আমরা সবাই বোধহয় একটু বেশি দিন বাঁচতে চাই। কিন্তু শুধু বয়স নয়, চাই প্রাণবন্ত, সুস্থ, ঝরঝরে জীবন। কিন্তু দীর্ঘায়ুর সেই রহস্যটা কোথায়? সেটা কি লাখ টাকা খরচ করে লংজিভিটি ক্লিনিকে গিয়ে বা জিনোম সিকোয়েন্সিং করিয়ে পাওয়া যায়?
যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ড. এরিক টোপোল বলছেন, আমাদের প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজের মধ্যেই দীর্ঘায়ুর রহস্য লুকিয়ে আছে। তিনি ‘সুপার এজারস: অ্যান এভিডেন্স-বেইজড অ্যাপ্রোচ টু লংজিভিটি’ বইতে লিখেছেন, ‘দীর্ঘ জীবন মানে কেবল বয়স বাড়ানো নয়। এর মানে হলো শরীর ও মনের এমন ভারসাম্য রাখা, যেখানে বয়স শুধু একটি সংখ্যা হয়ে থাকে।’
এরিক টোপোল এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল গবেষকদের একজন। তাঁর মতে, আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেমই (রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা) হলো আসল চাবিকাঠি। যেটা ঠিকঠাক কাজ করলে অনেক বয়সজনিত রোগ আসেই না। আর একবার ইমিউন সিস্টেম ভেঙে পড়লে তার পরিণতি হয় ভয়ংকর।
এরিক টোপোল মনে করেন, চিকিৎসাবিজ্ঞান জানে কীভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ানো যায়, যাতে বয়সজনিত রোগগুলো অনেক দেরিতে আসে, বা একেবারেই আসে না।
এরিক টোপোলের বই অনুসারে, এই কাজটা তিনভাবে করা যায়। প্রথমত, এমন জীবনযাপন অভ্যাস তৈরি করে যা ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় রাখে। দ্বিতীয়ত, নতুন ধরনের ওষুধের সহায়তা নিয়ে (নিউ ক্লাসেস অব ড্রাগস)। আর তৃতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে নিজের শরীরের রোগের ঝুঁকি আগে থেকেই শনাক্ত করে।
লাইফস্টাইল প্লাস
টোপোলের মতে, আধুনিক প্রযুক্তি এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে একজন মানুষ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোন রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, সেটি আগেভাগেই বোঝা সম্ভব। ফলে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া যায়। হয়তো পুরোপুরি রোধ করা যায় না, কিন্তু তার প্রভাব কমানো যায়।
এই জায়গায়ই আসে টোপোলের ধারণা ‘লাইফস্টাইল প্লাস’। এটি মূলত প্রতিদিনের জীবনযাপনে কিছু বাড়তি সচেতনতা। যেখানে আমরা শুধু স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার মধ্যেই থেমে থাকি না। বরং খেয়াল রাখি চারপাশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষাক্ত উপাদানগুলোর প্রতিও।
টোপোল বলেন, ‘মনে করা হয় জিনই সব নির্ধারণ করে। কিন্তু বাস্তবে জেনেটিক্সের প্রভাব খুবই সীমিত।’ তিনি ১৪০০ জন ‘সুস্থ বয়স্ক’ মানুষকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁরা সবাই আশির বেশি বয়সের। আর তাঁরা কোনো ওষুধ খান না, কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগেও ভুগছেন না। তাঁদের জিন পরীক্ষা করে দেখা যায়, ‘অসুস্থ বয়স্ক’দের তুলনায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ ভালো জিন নয়, বরং ভালো অভ্যাসই তাঁদের সুস্থ রেখেছে।
চাই প্রাণবন্ত, সুস্থ, ঝরঝরে জীবন। সংগৃহীত ছবিতাহলে রোগ আসে কীভাবে?
টোপোল বলছেন, রোগ আসে যখন আমাদের ইমিউন সিস্টেম নিজের ভারসাম্য হারায়। যাকে বলা হয় ‘ডিসরেগুলেশন’। তখন শরীরে এক ধরনের অদৃশ্য প্রদাহ শুরু হয়, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘ইনফ্ল্যামএজিং’। এই প্রদাহই একসময় মরণঘাতী রোগের জন্ম দেয়। তিনি বলেন, ‘যদি ইমিউন সিস্টেম ঠিক থাকে, ক্যানসার ছড়াতেই পারে না।’
তাহলে সমাধান কী? টোপোলের উত্তর, ইমিউন সিস্টেমকে ফিট রাখা। এর মানে ব্যায়াম, ঘুম, সামাজিক যোগাযোগ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস—সবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তিনি আরও যোগ করেছেন রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিংয়ের কথা। মানে ওজন তোলা বা শক্তি বৃদ্ধির ব্যায়াম। তিনি বলেন ‘শুধু দৌড়ঝাঁপ নয়। পেশিশক্তিও তৈরি করাও জরুরি। এটা শরীরকে শেখায় কীভাবে স্ট্রেস সামলাতে হয়।’ টোপোল নিজেই ৭১ বছর বয়সে সপ্তাহে পাঁচ দিন হাঁটেন বা দৌড়ান, আর দুই দিন ওজন তোলেন।
নতুন ধরনের ওষুধ ও এআই
এখানেই শেষ নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচিত কিছু ওষুধ যেমন ‘জিএলপি-ওয়ান’ মূলত ডায়াবেটিস ও ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি হলেও এখন দেখা যাচ্ছে, এগুলো মস্তিষ্ক ও শরীরের প্রদাহ কমায়। ফলে কিডনি ও হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। টোপোলের ভাষায়, ‘এগুলো যেন আমাদের ঠিক যেটা দরকার, সেটাই করছে। এটি ইমিউন সিস্টেমে ভারসাম্যে রাখছে।’ তিনি মনে করেন, নতুন নতুন ওষুধের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মানুষ আরও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার উপায় পেতে পারে।
টোপোল মনে করেন, দীর্ঘায়ুর ব্যাপারটি প্রযুক্তির সঙ্গেও খানিক জড়িয়ে আছে। কারণ, আমাদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যও এখন সুস্থভাবে বেশি দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনার অন্যতম চাবিকাঠি। মেডিকেল গবেষকদের ক্ষেত্রে আগে সমস্যাটা ছিল, এগুলো আগে নানা জায়গায় আলাদা আলাদাভাবে জমা থাকত। ফলে শরীরের সামগ্রিক অবস্থার একটা পূর্ণচিত্র পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ত। কিন্তু এখন মেডিকেল সেক্টরে এসেছে ‘মাল্টি-মডাল’ এআই। যেটা টেক্সট, ছবি, ভিডিও, অডিও—সব ধরনের তথ্য একত্রে নিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারে।
টোপোল বলেন, ‘এখন আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডেটা পয়েন্ট বিশ্লেষণ করতে পারি। যা একজন মানুষ কোনো দিন দ্রুত ও একসঙ্গে পারবে না। ফলে, কোন রোগের ঝুঁকি বাড়ছে, তা আগে থেকেই জানা সম্ভব।’ তিনি মনে করেন, এই প্রযুক্তি একদিন হয়তো আমাদের জানিয়ে দেবে, কোন খাবার আমাদের শরীরের সঙ্গে মানাচ্ছে না, কোন সময় ব্যায়াম সবচেয়ে কার্যকর, কিংবা ঘুমের কোন প্যাটার্ন আমাদের রোগপ্রতিরোধে সহায়তা করছে।
লেখা: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট অবলম্বনে