.png)
খসড়ার সবচেয়ে আলোচিত প্রস্তাব হলো—বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া। এতে বেতন, ভাতা ও প্রোটোকলও মন্ত্রীর সমান হবে। মনসুরের যুক্তি, এই মর্যাদা ব্যাংকের মর্যাদা ও নীতিগত স্বাধীনতা বাড়াবে। তবে সমালোচকদের মতে, এতে ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হতে পারে এবং জবাবদিহি দুর্বল হবে।

স্ট্রিম ডেস্ক

বাংলাদেশ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ একটি প্রস্তাবিত আইনগত সংস্কার। এর লক্ষ্য ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ সংশোধন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন, শাসনব্যবস্থা ও কার্যকর স্বাধীনতা বাড়ানো। দেশি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা এই অধ্যাদেশের বৃহত্তর লক্ষ্য অতীতের আর্থিক খাতের অনিয়ম দূর করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। এর কাঠামো যুক্তরাজ্যের ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ও ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যপদ্ধতির অনুসরণে তৈরি করা হয়েছে।
এই খসড়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও আইএমএফ-এর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা সংক্রান্ত সুপারিশের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে বিষয়টি জানান। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেককে গভর্নর আলাদা চিঠি পাঠিয়ে বলেছেন, বিদ্যমান বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ সংশোধন করে এ অধ্যাদেশ করা হচ্ছে।
অধ্যাদেশ জারির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উপদেষ্টা ও সচিবদের সহযোগিতা চান তিনি। মনসুর বলেন এই অধ্যাদেশ সংশোধন করার জন্য বর্তমান সময়টিই সবচেয়ে উপযুক্ত। তাঁর মতে, অতীতের সরকারগুলো রাজনৈতিক কারণ ও প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাবে এমন সংস্কার আনতে পারেনি।
খসড়ার সবচেয়ে আলোচিত প্রস্তাব হলো—বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া। এতে বেতন, ভাতা ও প্রোটোকলও মন্ত্রীর সমান হবে। মনসুরের যুক্তি, এই মর্যাদা ব্যাংকের মর্যাদা ও নীতিগত স্বাধীনতা বাড়াবে। তবে সমালোচকদের মতে, এতে ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হতে পারে এবং জবাবদিহি দুর্বল হবে।
রাজনৈতিক পরাধীনতা থেকে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
অতীতে গভর্নররা সবসময় নিরপেক্ষ নীতিনির্ধারণের চেয়ে সরকারি নির্দেশনাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এই দুর্বলতা নানা বড় কেলেঙ্কারিতে স্পষ্ট হয়েছে। ২০১৬ সালের সাইবার জালিয়াতিতে রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি এবং এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ—এই দুটি ঘটনা ব্যাংকের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত ও স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্ট করে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ও মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের সুযোগ তৈরি করে। নতুন খসড়া আইএমএফ-এর ২০২১ সালের ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক ইনডিপেনডেন্স ফ্রেমওয়ার্ক’-এর সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। মনসুর তাঁর চিঠিতে বলেন, এটি হবে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘গুরুত্বপূর্ণ অবদান’, যা অতীতের ভুল ও অনিয়ম ঠেকিয়ে একটি ‘আধুনিক, স্বশাসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ গঠনের পথ খুলে দেবে। এ ছাড়া স্বজনপ্রীতি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং একচেটিয়া চর্চায় জর্জরিত একটি খাতের আস্থা ফিরিয়ে আনবে।
খসড়া অধ্যাদেশের মূল বিষয়সমূহ
এই খসড়া অধ্যাদেশে কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমকে রাজনীতি থেকে পৃথক করা, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা এবং তদারকি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে কিছু ভিন্নতা থাকলেও মূল ধারাগুলো বোর্ডের গঠন, নিয়োগ ও অপসারণ প্রক্রিয়া, ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর কেন্দ্র করে তৈরি।
বোর্ডের গঠন: সরকারের প্রতিনিধি সংখ্যা ৩ জন (অর্থ সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব) থেকে কমিয়ে ১ জনে আনা হবে। স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ৪ থেকে বাড়িয়ে ৬ জন করা হবে। ফলে মোট সদস্য হবে ৯ জন, গভর্নর থাকবেন চেয়ারম্যান হিসেবে। বিকল্প প্রস্তাবে গভর্নর, দুজন উপ-গভর্নর এবং গভর্নরের সুপারিশকৃত তালিকা থেকে ৮ জন পরিচালক নিয়ে ১১ সদস্যের বোর্ডের প্রস্তাবও রয়েছে।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো— নির্বাহী প্রভাব সীমিত করা, পেশাদার ও নিরপেক্ষ নীতিনির্ধারণে সহায়ক হওয়া। আইএমএফ-এর উদ্বেগ অনুযায়ী সরকারের অতিরিক্ত আসন কমানো। বৈচিত্র্য ও নিরপেক্ষতা বাড়ানো।
নিয়োগ প্রক্রিয়া: গভর্নর ও উপ-গভর্নর পদে প্রার্থী নির্বাচনে তিন সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির চেয়ারম্যান হবেন সাবেক অর্থ বা পরিকল্পনা মন্ত্রী/উপদেষ্টা অথবা সাবেক গভর্নর। রাষ্ট্রপতি যোগ্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেবেন। মেয়াদ হবে ৬ বছর, একবার পুনর্নিয়োগযোগ্য। একইসঙ্গে অন্য কোনো সরকারি বা আইনসভা পদে থাকা যাবে না।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো— রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা। আনুগত্যনির্ভর নিয়োগ সংস্কৃতি বন্ধ করা।
অপসারণ প্রক্রিয়া: অভিযোগ তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হবে। শুধুমাত্র বিচারিক বা আইনানুগ প্রক্রিয়ায় অপসারণ করা যাবে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের অনুমোদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো— নির্বিচার বরখাস্তের ঝুঁকি কমানো এবং মেয়াদকালের নিশ্চয়তা ও স্বাধীনতা বজায় রাখা।
ক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসন বাড়ানো: ব্যাংক নিজস্ব বেতন কাঠামো নির্ধারণ, পদ সৃষ্টি, কর্মকর্তা নিয়োগ ও নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষমতা পাবে (রাষ্ট্রপতির অনুমোদনসাপেক্ষে)। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও একচেটিয়া প্রভাব রোধে সমন্বিত তদারকি কাঠামো তৈরি হবে। বোর্ড পূর্ণ কৌশলগত ও তদারকি নিয়ন্ত্রণ পাবে।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো—নির্বাহী নির্ভরতা হ্রাস, কার্যকর স্বাধীনতা ও নৈতিক তদারকি বৃদ্ধি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা জোরদার করা।
মূলধন বৃদ্ধি: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ কোটি টাকা করা হবে (৩৩ গুণের বেশি বৃদ্ধি)।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো—আর্থিক সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো।
জবাবদিহি ব্যবস্থা: সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে তদারকি (শাসক ও বিরোধী দলের ৫০ শতাংশ করে সমান অংশগ্রহণ)। নিয়োগে বয়সসীমা নির্ধারণের সম্ভাবনা। মুদ্রা ও বৈদেশিক মুদ্রানীতির সমন্বয়ে ‘কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল’ গঠন করা হবে, যার সভাপতি হবেন অর্থমন্ত্রী এবং সদস্য থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো—স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেও ভারসাম্যপূর্ণ জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
আরও কিছু সংস্কারের মধ্যে রয়েছে—
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন: পরিচালক পদে মেয়াদ কমানো ও যোগ্যতা যাচাই প্যানেল গঠন।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন: বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের বিধান।
ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স আইন: আমানত সুরক্ষার সীমা ২ লাখ টাকায় উন্নীত করা।
এছাড়া ব্যাংক খাতের পুনর্গঠন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম ও বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
গভর্নরকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব কেন
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রস্তাব করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদমর্যাদা পূর্ণ মন্ত্রীর সমান করা হোক। বর্তমানে এই পদ সচিবদের চেয়ে উঁচু হলেও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নিচে। তাঁর মতে, এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ‘একটি মৌলিক কাঠামোগত পদক্ষেপ।’ বিভিন্ন চিঠি ও সাক্ষাৎকারে মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনই মূল দর্শন। যদি গভর্নরের পদ মন্ত্রীর সমান হয়, তবে সেই স্বাধীনতা আরও শক্তিশালী হবে।’
তিনি যুক্তি দেন, এতে প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা বাড়বে, অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সহজ হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব আরও শক্তিশালী হবে। ফলে নীতিনির্ধারণে সরকারনির্ভরতা কমে যাবে ও সমান মর্যাদায় নীতি আলোচনায় অংশ নেওয়া সম্ভব হবে। মনসুর এটিকে আইএমএফের নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেও দাবি করেন। তাঁর মতে, এটি অতীতের নীতিগত বাধ্যতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি করবে।
সুবিধা: এই মর্যাদা গভর্নরকে আরও দৃঢ়ভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা দেবে। মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে নীতিগত সমন্বয় সহজ হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি শক্তিশালী হবে। এতে আইএমএফ বা ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস (বিআইএস)-এর সঙ্গে আলোচনায় বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। মনসুর একে ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার এক গর্বের মুহূর্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অসুবিধা ও ঝুঁকি: সমালোচকদের মতে, শুধু পদমর্যাদা বাড়ালে ফলাফল ভালো হবে না—এটি নির্ভর করে ব্যক্তির সক্ষমতা ও সততার ওপর। সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও পর্ষদ সদস্য মোস্তাফা কে. মুজেরি সতর্ক করেছেন, অতিরিক্ত স্বাধীনতা কখনও ‘একনায়কতন্ত্র, অযৌক্তিকতা ও অতি-ক্ষমতাবাদে’ রূপ নিতে পারে। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংঘাতও দেখা দিতে পারে।
তিনি অতীতের উদাহরণ টেনে বলেন, গভর্নর আতিউর রহমানের সময় সিদ্ধান্তগুলো এতটাই কেন্দ্রীভূত ছিল যে, বোর্ড সদস্যরা কেলেঙ্কারির খবর মিডিয়া থেকেই জানতে পারতেন। মুজেরির মতে, ভারসাম্য রক্ষায় বয়সসীমা নির্ধারণ ও বোর্ডের ক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি।
আন্তর্জাতিক তুলনা: মনসুর যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের উদাহরণ দেন, যেখানে গভর্নররা মন্ত্রীর সমমর্যাদা ভোগ করেন। এসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন হলেও সরকার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কানাডা, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের বোর্ড কাঠামোতেও সরকারের প্রতিনিধিত্ব সীমিত রাখা হয়, যাতে নীতি নির্ধারণে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।
প্রভাব, ঝুঁকি, চ্যালেঞ্জ ও পরিণতি
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ কার্যকর হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন বাড়বে। এতে মুদ্রানীতি রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হতে পারে। এটি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে (বর্তমানে ২০২৫ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ) সহায়তা করবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হবে। তদারকি ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি রোধ সম্ভব হবে। এটি আইএমএফের কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা রাজস্ব বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণের লক্ষ্যে কাজ করছে।
তবে গভর্নরের প্রস্তাব বাস্তবায়নে প্রশাসনিক প্রতিরোধ দেখা দিতে পারে। মনসুর নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘সরকার ও আমলারা হয়তো আপত্তি তুলবে, কিন্তু আর্থিক খাতের শাসন রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।’ সংসদীয় তদারকি দুর্বল হলে (‘দাঁতহীন কাঠামো’ হিসেবে বর্ণিত) এই সংস্কার কার্যকারিতা হারাতে পারে। আবার সরকারের প্রতিনিধিত্ব কমলে সাধারণ জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কাও ব্যাংক খাতের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা প্রকাশ করেছেন।
সংস্কারটি বাস্তবায়িত হলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারেও সহায়ক হতে পারে, বিশেষত ২০২৫ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে। তবে যথাযথ ভারসাম্য না থাকলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ঝুঁকি রয়ে যায়। ‘কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল’ মুদ্রা ও রাজস্বনীতির সমন্বয় রক্ষা করবে, তবে স্বাধীনতাও অক্ষুণ্ণ রাখবে।
প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রস্তাবটিকে ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল’ বলে মন্তব্য করেছেন এবং জানিয়েছেন এটি মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে পর্যালোচনাধীন। মোস্তাফা মুজেরির মতে, গভর্নরের মর্যাদা বাড়ানোর চেয়ে বোর্ডের ক্ষমতা ও জবাবদিহি বাড়ানো বেশি জরুরি। ব্যাংক কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এতে দায়বদ্ধতা কমে যেতে পারে এবং নীতিগত বিভাজন বাড়তে পারে। মনসুর এ অবস্থায় টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে।
বাংলাদেশ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আধুনিকায়নের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা। গভর্নরকে মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাবটি এর প্রতীকী হলেও বিতর্কিত উপাদান। অধ্যাদেশটি যদি অধ্যাদেশ আকারে দ্রুত কার্যকর হয়, তবে এটি আর্থিক কেলেঙ্কারি প্রতিরোধ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ঝুঁকি রোধে যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রয়োজন।
মানসুরের ভাষায়, এটি বাংলাদেশের আর্থিক ইতিহাসের ‘একটি সংকটময় মুহূর্ত।’ অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের আর্থিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ একটি প্রস্তাবিত আইনগত সংস্কার। এর লক্ষ্য ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ সংশোধন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন, শাসনব্যবস্থা ও কার্যকর স্বাধীনতা বাড়ানো। দেশি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা এই অধ্যাদেশের বৃহত্তর লক্ষ্য অতীতের আর্থিক খাতের অনিয়ম দূর করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। এর কাঠামো যুক্তরাজ্যের ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ও ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যপদ্ধতির অনুসরণে তৈরি করা হয়েছে।
এই খসড়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও আইএমএফ-এর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা সংক্রান্ত সুপারিশের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে বিষয়টি জানান। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেককে গভর্নর আলাদা চিঠি পাঠিয়ে বলেছেন, বিদ্যমান বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ সংশোধন করে এ অধ্যাদেশ করা হচ্ছে।
অধ্যাদেশ জারির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উপদেষ্টা ও সচিবদের সহযোগিতা চান তিনি। মনসুর বলেন এই অধ্যাদেশ সংশোধন করার জন্য বর্তমান সময়টিই সবচেয়ে উপযুক্ত। তাঁর মতে, অতীতের সরকারগুলো রাজনৈতিক কারণ ও প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাবে এমন সংস্কার আনতে পারেনি।
খসড়ার সবচেয়ে আলোচিত প্রস্তাব হলো—বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া। এতে বেতন, ভাতা ও প্রোটোকলও মন্ত্রীর সমান হবে। মনসুরের যুক্তি, এই মর্যাদা ব্যাংকের মর্যাদা ও নীতিগত স্বাধীনতা বাড়াবে। তবে সমালোচকদের মতে, এতে ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হতে পারে এবং জবাবদিহি দুর্বল হবে।
রাজনৈতিক পরাধীনতা থেকে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
অতীতে গভর্নররা সবসময় নিরপেক্ষ নীতিনির্ধারণের চেয়ে সরকারি নির্দেশনাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এই দুর্বলতা নানা বড় কেলেঙ্কারিতে স্পষ্ট হয়েছে। ২০১৬ সালের সাইবার জালিয়াতিতে রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি এবং এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ—এই দুটি ঘটনা ব্যাংকের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত ও স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্ট করে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ও মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের সুযোগ তৈরি করে। নতুন খসড়া আইএমএফ-এর ২০২১ সালের ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক ইনডিপেনডেন্স ফ্রেমওয়ার্ক’-এর সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। মনসুর তাঁর চিঠিতে বলেন, এটি হবে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘গুরুত্বপূর্ণ অবদান’, যা অতীতের ভুল ও অনিয়ম ঠেকিয়ে একটি ‘আধুনিক, স্বশাসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ গঠনের পথ খুলে দেবে। এ ছাড়া স্বজনপ্রীতি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং একচেটিয়া চর্চায় জর্জরিত একটি খাতের আস্থা ফিরিয়ে আনবে।
খসড়া অধ্যাদেশের মূল বিষয়সমূহ
এই খসড়া অধ্যাদেশে কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমকে রাজনীতি থেকে পৃথক করা, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা এবং তদারকি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে কিছু ভিন্নতা থাকলেও মূল ধারাগুলো বোর্ডের গঠন, নিয়োগ ও অপসারণ প্রক্রিয়া, ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর কেন্দ্র করে তৈরি।
বোর্ডের গঠন: সরকারের প্রতিনিধি সংখ্যা ৩ জন (অর্থ সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব) থেকে কমিয়ে ১ জনে আনা হবে। স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ৪ থেকে বাড়িয়ে ৬ জন করা হবে। ফলে মোট সদস্য হবে ৯ জন, গভর্নর থাকবেন চেয়ারম্যান হিসেবে। বিকল্প প্রস্তাবে গভর্নর, দুজন উপ-গভর্নর এবং গভর্নরের সুপারিশকৃত তালিকা থেকে ৮ জন পরিচালক নিয়ে ১১ সদস্যের বোর্ডের প্রস্তাবও রয়েছে।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো— নির্বাহী প্রভাব সীমিত করা, পেশাদার ও নিরপেক্ষ নীতিনির্ধারণে সহায়ক হওয়া। আইএমএফ-এর উদ্বেগ অনুযায়ী সরকারের অতিরিক্ত আসন কমানো। বৈচিত্র্য ও নিরপেক্ষতা বাড়ানো।
নিয়োগ প্রক্রিয়া: গভর্নর ও উপ-গভর্নর পদে প্রার্থী নির্বাচনে তিন সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির চেয়ারম্যান হবেন সাবেক অর্থ বা পরিকল্পনা মন্ত্রী/উপদেষ্টা অথবা সাবেক গভর্নর। রাষ্ট্রপতি যোগ্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেবেন। মেয়াদ হবে ৬ বছর, একবার পুনর্নিয়োগযোগ্য। একইসঙ্গে অন্য কোনো সরকারি বা আইনসভা পদে থাকা যাবে না।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো— রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা। আনুগত্যনির্ভর নিয়োগ সংস্কৃতি বন্ধ করা।
অপসারণ প্রক্রিয়া: অভিযোগ তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হবে। শুধুমাত্র বিচারিক বা আইনানুগ প্রক্রিয়ায় অপসারণ করা যাবে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের অনুমোদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো— নির্বিচার বরখাস্তের ঝুঁকি কমানো এবং মেয়াদকালের নিশ্চয়তা ও স্বাধীনতা বজায় রাখা।
ক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসন বাড়ানো: ব্যাংক নিজস্ব বেতন কাঠামো নির্ধারণ, পদ সৃষ্টি, কর্মকর্তা নিয়োগ ও নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষমতা পাবে (রাষ্ট্রপতির অনুমোদনসাপেক্ষে)। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও একচেটিয়া প্রভাব রোধে সমন্বিত তদারকি কাঠামো তৈরি হবে। বোর্ড পূর্ণ কৌশলগত ও তদারকি নিয়ন্ত্রণ পাবে।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো—নির্বাহী নির্ভরতা হ্রাস, কার্যকর স্বাধীনতা ও নৈতিক তদারকি বৃদ্ধি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা জোরদার করা।
মূলধন বৃদ্ধি: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ কোটি টাকা করা হবে (৩৩ গুণের বেশি বৃদ্ধি)।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো—আর্থিক সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো।
জবাবদিহি ব্যবস্থা: সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে তদারকি (শাসক ও বিরোধী দলের ৫০ শতাংশ করে সমান অংশগ্রহণ)। নিয়োগে বয়সসীমা নির্ধারণের সম্ভাবনা। মুদ্রা ও বৈদেশিক মুদ্রানীতির সমন্বয়ে ‘কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল’ গঠন করা হবে, যার সভাপতি হবেন অর্থমন্ত্রী এবং সদস্য থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর।
এর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা হলো—স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেও ভারসাম্যপূর্ণ জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
আরও কিছু সংস্কারের মধ্যে রয়েছে—
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন: পরিচালক পদে মেয়াদ কমানো ও যোগ্যতা যাচাই প্যানেল গঠন।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন: বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের বিধান।
ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স আইন: আমানত সুরক্ষার সীমা ২ লাখ টাকায় উন্নীত করা।
এছাড়া ব্যাংক খাতের পুনর্গঠন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম ও বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
গভর্নরকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব কেন
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রস্তাব করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদমর্যাদা পূর্ণ মন্ত্রীর সমান করা হোক। বর্তমানে এই পদ সচিবদের চেয়ে উঁচু হলেও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নিচে। তাঁর মতে, এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ‘একটি মৌলিক কাঠামোগত পদক্ষেপ।’ বিভিন্ন চিঠি ও সাক্ষাৎকারে মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনই মূল দর্শন। যদি গভর্নরের পদ মন্ত্রীর সমান হয়, তবে সেই স্বাধীনতা আরও শক্তিশালী হবে।’
তিনি যুক্তি দেন, এতে প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা বাড়বে, অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সহজ হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব আরও শক্তিশালী হবে। ফলে নীতিনির্ধারণে সরকারনির্ভরতা কমে যাবে ও সমান মর্যাদায় নীতি আলোচনায় অংশ নেওয়া সম্ভব হবে। মনসুর এটিকে আইএমএফের নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেও দাবি করেন। তাঁর মতে, এটি অতীতের নীতিগত বাধ্যতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি করবে।
সুবিধা: এই মর্যাদা গভর্নরকে আরও দৃঢ়ভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা দেবে। মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে নীতিগত সমন্বয় সহজ হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি শক্তিশালী হবে। এতে আইএমএফ বা ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস (বিআইএস)-এর সঙ্গে আলোচনায় বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। মনসুর একে ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার এক গর্বের মুহূর্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অসুবিধা ও ঝুঁকি: সমালোচকদের মতে, শুধু পদমর্যাদা বাড়ালে ফলাফল ভালো হবে না—এটি নির্ভর করে ব্যক্তির সক্ষমতা ও সততার ওপর। সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও পর্ষদ সদস্য মোস্তাফা কে. মুজেরি সতর্ক করেছেন, অতিরিক্ত স্বাধীনতা কখনও ‘একনায়কতন্ত্র, অযৌক্তিকতা ও অতি-ক্ষমতাবাদে’ রূপ নিতে পারে। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংঘাতও দেখা দিতে পারে।
তিনি অতীতের উদাহরণ টেনে বলেন, গভর্নর আতিউর রহমানের সময় সিদ্ধান্তগুলো এতটাই কেন্দ্রীভূত ছিল যে, বোর্ড সদস্যরা কেলেঙ্কারির খবর মিডিয়া থেকেই জানতে পারতেন। মুজেরির মতে, ভারসাম্য রক্ষায় বয়সসীমা নির্ধারণ ও বোর্ডের ক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি।
আন্তর্জাতিক তুলনা: মনসুর যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের উদাহরণ দেন, যেখানে গভর্নররা মন্ত্রীর সমমর্যাদা ভোগ করেন। এসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন হলেও সরকার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কানাডা, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের বোর্ড কাঠামোতেও সরকারের প্রতিনিধিত্ব সীমিত রাখা হয়, যাতে নীতি নির্ধারণে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।
প্রভাব, ঝুঁকি, চ্যালেঞ্জ ও পরিণতি
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ কার্যকর হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন বাড়বে। এতে মুদ্রানীতি রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হতে পারে। এটি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে (বর্তমানে ২০২৫ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ) সহায়তা করবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হবে। তদারকি ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি রোধ সম্ভব হবে। এটি আইএমএফের কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা রাজস্ব বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণের লক্ষ্যে কাজ করছে।
তবে গভর্নরের প্রস্তাব বাস্তবায়নে প্রশাসনিক প্রতিরোধ দেখা দিতে পারে। মনসুর নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘সরকার ও আমলারা হয়তো আপত্তি তুলবে, কিন্তু আর্থিক খাতের শাসন রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।’ সংসদীয় তদারকি দুর্বল হলে (‘দাঁতহীন কাঠামো’ হিসেবে বর্ণিত) এই সংস্কার কার্যকারিতা হারাতে পারে। আবার সরকারের প্রতিনিধিত্ব কমলে সাধারণ জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কাও ব্যাংক খাতের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা প্রকাশ করেছেন।
সংস্কারটি বাস্তবায়িত হলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারেও সহায়ক হতে পারে, বিশেষত ২০২৫ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে। তবে যথাযথ ভারসাম্য না থাকলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ঝুঁকি রয়ে যায়। ‘কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল’ মুদ্রা ও রাজস্বনীতির সমন্বয় রক্ষা করবে, তবে স্বাধীনতাও অক্ষুণ্ণ রাখবে।
প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রস্তাবটিকে ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল’ বলে মন্তব্য করেছেন এবং জানিয়েছেন এটি মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে পর্যালোচনাধীন। মোস্তাফা মুজেরির মতে, গভর্নরের মর্যাদা বাড়ানোর চেয়ে বোর্ডের ক্ষমতা ও জবাবদিহি বাড়ানো বেশি জরুরি। ব্যাংক কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এতে দায়বদ্ধতা কমে যেতে পারে এবং নীতিগত বিভাজন বাড়তে পারে। মনসুর এ অবস্থায় টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে।
বাংলাদেশ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আধুনিকায়নের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা। গভর্নরকে মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাবটি এর প্রতীকী হলেও বিতর্কিত উপাদান। অধ্যাদেশটি যদি অধ্যাদেশ আকারে দ্রুত কার্যকর হয়, তবে এটি আর্থিক কেলেঙ্কারি প্রতিরোধ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ঝুঁকি রোধে যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রয়োজন।
মানসুরের ভাষায়, এটি বাংলাদেশের আর্থিক ইতিহাসের ‘একটি সংকটময় মুহূর্ত।’ অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের আর্থিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
.png)

৩০০-র বেশি লেখক, শিক্ষাবিদ ও সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতামত বিভাগে লেখা থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা একত্রে এই পদক্ষেপ নিয়েছেন পত্রিকাটিকে গাজায় চলমান গণহত্যায় এর ভূমিকার জন্য দায়ী করতে।
১২ ঘণ্টা আগে
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে চার দিনব্যাপী আলোচনার পর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনা ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়েছে ২৮ অক্টোবর। কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠককে ‘শেষ চেষ্টা’ হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অভিযোগের কারণে আলোচনাটি ভেঙে পড়ে।
১ দিন আগে
যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনা ও বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে ‘বিরল খনিজ’ বিশ্বজুড়ে আলোচনায়। ১৭টি রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট (আরইই) বা বিরল মৃত্তিকা উপাদানকে বলা বিরল হয় বিরল খনিজ। এই ধাতুগুলো রাসায়নিকভাবে প্রায় একইরকম।
১ দিন আগে
আর্জেন্টিনার মধ্যবর্তী সংসদ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই তার চরম ডানপন্থী অর্থনৈতিক সংস্কারের পক্ষে জোরালো জনসমর্থন অর্জন করেছেন। তার দল লা লিবেরতাদ আভানজা জাতীয় ভোটে ৪১ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে বিপুল ব্যবধানে জয় লাভ করে।
১ দিন আগে