leadT1ad

আব্বাসউদ্দীন আহমদ যেভাবে ভাওয়াইয়াকে নিয়ে এলেন গ্রাম থেকে গ্রামোফোনে

আজ ২৭ অক্টোবর ভাওয়াইয়া সংগীতসম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদের জন্মদিন। তিনি ভাওয়াইয়াকে নিয়ে গেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। তাঁর কণ্ঠে গাওয়া বহু ভাওয়াইয়া গান পেয়েছে অমরত্ব। আব্বাসউদ্দীন ছিলেন প্রথম বাঙালি মুসলিম সংগীতশিল্পী, যিনি নিজের নামে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে গান প্রকাশ করেন।

স্ট্রিম গ্রাফিক

১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর। তৎকালীন ভারতের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুরে জন্ম নেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন আইনজীবী। ছেলেকেও একই পথে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু আব্বাসউদ্দীন ছোটবেলা থেকেই গান ভালোবাসতেন। শৈশবে তাঁর গানের প্রতি এই অনুরাগ জন্মেছিল মর্সিয়া গানের মধ্য দিয়ে। আর গ্রামের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আব্বাসউদ্দীনের প্রাণভোমরা ছিল ভাওয়াইয়া গান। গ্রামের পথে পথে আপন খেয়ালেই তিনি গানের চর্চা করতেন। গ্রামের কৃষক, খেটে-খাওয়া মানুষের গাওয়া পল্লিগীতিই ছিল তাঁর প্রথম সংগীত শিক্ষা। আব্বাসউদ্দীনের ভাষায়, ‘আমার গ্রামে ছিল বহু ভাওয়াইয়া গায়ক। সারাটা গ্রাম সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত গানের সুরে মুখরিত হয়ে থাকত। গ্রামের পূর্বে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। আমাদের আধিয়ারী প্রজারা হাল বাইতে বাইতে, পাট নিড়াতে নিড়াতে গাইত ভাওয়াইয়া গান। সেই সব গানের সুরেই আমার মনের নীড়ে বাসা বেঁধেছিল ভাওয়াইয়া গানের পাখি।’

আব্বাসউদ্দীন আহমদ। সংগৃহীত ছবি
আব্বাসউদ্দীন আহমদ। সংগৃহীত ছবি

কুচবিহারের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করার পর আব্বাসউদ্দীন ভর্তি হন তুফানগঞ্জ স্কুলে। সেখানে পড়ার সময়ই তাঁর জীবনে আসে সুরের নতুন পাঠ। মোবারক হোসেনের নামের এক ডাক্তারের কাছে তিনি প্রথমবার রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন। প্রতিদিন ক্লাস শেষে ছুটে যেতেন গান শুনতে। মোবারক হোসেনের কাছ থেকে কিছু গানও শেখেন।

একবার স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্কুল কমিটির সদস্য মোবারক হোসেন হঠাৎ করেই গানের প্রতিযোগিতার প্রস্তাব করেন। তাতে অংশ নেন ছোট্ট আব্বাসউদ্দীন। গেয়ে শোনান রবীন্দ্রনাথের গান ‘অমল ধবল পালে লেগেছে’। গেয়েছিলেন আরও একটি গান, ‘সভা যখন ভাঙবে তখন শেষের গানটি যাব গেয়ে’। এই প্রতিযোগিতায় তিনি পান দশ টাকা সমমূল্যের বই পুরস্কার, আর সেই সঙ্গে সবার প্রশংসা। তখন কেউ ভাবতেও পারেনি, এই ছেলেটিই একদিন বাংলার পল্লীগীতিকে পৌঁছে দেবে বাংলার ঘরে ঘরে।

আইএ পাশ করার পর আব্বাসউদ্দীন চেয়েছিলেন লক্ষ্ণৌর মরিস মিউজিক কলেজে ভর্তি হতে, কিন্তু পরিবার রাজি হয়নি। এরপর তিনি রংপুরে বিএ পড়তে যান, তবে মশার যন্ত্রণায় রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই এক জনসভায় গেয়েছিলেন নজরুলের ‘ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা’।

এরপর বিএ পাস না করেই আব্বাসউদ্দীন পড়ালেখা ছেড়ে দিলেন। কলকাতায় গিয়ে ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন। পরে কাজী নজরুল ইসলামের সংস্পর্শে এসে পান নতুন অনুপ্রেরণা। নজরুলের লেখা ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ তাঁর কণ্ঠে রেকর্ডও হয়।

ভাওয়াইয়া গান প্রথমবার রেকর্ডও হয়েছিল আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠেই। তাঁর গাওয়া প্রথম দুই ভাওয়াইয়া গান ছিল ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’ আর ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’।

আব্বাসউদ্দীন ছিলেন প্রথম বাঙালি মুসলিম সংগীতশিল্পী, যিনি নিজের নামে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে গান প্রকাশ করেন। ১৯৩০ সালে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচএমভি) থেকে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়। গান দুটি ছিল 'স্মরণ পারের ওগো প্রিয়' এবং 'কোন বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে গো।' এরপর তিনি মন দেন পল্লিগীতিতে। তিনি বুঝেছিলেন, মানুষের মাটির গানই বাংলার প্রাণকে নাড়া দিতে পারে। তাই ভাওয়াইয়াকে তিনি তুলে আনলেন শহরে, রেডিওতে, রেকর্ডে আর মঞ্চে।

ভাওয়াইয়া গান প্রথমবার রেকর্ডও হয়েছিল আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠেই। তাঁর গাওয়া প্রথম দুই ভাওয়াইয়া গান ছিল ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’ আর ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’। এর আগেও তিনি একটি গান রেকর্ড করেছিলেন, কিন্তু কোম্পানির অনুরোধে কিছু শব্দ বদলাতে হয়।

এতে আব্বাসউদ্দীন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। নিজের বই ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’-তে তিনি লিখেছেন, ‘খরস্রোতা ছোট্ট পাহাড়ি নদী তোরষা-কুচবিহারের পাদমূল ধৌত করে তরতর বেগে চলেছে। তারি তীরে তীরে গান গেয়ে চলেছে মোষের পিঠে করে দোতারা বাজিয়ে মেষ-চালক মৈশালের দল। তাদের কণ্ঠের সুর ছেলেবেলার আমার কণ্ঠে বেঁধেছিল বাসা। তাদের মুখের ভাষাই আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষাকে অবিকৃত রেখে গান দিতে পারলাম না। মনে জেগে আছে ক্ষোভ।’

কাজী মোতাহার হোসেন ও উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমিতে) আব্বাসউদ্দীন আহমদ (বামে), ১৯৫৫ সালের ছবি। উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া ছবি
কাজী মোতাহার হোসেন ও উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমিতে) আব্বাসউদ্দীন আহমদ (বামে), ১৯৫৫ সালের ছবি। উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া ছবি

তবে পরে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ ও ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ গান দুটি তিনি অবিকৃত রেখেই রেকর্ড করেন। গান দুটি বের হওয়ার পর ‘এইচএমভি’ কোম্পানি তাদের প্রচারপত্রে লিখেছিল, ‘পল্লী-গীতি রাজ্যের দুয়োরানী এই ভাওয়াইয়া গানকে সর্বপ্রথম আব্বাস সাহেবই আদর করে রাজ-অন্তঃপুরে ডেকে আনলেন। তখন আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম উপেক্ষিত দুয়োরাণীর রূপ-শ্রী সুয়োরানীর চেয়ে তো কম নয়! এবং তার চেয়ে মুগ্ধ হলাম তার নিতান্ত সরল হৃদয়ের মাধুরীতে! এর জন্য সমগ্র রসিকজনের অভিনন্দনের মালা পাওয়া উচিত পল্লী দুলাল আব্বাস সাহেবের। বহু দুর্লভ ভাওয়াইয়া গান তিনি সংগ্রহ করে আপনাদের সামনে উপহার দিয়েছেন।’

সেই থেকে শুরু। আর থেমে থাকেননি। আব্বাসউদ্দীন ভাওয়াইয়াকে নিয়ে গেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। তাঁর কণ্ঠে গাওয়া বহু ভাওয়াইয়া গান পেয়েছে অমরত্ব। তাঁর গানে পাওয়া যায় শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট, প্রেম, বিচ্ছেদ আর আশার কথা।

আব্বাসউদ্দীনের গানের বিশেষত্ব ছিল, তিনি মাঠের গানকে রেকর্ডে তুললেও তাতে মাটির গন্ধ হারায়নি। তবে শুধু ভাওয়াইয়া নয়, আধুনিক, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মুর্শিদি, মার্সিয়া, দেহতত্ত্ব—সবধরনের গান গেয়েছেন। তাঁর গানে ছিল মানুষের জীবনবোধ। কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের ইসলামি ভাবধারায় রচিত গানেও তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি বাংলাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীর মননশীলতার বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।

আব্বাসউদ্দীনের গানের বিশেষত্ব ছিল, তিনি মাঠের গানকে রেকর্ডে তুললেও তাতে মাটির গন্ধ হারায়নি। তবে শুধু ভাওয়াইয়া নয়, আধুনিক, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মুর্শিদি, মার্সিয়া, দেহতত্ত্ব—সবধরনের গান গেয়েছেন।

আব্বাসউদ্দীন ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় থাকতেন। শুরুতে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অস্থায়ী চাকরি করেন, পরে কৃষি দপ্তরে স্থায়ী পদ পান। এ কে ফজলুল হকের আমলে তিনি সরকারি রেকর্ডিং বিশেষজ্ঞ হন। দেশভাগের পর তিনি কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। সবকিছু ফেলে এসে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার দপ্তরে। চাকরির পাশাপাশি তিনি গান গাইতে থাকেন, পল্লীগীতি সংগ্রহ করতে থাকেন। প্রত্যন্ত এলাকায় গড়ে তোলেন সংগীতকেন্দ্র।

আব্বাসউদ্দীন ভাওয়াইয়াকে বিশ্বমঞ্চেও পৌঁছে দিয়েছেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যান ম্যানিলার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সঙ্গীত সম্মেলনে, ১৯৫৬ সালে জার্মানির আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত সম্মেলনে, ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনের প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে। বিদেশের মঞ্চে তিনি গেয়েছেন বাংলার মাঠের গান।

আব্বাসউদ্দীনের জীবন শুধু গানের নয়, সংগ্রামেরও। যাত্রাপালা থেকে রেডিও, লোকগান থেকে সিনেমা, সব জায়গায় তিনি নতুনদের জন্য পথ তৈরি করেছেন। ১৯৩০-এর দশকে মুসলমানদের সিনেমায় অভিনয় করতে দেখাই যেত না। সে সময়ে ‘বিষ্ণুমায়া’, ‘মহানিশা’, ‘ঠিকাদার’, ‘একটি কথা’র মতো চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন আর গানও গেয়েছেন।

১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই মহান শিল্পী চলে গেলেন চিরবিদায় নিয়ে। কিন্তু তাঁর গান আজও বেঁচে আছে বাংলার প্রতিটি প্রান্তে। কেউ যখন গেয়ে ওঠে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই…’, তখন মনে হয় যেন ফিরে এসেছেন তিনি, যে মানুষ গানকে পৌঁছে দিয়েছিলেন মানুষের কাছে, আর মানুষকে পৌঁছে দিয়েছিলেন গানের কাছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত