leadT1ad

লালন ফকির ও গাঁজা

লালন ফকির কিংবা লালন ফকিরের অনুসারীদেরকে গাঁজাখোর তকমা দেওয়ার প্রবণতা চলছে। লালন কি গাঁজা খেতেন? লালন কি শিষ্যদেরকে গাঁজা খেতে অনুমতি বা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেছেন? লালন ফকির ও গাঁজার সম্পর্ক বা সম্পর্কহীনতা নিয়ে এই লেখা।

সিনা হাসান
সিনা হাসান
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ০০
লালন ও গাঁজা। স্ট্রিম গ্রাফিক

লালন ফকির গাঁজা বা অন্য কোন মাদকদ্রব্য সেবন করতেন না। তবে তাঁর কোনো কোনো শিষ্য করতেন।
আচ্ছা, লালন যদি সেটা না করেন তাহলে তাঁর শিষ্য ক্যানো করতেন? ফকিরমতে তো গুরুর মতো করে চলতে হয়। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন ওঠে—এর কারণ কী। এখানে একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন।

সে কথায় আসছি তবে আগে বলি, নিখিল বঙ্গের ইতিহাসে ফকির, বাউল, জমিদার, চৌকিদার, অফিসার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবিসহ বহু রকমের মানুষই গাঁজা সেবন করেন/ করতেন। তবে ফকির—স্পেশালি লালন ভক্তদের প্রতি গাঁজাসেবী তকমা দেবার একটা প্রবণতা গত ২০-২৫ বছরে ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। আমি মনে করি, এটা গাঁজা ও ফকির উভয়ের প্রতিই অবিচার।

ভূমিকা দীর্ঘ না করে ব্যাখ্যায় যাই। ক্যানো ব্যক্তি লালন গাঁজা না সেবন করলেও তাঁর শিষ্যরা করেন এবং এ দুয়ের সম্পর্ক কী!
তা বিষয় হলো দুটি—
১.গুরুমুখী চর্চা ও
২. অপরের সক্ষমতাকে সম্মান।

বিষয় দুটি ব্যাখ্যার আগে আরেকটি বিষয় বলে নেওয়া দরকার। বললে, এই গাঁজা খাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। তা হলো চুল, দাঁড়ি ও গোঁফ।

নিখিল বঙ্গের ইতিহাসে ফকির, বাউল, জমিদার, চৌকিদার, অফিসার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবিসহ বহু রকমের মানুষই গাঁজা সেবন করেন/ করতেন। তবে ফকির—স্পেশালি লালন ভক্তদের প্রতি গাঁজাসেবী তকমা দেবার একটা প্রবণতা গত ২০-২৫ বছরে ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। আমি মনে করি, এটা গাঁজা ও ফকির উভয়ের প্রতিই অবিচার।

আমরা কি লক্ষ্য করেছি যে একই লালনের শিষ্য সবাই, কিন্তু কোনো সাধুর চুল বড়, কোনো সাধুর ছোট, কারও গোঁফ আছে, কারও নাই, কারও দাঁড়ি আছে বড়, কারও মাঝারি আবার কারও নাই?
কারণ হলো, বাউল-ফকির চর্চা এমন চর্চা যেখানে গুরু রূপে রূপ ধারণ করতে হয়। যার গুরুর চুল বড়, সেই শিষ্যও চুল বড় রাখে। গুরুর দাঁড়ি থাকলে শিষ্যও দাঁড়ি রাখে। যাঁর গুরু মাছ খান না তাঁর শিষ্যও মাছ খান না। যাঁর গুরু গাঁজার সেবা নেন, তাঁর শিষ্যও গাঁজার সেবা নেন। উদাহরণ দিলে বলা যাবে, খোদাবক্স শাহ্‌র গোঁফ ছিল; তাঁর ভক্ত বজলু ফকিরের গোঁফ আছে। গুরু সালাম ফকির গাঁজা খান না, ভক্ত রুস্তম ফকিরও তাই খান না। টুনটুন ফকিরের গুরু নহীর ফকির মাছ খান না, ফলে টুনটুন ফকিরও খান না। দুর্লভ সাঁইয়ের যেরকম চুল-দাঁড়ি ছিল, তেমনি চুল-দাঁড়ি তাঁর ভক্ত কলিমুদ্দিন ফকিরেরও। এক নম্বর বিষয় তো বললাম, গুরুমুখী বিদ্যা, গুরু রূপে রূপ ধারণ।

এবার প্রশ্ন আসে, সবার গুরুই তো লালন, তাহলে তো সবারই লালনের মতো চুল- দাঁড়ি- মাছ- গাঁজা—সব কিছু এক হিসেবে মেইনটেইন করার কথা। তা তো হলো না। ক্যানো? একই লালনের শিষ্য হলে ক্যানো তাহলে শিষ্যদের প্র্যাকটিস আলাদা?

এবার আসে হলো দ্বিতীয় বিষয়, অপরকে সম্মান। লালন তাঁর কোন কোনো শিষ্যকে অত্যন্ত সম্মান করতেন, যেমন তাঁর পালক পিতা ও প্রথম শিষ্য মলম শাহ্, পণ্ডিত মনিরুদ্দিন শাহ্, মা মতিজান, লালনের জীবনসঙ্গী বিশাখা ফকিরানি প্রমুখ।

লালনের কাছে যাঁরা আসতেন, তাঁরা নানাভাবে লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতেন। কেউ ভালোবেসে, কেউ বাহাস বা বিতর্ক করতে এসে, কেউ খোঁজ পেয়ে—নানাজন নানাভাবে শিষ্য হতেন। তাঁদের বয়স, শিক্ষা, ব্যবহার, মেধা, আচরণ—সবই ছিল ভিন্ন ভিন্ন। তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন বয়স্ক, কেউ কেউ ছিলেন খুব মেধাবী। তাঁরা নিজেরা জানতেন যে ক্যানো তাঁর চুল বড় বা ছোট, ক্যানো তিনি গাঁজা খান কিংবা খান না। শিষ্যদের মধ্যে যাঁদের যুক্তি ও আচরণ লালনের পছন্দের ছিল, তাঁদের তিনি গুরু হিসেবে স্বাধীনতা দিয়েছেন গাঁজা খাওয়ার বা মাছ খাওয়ার বা চুল ছোট রাখার কিংবা চুল- দাঁড়ি না রেখে শুধু গোঁফ রাখার। যাঁরা বুঝদার ব্যাক্তি ছিলেন, তাঁরা লালনের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন, অনেকে বয়সেও বড় ছিলেন। লালন যুবক বয়সেই অনেকসংখ্যক বিভিন্ন বয়সী শিষ্য লাভ করেন। তাঁরা ধ্যানে মনসংযোগ আনতে এবং কেউ দীর্ঘদিনের অভ্যাসে গাঁজা খেতেন। তাঁরা গাঁজা খেয়ে কখনো অন্যের কোন ক্ষতি করেননি। তাঁদের মনোসংযোগে গাঁজা সাহায্য করত। আর গাঁজা তো হাজার হাজার বছর ধরে মেডিটেশনে সহায়ক প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে গৃহীত। একটা কথা আছে না? ছুরি দিয়ে সন্ত্রাসী খুন করে আর ডাক্তার অপারেশন করে। জিনিস কিন্তু একই, ব্যাবহার ভিন্ন। পাশাপাশি ফকির ধর্মে একটা কথা আছে, ‘রতি স্থির না হলে মতি স্থির হয় না’ আর গাঁজা রতি (কাম রিপু) স্থির করতে সহায়ক প্রাকৃতিক উপাদান। আর সেই লালনের সময়কালে ১৭০০ সালের শেষদিক ও ১৮০০ সালের পরে গাঁজা তো আর আজকের মতো ঘৃণিতও ছিল না; নিষিদ্ধ তো হলো সেদিন—১৯৮০ সালেরও পরে।

কিন্তু যাঁরা গাঁজা খেয়ে গিয়ে অন্যের কোন ক্ষতি করত বা নেশা করাটা মূখ্য ছিল তাদের অনুমতি দিতেন না। কারণ, তাদের ধ্যান বা মনোস্থির এর চেয়েও গাঁজার দমের নেশাটা মুখ্য ছিল। লালন নিজেই তো বলেছেন, ‘গাঁজায় দম চড়িয়ে মনা ব্যোম কালী আর বলিস নারে’। যাঁদের যুক্তি লালনের পছন্দ হয়নি, তাঁদের সেসব অনুমতিও দেননি।

একটা কথা বুঝতে হবে। সেসময় কিন্তু প্যাকেটজাত সিগারেট ছিল না। এখনকার সময়ে যেভাবে ধূমপায়ীরা সিগারেট কিনে অভ্যস্ত এবং গাঁজা সমাজে নিষিদ্ধ তখনকার সমাজ বাস্তবতা তেমন ছিল না। পাশাপাশি এটা নিয়েও ভিন্ন পরিসরে আলোচনা হতে পারে যে এর সাথে কর্পোরেট কনজুমারিজমের সম্পর্ক কতখানি। যা হোক, লালনের ভক্তদের মধ্যে যারা মানুষ হিসেবে কাজে-কর্মে ও আচরণে লালনের কাছে প্রিয় ছিলেন, তাঁদেরই সেই অনুমতি লালন দিয়েছেন।

কিন্তু যাঁরা গাঁজা খেয়ে গিয়ে অন্যের কোন ক্ষতি করত বা নেশা করাটা মূখ্য ছিল তাদের অনুমতি দিতেন না। কারণ, তাদের ধ্যান বা মনোস্থির এর চেয়েও গাঁজার দমের নেশাটা মুখ্য ছিল। লালন নিজেই তো বলেছেন, ‘গাঁজায় দম চড়িয়ে মনা ব্যোম কালী আর বলিস নারে’। যাঁদের যুক্তি লালনের পছন্দ হয়নি, তাঁদের সেসব অনুমতিও দেননি। তেমনটাই ফকির-সাধুদের মুখে জেনেছি। এখন লালনের মৃত্যুর প্রায় ১৩৫ বছর পার হয়ে এসে সেই শিষ্যদের শিষ্য সংখ্যা তো বেড়েছে। তাঁরা তাই কেউ গাঁজা খাচ্ছে আর কেউ খাচ্ছে না। যাঁর গুরু সেবন করছেন, তাঁদের শিষ্যও সেবন করছেন। তাই বলা যায়, যে কারণে লালনপন্থীদের কেউ চুল বড় রাখেন আবার কেউ ছোট, কেউ মাছ খান আবার কেউ খান না, সেই একই কারণে কেউ গাঁজার সেবা নেন আর কেউ নেন না। তবে লালন গাঁজার সেবা নিতেন বলে কখনো কোনো সাধুর কাছে শুনিনি, তিনি নিতেন না বলেই আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্বাস।

সাথে আরেকটা কথা না বললেই নয়, ‘লালন মেলা’ হলে যে গাঁজার আখড়া বসে বলে আমরা জানি, তার সাথে মাদক সিন্ডিকেটের সাথে বা লাখো লাখো নেশাখোরের সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু লালনের সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই।
ইনফ্যাক্ট, এই ‘লালন মেলা’ নামক একবিংশ শতকের মাল/বস্তু/ব্যাপারের সাথেই লালনের কোনো সম্পর্ক নাই। তিনি কোনো মেলা-টেলা করেননি, করতে বলেনও নাই। আর সেখানে ০.৫% ও লালন ভক্ত যায় কি না, আমার সন্দেহ আছে। সর্বশেষ ১৯৮২ সালে হাজারো ফকিরকে মেরে ও দুর্লভ শাহ্কে মেরে তাঁর কাছ থেকে লালনের ঘরের সিন্দুকের চাবি কেড়ে নিয়ে তাঁদের চুল কেটে বিতাড়িত করে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে তৎকালীন সরকারই গাঁজাকে এদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত করে মার্কেট আউট করে দেয়। ফলে দেশ ভরে যায় ভয়ংকর মাদক ফেন্সিডিল ও হেরোইনে। আর গাঁজা খাওয়ার দোষটা দেয়া হলো সেই লালন অনুসারীদেরকেই! এ এক প্রহসন।

সে কথা দুর্লভ শাহ্ আমাকে বলেছেন। আমি তাঁকে জীবিত পেয়েছিলাম। গাঁজা তো দূরের কথা আমি তাঁকে দেখেছি গোল্ডলিফ সিগারেট খেতে। ধার করা স্বল্পমেগাপিক্সেলসম্বলিত ক্যামেরায় সে ছবিও তুলে রেখেছি।

ধূমপানরত দুর্লভ সাঁই। তখন (২০১২) তাঁর বয়স আনুমানিক ১২২ বছর। ছবি: লেখক
ধূমপানরত দুর্লভ সাঁই। তখন (২০১২) তাঁর বয়স আনুমানিক ১২২ বছর। ছবি: লেখক

আমি: ৮২ সালে যে আপনাদের মেরে চাবি কেঁড়ে নিয়েছিলো সে বিষয়ে বলেন।
দুর্লভ শাহ্: ‘ও বাবা বহুত মারছিলো। ঐ মৌলবী আর সামসুর মিনিস্টার মিলে কি মার যে মারছিলো বাবা..’
আমি: কেমন আহত হইছিল?
দুর্লভ শাহ্: ‘ঐদিন প্রায় ১৫০০ লোককে মারে, ১০ হাজার লোকের খাবার নষ্ট করে।’
আমি: যারা আপনার কলার ধরে চাবি কেড়ে নিয়ে আপনাদেরই বের করে দিছিল, তাদের কি আপমি ক্ষমা করতে পারছেন? (এ প্রশ্নটা এজন্য করেছি যে লালনপন্থীদের দয়া বা ক্ষমাসুলভ মনোভাব কেমন তা বোঝার জন্য)
দুর্লভ শাহ্: ‘তারা তো কবেই শেষ হয়ে গেছে’।

মেলায় যাঁরা নিজেদের দাবি করেন যে তাঁরা লালনের ভক্ত, তা তাঁদের মনগড়া কথা, তাঁরা ভাবেন যে মনে মনে ভালো লাগে, তাই ভক্ত হয়ে গেলাম। অন্তত ৩২ প্রকারের মাজারে মাজারে ঘোরা যাযাবর লোকজন ও ভ্রাম্যমান গাঁজা ব্যবসায়ীরা সেখানে যায়। আর যায় মধ্যবিত্ত তরুণ-যুবারা। ফকির আর শিল্পী এ দুটো যে আলাদা বিষয় তা-ই তো বেশির ভাগ মানুষ জানে না!

লালনের ভক্ত হতে হলে চারটি স্তর আছে—স্থূল, প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ। ভক্ত হওয়ার নিয়ম আছে; চাইলেই হওয়া যায় না। এই ভক্ত দাবিকারদের কয়জন সেসব জানেন, তা নিয়েই আমার সন্দেহ আছে। তবে হ্যাঁ, আজকাল অনেকে টাকা-পয়সা ঢেলেও গুরু বনে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের লাখো নেশাখোরের, মাদক ব্যবসায়ীর ও কর্পোরেটের মেলার নামে মার্কেটিংয়ের দায় দয়া করে লালন সাঁইয়ের ওপর দেবেন না। রমরমা এই মাদকমেলা বন্ধ করতে চাইলে এই কর্পোরেট মেলা বন্ধ করে লালনের আখড়া প্রকৃত সাধুদের ফিরিয়ে দিতে হবে।

[সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ধূমপান স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ৯ ও ৩৬ ধারা অনুযায়ী গাঁজা সেবন, উৎপাদন বা পরিবহন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।]

Ad 300x250

সম্পর্কিত