এমন কিছু সিনেমা বা টিভি সিরিজ থাকে যা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে ইচ্ছা হয়; মনে হয় অন্যরাও দেখুক। তেমনই সিনেমা ও টিভি সিরিজ নিয়ে পপ স্ট্রিমের নিয়মিত কন্টেন্ট সিরিজ ‘হোয়াই ইউ শুড ওয়াচ দিস’। আজ থাকলো এই সিরিজের প্রথম পর্ব।
তুফায়েল আহমদ
সিনেমা দেখারে এখন আর তেমন কোনো ক্রিয়েটিভ কাজ হিসাবে গোনায় ধরা হয় না। সিনেমা কি আর্ট নাকি স্রেফ বিনোদন— এই ক্যাচাল ‘আদর্শ সিনেমাপ্রেমী’দের কাছে যতই কুরুচিপূর্ণ শোনাক, গণতান্ত্রিক নিয়মে ‘সিনেমা এখন বিনোদন’ বলেই জয়যুক্ত হয়েছে। পাবলিক এখন পয়সা খরচ করে মজা পাওয়ার জন্যই হলে যায়, সাবস্ক্রিপশন কেনে।
তার মানে এই না যে, বিনোদন হলেই সেটা আর্ট হতে পারবে না। তবে মোটা দাগে, সিরিয়াস সমালোচকেরা আর্ট আর বিনোদনকে এক পাল্লায় মাপতে নারাজ। তবে এই আর্ট, বিনোদন আর আঁতেলগিরির বিতর্কের মধ্যেই হুট করে বাম হাত ঢুকিয়ে দেয় কিছু আজগুবি সিনেমা। প্রথম দেখায় স্রেফ বিনোদন, দ্বিতীয় দফায় দেখলে বুঝবেন বিনোদনের আড়ালে কিছু চিন্তার খোরাকও আছে। আর ভুলক্রমে তৃতীয়বার দেখে ফেললে তো কেল্লাফতে! দেখবেন মজা হাওয়া, বিনোদন গায়েব। আছে শুধু খোঁচা আর অবিরাম উস্কানি। এমনই এক সিনেমা উডি অ্যালেনের ‘জেলিগ’ (১৯৮৩)।
জেলিগ হলো চুপচাপ ঘরে ঢোকা, গলা খাঁকারি দিয়ে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাওয়া অনাহূত অতিথির মতো। যে চায় আপনি তাকে হালকা পাত্তা দেন। সত্যি বলতে আপনার আসলেই জেলিগ সিনেমাটাকে পাত্তা দেওয়া উচিত। এই সিনেমা ঢাক-ঢোল পেটায় না, বরং পাড়ার আড্ডায় গিয়ে আধা কাপ চা অর্ডার করে, তারপর ধীরে ধীরে আপনারই টোনে কথা বলা শুরু করে। আর এই গোলমালে ভরা পৃথিবীতে কেউ একজন আপনাকে অনুকরণ করলে তাকে তো অল্প হলেও পাত্তা দেওয়া উচিত।
উডি অ্যালেনের ১৯৮৩ সালের এই কমেডি মাস্টারপিস আসলে সিনেমা কম, গিরগিটি বেশি। সিনেমার মূল চরিত্র জেলিগের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। এত ভদ্র, নিরামিষ, চুপচাপ স্বভাবের জেলিগ যার সঙ্গেই কথা বলে বা আড্ডা দেয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মতো হয়ে যায়। বুঝতে পারেননি বোধহয় বিষয়টা। সহজ করে বলি, ধরেন জেলিগ রোগী হয়ে গেছেন কোনো হাসপাতালে, কথা বলছেন একজন ডাক্তারের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খেয়াল করবেন জেলিগ নিজেও ডাক্তারের মতো কথা বলতে শুরু করেছেন। আর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো আপনি দেখবেন জেলিগের গায়ে আচমকা সাদা গাউন আর গলায় স্টেথোস্কোপ।
জেলিগের রোগটা অদ্ভুত; সবাই যাতে তাকে পছন্দ করে, গ্রহণ করে, এই আশায় সে শারীরিক ও মানসিকভাবে বদলে যায়। তাকে যদি ক্রিকেটারের সঙ্গে ছেড়ে দেন, আপনি বুঝতেই পারবেন না যে জেলিগ ক্রিকেটার নয়। মিউজিশিয়ান, সৈনিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী—কোনো কিছুই হওয়া বাদ রাখেনি সে। জেলিগ যেন মনুষ্যরূপী গিরগিটি। কেউ বলে সে এলিয়েন, কেউ বলে বিদেশি এজেন্ট, কেউ বলে পাবলিসিটি স্টান্ট!
তাকে যদি শাহবাগের রবীন্দ্রসংগীতপন্থীদের মধ্যে রাখেন, কিছুক্ষণের মধ্যে সে পরবে ঝকঝকে সাদা পাঞ্জাবি, গলায় তুলে নেবে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গানের লাইন। টঙের দোকানের আড্ডায় গরমাগরম ‘মেসি-রোনালদো কে সেরা’ বিতর্কের মধ্যে ফেললে জেলিগের মুখে বের হবে ফুটবল সংক্রান্ত বিশাল বিশাল পরিসংখ্যান আর বিশ্লেষণ। এমনকি জেলিগকে যদি অনেকক্ষণ বকুল ফুলের গাছের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখেন, সম্ভাবনা আছে তাঁর গা থেকে ধীরে ধীরে মিষ্টি কিন্তু কটু গন্ধ বেরোবে।
শুনে আপনার মনে হচ্ছে না, দূর! এ তো একদম পাগলামি। অযৌক্তিক! কিন্তু উডি অ্যালেনের হাতে সিনেমাটা হয়ে ওঠে আমাদের ‘সবার সঙ্গে মানিয়ে’ নেওয়ার অভ্যাসের নিখুঁত ব্যঙ্গচিত্র। এই অযৌক্তিক, ব্যঙ্গাত্মক সিনেমাটা উডি অ্যালেন বানিয়েছেন ডকুমেন্টারি স্টাইলে। সিনেমাটা জুড়ে আছে সাদা-কালো তথ্যচিত্র—গম্ভীর কণ্ঠে বর্ণনা, ফাইল ফুটেজ, আর জেলিগের আজব রোগ নিয়ে ‘বিশেষজ্ঞ’দের সাক্ষাৎকার।
প্রশ্নটা দাঁড়ায়—জেলিগ কি এক চিকিৎসাবিদ্যার বিস্ময়, নাকি মনস্তত্ত্বের ধাঁধা? নাকি সে আসলে টিকে থাকার জন্য যেভাবেই হোক মানিয়ে চলা আমাদের চিরচেনা বাঁচার কৌশলের প্রতীক?
উডি অ্যালেনের স্বভাবসুলভ হিউমার আর পাঞ্চলাইনের মুনশিয়ানায় আটকে গেলে সিনেমার আসল গল্প হারিয়ে যাবে। জেলিগ এমন এক মানুষ, যে মিশে যেতে চায় এতটাই মরিয়া হয়ে, যে শেষে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সে আমাদেরই অবচেতন ভয়— ‘আমি কি সবার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি’, ‘লোকজন কী ভাববে’, ‘সবাই যেমন, আমিও তেমন’।
সিনেমাটা দেখতে গিয়ে বুঝবেন আপনি একজন জেলিগ।
প্রমাণ চান? ধরুন, আপনার আশেপাশের সবাই বলছে ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমাটা দারুণ হয়েছে, নোলান তো এই যুগের ফাইনেস্ট ডিরেক্টর, ব্লা ব্লা ব্লা। আপনি ওপেনহাইমারের নাম শুনলেও নোলানকে চেনেন না, সিনেমা দেখা তো বহুদূর। সবার সঙ্গে আলাপে অংশ নিতে না পেরে আপনার ভয় হতে লাগল, ‘হায় হায়! সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না বোধহয়? আমার সঙ্গে কথা বলতে কেউ মজা পায় না বোধহয়? কেউ মনে হয় আমাকে পাত্তা দেবে না।’
একাকীত্ব আর বিচ্ছিন্নতার ভয়ে আপনি মিথ্যে ভান শুরু করলেন। ওপেনহাইমার না দেখেই বললেন, ‘সিনেমাটা তো সেরা হয়েছে। নোলান তো গড লেভেলের ডিরেক্টর।’ নিজের অজান্তেই একটা সম্পূর্ণ নতুন ‘মিথ্যা আমি’-র জন্ম হলো। আপনিও জেলিগ হয়ে উঠলেন। জেলিগের বেলাতেও তাই ঘটে, শুধু একটু চরম পর্যায়ে, তাই আমরা দেখে হকচকিয়ে যাই। আমরা সবাই কিছুটা জেলিগ, সবাই গিরগিটি। কেউ দ্রুত রং বদলায়, কেউ ধীরে। জেলিগ শুধু রঙটা পুরোপুরি মেশাতে পারে।
এরপর আসেন ড. ইউডোরা ফ্লেচার (মিয়া ফ্যারো)। বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, অথচ ক্রমশ বিরক্ত হয়ে পড়া এক মনোচিকিৎসক। তিনি জেলিগকে নিজের সত্তা ফিরে পেতে সাহায্য করতে চান। জেলিগের এই রূপবদলের অসুখের সমাধান করতে চান। কিন্তু জেলিগ তো জেলিগই! উল্টো কিছুক্ষণের জন্য বিয়ের ঘটকে পরিণত হয়ে ড. ইউডোরাকেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। কোনো ভালো ছেলে দেখব?’
এসব কৌতুক, ব্যঙ্গ, আর স্যাটায়ারের নিচে আছে এক কোমল প্রেমের গল্প। জেলিগ যে চায়, কেউ তাকে একটু পড়ুক, বুঝুক। অন্যদিকে ড. ইউডোরা যে চায় জেলিগকে পড়তে, আর একটু বুঝতে। চিকিৎসার পদ্ধতি, ওষুধ, হিপনোসিস এগুলো তো নিছক প্রক্রিয়া। জেলিগের আসল চিকিৎসা ছিল ইউডোরার সহানুভূতি ও আস্থা। ইউডোরার ভালোবাসা জেলিগকে প্রথমবারের মতো এমন এক আশ্রয় দেয়, যেখানে অন্যের মতো হওয়ার জন্য তার নিজের চেহারা বদলাতে হয় না। যে মানুষটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল, সে-ই প্রথম একজনের চোখে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে খুঁজে পায়।
আজকের এই তীব্র গতির, স্ট্রিমিং-পূর্ণ পৃথিবীতে জেলিগ এক ধরনের শান্ত সিগারেটবিরতি—চুপচাপ, বিনয়ী, অথচ গভীর। তাহলে এখন কেন দেখছেন না ‘জেলিগ’ সিনেমাটা? সিনেমাটা দেখতে দেখতে আপনি দেখবেন নিজেকেই—আত্মীয়দের, অফিসের কলিগকে, সেই বন্ধুকে যে আড্ডাভেদে রাজনৈতিক রঙ বদলায়। দেখবেন সেই কাজিনকে, যে মাত্র দুই সপ্তাহ বিদেশে সফরে গিয়ে ফিরে এসেছে ‘ফরেন অ্যাকসেন্ট’ নিয়ে।
আমরা সবাই একটু করে নিজের জায়গা খুঁজতে থাকা লিওনার্ড জেলিগ। কেউ যেন আমাদের ‘সত্যিকারের আমিটাকে’ একবার অন্তত চিনে ফেলে, সেই আশায় বেঁচে থাকা। আর যদি এই সব নাটকের মধ্যে দাঁড়িয়ে জেলিগ সিনেমাটা দেখে নিজেদের নিয়েই একটু হাসতে পারি! তবে বুঝে নিন ‘আমরাও আসলে ঠিকঠাক মানিয়ে নিচ্ছি।’
সিনেমা দেখারে এখন আর তেমন কোনো ক্রিয়েটিভ কাজ হিসাবে গোনায় ধরা হয় না। সিনেমা কি আর্ট নাকি স্রেফ বিনোদন— এই ক্যাচাল ‘আদর্শ সিনেমাপ্রেমী’দের কাছে যতই কুরুচিপূর্ণ শোনাক, গণতান্ত্রিক নিয়মে ‘সিনেমা এখন বিনোদন’ বলেই জয়যুক্ত হয়েছে। পাবলিক এখন পয়সা খরচ করে মজা পাওয়ার জন্যই হলে যায়, সাবস্ক্রিপশন কেনে।
তার মানে এই না যে, বিনোদন হলেই সেটা আর্ট হতে পারবে না। তবে মোটা দাগে, সিরিয়াস সমালোচকেরা আর্ট আর বিনোদনকে এক পাল্লায় মাপতে নারাজ। তবে এই আর্ট, বিনোদন আর আঁতেলগিরির বিতর্কের মধ্যেই হুট করে বাম হাত ঢুকিয়ে দেয় কিছু আজগুবি সিনেমা। প্রথম দেখায় স্রেফ বিনোদন, দ্বিতীয় দফায় দেখলে বুঝবেন বিনোদনের আড়ালে কিছু চিন্তার খোরাকও আছে। আর ভুলক্রমে তৃতীয়বার দেখে ফেললে তো কেল্লাফতে! দেখবেন মজা হাওয়া, বিনোদন গায়েব। আছে শুধু খোঁচা আর অবিরাম উস্কানি। এমনই এক সিনেমা উডি অ্যালেনের ‘জেলিগ’ (১৯৮৩)।
জেলিগ হলো চুপচাপ ঘরে ঢোকা, গলা খাঁকারি দিয়ে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাওয়া অনাহূত অতিথির মতো। যে চায় আপনি তাকে হালকা পাত্তা দেন। সত্যি বলতে আপনার আসলেই জেলিগ সিনেমাটাকে পাত্তা দেওয়া উচিত। এই সিনেমা ঢাক-ঢোল পেটায় না, বরং পাড়ার আড্ডায় গিয়ে আধা কাপ চা অর্ডার করে, তারপর ধীরে ধীরে আপনারই টোনে কথা বলা শুরু করে। আর এই গোলমালে ভরা পৃথিবীতে কেউ একজন আপনাকে অনুকরণ করলে তাকে তো অল্প হলেও পাত্তা দেওয়া উচিত।
উডি অ্যালেনের ১৯৮৩ সালের এই কমেডি মাস্টারপিস আসলে সিনেমা কম, গিরগিটি বেশি। সিনেমার মূল চরিত্র জেলিগের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। এত ভদ্র, নিরামিষ, চুপচাপ স্বভাবের জেলিগ যার সঙ্গেই কথা বলে বা আড্ডা দেয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মতো হয়ে যায়। বুঝতে পারেননি বোধহয় বিষয়টা। সহজ করে বলি, ধরেন জেলিগ রোগী হয়ে গেছেন কোনো হাসপাতালে, কথা বলছেন একজন ডাক্তারের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খেয়াল করবেন জেলিগ নিজেও ডাক্তারের মতো কথা বলতে শুরু করেছেন। আর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো আপনি দেখবেন জেলিগের গায়ে আচমকা সাদা গাউন আর গলায় স্টেথোস্কোপ।
জেলিগের রোগটা অদ্ভুত; সবাই যাতে তাকে পছন্দ করে, গ্রহণ করে, এই আশায় সে শারীরিক ও মানসিকভাবে বদলে যায়। তাকে যদি ক্রিকেটারের সঙ্গে ছেড়ে দেন, আপনি বুঝতেই পারবেন না যে জেলিগ ক্রিকেটার নয়। মিউজিশিয়ান, সৈনিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী—কোনো কিছুই হওয়া বাদ রাখেনি সে। জেলিগ যেন মনুষ্যরূপী গিরগিটি। কেউ বলে সে এলিয়েন, কেউ বলে বিদেশি এজেন্ট, কেউ বলে পাবলিসিটি স্টান্ট!
তাকে যদি শাহবাগের রবীন্দ্রসংগীতপন্থীদের মধ্যে রাখেন, কিছুক্ষণের মধ্যে সে পরবে ঝকঝকে সাদা পাঞ্জাবি, গলায় তুলে নেবে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গানের লাইন। টঙের দোকানের আড্ডায় গরমাগরম ‘মেসি-রোনালদো কে সেরা’ বিতর্কের মধ্যে ফেললে জেলিগের মুখে বের হবে ফুটবল সংক্রান্ত বিশাল বিশাল পরিসংখ্যান আর বিশ্লেষণ। এমনকি জেলিগকে যদি অনেকক্ষণ বকুল ফুলের গাছের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখেন, সম্ভাবনা আছে তাঁর গা থেকে ধীরে ধীরে মিষ্টি কিন্তু কটু গন্ধ বেরোবে।
শুনে আপনার মনে হচ্ছে না, দূর! এ তো একদম পাগলামি। অযৌক্তিক! কিন্তু উডি অ্যালেনের হাতে সিনেমাটা হয়ে ওঠে আমাদের ‘সবার সঙ্গে মানিয়ে’ নেওয়ার অভ্যাসের নিখুঁত ব্যঙ্গচিত্র। এই অযৌক্তিক, ব্যঙ্গাত্মক সিনেমাটা উডি অ্যালেন বানিয়েছেন ডকুমেন্টারি স্টাইলে। সিনেমাটা জুড়ে আছে সাদা-কালো তথ্যচিত্র—গম্ভীর কণ্ঠে বর্ণনা, ফাইল ফুটেজ, আর জেলিগের আজব রোগ নিয়ে ‘বিশেষজ্ঞ’দের সাক্ষাৎকার।
প্রশ্নটা দাঁড়ায়—জেলিগ কি এক চিকিৎসাবিদ্যার বিস্ময়, নাকি মনস্তত্ত্বের ধাঁধা? নাকি সে আসলে টিকে থাকার জন্য যেভাবেই হোক মানিয়ে চলা আমাদের চিরচেনা বাঁচার কৌশলের প্রতীক?
উডি অ্যালেনের স্বভাবসুলভ হিউমার আর পাঞ্চলাইনের মুনশিয়ানায় আটকে গেলে সিনেমার আসল গল্প হারিয়ে যাবে। জেলিগ এমন এক মানুষ, যে মিশে যেতে চায় এতটাই মরিয়া হয়ে, যে শেষে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সে আমাদেরই অবচেতন ভয়— ‘আমি কি সবার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি’, ‘লোকজন কী ভাববে’, ‘সবাই যেমন, আমিও তেমন’।
সিনেমাটা দেখতে গিয়ে বুঝবেন আপনি একজন জেলিগ।
প্রমাণ চান? ধরুন, আপনার আশেপাশের সবাই বলছে ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমাটা দারুণ হয়েছে, নোলান তো এই যুগের ফাইনেস্ট ডিরেক্টর, ব্লা ব্লা ব্লা। আপনি ওপেনহাইমারের নাম শুনলেও নোলানকে চেনেন না, সিনেমা দেখা তো বহুদূর। সবার সঙ্গে আলাপে অংশ নিতে না পেরে আপনার ভয় হতে লাগল, ‘হায় হায়! সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না বোধহয়? আমার সঙ্গে কথা বলতে কেউ মজা পায় না বোধহয়? কেউ মনে হয় আমাকে পাত্তা দেবে না।’
একাকীত্ব আর বিচ্ছিন্নতার ভয়ে আপনি মিথ্যে ভান শুরু করলেন। ওপেনহাইমার না দেখেই বললেন, ‘সিনেমাটা তো সেরা হয়েছে। নোলান তো গড লেভেলের ডিরেক্টর।’ নিজের অজান্তেই একটা সম্পূর্ণ নতুন ‘মিথ্যা আমি’-র জন্ম হলো। আপনিও জেলিগ হয়ে উঠলেন। জেলিগের বেলাতেও তাই ঘটে, শুধু একটু চরম পর্যায়ে, তাই আমরা দেখে হকচকিয়ে যাই। আমরা সবাই কিছুটা জেলিগ, সবাই গিরগিটি। কেউ দ্রুত রং বদলায়, কেউ ধীরে। জেলিগ শুধু রঙটা পুরোপুরি মেশাতে পারে।
এরপর আসেন ড. ইউডোরা ফ্লেচার (মিয়া ফ্যারো)। বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, অথচ ক্রমশ বিরক্ত হয়ে পড়া এক মনোচিকিৎসক। তিনি জেলিগকে নিজের সত্তা ফিরে পেতে সাহায্য করতে চান। জেলিগের এই রূপবদলের অসুখের সমাধান করতে চান। কিন্তু জেলিগ তো জেলিগই! উল্টো কিছুক্ষণের জন্য বিয়ের ঘটকে পরিণত হয়ে ড. ইউডোরাকেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। কোনো ভালো ছেলে দেখব?’
এসব কৌতুক, ব্যঙ্গ, আর স্যাটায়ারের নিচে আছে এক কোমল প্রেমের গল্প। জেলিগ যে চায়, কেউ তাকে একটু পড়ুক, বুঝুক। অন্যদিকে ড. ইউডোরা যে চায় জেলিগকে পড়তে, আর একটু বুঝতে। চিকিৎসার পদ্ধতি, ওষুধ, হিপনোসিস এগুলো তো নিছক প্রক্রিয়া। জেলিগের আসল চিকিৎসা ছিল ইউডোরার সহানুভূতি ও আস্থা। ইউডোরার ভালোবাসা জেলিগকে প্রথমবারের মতো এমন এক আশ্রয় দেয়, যেখানে অন্যের মতো হওয়ার জন্য তার নিজের চেহারা বদলাতে হয় না। যে মানুষটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল, সে-ই প্রথম একজনের চোখে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে খুঁজে পায়।
আজকের এই তীব্র গতির, স্ট্রিমিং-পূর্ণ পৃথিবীতে জেলিগ এক ধরনের শান্ত সিগারেটবিরতি—চুপচাপ, বিনয়ী, অথচ গভীর। তাহলে এখন কেন দেখছেন না ‘জেলিগ’ সিনেমাটা? সিনেমাটা দেখতে দেখতে আপনি দেখবেন নিজেকেই—আত্মীয়দের, অফিসের কলিগকে, সেই বন্ধুকে যে আড্ডাভেদে রাজনৈতিক রঙ বদলায়। দেখবেন সেই কাজিনকে, যে মাত্র দুই সপ্তাহ বিদেশে সফরে গিয়ে ফিরে এসেছে ‘ফরেন অ্যাকসেন্ট’ নিয়ে।
আমরা সবাই একটু করে নিজের জায়গা খুঁজতে থাকা লিওনার্ড জেলিগ। কেউ যেন আমাদের ‘সত্যিকারের আমিটাকে’ একবার অন্তত চিনে ফেলে, সেই আশায় বেঁচে থাকা। আর যদি এই সব নাটকের মধ্যে দাঁড়িয়ে জেলিগ সিনেমাটা দেখে নিজেদের নিয়েই একটু হাসতে পারি! তবে বুঝে নিন ‘আমরাও আসলে ঠিকঠাক মানিয়ে নিচ্ছি।’
লালন ফকির কিংবা লালন ফকিরের অনুসারীদেরকে গাঁজাখোর তকমা দেওয়ার প্রবণতা চলছে। লালন কি গাঁজা খেতেন? লালন কি শিষ্যদেরকে গাঁজা খেতে অনুমতি বা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেছেন? লালন ফকির ও গাঁজার সম্পর্ক বা সম্পর্কহীনতা নিয়ে এই লেখা।
৪ দিন আগেতিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান সম্প্রতি লোকান্তরিত হলেন। নব্বয়ের দশকের কিশোরদের কল্পনার দুনিয়া শাসন করেছে তার সৃষ্ট মুসা-কিশোর-রবিনরা। নব্বয়ের দশকের লোকপ্রিয় সাহিত্য, সংস্কৃতি আর সেখানে রকিব হাসানের ভূমিকা নিয়ে এই লেখা
৫ দিন আগেসেদিনও বিকেলটা কেটে যাচ্ছিল টিকটকের অতল গহ্বরে। জানেন তো, ওই যে যখন স্ক্রল করতে করতে দুনিয়ার আর কোনো হুঁশ থাকে না, মগজটা যেন অন্য কারও কাছে বন্ধক রাখা। ঠিক তখনই চোখে পড়ল একটা ভিডিও। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরের কোনো এক বিল্ডিংয়ের ভেতরের দৃশ্য।
৭ দিন আগেডায়ান কিটন কেবলই অভিনেত্রী ছিলেন না, ছিলেন এক সাংস্কৃতিক বিস্ময়; সারল্য ও অকৃত্রিমতার আইকন, হাতের ইশারা ও নিখুঁত তোতলামিতে গভীর, হাস্যকর ও হৃদয়বিদারক সত্যি তুলে ধরার এক অনন্য শিল্পী। লা-দি-দা-খ্যাত এই শিল্পীর প্রতি পপস্ট্রিমের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
৯ দিন আগে