leadT1ad

শীতকালে কেন আমাদের মন খারাপ হয়

শীত এলেই অনেকের মুড যেন একটু থমকে যায়। অকারণে মন খারাপ বা ক্লান্তি ঘিরে ধরে। প্রশ্ন জাগে, শীতকাল কি সত্যিই আমাদের মুড অফ করে দেয়? নাকি এর পেছনে আছে শরীরের কোনো প্রতিক্রিয়া? শীতে আমাদের বিষণ্নতার কারণ খুঁজে দেখা যাক।

রাতুল আল আহমেদ
রাতুল আল আহমেদ

শীতকালে মন খারাপ হওয়ার প্রতীকী ছবি। স্ট্রিম গ্রাফিক

সারাদেশেই এখন কমবেশি শীত নেমেছে। এ সময় সকালে স্কুল-কলেজ বা অফিসে যেতে কেমন একটা আলসেমি লাগেই। তবে আমার সমস্যা অফিসে যাওয়া নয়, বরং অফিস থেকে বাড়ি ফেরা। গরমের দিনে যেখানে সাতটা বাজলেও আকাশে সোনার রেখা ভেসে থাকত, সেখানে এখন পাঁচটার পর অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি অন্ধকার শহরে লাল-নীল বাতি ঝলকাচ্ছে। এত মানুষের ভিড় ঠেলে বাড়ি ফিরতে বড্ড হয়রান লাগে তখন।

বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, এমনটা যে কেবল আমার সঙ্গেই হয় তা নয়। দুনিয়াজুড়েই নাকি দিনের আলো নিভে যেতে শুরু করলে কিছু মানুষের মধ্যে দেখা দেয় অকারণ ক্লান্তি, মন খারাপ, কাজে অমনোযোগ বা নিছক অস্থিরতা। এগুলোকে আমরা কখনো ‘শীতের অলসতা’, আবার কখনো স্রেফ ‘মুড অফ’ হিসেবে দেখি। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় এর একটি নাম আছে—সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার বা স্যাড।

অনেকেই জানেন না যে শীত শুরু হলে আমাদের দেহে যে পরিবর্তন হয়, তার সবই আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এ সময়ে প্রকৃতি শুধুমাত্র গাছপালা নয়, প্রাণীকুলকেও এক ধরনের শান্ত ও নিস্তব্ধ অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়। মানুষও এই প্রাকৃতিক ছন্দের বাইরে নয়।

প্রকৃতির দিকে তাকালেই দেখা যায়, শীত নামলে অনেক প্রাণী শীতঘুমে চলে যায়, আবার যারা সক্রিয় থাকে, তাদের অনেকেই স্বাভাবিক কাজকর্ম কমিয়ে ফেলে। কারণ, শীতে খাবারের অভাব, আলো কমে যাওয়া এবং শরীরে শক্তি খরচের সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে বেঁচে থাকার কৌশল বদলে যায়।

প্রকৃতির দিকে তাকালেই দেখা যায়, শীত নামলে অনেক প্রাণী শীতঘুমে চলে যায়, আবার যারা সক্রিয় থাকে, তাদের অনেকেই স্বাভাবিক কাজকর্ম কমিয়ে ফেলে। কারণ, শীতে খাবারের অভাব, আলো কমে যাওয়া এবং শরীরে শক্তি খরচের সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে বেঁচে থাকার কৌশল বদলে যায়। মানুষের ক্ষেত্রেও আলো কমে যাওয়াটা বড় প্রভাবক। শীতের দিনে সূর্যোদয় দেরিতে হয়, আর সূর্যাস্তও স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে আসে। ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি, যেটিকে সার্কাডিয়ান রিদম বলা হয়, তা আস্তে আস্তে নিজের তাল হারাতে শুরু করে। যে ঘড়ি আমাদের ঘুম, জাগরণ, ক্ষুধা, শক্তি এবং মুডের নকশা তৈরি করে, সেই ঘড়িতে ছোটখাটো সময়ের গরমিলও মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে।

এছাড়াও আলো কমে গেলে মস্তিষ্কে মেলাটোনিন নামের হরমোনের উৎপাদন মাত্রা বেড়ে যায়, যা ঘুম ও অবসন্নতাকে বাড়িয়ে দেয়। একই সময়ে কমে যায় মুড ভালো রাখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক সেরোটোনিন। এর ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা নিস্তেজ, দুর্বল ও বিষণ্ন অনুভব করে।

বিজ্ঞানের ভাষায় এর একটি নাম আছে—সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার বা স্যাড। সংগৃহীত ছবি
বিজ্ঞানের ভাষায় এর একটি নাম আছে—সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার বা স্যাড। সংগৃহীত ছবি

বৈজ্ঞানিকগণ বলছেন, এ প্রতিক্রিয়া জন্মগতভাবে আমাদের ভেতর বিবর্তনিক প্রক্রিয়ায় গেঁথে আছে। প্রাণীজগতের অনেক প্রজাতির মতো মানুষও অতীতে শীতের সময় কম শক্তি ব্যয় করে বেঁচে থাকার কৌশল শিখেছিল। আধুনিক জীবনযাপন সেই আদিম ছন্দকে সরাতে পারেনি। শুধু এতটাই আড়াল করে রেখেছে যে আমরা সেটা অনুভব করলেও তার কারণ বুঝতে পারি না। ঠিক এ সূক্ষ্ম পরিবর্তনের কারণেই শীতের শুরুতেই কারও কারও মন ভারী হয়ে আসে। কেউ আবার সারাদিন ঘুমাতে চায়, কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না, মানুষের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহও কমে যায়। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় পুরোনো বিষণ্নতা, পরিবারে কারো এ সমস্যার উপস্থিতি বা ভৌগোলিক কারণে দীর্ঘ শীত, তাহলে সমস্যা বাড়তে পারে।

বিজ্ঞান বলছে, মানুষের মনের এই ঋতুভিত্তিক অবস্থার শেকড় আরও গভীরে। সেরোটোনিন উৎপাদনের জিনে ভিন্নতা, মস্তিষ্কে সেই সিগন্যাল প্রক্রিয়াকরণের পরিবর্তন, কিংবা আলো থেকে পাওয়া উদ্দীপনাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা না করা—এসব কারণেও ‘স্যাড’ নামে পরিচিত এই অবস্থা দেখা দিতে পারে। এমনকি ব্যক্তিত্বের ধরনও এতে ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশ্বজুড়ে এই সমস্যার বিস্তার সমান নয়। যেমন নর্ডিক দেশগুলোর বেশিরভাগ অঞ্চলে দীর্ঘ শীতের কারণে স্যাড অত্যন্ত পরিচিত একটি অভিজ্ঞতা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় একই উত্তরের দেশ আইসল্যান্ডে এর হার তুলনামূলকভাবে খুবই কম। একাধিক গবেষণা বলছে, এর কারণ হতে পারে দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার মানুষের খাদ্যাভ্যাস, বিশেষ করে প্রচুর মাছ খাওয়া, যা ভিটামিন ডি এবং ডিএইচএর মতো পুষ্টিতে সমৃদ্ধ। আবার কানাডায় আইসল্যান্ডিক বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও স্যাডের হার কম দেখা গেছে, যা এই খাদ্যাভ্যাস তত্ত্বকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। অর্থাৎ, শীতের অন্ধকারে মনের আলো নিভে যেতে চাইলেও কিছু সাংস্কৃতিক বা খাদ্যসংক্রান্ত উপাদান সেই অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে রাখতে সাহায্য করতে পারে।

এগুলোকে আমরা কখনো ‘শীতের অলসতা’, আবার কখনো স্রেফ ‘মুড অফ’ হিসেবে দেখি। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় এর একটি নাম আছে—সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার বা স্যাড।

মানুষ কেন শীতে বিষণ্ন হয়, তার উত্তর যতটা জটিল, সমাধান কিন্তু ততটাও কঠিন নয়। স্যাডের চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি সফলতার হার দেখা গেছে আলো ব্যবহারে। একে লাইট থেরাপি বলা হয়। এটি একটি বিশেষ ধরনের আলো, যা দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল। এতে মেলাটোনিন কমে এবং সেরোটোনিন উৎপাদন বাড়ে। তবে শীত জুড়ে নিয়মিত আলো পাওয়া গেলে ফল আরও ভালো হয়। কেউ কেউ আবার ভোরে আলো জ্বলে ওঠার একটি ধাপে ধাপে বাড়ানো সিস্টেম ব্যবহার করেন, যাতে ভোরের মতো অনুভূতি তৈরি হয়। এটিও বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আলো ছাড়াও ব্যায়াম এখানে একটি বড় ভূমিকা রাখে। শীতকালে শরীর স্বাভাবিকভাবেই কম সক্রিয় হয়ে যায়, আর ব্যায়াম সেই প্রবণতাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বাইরে হাঁটা, একটু রোদে দাঁড়ানো, নিয়মিত শরীরচর্চার মতো ছোটখাটো পরিবর্তনগুলো মস্তিষ্ককে জানায় যে শরীর এখনও সক্রিয় এবং দিনের স্বাভাবিক ছন্দ সচল আছে। মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যান্য সমস্যার মতোই স্যাডের ক্ষেত্রেও ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষত যদি উপসর্গগুলি দীর্ঘমেয়াদি হয় বা দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে। তবে যেকোনো চিকিৎসা শুরু করতে হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শই সবচেয়ে নিরাপদ।

সব মিলিয়ে স্যাড এমন একটি অবস্থা, যা প্রতি শীতে হাজারো মানুষের জীবনে নিভৃতে ঢুকে পড়ে। কেউ এটা বুঝতে পারেন, কেউ পারেন না। বুঝতে পারার পর আবার কেউ অবচেতনেই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক মনে করে গ্রহণ করে নেন। কিন্তু শীতের অন্ধকার যে মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে, এটা অস্বীকারের উপায় নেই। শীত মানেই তাই শুধু উৎসব বা ছুটি নয়; কারও কারও কাছে এটা মনকে শক্ত করে ধরার সময়, নিজেকে বুঝে চলার সময়। তবে ভালো দিক হলো এর সঙ্গে লড়াই করা শেখা যায়, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে এটা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়, বরং মানবদেহের স্বাভাবিক জৈবিক প্রতিক্রিয়া।

Ad 300x250

সম্পর্কিত