তুফায়েল আহমদ

আইনের দেবী থেমিসের চোখে কালো কাপড় বাঁধা থাকে। এর কেতাবি অর্থ, বিচার হবে অন্ধ বা নিরপেক্ষ; আবেগ, পরিচয় বা দৃশ্যমান চাকচিক্য সেখানে প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু আমার মনে হয় ঘটনা অন্য। থেমিস সম্ভবত লজ্জায় চোখ বাইন্ধা রাখছেন। বাস্তব জীবনে বিচারকের হাতুড়ি, আদালতের কাঠগড়া আর আইনের মোটা বইয়ের ফাঁকফোকর গলে প্রায়শই প্রকৃত অপরাধী বিএমডব্লিউ নিয়া বের হয়ে যায়, আর নির্দোষ পাবলিক জেলের ঘানি টানে।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে ‘বিচার’ ও ‘অবিচার’ এই দুইটা শব্দ একে অপরের ছায়ার মতো হাঁটছে, অনেকটা ‘টম অ্যান্ড জেরি’র মতো; একজন পালায় আরেকজন ধাওয়া করে। আর শিল্পমাধ্যম হিসেবে সিনেমা বারবার এই ইঁদুর-বিড়াল খেলাকে তুলে আনছে আমাদের সামনে।
কখনও আদালত কক্ষের শ্বাসরূদ্ধকর যুক্তি-তর্ক, কখনও বা আদালতের বাইরে সমাজের নিজস্ব ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’, আবার কখনও বিচারব্যবস্থার ধীরগতির জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া মানুষের হাহাকার—সেলুলয়েডের ফিতায় এসব গল্প কেবল বিনোদন হয়ে থাকে নাই, হয়ে উঠছে সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’ থেকে শুরু করে ‘কোর্ট’—বিশ্বসিনেমার সাতটি কালজয়ী চলচ্চিত্রকে সামনে রেখে আজ আমরা পপকর্ন হাতে দেখার চেষ্টা করব, সিনেমার চোখে বিচার, অবিচার ও ন্যায়বিচারের স্বরূপ কেমন।
১. টুয়েলভ অ্যাংগ্রি মেন (১৯৫৭): কনফার্মেশন বায়াস ও বিবেকের দংশন
বাবার হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এক কিশোরের ভাগ্য নির্ধারণ করতে বদ্ধ ঘরে জড়ো হন বারোজন জুরি সদস্য। প্রথাগত বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড প্রায় নিশ্চিত। এগারোজন জুরিই মনে করেন ছেলেটি দোষী। কিন্তু মাত্র একজন জুরি (যিনি ৮ নম্বর) ভিন্নমত পোষণ করেন এবং শুরু হয় শ্বাসরূদ্ধকর এক তর্কের লড়াই।

টুয়েলভ অ্যাংগ্রি মেন সিনেমাটি মূলত ‘কনফার্মেশন বায়াস’ বা বদ্ধমূল ধারণার এক মনস্তাত্ত্বিক ল্যাবরেটরি। বারোজন জুরির প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব সংস্কার, শ্রেণিবিদ্বেষ এবং ব্যক্তিগত ট্রমা নিয়ে টেবিলে বসছেন। কেউ ‘বস্তি’র ছেলে মানেই অপরাধী ভাবছেন, কেউ বা নিজের সন্তানের ওপর রাগ ঝাড়ছেন অভিযুক্তের ওপর। পরিচালক দেখান, বিচার কেবল সাক্ষ্য-প্রমাণের অংক নয়, এটি দেখার ভঙ্গিও। ১২ জন জুরির অনেকের ভাবখানা এমন—‘ভাই তাড়াতাড়ি ফাঁসিটা দেন, বাসায় গিয়া ডিনার করব।’ কিন্তু ‘রিজনেবল ডাউট’ বা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ যে একজন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে, তা এখানে প্রতিষ্ঠিত। গণতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থায় আমরা যে বলি ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সত্য’—এই ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সিনেমাটি প্রমাণ করে, ভিড়ের মাঝে একা দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলার সাহসই ন্যায়বিচারের শেষ ভরসা।
২. টু কিল আ মকিংবার্ড (১৯৬২): বর্ণবাদ যখন বিচারক
১৯৩০-এর মহামন্দার সময়কার আমেরিকার এক ছোট শহরে টম রবিনসন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের বিরুদ্ধে এক শ্বেতাঙ্গ নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। শহরের সবাই যখন টমকে দোষী ধরে নিছে, তখন তার পক্ষে দাঁড়ান আইনজীবী অ্যাটিকাস ফিঞ্চ, যিনি বিশ্বাস করেন আদালতে সবার অধিকার সমান।

এই সিনেমা দেখায়, আইন ও সমাজ যখন মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন আইন কতটা অসহায় হয়ে পড়ে। অ্যাটিকাস ফিঞ্চ আদালতে অকাট্য যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দেন যে অভিযোগকারী নারী মিথ্যা বলছেন এবং টমের পক্ষে এই অপরাধ করা শারীরিকভাবে অসম্ভব। কিন্তু সেই আদালত কক্ষের ‘অদৃশ্য বিচারক’ ছিল বর্ণবাদ। জুরিরা তথ্যের ভিত্তিতে নয়, চামড়ার রঙের ভিত্তিতে রায় দেয়। এই সিনেমা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বিচারব্যবস্থা শূন্যে ভেসে থাকে না; এটি সমাজেরই প্রতিচ্ছবি।
সিনেমার শেষের দিকে, আদালত কক্ষের দোতলায় দাঁড়িয়ে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অ্যাটিকাস ফিঞ্চকে সম্মান জানানোর দৃশ্যটি আজও দর্শকের চোখে জল এনে দেয়। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, সমাজ যদি পচে যায়, তবে আদালত থেকে ন্যায়বিচার আশা করা আর মরা গাছে ফল আশা করা একই।
৩. দি হান্ট / জাগটেন (২০১২): গসিপ যখন আদালতের চেয়েও ভয়াবহ
লুকাস একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষক। সবেমাত্র বিবাহবিচ্ছেদের ধকল কাটিয়ে উঠছেন। হঠাৎ তার স্কুলের এক ছোট্ট ছাত্রীর নিরীহ এক মিথ্যা কথা বা ভুল বোঝাবুঝি পুরো শহরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং লুকাসের বিরুদ্ধে ওঠে শিশু যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ অভিযোগ।

আদালতের কাজ শুরু হওয়ার আগেই সমাজ কীভাবে নিজের কোর্ট বসিয়ে রায় দিয়ে দেয়, এই সিনেমা তার এক ভয়াবহ দলিল। এখানে ভিলেন কোনো ব্যক্তি নয়, ভিলেন হলো ‘মাস হিস্টিরিয়া’ বা গণউন্মাদনা। মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষ ধরে নেয়, ‘শিশুরা কখনো মিথ্যা বলে না’—এই সরলীকরণ যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা দ্য হান্ট সিনেমা দেখিয়ে ছাড়ছে। পুলিশ বা আদালত কিছু প্রমাণ করার আগেই লুকাস তার বন্ধু, প্রতিবেশী, এমনকি প্রেমিকার কাছেও ঘৃণ্য পশুতে পরিণত হন। সুপারমার্কেটে তাকে মারধর করা হয়, তার কুকুরকে মেরে ফেলা হয়। ভালো সংবাদের চেয়ে ‘গসিপ’ যে আলোর গতিতে চলে, তা এখানে স্পষ্ট।
লুকাস নির্দোষ প্রমাণিত হলেও, সমাজের চোখে সন্দেহের দাগ কি পুরোপুরি মুছে যায়? শেষ দৃশ্যের বন্দুকের গুলিটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আইনি খাতায় নাম কাটা গেলেও সামাজিক কলঙ্ক মানুষের ছায়ার মতো আমৃত্যু লেগে থাকে।
৪. ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আনাতোলিয়া (২০১১): লাশ খোঁজার বোরিং জার্নি
একদল পুলিশ, একজন ডাক্তার আর একজন প্রসিকিউটর মিলে আনাতোলিয়ার নির্জন প্রান্তরে একখুনিকে নিয়ে ঘুরছে। উদ্দেশ্য, খুনি যেখানে লাশটি পুঁতে রাখছে সেই জায়গাটি খুঁজে বের করা। কিন্তু সমস্যা হলো, খুনি নিজেই মনে করতে পারছে না লাশটা ঠিক কোন গাছের নিচে বা কোন পাহাড়ের ঢালে পুঁতছিল!

হে প্রিয় পাঠক, আপনি যদি হলিউডি স্টাইলের অ্যাকশন আশা করেন যেখানে পুলিশ গাড়ি উড়িয়ে লাশ খুঁজে বের করবে, তবে এই সিনেমা দেখে আপনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু এই একঘেয়েমির ভেতরেই লুকিয়ে আছে সিনেমার আসল দর্শন। পরিচালক নুরি বিলগে জেলান দেখান, অপরাধ ও বিচার কোনো নাটকীয় ঘটনা নয়, বরং নোংরা, ক্লান্তিকর ও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
প্রসিকিউটর বা পুলিশ কর্মকর্তারা এখানে সুপারহিরো নন; তারাও রক্ত-মাংসের মানুষ, যারা লাশ খোঁজার চেয়ে বাড়ি গিয়ে গরম খাবারের আশা করে বা বাথরুমে যাওয়ার তাড়া অনুভব করে। অন্ধকার রাতে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় সত্যকে খোঁজার এই প্রচেষ্টা আসলে মানুষের অস্তিত্বের সংকটকেই প্রকট করে তোলে। লাশের ময়নাতদন্ত করার সময় যখন ডাক্তার ও কর্মকর্তাদের মধ্যে নির্লিপ্ত কথোপকথন চলে, তখন বোঝা যায়—রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে মানুষের মৃত্যু বা ন্যায়বিচার কেবল ‘ফাইল ক্লোজ’ করার প্রক্রিয়া মাত্র।
৫. আ সেপারেশন (২০১১): সত্যের গোলকধাঁধা
নাদের ও সিমিন দম্পতির বিচ্ছেদ আর তাদের একমাত্র মেয়ের কাস্টডি নিয়ে আইনি লড়াইয়ের মধ্যেই নাদের তার আলঝেইমার্সে আক্রান্ত বাবার দেখাশোনার জন্য একজন নারী কেয়ারটেকার রাখেন। একদিন এক অনাকাঙ্ক্ষিত ধস্তাধস্তিতে ওই নারীর গর্ভপাত ঘটে এবং ঐ নাদেরের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনেন—শুরু হয় এক জটিল আইনি ও নৈতিক লড়াই।

এই সিনেমার সবচেয়ে বড় বিউটি হলো—এখানে কোনো খলনায়ক নেই। বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে নাদের, তার স্ত্রী, কেয়ারটেকার এবং তার স্বামী—সবাই যখন যুক্তি দেয়, মনে হয় প্রত্যেকেই সঠিক। আবার পরক্ষণেই মনে হয় সবাই নিজেদের স্বার্থে একটু একটু মিথ্যা বলছে।
বিচারব্যবস্থা চায় ‘সাদা’ অথবা ‘কালো’ রায়, কিন্তু মানুষের জীবনটা মূলত ‘ধূসর’। ধর্মীয় অনুশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ইগোর লড়াইয়ে ‘ন্যায়বিচার’ শব্দটি এখানে আপেক্ষিক হয়ে পড়ে। নাদের মিথ্যা বলে তার বাবাকে বাঁচাতে, কেয়ারটেকার মিথ্যা বলে তার স্বামীর ঋণের বোঝা কমাতে। বিচারক বেচারা কী করবেন? তার তো ডিসপ্রিন খাওয়ার দশা! ফারহাদি দেখান, আইন কেবল ঘটনার বিচার করতে পারে, কিন্তু যে পরিস্থিতিতে মানুষ অপরাধ করে বা মিথ্যা বলে—সেই মনস্তত্ত্ব বোঝার সাধ্য আইনের মোটা বইয়ের নেই।
৬. কোর্ট (২০১৪): বিচার যখন প্রহসন
একজন বয়স্ক লোকসংগীত শিল্পী বা চারণকবিকে এক অদ্ভুত অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। দাবি করা হয়, তার গাওয়া একটি গান শুনে একজন ম্যানহোল পরিষ্কারকারী কর্মী আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত হয়েছে। এরপর শুরু হয় এক অন্তহীন ও হাস্যকর আইনি প্রক্রিয়া।

এই সিনেমায় আদালতের কোনো গ্ল্যামার নেই। নেই কোনো জাঁদরেল আইনজীবীর ‘অবজেকশন ইউর অনার’ চিৎকার। আছে স্যাঁতসেঁতে ঘর, সিলিং ফ্যানের ঘ্যানঘ্যানে আওয়াজ, আর বিচারক ও আইনজীবীদের নির্লিপ্ততা। অভিযোগটি যতটা হাস্যকর (গান শুনে আত্মহত্যা!), আইনি প্রক্রিয়াটি ততটাই ভয়াবহ ও অমানবিক। এখানে বিচারব্যবস্থার শ্রেণীচরিত্র নগ্নভাবে ফুটে ওঠে।
বিচারক ও প্রসিকিউটররা ইংরেজি বলা এলিট শ্রেণীর, আর অভিযুক্ত চারণকবি নিম্নবর্গের। তাদের ভাষাও এক নয়, যাপনও এক নয়। ডিফেন্স লইয়ারকে এক দৃশ্যে দেখা যায় অভিযুক্তের জামিন মঞ্জুরের জন্য জানপ্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছেন, ঠিক তার পরের দৃশ্যেই তাকে দেখা যায় পরিবারের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় বসে খোশগল্প করতে। অর্থাৎ, একজনের জীবন-মরণ সমস্যা অন্যজনের কাছে কেবল ‘নাইন-টু-ফাইভ’ ডিউটি। ব্রিটিশ আমলের সেকেলে আইন কীভাবে প্রান্তিক মানুষকে পিষে মারে, ‘কোর্ট’ তা নিরাবেগভাবে তুলে ধরে। বিচারক যখন ছুটির দিনে সমুদ্র সৈকতে সময় কাটান, তখন দর্শক বুঝতে পারেন—এই সিস্টেমে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করা আর পাথরের মূর্তির কাছে জল চাওয়া একই।
৭. দি শশাঙ্ক রিডেম্পশন (১৯৯৪): আশা নামের ড্রাগ
অ্যান্ডি ডুফ্রেসনে নামের এক সফল ব্যাংকার তার স্ত্রী ও তার প্রেমিককে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান, যদিও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ। শশাঙ্ক জেলের নির্মম পরিবেশে টিকে থাকার পাশাপাশি তিনি তিলে তিলে তার মুক্তির পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন।

আইএমডিবি তালিকার শীর্ষে থাকা এই সিনেমাটি দেখায় প্রাতিষ্ঠানিক অবিচারের চূড়ান্ত রূপ। জেলের ওয়ার্ডেন নর্টন নিজেকে বাইবেল-ভক্ত বলে দাবি করেন, অথচ তিনি নিজেই দুর্নীতিবাজ এবং শোষক। অ্যান্ডির নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ হাতে পাওয়ার পরেও তিনি তা ধামাচাপা দেন নিজের অবৈধ আয়ের পথ সচল রাখতে। এখানে শশাঙ্ক জেলখানা সমাজেরই এক ক্ষুদ্র সংস্করণ—যেখানে ক্ষমতা যার, ন্যায়বিচার তার। কিন্তু অ্যান্ডি হাল ছাড়েননি। তিনি প্রমাণ করেছেন, জীবনে অঙ্ক জানাটা কতটা জরুরি—সেটা ব্যাংকে হোক বা জেলে। জেলের রক্ষীদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল করে দিয়ে তিনি নিজের অবস্থান শক্ত করেন। আর উনিশ বছর ধরে ছোট্ট হাতুড়ি দিয়ে দেয়াল ফুটো করে তিনি কেবল জেল থেকেই পালাননি, বরং দুর্নীতিবাজ সিস্টেমকেও উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছেন।
তবে এই সিনেমার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দিক হলো ‘ইনস্টিটিউশনালাইজেশন’ বা দীর্ঘমেয়াদি বন্দিত্বের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব। জেলের বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান ব্রুকস হ্যাটলেন মুক্তি পাওয়ার পর আত্মহত্যা করেন। কেন? কারণ, পঞ্চাশ বছর জেলে থাকার পর বাইরের মুক্ত পৃথিবীটা তার কাছে অচেনা ও ভীতিকর মনে হয়েছিল। জেলের ভেতরে তিনি ছিলেন ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’, কিন্তু বাইরে তিনি কেবল এক জরাজীর্ণ বৃদ্ধ। পরাধীনতাই হয়ে উঠেছিল তার কমফোর্ট জোন, আর স্বাধীনতা হয়েছিল তার গলার ফাঁস।
অন্যদিকে, অ্যান্ডির বন্ধু রেড (মরগান ফ্রিম্যান)-ও ব্রুকসের পথেই হাঁটতে পারতেন। দীর্ঘ কারাবাস তাকেও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছিল। কিন্তু রেডকে বাঁচিয়ে রাখে অ্যান্ডির দেওয়া একটি ‘বিপজ্জনক’ উপহার—‘আশা’। অ্যান্ডি তাকে মেক্সিকোর এক নীল সমুদ্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিল এবং একটি কথা বলেছিল, ‘আশা খুব ভালো জিনিস, হয়তো সবচেয়ে ভালো জিনিস, আর ভালো জিনিস কখনো মরে না।’ ব্রুকস ব্যবস্থার কাছে হার মেনেছিলেন, কিন্তু রেড হার মানেননি কারণ অ্যান্ডি তাকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য (পার্পাস) দিয়ে গিয়েছিল।
‘দি শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ আমাদের শেখায়, আইন ভুল করতে পারে, বিচারক বিক্রি হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একটা ছোট্ট হাতুড়ি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর বুকের ভেতর ‘আশা’ জিইয়ে রাখতে পারলে—সবচেয়ে মোটা দেয়ালও ভেঙে ফেলা সম্ভব।
মজলিসে হাজিরান, ওপরে আলোচিত সাত সিনেমা ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভাষার ও ভিন্ন প্রেক্ষাপটের। কিন্তু এদের সুর এক। প্রতিটি সিনেমাই আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ‘আইন’ ও ‘ন্যায়বিচার’ সব সময় সমার্থক নয়।
টুয়েলভ অ্যাংগ্রি মেন বা টু কিল আ মকিংবার্ড দেখায়, বিচারব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হলেও মানবিক মূল্যবোধ ও সাহস দিয়ে তাকে সঠিক পথে আনা সম্ভব। অন্যদিকে, কোর্ট বা ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আনাতোলিয়া দেখায় সিস্টেমের উদাসীনতা ও অসারতা—যেখানে বিচারপ্রার্থী কেবল ফাইলের নিচে চাপা পড়া একটি নাম। দ্য হান্ট আমাদের সতর্ক করে যে, আমরা নিজেরাও অজান্তে বিচারক সেজে অবিচার করছি না তো?

অনারেবল মেনশনস
আইন-আদালত, অপরাধীর মনস্তত্ব, সমাজের ব্যবচ্ছেদ নিয়ে আরো কিছু সিনেমা দেখা যেতে পারে।
রাশোমন (১৯৫০): জাপানিজ গ্রুদেব আকিরা কুরুশাওয়ার মাস্টারপিস। একই ঘটনা চারজন চারভাবে বলে। সত্য আসলে কী? নাকি সত্য বইলা কিছু নাই?
অ্যানাটমি অফ এ ফল (২০২৩): স্বামী মারা গেছে, বউ কি খুনি? কোর্টরুম ড্রামা কারে বলে! সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ দেখতে চাইলে মাস্ট ওয়াচ।
মেমোরিজ অফ মার্ডার (২০০৩): কোরিয়ান পুলিশ আর সিরিয়াল কিলার। জাস্টিস না পাওয়ার হাহাকার আর ফ্রাস্ট্রেশন যদি ফিল করতে চান।
জয় ভীম (২০২১): ইন্ডিয়ান পুলিশি সিস্টেমের নগ্ন রূপ। ল কাস্টের মানুষেরা জাস্টিস চাইতে গেলে কী ঘটে, দেখলে গায়ের লোম দাঁড়ায় যাবে।
ভিসারানাই (২০১৫): ইন্টারোগেশনের নামে পুলিশি টর্চার। দুর্বল হার্টের লোকদের জন্য না। সিস্টেমের প্রতি ঘৃণা চলে আসবে।
পিংক (২০১৬): ‘না মানে না’—অমিতাভ বচ্চনের সেই ডায়লগ। কনসেন্ট আর নারী ঘটিত বিচারব্যবস্থা নিয়া জরুরি আলাপ।
জেড (১৯৬৯): পলিটিক্যাল থ্রিলার। সত্য ধামাচাপা দেওয়ার ক্লাসিক এক্সাম্পল। রাষ্ট্র যখন নিজেই ক্রিমিনাল, তখন কী হয়?
জাজমেন্ট অ্যাট নুরেমবার্গ (১৯৬১): নাৎসিদের বিচার। আমি শুধু বসের হুকুম পালন করছি—এই অজুহাত কি আদালতে খাটে?
দ্য ভারডিক্ট (১৯৮২): এক মাতাল উকিলের কামব্যাক স্টোরি। সিস্টেমের বিরুদ্ধে একা লড়াই করার আরেকটা ক্লাসিক।
ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার (১৯৭৯): বাচ্চার কাস্টডি নিয়া বাবা-মায়ের লড়াই। ইমোশনাল রলারকোস্টার। এখানে কে ঠিক আর কে ভুল, বলা কঠিন।
শহীদ (২০১২): এক মানবাধিকার আইনজীবীর রিয়েল লাইফ স্টোরি। যে লোকটা আজীবন অন্যের জন্য লড়ছে, তার বিচার কে করবে?
সিনেমার লেন্স দিয়ে দেখা এই বিচার-অবিচারের গল্পগুলো আসলে আমাদের বিবেকের সামনে রাখা আয়না। তাই সাধু সাবধান! বিচার চাইতে আদালতে যাওয়ার আগে দুবার ভাবুন। আর পপকর্ন হাতে নিরাপদ দূরত্বে বসে এই সিনেমাগুলো দেখে নেওয়াই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, সেলুলয়েডের পর্দায় অবিচার হলেও শেষে একটা ‘দি এন্ড’ থাকে; বাস্তবে সেই শেষটা কোথায়, কেউ জানে না।

আইনের দেবী থেমিসের চোখে কালো কাপড় বাঁধা থাকে। এর কেতাবি অর্থ, বিচার হবে অন্ধ বা নিরপেক্ষ; আবেগ, পরিচয় বা দৃশ্যমান চাকচিক্য সেখানে প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু আমার মনে হয় ঘটনা অন্য। থেমিস সম্ভবত লজ্জায় চোখ বাইন্ধা রাখছেন। বাস্তব জীবনে বিচারকের হাতুড়ি, আদালতের কাঠগড়া আর আইনের মোটা বইয়ের ফাঁকফোকর গলে প্রায়শই প্রকৃত অপরাধী বিএমডব্লিউ নিয়া বের হয়ে যায়, আর নির্দোষ পাবলিক জেলের ঘানি টানে।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে ‘বিচার’ ও ‘অবিচার’ এই দুইটা শব্দ একে অপরের ছায়ার মতো হাঁটছে, অনেকটা ‘টম অ্যান্ড জেরি’র মতো; একজন পালায় আরেকজন ধাওয়া করে। আর শিল্পমাধ্যম হিসেবে সিনেমা বারবার এই ইঁদুর-বিড়াল খেলাকে তুলে আনছে আমাদের সামনে।
কখনও আদালত কক্ষের শ্বাসরূদ্ধকর যুক্তি-তর্ক, কখনও বা আদালতের বাইরে সমাজের নিজস্ব ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’, আবার কখনও বিচারব্যবস্থার ধীরগতির জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া মানুষের হাহাকার—সেলুলয়েডের ফিতায় এসব গল্প কেবল বিনোদন হয়ে থাকে নাই, হয়ে উঠছে সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’ থেকে শুরু করে ‘কোর্ট’—বিশ্বসিনেমার সাতটি কালজয়ী চলচ্চিত্রকে সামনে রেখে আজ আমরা পপকর্ন হাতে দেখার চেষ্টা করব, সিনেমার চোখে বিচার, অবিচার ও ন্যায়বিচারের স্বরূপ কেমন।
১. টুয়েলভ অ্যাংগ্রি মেন (১৯৫৭): কনফার্মেশন বায়াস ও বিবেকের দংশন
বাবার হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এক কিশোরের ভাগ্য নির্ধারণ করতে বদ্ধ ঘরে জড়ো হন বারোজন জুরি সদস্য। প্রথাগত বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড প্রায় নিশ্চিত। এগারোজন জুরিই মনে করেন ছেলেটি দোষী। কিন্তু মাত্র একজন জুরি (যিনি ৮ নম্বর) ভিন্নমত পোষণ করেন এবং শুরু হয় শ্বাসরূদ্ধকর এক তর্কের লড়াই।

টুয়েলভ অ্যাংগ্রি মেন সিনেমাটি মূলত ‘কনফার্মেশন বায়াস’ বা বদ্ধমূল ধারণার এক মনস্তাত্ত্বিক ল্যাবরেটরি। বারোজন জুরির প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব সংস্কার, শ্রেণিবিদ্বেষ এবং ব্যক্তিগত ট্রমা নিয়ে টেবিলে বসছেন। কেউ ‘বস্তি’র ছেলে মানেই অপরাধী ভাবছেন, কেউ বা নিজের সন্তানের ওপর রাগ ঝাড়ছেন অভিযুক্তের ওপর। পরিচালক দেখান, বিচার কেবল সাক্ষ্য-প্রমাণের অংক নয়, এটি দেখার ভঙ্গিও। ১২ জন জুরির অনেকের ভাবখানা এমন—‘ভাই তাড়াতাড়ি ফাঁসিটা দেন, বাসায় গিয়া ডিনার করব।’ কিন্তু ‘রিজনেবল ডাউট’ বা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ যে একজন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে, তা এখানে প্রতিষ্ঠিত। গণতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থায় আমরা যে বলি ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সত্য’—এই ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সিনেমাটি প্রমাণ করে, ভিড়ের মাঝে একা দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলার সাহসই ন্যায়বিচারের শেষ ভরসা।
২. টু কিল আ মকিংবার্ড (১৯৬২): বর্ণবাদ যখন বিচারক
১৯৩০-এর মহামন্দার সময়কার আমেরিকার এক ছোট শহরে টম রবিনসন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের বিরুদ্ধে এক শ্বেতাঙ্গ নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। শহরের সবাই যখন টমকে দোষী ধরে নিছে, তখন তার পক্ষে দাঁড়ান আইনজীবী অ্যাটিকাস ফিঞ্চ, যিনি বিশ্বাস করেন আদালতে সবার অধিকার সমান।

এই সিনেমা দেখায়, আইন ও সমাজ যখন মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন আইন কতটা অসহায় হয়ে পড়ে। অ্যাটিকাস ফিঞ্চ আদালতে অকাট্য যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দেন যে অভিযোগকারী নারী মিথ্যা বলছেন এবং টমের পক্ষে এই অপরাধ করা শারীরিকভাবে অসম্ভব। কিন্তু সেই আদালত কক্ষের ‘অদৃশ্য বিচারক’ ছিল বর্ণবাদ। জুরিরা তথ্যের ভিত্তিতে নয়, চামড়ার রঙের ভিত্তিতে রায় দেয়। এই সিনেমা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বিচারব্যবস্থা শূন্যে ভেসে থাকে না; এটি সমাজেরই প্রতিচ্ছবি।
সিনেমার শেষের দিকে, আদালত কক্ষের দোতলায় দাঁড়িয়ে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অ্যাটিকাস ফিঞ্চকে সম্মান জানানোর দৃশ্যটি আজও দর্শকের চোখে জল এনে দেয়। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, সমাজ যদি পচে যায়, তবে আদালত থেকে ন্যায়বিচার আশা করা আর মরা গাছে ফল আশা করা একই।
৩. দি হান্ট / জাগটেন (২০১২): গসিপ যখন আদালতের চেয়েও ভয়াবহ
লুকাস একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষক। সবেমাত্র বিবাহবিচ্ছেদের ধকল কাটিয়ে উঠছেন। হঠাৎ তার স্কুলের এক ছোট্ট ছাত্রীর নিরীহ এক মিথ্যা কথা বা ভুল বোঝাবুঝি পুরো শহরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং লুকাসের বিরুদ্ধে ওঠে শিশু যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ অভিযোগ।

আদালতের কাজ শুরু হওয়ার আগেই সমাজ কীভাবে নিজের কোর্ট বসিয়ে রায় দিয়ে দেয়, এই সিনেমা তার এক ভয়াবহ দলিল। এখানে ভিলেন কোনো ব্যক্তি নয়, ভিলেন হলো ‘মাস হিস্টিরিয়া’ বা গণউন্মাদনা। মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষ ধরে নেয়, ‘শিশুরা কখনো মিথ্যা বলে না’—এই সরলীকরণ যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা দ্য হান্ট সিনেমা দেখিয়ে ছাড়ছে। পুলিশ বা আদালত কিছু প্রমাণ করার আগেই লুকাস তার বন্ধু, প্রতিবেশী, এমনকি প্রেমিকার কাছেও ঘৃণ্য পশুতে পরিণত হন। সুপারমার্কেটে তাকে মারধর করা হয়, তার কুকুরকে মেরে ফেলা হয়। ভালো সংবাদের চেয়ে ‘গসিপ’ যে আলোর গতিতে চলে, তা এখানে স্পষ্ট।
লুকাস নির্দোষ প্রমাণিত হলেও, সমাজের চোখে সন্দেহের দাগ কি পুরোপুরি মুছে যায়? শেষ দৃশ্যের বন্দুকের গুলিটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আইনি খাতায় নাম কাটা গেলেও সামাজিক কলঙ্ক মানুষের ছায়ার মতো আমৃত্যু লেগে থাকে।
৪. ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আনাতোলিয়া (২০১১): লাশ খোঁজার বোরিং জার্নি
একদল পুলিশ, একজন ডাক্তার আর একজন প্রসিকিউটর মিলে আনাতোলিয়ার নির্জন প্রান্তরে একখুনিকে নিয়ে ঘুরছে। উদ্দেশ্য, খুনি যেখানে লাশটি পুঁতে রাখছে সেই জায়গাটি খুঁজে বের করা। কিন্তু সমস্যা হলো, খুনি নিজেই মনে করতে পারছে না লাশটা ঠিক কোন গাছের নিচে বা কোন পাহাড়ের ঢালে পুঁতছিল!

হে প্রিয় পাঠক, আপনি যদি হলিউডি স্টাইলের অ্যাকশন আশা করেন যেখানে পুলিশ গাড়ি উড়িয়ে লাশ খুঁজে বের করবে, তবে এই সিনেমা দেখে আপনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু এই একঘেয়েমির ভেতরেই লুকিয়ে আছে সিনেমার আসল দর্শন। পরিচালক নুরি বিলগে জেলান দেখান, অপরাধ ও বিচার কোনো নাটকীয় ঘটনা নয়, বরং নোংরা, ক্লান্তিকর ও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
প্রসিকিউটর বা পুলিশ কর্মকর্তারা এখানে সুপারহিরো নন; তারাও রক্ত-মাংসের মানুষ, যারা লাশ খোঁজার চেয়ে বাড়ি গিয়ে গরম খাবারের আশা করে বা বাথরুমে যাওয়ার তাড়া অনুভব করে। অন্ধকার রাতে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় সত্যকে খোঁজার এই প্রচেষ্টা আসলে মানুষের অস্তিত্বের সংকটকেই প্রকট করে তোলে। লাশের ময়নাতদন্ত করার সময় যখন ডাক্তার ও কর্মকর্তাদের মধ্যে নির্লিপ্ত কথোপকথন চলে, তখন বোঝা যায়—রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে মানুষের মৃত্যু বা ন্যায়বিচার কেবল ‘ফাইল ক্লোজ’ করার প্রক্রিয়া মাত্র।
৫. আ সেপারেশন (২০১১): সত্যের গোলকধাঁধা
নাদের ও সিমিন দম্পতির বিচ্ছেদ আর তাদের একমাত্র মেয়ের কাস্টডি নিয়ে আইনি লড়াইয়ের মধ্যেই নাদের তার আলঝেইমার্সে আক্রান্ত বাবার দেখাশোনার জন্য একজন নারী কেয়ারটেকার রাখেন। একদিন এক অনাকাঙ্ক্ষিত ধস্তাধস্তিতে ওই নারীর গর্ভপাত ঘটে এবং ঐ নাদেরের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনেন—শুরু হয় এক জটিল আইনি ও নৈতিক লড়াই।

এই সিনেমার সবচেয়ে বড় বিউটি হলো—এখানে কোনো খলনায়ক নেই। বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে নাদের, তার স্ত্রী, কেয়ারটেকার এবং তার স্বামী—সবাই যখন যুক্তি দেয়, মনে হয় প্রত্যেকেই সঠিক। আবার পরক্ষণেই মনে হয় সবাই নিজেদের স্বার্থে একটু একটু মিথ্যা বলছে।
বিচারব্যবস্থা চায় ‘সাদা’ অথবা ‘কালো’ রায়, কিন্তু মানুষের জীবনটা মূলত ‘ধূসর’। ধর্মীয় অনুশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ইগোর লড়াইয়ে ‘ন্যায়বিচার’ শব্দটি এখানে আপেক্ষিক হয়ে পড়ে। নাদের মিথ্যা বলে তার বাবাকে বাঁচাতে, কেয়ারটেকার মিথ্যা বলে তার স্বামীর ঋণের বোঝা কমাতে। বিচারক বেচারা কী করবেন? তার তো ডিসপ্রিন খাওয়ার দশা! ফারহাদি দেখান, আইন কেবল ঘটনার বিচার করতে পারে, কিন্তু যে পরিস্থিতিতে মানুষ অপরাধ করে বা মিথ্যা বলে—সেই মনস্তত্ত্ব বোঝার সাধ্য আইনের মোটা বইয়ের নেই।
৬. কোর্ট (২০১৪): বিচার যখন প্রহসন
একজন বয়স্ক লোকসংগীত শিল্পী বা চারণকবিকে এক অদ্ভুত অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। দাবি করা হয়, তার গাওয়া একটি গান শুনে একজন ম্যানহোল পরিষ্কারকারী কর্মী আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত হয়েছে। এরপর শুরু হয় এক অন্তহীন ও হাস্যকর আইনি প্রক্রিয়া।

এই সিনেমায় আদালতের কোনো গ্ল্যামার নেই। নেই কোনো জাঁদরেল আইনজীবীর ‘অবজেকশন ইউর অনার’ চিৎকার। আছে স্যাঁতসেঁতে ঘর, সিলিং ফ্যানের ঘ্যানঘ্যানে আওয়াজ, আর বিচারক ও আইনজীবীদের নির্লিপ্ততা। অভিযোগটি যতটা হাস্যকর (গান শুনে আত্মহত্যা!), আইনি প্রক্রিয়াটি ততটাই ভয়াবহ ও অমানবিক। এখানে বিচারব্যবস্থার শ্রেণীচরিত্র নগ্নভাবে ফুটে ওঠে।
বিচারক ও প্রসিকিউটররা ইংরেজি বলা এলিট শ্রেণীর, আর অভিযুক্ত চারণকবি নিম্নবর্গের। তাদের ভাষাও এক নয়, যাপনও এক নয়। ডিফেন্স লইয়ারকে এক দৃশ্যে দেখা যায় অভিযুক্তের জামিন মঞ্জুরের জন্য জানপ্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছেন, ঠিক তার পরের দৃশ্যেই তাকে দেখা যায় পরিবারের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় বসে খোশগল্প করতে। অর্থাৎ, একজনের জীবন-মরণ সমস্যা অন্যজনের কাছে কেবল ‘নাইন-টু-ফাইভ’ ডিউটি। ব্রিটিশ আমলের সেকেলে আইন কীভাবে প্রান্তিক মানুষকে পিষে মারে, ‘কোর্ট’ তা নিরাবেগভাবে তুলে ধরে। বিচারক যখন ছুটির দিনে সমুদ্র সৈকতে সময় কাটান, তখন দর্শক বুঝতে পারেন—এই সিস্টেমে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করা আর পাথরের মূর্তির কাছে জল চাওয়া একই।
৭. দি শশাঙ্ক রিডেম্পশন (১৯৯৪): আশা নামের ড্রাগ
অ্যান্ডি ডুফ্রেসনে নামের এক সফল ব্যাংকার তার স্ত্রী ও তার প্রেমিককে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান, যদিও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ। শশাঙ্ক জেলের নির্মম পরিবেশে টিকে থাকার পাশাপাশি তিনি তিলে তিলে তার মুক্তির পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন।

আইএমডিবি তালিকার শীর্ষে থাকা এই সিনেমাটি দেখায় প্রাতিষ্ঠানিক অবিচারের চূড়ান্ত রূপ। জেলের ওয়ার্ডেন নর্টন নিজেকে বাইবেল-ভক্ত বলে দাবি করেন, অথচ তিনি নিজেই দুর্নীতিবাজ এবং শোষক। অ্যান্ডির নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ হাতে পাওয়ার পরেও তিনি তা ধামাচাপা দেন নিজের অবৈধ আয়ের পথ সচল রাখতে। এখানে শশাঙ্ক জেলখানা সমাজেরই এক ক্ষুদ্র সংস্করণ—যেখানে ক্ষমতা যার, ন্যায়বিচার তার। কিন্তু অ্যান্ডি হাল ছাড়েননি। তিনি প্রমাণ করেছেন, জীবনে অঙ্ক জানাটা কতটা জরুরি—সেটা ব্যাংকে হোক বা জেলে। জেলের রক্ষীদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল করে দিয়ে তিনি নিজের অবস্থান শক্ত করেন। আর উনিশ বছর ধরে ছোট্ট হাতুড়ি দিয়ে দেয়াল ফুটো করে তিনি কেবল জেল থেকেই পালাননি, বরং দুর্নীতিবাজ সিস্টেমকেও উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছেন।
তবে এই সিনেমার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দিক হলো ‘ইনস্টিটিউশনালাইজেশন’ বা দীর্ঘমেয়াদি বন্দিত্বের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব। জেলের বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান ব্রুকস হ্যাটলেন মুক্তি পাওয়ার পর আত্মহত্যা করেন। কেন? কারণ, পঞ্চাশ বছর জেলে থাকার পর বাইরের মুক্ত পৃথিবীটা তার কাছে অচেনা ও ভীতিকর মনে হয়েছিল। জেলের ভেতরে তিনি ছিলেন ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’, কিন্তু বাইরে তিনি কেবল এক জরাজীর্ণ বৃদ্ধ। পরাধীনতাই হয়ে উঠেছিল তার কমফোর্ট জোন, আর স্বাধীনতা হয়েছিল তার গলার ফাঁস।
অন্যদিকে, অ্যান্ডির বন্ধু রেড (মরগান ফ্রিম্যান)-ও ব্রুকসের পথেই হাঁটতে পারতেন। দীর্ঘ কারাবাস তাকেও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছিল। কিন্তু রেডকে বাঁচিয়ে রাখে অ্যান্ডির দেওয়া একটি ‘বিপজ্জনক’ উপহার—‘আশা’। অ্যান্ডি তাকে মেক্সিকোর এক নীল সমুদ্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিল এবং একটি কথা বলেছিল, ‘আশা খুব ভালো জিনিস, হয়তো সবচেয়ে ভালো জিনিস, আর ভালো জিনিস কখনো মরে না।’ ব্রুকস ব্যবস্থার কাছে হার মেনেছিলেন, কিন্তু রেড হার মানেননি কারণ অ্যান্ডি তাকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য (পার্পাস) দিয়ে গিয়েছিল।
‘দি শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ আমাদের শেখায়, আইন ভুল করতে পারে, বিচারক বিক্রি হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একটা ছোট্ট হাতুড়ি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর বুকের ভেতর ‘আশা’ জিইয়ে রাখতে পারলে—সবচেয়ে মোটা দেয়ালও ভেঙে ফেলা সম্ভব।
মজলিসে হাজিরান, ওপরে আলোচিত সাত সিনেমা ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভাষার ও ভিন্ন প্রেক্ষাপটের। কিন্তু এদের সুর এক। প্রতিটি সিনেমাই আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ‘আইন’ ও ‘ন্যায়বিচার’ সব সময় সমার্থক নয়।
টুয়েলভ অ্যাংগ্রি মেন বা টু কিল আ মকিংবার্ড দেখায়, বিচারব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হলেও মানবিক মূল্যবোধ ও সাহস দিয়ে তাকে সঠিক পথে আনা সম্ভব। অন্যদিকে, কোর্ট বা ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আনাতোলিয়া দেখায় সিস্টেমের উদাসীনতা ও অসারতা—যেখানে বিচারপ্রার্থী কেবল ফাইলের নিচে চাপা পড়া একটি নাম। দ্য হান্ট আমাদের সতর্ক করে যে, আমরা নিজেরাও অজান্তে বিচারক সেজে অবিচার করছি না তো?

অনারেবল মেনশনস
আইন-আদালত, অপরাধীর মনস্তত্ব, সমাজের ব্যবচ্ছেদ নিয়ে আরো কিছু সিনেমা দেখা যেতে পারে।
রাশোমন (১৯৫০): জাপানিজ গ্রুদেব আকিরা কুরুশাওয়ার মাস্টারপিস। একই ঘটনা চারজন চারভাবে বলে। সত্য আসলে কী? নাকি সত্য বইলা কিছু নাই?
অ্যানাটমি অফ এ ফল (২০২৩): স্বামী মারা গেছে, বউ কি খুনি? কোর্টরুম ড্রামা কারে বলে! সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ দেখতে চাইলে মাস্ট ওয়াচ।
মেমোরিজ অফ মার্ডার (২০০৩): কোরিয়ান পুলিশ আর সিরিয়াল কিলার। জাস্টিস না পাওয়ার হাহাকার আর ফ্রাস্ট্রেশন যদি ফিল করতে চান।
জয় ভীম (২০২১): ইন্ডিয়ান পুলিশি সিস্টেমের নগ্ন রূপ। ল কাস্টের মানুষেরা জাস্টিস চাইতে গেলে কী ঘটে, দেখলে গায়ের লোম দাঁড়ায় যাবে।
ভিসারানাই (২০১৫): ইন্টারোগেশনের নামে পুলিশি টর্চার। দুর্বল হার্টের লোকদের জন্য না। সিস্টেমের প্রতি ঘৃণা চলে আসবে।
পিংক (২০১৬): ‘না মানে না’—অমিতাভ বচ্চনের সেই ডায়লগ। কনসেন্ট আর নারী ঘটিত বিচারব্যবস্থা নিয়া জরুরি আলাপ।
জেড (১৯৬৯): পলিটিক্যাল থ্রিলার। সত্য ধামাচাপা দেওয়ার ক্লাসিক এক্সাম্পল। রাষ্ট্র যখন নিজেই ক্রিমিনাল, তখন কী হয়?
জাজমেন্ট অ্যাট নুরেমবার্গ (১৯৬১): নাৎসিদের বিচার। আমি শুধু বসের হুকুম পালন করছি—এই অজুহাত কি আদালতে খাটে?
দ্য ভারডিক্ট (১৯৮২): এক মাতাল উকিলের কামব্যাক স্টোরি। সিস্টেমের বিরুদ্ধে একা লড়াই করার আরেকটা ক্লাসিক।
ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার (১৯৭৯): বাচ্চার কাস্টডি নিয়া বাবা-মায়ের লড়াই। ইমোশনাল রলারকোস্টার। এখানে কে ঠিক আর কে ভুল, বলা কঠিন।
শহীদ (২০১২): এক মানবাধিকার আইনজীবীর রিয়েল লাইফ স্টোরি। যে লোকটা আজীবন অন্যের জন্য লড়ছে, তার বিচার কে করবে?
সিনেমার লেন্স দিয়ে দেখা এই বিচার-অবিচারের গল্পগুলো আসলে আমাদের বিবেকের সামনে রাখা আয়না। তাই সাধু সাবধান! বিচার চাইতে আদালতে যাওয়ার আগে দুবার ভাবুন। আর পপকর্ন হাতে নিরাপদ দূরত্বে বসে এই সিনেমাগুলো দেখে নেওয়াই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, সেলুলয়েডের পর্দায় অবিচার হলেও শেষে একটা ‘দি এন্ড’ থাকে; বাস্তবে সেই শেষটা কোথায়, কেউ জানে না।

টিকটক, রিলস, ইউটিউব কিংবা ইউটিউব শর্টস– সর্বত্র এখন ভোজপুরি গানের আধিপত্য। বিহার, পূর্ব-উত্তর প্রদেশ ও সংলগ্ন অঞ্চলের ভাষার এই গান কীভাবে বিশ্ব মাতাচ্ছে, দেখাচ্ছে ভাইরালের ভেল্কি? এই প্রশ্নের বিস্তারিত শুলুকসন্ধানের প্রয়াস এই লেখা।
৭ দিন আগে
দেশের ডিজিটাল স্পেসজুড়ে এখন চলছে বটের রাজত্ব। বিটিভির ভাষায় বললে বট আইডির বাম্পার ফলন। ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি বট। মহা সমারোহে চলছে ‘একটি মানুষ একটি বট আইডি’ প্রকল্প। চলুন জানি, নানা ধরণের বটের কর্মকান্ড; ঘুরে আসি বাংলার ডিজিটাল বটমূল।
৮ দিন আগে
শূন্য দশক বাংলা মিউজিকের একটা ক্রান্তিকাল। নিউজিকে নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব এবং ট্রাডিশনাল মিউজিকের নতুন উপস্থাপনের দশক। শিরিনের বিখ্যাত গান পাঞ্জাবিওয়ালাকে কেন্দ্র করে, শূন্য দশকের ফোক ফিউশন নিয়ে এই লেখা।
১৩ দিন আগে
আজ বিশ্ব টয়লেট দিবস। টয়লেট বিষয়ে দার্শনিকেরা রহস্যজনকভাবে নীরব। কিন্তু কেন?—জিজ্ঞাসার উত্তর খোজার চেষ্টা এই লেখা।
১৫ দিন আগে