leadT1ad

তিনারিওয়েন: মিলিটারি ক্যাম্প থিকা মিউজিক কালেকটিভ

বিশ্বখ্যাত মিউজিক কালেক্টিভ তিনারিওয়েন। আফ্রিকার সাহারা অঞ্চল থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া তিনারিওয়েনকে নিয়ে এটি সম্ভবত বাংলা ভাষায় প্রথম কোন লেখা। তিনারিওয়েনকে দিয়ে শুরু হলো পপ স্ট্রিমের নতুন সিরিজ ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক’-এর প্রথম পর্ব।

অর্ণব সিদ্দিকী
অর্ণব সিদ্দিকী

স্ট্রিম গ্রাফিক

রেফিউজি ক্যাম্পে বাইড়া উঠা ইব্রাহীম আগ আলহাবিব ছোটবেলায় মালি ও আলজেরিয়ার সীমান্তে ঘুইরা বেড়াইতো। তার কানে ভাইসা আসত সাহারা মরুভূমির বেদুঈনদের গীত, ‘তেন্দে’ নামের সাহারান ড্রামের ছন্দ, আর নারী গলায় পুরানা তুয়ারেগ কবিতার প্রতিধ্বনি।

একবার একটা ওয়েস্টার্ন সিনেমায় এক কাউবয়রে গিটার বাজাইতে দেখে সে। সেই সাউন্ড তার মাথায় গাইথা যায়। পরে টিনের ক্যান, লাঠি আর বাইসাইকেলের ব্রেকের তার দিয়া নিজের হাতেই বানাইয়া ফেলে একটা হোমমেড গিটার। ইব্রাহিম তখনও বুঝতে পারে নাই, সে কেমন রেভ্যুলুশনের জন্ম দিতে যাইতেসে।

ক্ষতের ইতিহাস

ফ্রেঞ্চরা চইলা যাওয়ার পরে ১৯৬০ সালে জাতিরাষ্ট্র মালি গঠিত হয়। সাহারা মরুভূমির যাযাবর তুয়ারেগদের সামনে আসে বর্ডার আর সরকারের মতো অদ্ভুত সব কনসেপ্ট। হুমকি দেয়া হয় এরা যেন এদের লাইফস্টাইল বদলায়া ‘সভ্য’ হইয়া উঠে। শুরু হয় অতিরিক্ত ট্যাক্স আদায়। সরকার গরু-ছাগলের উপরেও ট্যাক্স বসায়। প্রতিবাদ করলে চলতো ধরপাকড়, এমনকি প্রকাশ্যে পিটাইয়া হত্যা। এইভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এরা কোনঠাসা হইয়া পড়ে। তবে এই ভায়োলেন্সের মধ্যেই আস্তে আস্তে তৈরী হয় বিদ্রোহের জমিনও। কারণ তুয়ারেগদের ইতিহাসে একমাত্র সুফি ঘরানার ইসলাম ছাড়া আর কোনোকিছুই তারা সহজে মাইনা নেয় নাই। রাষ্ট্র গঠনের ৩ বছরের মাথায় অটোনোমির দাবিতে শুরু হইলো ৬৩-র তুয়ারেগ বিদ্রোহ। নিজেদের মতো থাকতে চাওয়া এই গোষ্ঠী হইয়া উঠলো হত্যাযোগ্য ‘সন্ত্রাসী’। তখন ইব্রাহীমের বয়স মাত্র চার। ওই বছরই তার বাপরে বিদ্রোহে জড়িত থাকার ‘অপরাধে’ ফাঁসিতে ঝুলাইয়া হত্যা করে মালি সরকার। এই স্মৃতি তার মনে যে গভীর ক্ষত তৈরী করসিলো তা-ই পরে সুরের মাধ্যমে মরুভূমি পার হইয়া পৃথিবীর জমিনে ছড়াইয়া পরে।

নিজেদের মিউজিকরে তারা বলে ‘আস্সাউফ’ —তামাশেক ভাষায় যার অর্থ নস্টালজিয়া যেটা বিষন্নতার জন্ম দেয়। ব্লুজ মিউজিকের প্যাটার্ন আর বেদনার অনুভূতির সাথে ‘আস্সাউফ’ এর মিল আছে। কারণ ব্লুজের পেন্টাটনিক স্কেল, পুনরাবৃত্তিমূলক ছন্দ, মাইনর টোনালিটি, আর কল-অ্যান্ড-রেসপন্স পদ্ধতির শিকড় সেই আফ্রিকান ট্র‍্যাডিশনাল মিউজিকেই পাওয়া যায়। কিন্তু তিনারিওয়ানের গিটার ড্রিভেন সাউন্ড, বেইজ, ড্রামস, ‘তেহেরদেন্ত’ (তিন তারের বাদ্যযন্ত্র), ইমজাদ (এক তারের বাদ্যযন্ত্র) ও তেন্দে (ট্র‍্যাডিশনাল ড্রাম) আর মেলানকলিক লিরিক্সের মিক্সচার নিজস্ব মিউজিক তৈরী করে। যেটা শুধুমাত্র ব্লুজ, রক অথবা ট্র্যাডিশনাল মিউজিকের ক্রাইটেরিয়াতে বুঝা যায় না।

মিলিটারি ক্যাম্পে পাওয়া ইলেকট্রিক গিটার

‘৬৩ তে শুরু হওয়া বিদ্রোহরে অনেক বছর ধইরা সেনাবাহিনী দিয়া দমনের চেষ্টা করে মালি সরকার। এর মধ্যে সাহারার অন্যান্য অঞ্চলেও চলতে থাকে যাযাবর জনগোষ্ঠি উচ্ছেদ। জমিন, খাবার, নিরাপত্তা আর কাজহীন হইয়া পড়ে অনেকেই। কিছুদিন জেলে কাঠমিস্ত্রির কাজ করার পরে ইব্রাহীমের দেখা হয় হাসান আর আবেলিনের সাথে। এরা হইয়া উঠে ভাই-ব্রাদার। একাশিয়া গাছের ছায়া, তাঁবু অথবা তারাভরা আকাশের নিচে আগুন জ্বালাইয়া বইসা আড্ডা দিতো, চা-বিড়ি খাইতো এরা। একোস্টিক গিটার আর ট্র‍্যাডিশনাল ইন্সট্রুমেন্ট দিয়া পুরানা তুয়ারেগ মেলোডি আর আলী ফারকা ত্যুরের গান গাইতো। মাঝেমধ্যে আশেপাশের বিয়াশাদি আর ট্র‍্যাডিশনাল উৎসবেও বাজাইতো, কিন্তু ক্ষত, নির্বাসন আর স্বরাজের আকাঙ্খায় এরা এক হাতে গিটার আর আরেকহাতে বন্দুক তুইলা নেয়।

‘৮০ সালের শুরুর দিকে পাশের দেশ লিবিয়ায় গাদ্দাফি সরকার ক্ষমতায়। গাদ্দাফি ভূমিহীন ও নিরাপত্তাহীন জনগোষ্ঠিগুলারে খাবার, আশ্রয় আর মিলিটারি ট্রেনিং দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়া, প্যান-আরব আন্দোলনে দাওয়াত দেয়। পরে তুয়ারেগ, হাউসা, ফুলানি, তুবু ও ফিলিস্তিনি আরবসহ প্রায় ২০ হাজার লোক যোগ দেয় দক্ষিণ লিবিয়ার সেই মিলিটারি ক্যাম্পে। মালির ইব্রাহীম আর আলজেরিয়ার আলহাসানও যোগ দেয় সেইখানে।

তবে যেকোনো মিলিটারি ক্যাম্পের জীবনের মতোই ঐটা ছিলো বোরিং আর বিরক্তিকর। তাই একটু চিল করতে আর মনের বেদনা কমাইতে ট্রেনিং শেষে রাতের অবসরে এরা আড্ডা দিতো, গানবাজনা করতো। সেইখানেই প্রথমবারের মতো ইলেকট্রিক গিটারের সাথে পরিচিত হয় এরা। এর মধ্যে যারা আগে থিকাই একোস্টিক বাজাইতে পারতো তারা শিখ্যা ফেললো ইলেক্ট্রিক গিটারও। কয়েক বছর পরে ত্রিপোলির একটা ক্যাম্পে ইব্রাহিমদের দেখা হয় গিটারিস্ট কেগু আগ আসাদ আর আলহুসেইনির সাথে।

জন্ম নেয় তিনারিওয়েন—তামাশেক ভাষার এই শব্দের অর্থ ‘মরুভূমির সন্তানেরা।’

তিনারিওয়েন। ছবি: দিনইয়া ম্যাগাজিন
তিনারিওয়েন। ছবি: দিনইয়া ম্যাগাজিন

তাদের গানে জায়গা পায় মানুষ, স্বাধীনতা, স্মৃতি, মরুভূমি, নির্বাসন আর আশার গল্পের পোয়েটিক এক্সপ্রেশন। যাযাবর লাইফস্টাইল আর নির্বাসনের কারণে তিনারিওয়েনের মিউজিক ছড়াইয়া পড়ে মালি, আলজেরিয়া ও নাইজারে। ক্যাসেটের যুগে তাদের গান ঘোরাফেরা করতো মরুভূমির বিচিত্র ইন্ডিজেনাস যাযাবর জনগোষ্ঠীর হাতে হাতে। একবার তুয়ারেগ নারী শিল্পী মিনা ওয়ালেট ওমাররে তার আম্মা তামাক স্কোর দিতে পাঠায়। সেইখানে এক বেদুঈনের কাছে সে প্রথমবারের মতো তিনারিওয়েনের ক্যাসেট শুনে। শুইনা এতটাই ভাল্লাগে যে পরে একসময় সেও তিনারিওয়েনের সদস্য হইয়া যায়।

মিনা ওয়ালেট ওমার। ছবি: লিনাস ওল্ফ
মিনা ওয়ালেট ওমার। ছবি: লিনাস ওল্ফ

‘আস্সাউফ’—নস্টালজিয়া এ্যাজ মেলানকলি

প্রথমবার তিনারিওয়েন শুইনা মনে হইসিলো—মিউজিকে ভাষা আসলে সেকেন্ডারি জিনিস। মানে তামাশেক ভাষা না জানলে আপনে কথাগুলা বুঝবেন না, তাও পুরা ব্যাপারটা আপনারে ছুইয়া যাবে। কারণ মিউজিকের নিজের একটা ভাষা আছে, যেটা শব্দের বাইরেও কাজ করে। এইটা কাটাতার-ফাটাতারের উর্ধ্বের ঘটনা। ঘরছাড়া এই শিল্পীদের গানবাজনার সাথে আপনেও রিলেট করতে পারবেন যদি আপনার ভিত্রেও বিষণ্নতা, আকাঙ্খা বা হারানোর অনুভূতি ঘোরাফেরা করে। তিনারিওয়েন আমারে আমার ছাইড়া আসা ঘরের কথা মনে করাইয়া বেদনা দেয়, সাথে মিউজিকের মলম লাগাইয়া মাথাও হাতাইয়া দেয়। ছোটবেলার স্মৃতিমাখা মরা খোয়াই নদীর পাড়ে চইষা বেড়ানোর দৃশ্য মনে করায়।

আবার চোখ মুইজা শুনলে মাঝেমধ্যে লাগে যাপন না করা অথবা চাপমুক্ত একটা ঘুমের স্বপ্নে দেখা মরুভুমির কোনো র‍্যান্ডম সূর্যডোবা বিকালে চইলা গেছি। হাততালি আর গিটারের নোটগুলা উটের পিঠে সওয়ার হইয়া চলতে থাকে। এদের বেশিরভাগ গানের সুর মন্ত্রের মতো স্থির, আবার বেদনার মতো তীব্র। নারী শিল্পীর গলায় হারমোনি আর উলুধব্বনিরে মরীচিকার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো মনে হয়। তবে এর মধ্যে কিছু গান শুনলে আপনার হাত পা ছুইড়া নাচতেও ইচ্ছা করতে পারে।

তিনারিয়েন। ছবি: ব্যান্ডক্যাম্প
তিনারিয়েন। ছবি: ব্যান্ডক্যাম্প

অন্যদিকে, তিনারিওয়েন লাইভ পারফর্মেন্সে ট্র্যাডিশনাল গয়না, ড্রেস তাগেলমাস্ত ও তাসুওয়ার্ত

পইরা গানের তাল অনুযায়ী অনেকটা সূফী ঢঙের নাচ, হাততালি, নারী কণ্ঠের উলু আর হারমোনি যে আবহ তৈরী করে, সেইটা ইউনিক। নিজেদের মিউজিকরে তারা বলে ‘আস্সাউফ’ —তামাশেক ভাষায় যার অর্থ নস্টালজিয়া যেটা বিষন্নতার জন্ম দেয়। ব্লুজ মিউজিকের প্যাটার্ন আর বেদনার অনুভূতির সাথে ‘আস্সাউফ’ এর মিল আছে। কারণ ব্লুজের পেন্টাটনিক স্কেল, পুনরাবৃত্তিমূলক ছন্দ, মাইনর টোনালিটি, আর কল-অ্যান্ড-রেসপন্স পদ্ধতির শিকড় সেই আফ্রিকান ট্র‍্যাডিশনাল মিউজিকেই পাওয়া যায়। কিন্তু তিনারিওয়ানের গিটার ড্রিভেন সাউন্ড, বেইজ, ড্রামস, ‘তেহেরদেন্ত’ (তিন তারের বাদ্যযন্ত্র), ইমজাদ (এক তারের বাদ্যযন্ত্র) ও তেন্দে (ট্র‍্যাডিশনাল ড্রাম) আর মেলানকলিক লিরিক্সের মিক্সচার নিজস্ব মিউজিক তৈরী করে। যেটা শুধুমাত্র ব্লুজ, রক অথবা ট্র্যাডিশনাল মিউজিকের ক্রাইটেরিয়াতে বুঝা যায় না। এর আছে নিজস্ব এনার্জি, এটিচিউড আর মেজাজ। তবুও ওয়েস্টের কিছু মাথাপাতলা মিউজিক জার্নালিস্ট প্রায়ই টিনারিওয়েনরে ‘ডেজার্ট ব্লুজ’ নামে ব্র্যান্ড করে। এই লেবেল, তাদের মিউজিকের ঔপনিবেশিক পাঠ।

গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আব্দাল্লাহ আগ আলহুসেইনী ব্যান্ডওয়াগনে এক ইন্টারভিউয়ে বলে, ‘আমরা যে ধরনের পরিবেশে বাইচা থাকি সেইটাই আমাদের মিউজিকের সরাসরি ইন্সপিরেশন। আমাদের যাযাবর গোষ্ঠিগুলার ঐতিহ্যবাহী মিউজিক থিকা আমরা হেভিলি ইনফ্লুয়েন্সড। উটের বিভিন্ন চলনের ঢঙ আমাদের গানের তাল ঠিক কইরা দেয়। এই কাব্য মূলত আমাদের পূর্বসূরীদের পুরানা প্র‍্যাক্টিস, যেটা আমরা কিছু আধুনিক অনুপ্রেরণা আর গিটার, ড্রামসের টিউন মিশাইয়া গত ৪০ বছর ধইরা চর্চা কইরা আসতেসি।’

এরা জিমি হেন্ড্রিক্স, বব ডিলান, জেমস ব্রাউন, বনি এমসহ আফ্রিকা, আরবের অনেক শিল্পীদের মিউজিক শুনে। ভারতের কিরণ আহলুওয়ালিয়ার সাথে সাবকন্টিনেন্টের কাওয়ালির সাথে নিজেদের মিউজিকের কোলাবোরেশনও আছে। ইন্টারেস্টিংলি এদের মিউজিকে হিপহপের অনুপ্রেরণাও লক্ষ্য করা যায়। এদের আরাওয়ান আর তেনহেরত গানগুলা র‍্যাপ এর ঢঙে গাওয়া। তাই তিনারিওয়েনরে এক্সোটিক কইরা দেখার কিছু নাই। এরা শুধুমাত্র ‘মরুভূমির ব্লুজ ব্যান্ড না’—এরা দুনিয়ার তাবত মিউজিকের সমুদ্রে ডুব দেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমসাময়িক মিউজিক থিকাও এরা ইন্সপিরেশন নেয়, তবে গায় নিজেদের মতো কইরা।

কর্তৃত্ববাদের কবলে তিনারিওয়েন

তিনারিওয়েন ফর্ম হওয়ার পর থিকাই তাদের যাত্রা ছিলো গ্যাঞ্জামে ভরা। তুয়ারেগ বিদ্রোহে জড়িত থাকার কারণে ১৯৮৯ সালে মালি সরকার তাদের ক্যাসেট নিষিদ্ধ কইরা দেয়। সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলমান থাকে অনেকদিন। পরে নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে তুয়ারেগ আর মালি সরকারের মধ্যে একটা শান্তিচুক্তি হয়। তিনারিওয়েন সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগ্রাম থিকা বাইর হইয়া শান্তি ছড়াইয়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই অংশ হিসাবে এরা ফরাসি মিউজিক কালেকটিভ Lo'Jo এর সাথে মিল্যা আয়োজন করে Festival au Désert অর্থাৎ মরুভূমির উৎসব। এইটা মার্কেটিং গিমিকের জমিন উৎরাইয়া মরুভূমির বিচিত্র যাযাবর জনগোষ্ঠীগুলার মিউজিক ও ব্যবসায়িক লেনাদেনার জায়গা তৈরী কইরা দিসিলো। এতে আফ্রিকান লেজেন্ড আলী ফারকা তুরে, উমু সাঙ্গারে, বাসুকু কুয়াতে থিকা লেড জেপেলিন এর ভোকালিস্ট রবার্ট প্ল্যান্ট, U2-র ভোকালিস্ট বনো, পাংক ব্যান্ড ব্ল্যাক ফায়ারসহ আরো অনেকেই অংশ নিসিলো। ২০০১ থিকা টানা ১২ বছর এই ফ্যাস্টিভাল নামাইতে পারলেও এক পর্যায়ে ঝামেলা বাধায় আল কায়েদা। ইউরোপ, আম্রিকা থিকা আসা ট্যুরিস্টদের অপহরণ কইরা মুক্তিপণ আদায় করতে থাকে এরা। পরে নিরাপত্তার অজুহাতে এই আয়োজন বন্ধ করে মালি সরকার। ফেস্টিভ্যাল এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গেলে এখনো ‘Still in exile’ অর্থাৎ ‘এখনো নির্বাসনে’ লেখাটা চোখে পড়ে।

ন্যাটো গাদ্দাফিরে হত্যা করলে তুয়ারেগরা নিজেদের ভূমিতে ফিইরা যায়। অটোনোমির আশায় যোগ দেয় মিলিট্যান্ট ইসলামিস্ট গ্ৰুপদের সাথে এবং কিছুদিনের জন্য সফলও হয়। নিজেদের অঞ্চলরে এরা মুক্ত ঘোষণা করে। তবে দুইপক্ষের ইসলাম, ক্ষমতা আর ফ্রিডমের বোঝাপড়া ভিন্ন। কারণ তুয়ারেগরা মাতৃতান্ত্রিক, সুন্নী মালিকী মাজহাব, সুফিবাদী স্পিরিচুয়ালিটি আর মরুভূমির ইন্ডিজেনাস লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত। নারীদের ‘ইমিজাদ’ নামের এক তারওয়ালা ট্রাডিশনাল বাদ্যযন্ত্র বাজানো এদের কালচারের একটা পরিচিত দৃশ্য। গডমাদারখ্যাত লাল্লা বাদী বা মিঞা ওয়ালেত ওমারের মতো অসংখ্য নারী শিল্পী তুয়ারেগ মিউজিকরে জিয়াইয়া রাখসে। অন্যদিকে আনসার- দ্বীন আর আল কায়েদার মতো সংগঠন চাইতো ‘শরিয়া আইন’। তুয়ারেগদের লাইফস্টাইল তাদের কাছে ‘হারাম’। তাই ক্ষমতা পাওয়ার সাথে সাথে তাদের উপর শুরু হয় মিলিট্যান্ট ইসলামিস্ট গ্ৰুপদের তাফালিং। এরা গানবাজনারে নিষিদ্ধ করে, পুড়াইয়া ফেলে অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র। নারীদের জীবনে নামে কর্তৃত্বের খবরদারি।

এরই সূত্র ধইরা, ২০১৩ সালের শুরুর দিকে তিনারিওয়েনের ভোকালিস্ট ও গিটারিস্ট আব্দাল্লাহ আগ লামিদারে অপহরণ করে আনসার-দ্বীন; যদিও কিছুদিন পরেই সে পালাইয়া আসতে পারসিলো।

তুয়ারেগদের মুখে গিটারিস্ট কেদু আগ আসাদরে নিয়ে একটা গল্প ঘুরাফেরা করে। গল্পটা এইরকম যে - ‘৯০ এর বিদ্রোহে সে এক কান্ধে AK-47 আর আরেক কান্ধে একটা স্ট্রেটকাস্টার গিটার নিয়া হাজির হয়। সতেরোটা গুলি খাওয়ার পরেও সে বাইচা ফিরসিলো। বর্তমানেও তিনারিওয়েন নিজেদের এলাকায় কোনো কনসার্ট বা পারফরম্যান্স করতে পারে না– মানে এখনো নির্বাসিত।

৪৬ বছর এন্ড স্টিল কিকিং!

‘’তেনেরের পায়ের ছাপ মুইছা গেছে ,

খালি বাতাস জানে - আমরা কোন পথে হাটসিলাম’’

নিজেদের জমিনে পরবাসী হওয়া সত্ত্বেও, গত ৪৬ বছরে তিনারিওয়েন মোট নয়টা ষ্টুডিও এলবাম রিলিজ করসে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসংখ্য লাইভ কনসার্ট তো আছেই। আফ্রিকা, ইন্ডিয়া ,আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন শিল্পীর সাথে আছে কোলাবোরেশন। ২০১৭ সালের ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে লাইভ পারফরম্যান্স করে এরা। দুই বছর আগে রিলিজ হওয়া এলবাম Amatssou শুনলে মনে হয় এইটা তো সেই চিরপরিচিত তিনারিওয়েনই - ফ্রেশ, অথেন্টিক আর মেলানকলিক।

তাদের মিউজিকের শুইনা তৈরী হইসে বহু তুয়ারেগ ও অন্যান্য কালচারের মিউজিক কালেকটিভ যারা আফ্রিকান বা ওয়ার্ল্ড মিউজিকের বিশাল ভান্ডাররে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ কইরা তুলতেসে। সকল হেডম আর কর্তৃত্বরে মিডল ফিঙ্গার দেখাইয়া মরুভুমির বালু আর বাতাসের গন্ধ শরীরে মাইখা আজো হাইটা যাইতেসে তিনারিওয়েন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত