগর গবেষকরা মনে করেন, বস্তিতে আগুন লাগার সময় ও প্যাটার্নগুলো অত্যন্ত সন্দেহজনক। প্রায়ই দেখা যায়, সরকারি কোনো বড় প্রকল্পের ঘোষণা আসার পরপরই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। সরকার যখনই কড়াইলের জমিতে ‘মহাখালী হাইটেক পার্ক’ বা আইটি ভিলেজ করার পরিকল্পনা সামনে আনে, তখনই আগুনের প্রকোপ বেড়ে যায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আইনি প্রক্রিয়ায় উচ্ছেদ করা জটিল ও সময়সাপেক্ষ বলে আগুন লাগিয়ে জায়গাটি খালি করার বা ভীতি সৃষ্টি করার একটি নিষ্ঠুর কৌশল নেওয়া হয়। আগুন লাগলে মানুষ জান বাঁচাতে পালিয়ে যায়, আর সেই সুযোগে জায়গাটি সমতল করা সহজ হয়।
এছাড়া বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাধিক গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা নতুন করে ঘর তুলে চড়া দামে ভাড়া দেওয়ার জন্য পুরনো ঘর পোড়ানোর অভিযোগও রয়েছে। একে বলা হয় ‘দখল-পাল্টা দখলের রাজনীতি’।
অর্থনৈতিক অপরিহার্যতা ও অসমাপ্ত সমাধান
তবে কড়াইল বস্তিকে কেবল অবৈধ দখল বা অপরাধের কেন্দ্র হিসেবে দেখলে ভুল হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএসের গবেষণা মতে, কড়াইল বস্তি ঢাকার অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। গুলশান, বনানী ও মহাখালীর মতো অভিজাত বাণিজ্যিক এলাকার গৃহকর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী, রিকশাচালক এবং গার্মেন্টস কর্মীদের প্রধান আবাসনস্থল এই কড়াইল।
গুলশান বা বনানীতে যারা সেবা দেন, তারা যদি কড়াইলে না থাকতেন, তবে তাদের যাতায়াত খরচ বেড়ে যেত এবং শ্রমের দামও বাড়ত। অর্থাৎ, কড়াইল বস্তি অভিজাত ঢাকাকে সস্তায় শ্রম ও সেবা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। এই বিপুল শ্রমজীবী মানুষকে বাদ দিয়ে ঢাকার এই অংশের অর্থনীতি কল্পনা করা কঠিন।
কড়াইল বস্তি ঢাকার নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং সামাজিক বৈষম্যের এক জীবন্ত স্মৃতিস্তম্ভ। বারবার আগুন লাগার ঘটনা প্রমাণ করে যে, এখানকার লক্ষ লক্ষ মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই।
সরকার বিভিন্ন সময়ে বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের কথা বললেও, তা কার্যকর কোনো রূপ পায়নি। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ভাসানটেক বা মিরপুরে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য কিছু ফ্ল্যাট প্রকল্প নিলেও, তা কড়াইলের বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, কড়াইল উচ্ছেদ করে হাইটেক পার্ক বা বাণিজ্যিক ভবন করার আগে, সেখানে বসবাসরত এই বিশাল শ্রমজীবী মানুষের জন্য ‘লো-কস্ট হাউজিং’ বা স্বল্প আয়ের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যথায়, এক কড়াইল ভাঙলে শহরের আরেক প্রান্তে নতুন আরেক কড়াইল গড়ে উঠবে।
কারণ, শহরকে সচল রাখতে হলে শ্রমিকের প্রয়োজন, আর শ্রমিকের মাথা গোঁজার ঠাঁই না দিলে বস্তির সৃষ্টি অবধারিত। আগুনের লেলিহান শিখা হয়তো ঘর পুড়িয়ে দেয়, কিন্তু দারিদ্র্য আর প্রয়োজনের যে আগুন মানুষকে এখানে থাকতে বাধ্য করে, তা নেভানোর সাধ্য কোনো ফায়ার সার্ভিসের নেই।