—এইহানে তোর কয় বছর হইলরে রূপক? 
—অত হিসাব নাই। তয় ১৭০-এর কম না।
—অহন কী করবি ভাবছস?
—না, ভাবি নাই। তয় নতুন জায়গা খুঁজতে হইব আরকি।
না, কোনো মানুষ ১৭০ বছর বেঁচেছে বলে আমার জানা নেই। আপনারাও এখনই গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস খুলে বসবেন না। এখানে মানুষ নয়, ভূতের কথা বলা হচ্ছে। বয়স নিয়ে ‘এজ শেমিং’ না করলেই স্বীকার করতে হবে—ভূতেদের জন্য ১৭০ বছর তেমন কিছুই না। ওটা তো কেবল কৈশোর পেরোনোর বয়স। কিন্তু এই বয়সেই রুপক নামের ভূতকে নিজের বাসস্থান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রূপক মারা গিয়েছিল ১৮৫৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, সন্ধ্যার দিকে। যক্ষ্মা হয়েছিল, বয়স মাত্র আঠারো। ঢাকায় তখন কেরোসিনের আলোও বিলাসিতা। বাপ-মা ছেলেকে বাঁচাতে তাবিজ, ঝাড়ফুঁক, কবিরাজ—সবই করেছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। প্রাণটা বেরিয়ে যেতেই রুপক বুঝল, মৃত্যু কোনো মুক্তি নয়, বরং এক অন্যরকম জীবন শুরু।
এক শহর, বহু ভূত
অশরীরী রুপে প্রথম কয়েক মাস রুপক ছিল বেশ বিভ্রান্ত। ভয় দেখিয়ে কিছুটা আনন্দ পেত বটে, কিন্তু মাথা গোঁজার জায়গা পাচ্ছিল না। তবু সান্ত্বনা ছিল—তখন ঢাকায় ভূতদের জন্য বাসস্থান সংকট তেমন ছিল না। এক-আধটু ‘সিনিয়র ভূত’কে ‘সিকিউরিটি মানি’ দিলেই জায়গা মিলে যেত। কিন্তু সদ্য-মরা, গরিব ভূত রুপকের সে সামর্থ্য ছিল না।
তখনকার ঢাকায় গাছপালা বেশি, মানুষ কম, আর ভূতেরা মোটামুটি স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াত। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল, ‘রে রুপক, কলকাতা চলে যা। সেখানে এখন সাহেবদের অনেক ভুতুড়ে ঘর।’ কিন্তু রুপক যায়নি। অলসতা তার জাত-দোষ। নতুন ভূতেরা এখন একে বলে ‘কমফোর্ট জোন’।
অবশেষে রুপক এক খোলামেলা জায়গায় নিজের ঘর গড়ে নেয়। সময় কেটে যায়, শতাব্দী পেরোয়। ভূতসমাজে পদোন্নতি হতে হতে এখন সে এলাকার ভূত অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি। জীবন শান্তিপূর্ণ। রাতে হাওয়া খায়। মাঝে মাঝে নতুনদের ভয় দেখিয়ে শেখানো কীভাবে অদৃশ্য হওয়া যায়।
উচ্ছেদের হুজুগ
কিন্তু শান্তির দিন বেশিদিন টেকে না—ভূতেরও না। একরাতে খবর আসে, ওদের বসতিতে নাকি উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। কেউ এসে দালানকোঠা ভেঙে ফেলছে, কেউ গাছ কেটে দিচ্ছে। রুপক হতভম্ব। ১৭০ বছরের বাসস্থান, এখন কোথায় যাবে?
অমাবস্যার রাতে সে পশ্চিমপাড়ায় গিয়ে দেখে, বিশাল মিছিল। মানুষের। শত শত লোক, হাতে প্ল্যাকার্ড, মুখে স্লোগান—
‘অবৈধদের ঠিকানা, এই এলাকায় হবে না!’
রুপকের শরীর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। ভূতদের ‘অবৈধ’ বলা হচ্ছে! সে ভাবছিল, মানুষদের সময়মতো ঘুমানোর অভ্যাস গেছে, তাই কি তারা মাঝরাতে মিছিল করে? নাকি মধ্যরাত এখন ভূতদের নয়, মানুষদের সময়?
কিছুক্ষণ পর সে নিজের ভুল বুঝতে পারে—মানুষেরা শুধু নিজেদের ভয়ে বাঁচে না, ভয় বানাতেও ওস্তাদ হয়ে গেছে।
সেন্ট্রাল অ্যাসোসিয়েশন অব ভূতস
পরদিনই রুপক এলাকার সব ভূতকে ডাকে। সিদ্ধান্ত হয়, বিষয়টা উপরের দপ্তরে তোলা হবে—‘সেন্ট্রাল অ্যাসোসিয়েশন অব ভূতস’-এ।
গায়ে কালি মেখে, ধুলো ঝেড়ে, সবাই হাজির হয় সংগঠনের প্রধানের দরবারে। সবিস্তারে সমস্যার কথা শুনে প্রধানের মুখে এক চওড়া হাসি।
‘এ আর এমন কী! একটা বিবৃতি দিলেই হলো।’
রুপকের চোখ কপালে।
‘মালিক, আমরা তো উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছি! শুধু বিবৃতি দিলে হবে?’
প্রধান গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘অবশ্যই হবে। এই দেশে যেকোনো সমস্যার প্রাথমিক চিকিৎসা হলো বিবৃতি।’
‘আর যদি না হয়?’
‘তাহলে আবার বিবৃতি।’
‘তাঁরা যদি পাত্তাই না দেয়?’
‘তাহলে বলব—এটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নষ্টের ষড়যন্ত্র!’
রুপক তখন প্রায় চিৎকার করছিল, ‘আমরা ভূত! আমাদের তো বাসা লাগবে!’
বাকিরা কোনোভাবে থামায়, না হলে হয়তো ‘সেন্ট্রাল অ্যাসোসিয়েশন অব ভূতস’-এর সদর দপ্তরে গৃহযুদ্ধ লেগে যেত।
শেষ দেখা
অবশ্য ওই এলাকার ভূতদের শেষরক্ষা হয়নি। তাদের জায়গা ভেঙে এখন সেখানে গড়ে উঠেছে আধুনিক ফ্ল্যাট, ঝকঝকে রাস্তা, ক্যাফে, পার্কিং লট। ভূতেরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় শহরের প্রান্তে, পরিত্যক্ত কলোনিতে।
ভয় দেখানো এখন কষ্টের কাজ। মানুষদের সময় নেই ভয় পাওয়ার। তাঁরা এখন নিজেরাই নিজেদের ভয় দেখাতে ব্যস্ত।
সেদিন রুপক দেখে, রাস্তায় একজন পুরুষকে ঘিরে ধরেছে আরও কয়েকজন পুরুষ। অভিযোগ, ছেলেটির পোশাক ‘অশালীন’।
রুপক স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে। ভাবে—মানুষদের সংগঠনগুলো নিশ্চয়ই এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করে? নাকি সেখানেও শুধু বিবৃতি দেওয়া হয়?
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, 
‘এই শহরে এখন ভূতেরাই বৈধ—আর মানুষেরাই অবৈধ।’