শেখ হাসিনার পতনের পর মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাবি করে, তারা একটি বাস্তববাদী ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। এতে বাংলাদেশ নতুন এক পররাষ্ট্রনীতি পুনর্গঠনের পথে এগোচ্ছে। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি নতুন করে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে। গত বছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর সঙ্গত কারণেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠছে।
ইউনুসের ভাষায়, বাংলাদেশ এখন ‘সব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে’ নিজের স্বার্থ ও স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার জন্য। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টার মধ্যে রয়েছে উচ্চপর্যায়ের সামরিক সংলাপ, দুই দশক ধরে অচল থাকা অর্থনৈতিক কমিশনের পুনর্জাগরণ এবং পাকিস্তানের করাচি বন্দরে বাংলাদেশের পাটসহ বিভিন্ন রপ্তানি পণ্যের প্রবেশাধিকার। ২০২৪ সালের শেষার্ধেই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২৭ শতাংশ বেড়েছে।
আগস্টে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ‘ঐতিহাসিক’ ঢাকা সফর ভিসা অব্যাহতি, সাংস্কৃতিক সমঝোতা স্মারক ও বাণিজ্যচুক্তি এনে দিয়েছে। এরপর গত ২৫ অক্টোবর আসেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর দ্বিতীয় শীর্ষ কর্মকর্তা জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান (সিজেসিএসসি) জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা। এই সফরে তিনি বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এসব বৈঠকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সামরিক সহযোগিতা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যদিও এখনো বড় কোনো অস্ত্রচুক্তি হয়নি, তবে সম্পর্কের ধারাবাহিক অগ্রগতি ইঙ্গিত দিচ্ছে—দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও গভীর হতে পারে। সামনে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্মারক (এমওইউ) এবং সম্প্রসারিত যৌথ মহড়ার আনুষ্ঠানিক চুক্তি হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি সম্ভাব্য ‘নতুন প্রতিরক্ষা জোট’-এর ইঙ্গিত দেয়।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে এসব উদ্যোগকে শুধু দ্বিপাক্ষিক পদক্ষেপ নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় এক বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক পুনর্গঠন হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন বলছে, ‘দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্জাগরণ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।’
তবে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, ‘ভারতবিরোধী মনোভাব নিয়ে প্রায়শই অতিরঞ্জন করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ বৈদেশিক সম্পর্ক, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে, কেবল নিরাপত্তা বা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না। অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে।’
শত্রুতা থেকে সহযোগিতায়
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী ইতিহাসে নিহিত। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা ইসলামাবাদের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করে আসছে, যা আজও মেলেনি। অন্যদিকে, পাকিস্তান বরাবরই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টিতে দেখেছে। ফলে কার্যত দূরত্ব থেকেই গেছে। দুই দেশের বাণিজ্যও সীমিত ছিল—২০২৪ সালে পাকিস্তানের রপ্তানি ছিল ৬৬১ মিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশের মাত্র ৫৭ মিলিয়ন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সফরের সময় তরুণদের নতুন দল এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ–পাকিস্তান সম্পর্ক জোরদার করতে হলে ১৯৭১-এর বিষয়টি সম্মানের সঙ্গে নিষ্পত্তি করতে হবে।’ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দারের সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল, ‘মন পরিষ্কার করুন, একসঙ্গে এগিয়ে চলুন।’
তবে বাস্তবতার কারণে কূটনীতি এসব ইস্যু পাশ কাটিয়েই এগোচ্ছে। অধ্যাপক ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দেয়—বাংলাদেশ ‘ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি’ অনুসরণ করবে। হাসিনা আমলের মতো আর ভারতের প্রতি নতজানু হয়ে থাকবে না। এই সুযোগেই পাকিস্তান এগিয়ে আসে। অর্থনৈতিক বাস্তবতা এই সম্পর্কের প্রধান চালিকা শক্তি।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২১ সাল থেকে গড়ে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্ভাবনা অনেক। পাকিস্তান তুলা, চাল, সিমেন্ট ও ওষুধ রপ্তানি করতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশ দিতে পারে পাট, রাসায়নিক ও তৈরি পোশাক। বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের লক্ষ্য—২০২৭ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য দ্বিগুণ করা।
ভারতের প্রতি বেড়ে চলা বিরূপ মনোভাবও দুদেশকে কাছে টানছে। হাসিনার শাসনামলে ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ও অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশে ক্ষোভ বাড়ে। ২০২৫ সালের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের পর উভয় দেশেই ভারতের ‘আঞ্চলিক আধিপত্য’ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আইজাজ চৌধুরীর ভাষায়, ‘বাংলাদেশীরা ভারতীয় আধিপত্যের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এবং আমরা পাকিস্তানেও গত মে মাসের সংঘাতে তা দেখেছি। উভয় দেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছে।’
তবে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, ‘ভারতবিরোধী মনোভাব নিয়ে প্রায়শই অতিরঞ্জন করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ বৈদেশিক সম্পর্ক, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে, কেবল নিরাপত্তা বা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না। অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে।’
তবুও পরিবর্তনের গতি অস্বীকার করা যায় না—কূটনৈতিক ভিসা মওকুফ, করাচি-চট্টগ্রাম নৌপথ পুনরায় চালু এবং এ বছরের শেষে ঢাকা-করাচি সরাসরি ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনা এর প্রমাণ। এভাবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের বরফ গলছে রাজনৈতিক প্রয়োজন, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও আঞ্চলিক ভারসাম্যের নতুন বাস্তবতায়। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই নতুন এক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যা ‘সুইং স্টেট’ বা স্বাধীন ভারসাম্য রক্ষাকারী রাষ্ট্রগুলোর—যেমন বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা—আত্মপ্রকাশ ঘটায়। তারা এখন ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের বাইরে গিয়ে নিজস্ব কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উষ্ণতা এর স্পষ্ট উদাহরণ। বিশেষজ্ঞরা একে ‘গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক কৌশলগত মোড়’ হিসেবে দেখছেন।
আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট: বিভক্ত দক্ষিণ এশিয়া ও ‘সুইং স্টেট’-এর উত্থান
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ভারতই প্রধান শক্তি। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো অনেকটা ভারতের কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার ভূমিকায় ছিল। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তা সহযোগিতায় এই সম্পর্ক ছিল গভীর।
হাসিনা সরকারের সময় ভারতকেন্দ্রিক নীতি—যেমন নিরাপত্তা চুক্তি, যৌথ মহড়া ও অর্থনৈতিক সহায়তা—পাকিস্তানকে কার্যত একঘরে করে দেয়। বাংলাদেশ ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলনও বর্জন করে।
কিন্তু হাসিনার আমলে নতজানু নীতির কারণে দেশের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে, যা তার পতনের পর তীব্র রূপ নেয়। ভারতের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগে বাংলাদেশের নাগরিকদের বড় অংশ ক্ষুব্ধ হন। ২০২৪ সালের শেষদিকে সেন্টার ফর অল্টারনেটিভস এর এক জরিপে দেখা যায়, ৭৫ শতাংশ বাংলাদেশি চীনকে ইতিবাচকভাবে দেখেন, ৫৯ শতাংশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেন, আর মাত্র ১১ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ ভারতকে সমর্থন করেন।
পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই নতুন এক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যা ‘সুইং স্টেট’ বা স্বাধীন ভারসাম্য রক্ষাকারী রাষ্ট্রগুলোর—যেমন বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা—আত্মপ্রকাশ ঘটায়। তারা এখন ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের বাইরে গিয়ে নিজস্ব কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উষ্ণতা এর স্পষ্ট উদাহরণ। বিশেষজ্ঞরা একে ‘গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক কৌশলগত মোড়’ হিসেবে দেখছেন।
এই প্রেক্ষাপটে অনেক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা করছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন ‘চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ অক্ষ’ গড়ে উঠতে পারে। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আশোক স্বেইন মন্তব্য করেছেন, ‘চীন নতুনভাবে ১৯৬০-এর দশকের পুরনো অক্ষ—বেইজিং, ইসলামাবাদ ও ঢাকা—পুনর্গঠনের সুযোগ দেখছে, যা ভারতের বিরুদ্ধে ভারসাম্য তৈরি করবে।’
চীনের ভূমিকা ও ভারতের উদ্বেগ
চীন এই নতুন আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক গতিশীলতায় বড় ভূমিকা রাখছে। পাকিস্তানের ‘আয়রন ব্রাদার’ হিসেবে পরিচিত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) উভয় দেশকে যুক্ত করেছে। পাকিস্তানে সিপিইসি এবং বাংলাদেশে পায়রা বন্দর ও অবকাঠামো প্রকল্প এই বিআরআই এর অংশ। বিআরআই-এর আওতায় ২০২৫ সালের মার্চে ইউনুসের বেইজিং সফরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স ও শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের চুক্তিও হয়, যা ২০২৮ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
এছাড়া চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কুনমিং-এ অনুষ্ঠিত ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে সার্কের বিকল্প আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির ইঙ্গিতও মেলে, যা কার্যত ভারতকে উপেক্ষা করে। সম্প্রতি ঢাকা ২২০ কোটি ডলারে ১২-২০টি চীনা জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করেছে। এতে আঞ্চলিক আকাশশক্তির ভারসাম্য ভারতের বিপরীতে ঝুঁকতে পারে। লন্ডনের চ্যাথাম হাউসের এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ‘পাকিস্তানের পর আরেকটি সীমান্তবর্তী দেশ যদি চীনের তৈরি উন্নত যুদ্ধবিমান পায়, তা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়াবে।’
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর আওতায় বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগকারী হিসেবে চীন ইতিমধ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন তারা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে ‘চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিভুজ’ গড়ে তুলতে চাইছে, যা ভারতের কৌশলগত পরিধি সংকুচিত করতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে অনেক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা করছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন ‘চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ অক্ষ’ গড়ে উঠতে পারে। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আশোক স্বেইন মন্তব্য করেছেন, ‘চীন নতুনভাবে ১৯৬০-এর দশকের পুরনো অক্ষ—বেইজিং, ইসলামাবাদ ও ঢাকা—পুনর্গঠনের সুযোগ দেখছে, যা ভারতের বিরুদ্ধে ভারসাম্য তৈরি করবে।’
এই প্রক্রিয়া ভারতের ‘প্রতিবেশি প্রথম’ নীতিকে দুর্বল করছে, যার মাধ্যমে ভারত অর্থনৈতিক সহায়তা ও সংযোগ প্রকল্প যেমন ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়ক উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছিল। বাংলাদেশের এই নীতিগত পরিবর্তন বঙ্গোপসাগর অঞ্চলেও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। এটি বৈশ্বিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ।
অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) মতে, ‘এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়, যা আঞ্চলিক বিভাজনরেখাকে পুনর্নির্ধারণ করবে।’
চ্যাথাম হাউসের জুন ২০২৫-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে ঢাকা ইসলামাবাদ, বেইজিং ও নতুন অংশীদারদের দিকে ঝুঁকছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক জোট কাঠামোকে পুনর্গঠন করছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—উভয়কেই দক্ষিণ চীন সাগরে প্রবেশের কৌশলগত দ্বার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।’
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: ইন্দো-প্যাসিফিকে পরাশক্তিদের দাবা খেলা
এই পরিবর্তন এখন বৈশ্বিক পরিসরে যুক্ত হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বিনিয়োগ—যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে কারখানা স্থানান্তর ও বন্দর নির্মাণে অর্থায়ন—ঢাকাকে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের নেতৃত্বাধীন কোয়াড উদ্যোগের ভারসাম্য রক্ষায় চীনের কৌশলকে শক্তিশালী করছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র আফগান স্থিতিশীলতার জন্য পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে, ফলে ইসলামাবাদের আঞ্চলিক প্রভাব পরোক্ষভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনকে মোকাবিলায় আফগানিস্তানে ঘাঁটির সুযোগ পেতে পাকিস্তানকে এবং বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার পেতে বাংলাদেশকেও টানছে তারা।
কেউ কেউ বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে একত্র করছে—ভারতকে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতার শাস্তি দিতে।’
একইসঙ্গে সৌদি আরবের মতো উপসাগরীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে এবং তুরস্ক যৌথ প্রতিরক্ষা উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়ে মুসলিম বিশ্বের নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
চ্যাথাম হাউসের জুন ২০২৫-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে ঢাকা ইসলামাবাদ, বেইজিং ও নতুন অংশীদারদের দিকে ঝুঁকছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক জোট কাঠামোকে পুনর্গঠন করছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—উভয়কেই দক্ষিণ চীন সাগরে প্রবেশের কৌশলগত দ্বার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।’
উইলসন সেন্টারের বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, ঢাকা ও ইসলামাবাদ তাদের অগ্রগতি নিয়ে ‘ভারতকে চাপে ফেলতে’ সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। তিনি বলেন, এই সম্পর্ক শক্তিশালী হলে ‘বাস্তব অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা জোট’ও গড়ে উঠতে পারে।
ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস সতর্ক করে বলেছে, ‘এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এক নির্ধারক পরিবর্তন, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করবে।’
সম্ভাব্য পরিণতি: সুযোগ, ঝুঁকি ও নতুন দক্ষিণ এশিয়া
বাংলাদেশ-পাকিস্তানের এই নতুন সম্পর্কে ইতিবাচক সম্ভাবনার পাশাপাশি ঝুঁকিও রয়েছে। দুই দেশের সম্মিলিত বাজার প্রায় ৪৩ কোটি মানুষের। এটি পশ্চিম ইউরোপের দ্বিগুণ। বিজনেস কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দুই দেশের বাণিজ্য ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। এমন গুঞ্জনও ছড়িয়েছে যে পাকিস্তান হয়তো পারমাণবিক ছাতার আওতায় বাংলাদেশকে রাখতে চায়। স্থিতিশীলতা এলে সার্ক পুনর্জাগরণের সুযোগও মিলতে পারে।
তবে বাধাও কম নয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিদেশি বিনিয়োগে বাধা দিচ্ছে। আবার বাংলাদেশে ২০২৬ সালের নির্বাচনের পর নীতিগত পরিবর্তন আসতে পারে। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে পারে।
বিপরীতে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের নতুন সম্পর্ক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও পরোক্ষ সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। এটি চীনের ভারত-ঘেরাও নীতিকে শক্তিশালী করতে পারে। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে অস্ত্র সরবরাহ বাড়াতে পারে। যার ফলে দীর্ঘমেয়াদে দক্ষিণ এশিয়া হবে বহুমুখী শক্তির লড়াইয়ের ক্ষেত্র।
ভারত বাংলাদেশের পোশাক আমদানি সীমিত করেছ। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য কমে গেলে সুতা ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হতে পারে। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথনদীর পানি বণ্টন ইস্যুতেও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস সতর্ক করে বলেছে, ‘এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এক নির্ধারক পরিবর্তন, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করবে।’ বিশ্ববাণিজ্যেও এর প্রভাব পড়তে পারে—পাট ও পোশাক রপ্তানিতে বাধা তৈরি হলে দাম বাড়বে। আর বঙ্গোপসাগরে সামরিক উত্তেজনায় বিশ্ববাণিজ্যের খরচও বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উষ্ণতা কোনো রূপকথা নয়—এটি বাস্তব রাজনীতির ফল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা দুই দুর্বল অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে পারে, প্রতিরক্ষা সমঝোতা আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে পারে। কিন্তু ১৯৭১ সালের অমীমাংসিত ইতিহাস, ভারতের আশঙ্কা ও বৈশ্বিক শক্তির হস্তক্ষেপ এই প্রক্রিয়াকে ভঙ্গুর করে রেখেছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া: চাপ, নিয়ন্ত্রণ ও বিকল্প কৌশল
ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র রনধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, নয়া দিল্লি ‘ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে’ এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভারত সতর্ক কিন্তু কঠোর অবস্থান নিয়েছে। নয়া দিল্লি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা নরম করলেও নদীর পানি ভাগাভাগি আলোচনা স্থগিত করেছে এবং সীমান্ত টহল জোরদার করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, তারা ‘প্রতিবেশ-প্রথম নীতি’ পুনর্মূল্যায়ন করছে। ভারত এখন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও বাড়াতে চায়, যাতে পাকিস্তানের প্রভাব সীমিত থাকে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক চাপের অংশ হিসেবে তিস্তা বাঁধের অর্থায়ন বিলম্বিত করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
দীর্ঘমেয়াদে ভারত কোয়াড অংশীদারদের সঙ্গে সামুদ্রিক নিরাপত্তায় সহযোগিতা বাড়াতে পারে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবকাঠামো বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। ভারতের প্রতিক্রিয়ায় দেখা যেতে পারে কূটনৈতিক শীতলতা, যেমন—বাংলাদেশ থেকে আমদানি স্থগিত, সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার এবং ভূটান-নেপালকে কাছে টানা।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উষ্ণতা কোনো রূপকথা নয়—এটি বাস্তব রাজনীতির ফল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা দুই দুর্বল অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে পারে, প্রতিরক্ষা সমঝোতা আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে পারে। কিন্তু ১৯৭১ সালের অমীমাংসিত ইতিহাস, ভারতের আশঙ্কা ও বৈশ্বিক শক্তির হস্তক্ষেপ এই প্রক্রিয়াকে ভঙ্গুর করে রেখেছে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের এই পুনরুজ্জীবন উচ্চ-ঝুঁকি সত্ত্বেও ভূরাজনীতিতে ভারসাম্যের লক্ষ্যে পরিচালিত এক কৌশলগত পরিবর্তন। ঢাকার জন্য এটি স্বাধীন নীতির প্রতীক, কিন্তু বর্ডার লেন্সের ভাষায়, ‘একটি বিপজ্জনক জুয়াও’, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর শান্তিকে পরীক্ষা করছে। ভারতের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হলো সংলাপে ভারসাম্য রক্ষা করা—যাতে পরবর্তী দশকে ঘেরাও নয়, সহযোগিতাই ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: এক দশক উত্তেজনা ও ভারসাম্য
২০৩০ সালের মধ্যে এই পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন বহু-মেরুকেন্দ্রিক বাস্তবতা সৃষ্টি করতে পারে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে এই পরিবর্তন ভারতের চারপাশে এক ধরনের ‘ঘেরাও বলয়’ তৈরি করতে পারে—পশ্চিমে পাকিস্তান থেকে পূর্বে বাংলাদেশ পর্যন্ত। চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ জোট আঞ্চলিক বাণিজ্যপথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ভারতের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
এর বিপরীতে ভারত সামরিক ব্যয় ও কোয়াড জোটে সম্পৃক্ততা বাড়াতে পারে। সাইবার আক্রমণ, তথ্যযুদ্ধ ও প্রক্সি সংঘাতের ঝুঁকি বাড়বে। কিন্তু প্রতিবেশীদের আস্থা হারালে বৈশ্বিক পর্যায়ে তার প্রভাব দুর্বল হতে পারে।
অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা দক্ষিণ এশিয়ার মোট জিডিপি বৃদ্ধিকে বছরে ১-২ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে, বলে ধারণা করছে বিভিন্ন থিংক-ট্যাঙ্ক। অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যেমন চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের ৫ বিলিয়ন ডলারের সাবমেরিন ক্রয়, দেশের উন্নয়ন ব্যয়কে প্রতিরক্ষা খাতে সরিয়ে নিতে পারে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির মতামত লেখক সি রাজা মোহন বলেন, ‘বাংলাদেশকে বুঝতে হবে পাকিস্তানের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতার ঝুঁকি। কারণ এতে ভারতের প্রতিক্রিয়া তার ৫০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’
ডয়চে ভেলের (ডিডাব্লিউ) বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা ও ইসলামাবাদের সামুদ্রিক ও সামরিক সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা কাঠামোকে নতুনভাবে গড়ে তুলছে।’ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতার মাধ্যমে পরিস্থিতি প্রশমনে ভূমিকা রাখতে পারে।
চ্যাথাম হাউসের মতে, ভারতের প্রতিক্রিয়াই নির্ধারণ করবে এই নতুন আঞ্চলিক শৃঙ্খলা স্থিতিশীল হবে, নাকি অস্থিরতায় নিমজ্জিত হবে।
মুহাম্মদ ইউনুসের ভাষায়, বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো ভারসাম্য রক্ষা করা। কিন্তু ইতিহাস বলে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি সবসময় নড়বড়ে—প্রক্সি সংঘাত, নয়তো অপ্রত্যাশিত মীমাংসার ঝুঁকি আছে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের এই পুনরুজ্জীবন উচ্চ-ঝুঁকি সত্ত্বেও ভূরাজনীতিতে ভারসাম্যের লক্ষ্যে পরিচালিত এক কৌশলগত পরিবর্তন। ঢাকার জন্য এটি স্বাধীন নীতির প্রতীক, কিন্তু বর্ডার লেন্সের ভাষায়, ‘একটি বিপজ্জনক জুয়াও’, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর শান্তিকে পরীক্ষা করছে।
আরব নিউজের প্রতিবেদন মতে, এটি এক নতুন দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন। আঞ্চলিক ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতার স্বার্থেই বিশেষজ্ঞরা পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে সম্পর্ক আরও গভীর করার আহ্বান জানাচ্ছেন। ভারতের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হলো সংলাপে ভারসাম্য রক্ষা করা—যাতে পরবর্তী দশকে ঘেরাও নয়, সহযোগিতাই ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করে।