leadT1ad

ওদিকের হ্যালোইন ও এখানের ‘ভূত চতুদর্শী’

এই বিশ্বায়নের যুগে ‘হ্যালোইন’ নিয়ে কমবেশি সবাই জানেন। ইদানীংকালে এ নিয়ে আমাদের দেশে মাতামাতিও কম হয় না। অথচ আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে প্রায় একই রকম ‘ভূত চতুদর্শী’ নামে একটি উৎসব রয়েছে। এই দুটো উৎসবের ইতিহাস, মিল-অমিল সম্পর্কে জানেন কী?

অমিত বাপি বিশ্বাস
অমিত বাপি বিশ্বাস

প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ০০
স্ট্রিম গ্রাফিক

চাঁদনি রাত। ঘরে একা বসে আছি। টুং করে শব্দ হলো। নীরবতাকে চুরমার করে দিল। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কোনোকিছু ঘরে ঢুকছে। তখনই হঠাৎ মায়ের হাতে এসে কপাল ছুঁয়ে দিল। চোখ মেলে তাকাতেই দেখি মা মিষ্টি করে হেসে বলছেন,‘ভয় পেও না, সব কল্পনা শুধু গল্পের অংশ।’ সেদিন রাতে ঘুমানের আগে মা ভূতের গল্প বলেছিলেন। সেজন্যই হয়তো এমন ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই রাতের ভয় আর কৌতূহল এগুলোই আমাদের ভৌতিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সূচনা। আমরা অজানাকে জানার চেষ্টা করেছি। অদৃশ্য জগতের রহস্য জানার লোভ প্রাচীনকাল থেকে এখনো আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি।

এই অদৃশ্য জগতের প্রতি কৌতূহলই জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন উৎসবের। পৃথিবীর এক প্রান্তে হ্যালোইন, অন্য প্রান্তে ‘ভূত চতুদর্শী’। দুটো উৎসবই মৃত আত্মা, অজানা শক্তি এবং ভয়ের খেলার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু একটির জোয়ার হয়েছে বিশ্বব্যাপী, অন্যটি রয়ে গেছে আড়ালেই।

হ্যালোইন এবং ভূত চতুর্দশী—দুটো উৎসবের ধর্মীয় আবহ শুরুতে ছিল প্রায় একই ধরনের। কিন্তু হ্যালোইন সময়ের সঙ্গে দেশ, ধর্ম ও সংস্কৃতির সীমা পেরিয়েছে। জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী। এর মূল কারণ হলো ভৌতিক আবহ ধরে রাখা এবং মানুষের চিরায়ত কৌতূহল। কুমড়োর মুখোশ, ভয়ঙ্কর পোশাক, ভূতুড়ে গল্প—সবকিছু মিলিয়ে হ্যালোইন হয়ে উঠেছে সার্বজনীন আনন্দের উৎসব।

হ্যালোইন: ভূতেদের রাত

প্রাচীনকালে হ্যালোইন মূলত ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদযাপিত হতো। অবাক হবেন, এ ভুতুড়ে উৎসবটির ইতিহাস দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো। কেল্টিক জাতি আজকের আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে বসবাস করত। নভেম্বরের প্রথম দিনকে তাঁরা নববর্ষ বা ‘সাহ-উইন’ হিসেবে পালন করত। গ্রীষ্ম শেষ আর শীতের অন্ধকার শুরু হিসেবে তাঁরা অক্টোবরের শেষ রাতকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মনে করত। বিশ্বাস ছিল, এই রাতে সমস্ত প্রেতাত্মা ও অতৃপ্ত আত্মা মানুষের ক্ষতি করতে পারে। তাই মানুষ আগুন জ্বালিয়ে মুখোশ পরে, মন্ত্র পড়ে বৃত্তাকারে ঘুরত। এই রীতিই আজ হ্যালোইনের আকার নিয়েছে।

পশ্চিমা বিশ্বে বাহারি ভূতের সাজসজ্জায় পালিত হয় হ্যালোইন। সংগৃহীত ছবি
পশ্চিমা বিশ্বে বাহারি ভূতের সাজসজ্জায় পালিত হয় হ্যালোইন। সংগৃহীত ছবি

১৭৪৫ সালের দিকে খ্রিস্টান ক্যাথলিকদের মধ্যে ‘হ্যালোইন’ শব্দের প্রচলন ঘটে। শব্দটি এসেছে স্কটিশ ভাষার ‘অল হ্যালোজ ইভ’ থেকে, যার অর্থ ‘পবিত্র সন্ধ্যা’। সময়ের সঙ্গে হ্যালোইন হয়ে ওঠে মৃত্যুর সঙ্গে হাসি-মজা এবং ভৌতিক খেলার উৎসব। ১৮০০-এর দশকে আমেরিকায় এটি ছুটির দিনে পরিণত হয়। আর বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে শিশু-বৃদ্ধ সবাই একত্রে হ্যালোইন উদযাপন করতে শুরু করে।

আজ ইউরোপ-আমেরিকা, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে মানুষ কুমড়ো খোদাই করে, মুখোশ পরে পার্টিতে অংশ নেয়। ভুতুড়ে গল্প বলে এবং ভৌতিক সাজসজ্জায় রাত কাটায়। বাংলাদেশেও এখন হ্যালোইন পার্টির ট্রেন্ড দেখা যায়। সামাজিক মাধ্যম ও পাঁচ তারকা হোটেলে তরুণরা রঙিন মুখোশ ও পোশাক পরে আনন্দে মেতে ওঠে।

ভূত চতুর্দশী: অন্ধকারে প্রদীপের আলো

অন্যদিকে আমাদের নিজস্ব ‘ভূত চতুর্দশী’ হিন্দু ধর্মের বার্ষিক উৎসব। দীপাবলির পাঁচ দিনব্যাপী উৎসবের দ্বিতীয় দিনে, কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে এটি পালিত হয়। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে ‘নরক চতুর্দশী’ নামে পরিচিত। এই দিনে চোদ্দশাক খাওয়া, প্রদীপ প্রজ্বলন ও পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ করা রীতি রয়েছে। কালীপূজার দ্বিতীয় দিনে পালনের কারণে এটিকে ‘কালি চৌদাস’ও বলা হয়। মানুষ বিশ্বাস করে, প্রদীপ জ্বালালে দুষ্ট আত্মা দূরে থাকে, এবং মৃত্যুর দেবতা যমকেও সন্তুষ্ট করা যায়।

ভূত চতুদর্শীতে জ্বালানো হয় প্রদীপ। সংগৃহীত ছবি
ভূত চতুদর্শীতে জ্বালানো হয় প্রদীপ। সংগৃহীত ছবি

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি ভিন্নভাবে উদযাপিত হয়। গোয়াতে কাগজের তৈরি নরকাসুরের পুতুল পোড়ানো হয়। আতশবাজি ফাটানো হয়, সুগন্ধি তেল দিয়ে স্নান করা হয়। তামিলনাড়ুতে দীপাবলির দিনই ‘ভূত চতুর্দশী’। কর্ণাটকে ঐতিহ্যগতভাবে তেল দ্বারা স্নান, আরতি ও আতশবাজি ফাটানোর মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়। বাংলাদেশে এটি খুব সীমিতভাবে পালন হয়। বাড়ির চারপাশে প্রদীপ জ্বালানো ও পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ দেওয়ার মাধ্যমে।

দুই উৎসবের পার্থক্য

হ্যালোইন এবং ভূত চতুর্দশী—দুটো উৎসবের ধর্মীয় আবহ শুরুতে ছিল প্রায় একই ধরনের। কিন্তু হ্যালোইন সময়ের সঙ্গে দেশ, ধর্ম ও সংস্কৃতির সীমা পেরিয়েছে। জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী। এর মূল কারণ হলো ভৌতিক আবহ ধরে রাখা এবং মানুষের চিরায়ত কৌতূহল। কুমড়োর মুখোশ, ভয়ঙ্কর পোশাক, ভূতুড়ে গল্প—সবকিছু মিলিয়ে হ্যালোইন হয়ে উঠেছে সার্বজনীন আনন্দের উৎসব।

অন্যদিকে ‘ভূত চতুর্দশী’ বাংলার লোকধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। ভূতকেন্দ্রিক ভয়ঙ্কর উপস্থাপনার অভাব থাকায় এটি নিজের পরিধি পেরোতে পারেনি। আমাদের দেশীয় ‘ভূত’ আর ‘ভূত চতুদর্শী’ হ্যালোইনের তুলনায় অনেকটাই আড়াল ও নীরব।

শৈশবের সেই অন্ধকার রাতগুলো আর নেই, কিন্তু ভূতের প্রতি কৌতূহল এখনো আছে। হয়তো এ কারণেই পশ্চিমা হ্যালোইনের মতো আমাদেরও উৎসবগুলো একদিন বিশ্বব্যাপী আলো জ্বালাবে। যেমন ভূত চতুদর্শীর প্রদীপ অন্ধকারকে আলোকিত করে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত