leadT1ad

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মানবতার গল্প

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ২২: ১৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

আচ্ছা, এমন একজন নেতার কথা ভাবুন তো, যিনি পরাধীন ভারতে বসে ব্রিটিশ দারোগাকেই বুদ্ধির প্যাঁচে ফেলে ঘোল খাইয়ে ছাড়েন! আবার পরক্ষণেই যাঁর এক মজার কাণ্ডে হাসির রোল পড়ে যায়। এরকম তো একজনই ছিলেন। তিনি আর কেউ নন, বাংলার বাঘ, আমাদের সবার প্রিয় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।

তাঁর নাম শুনলেই শুধু বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ বা তুখোড় আইনবিদদের ছবি ভাসে না, ভেসে ওঠে এক বিশাল হৃদয়ের মানুষের ছবিও। যাঁর জীবনের পাতা ওল্টালে কখনও পাওয়া যায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দারুণ সব বুদ্ধির ঝলক, আবার কখনও মেলে নিখাদ হাসির খোরাক। চলুন, তাঁর জীবনের এমনই কিছু হাসির ও শিক্ষণীয় গল্পে ডুব দেওয়া যাক!

বিচক্ষণ আইনবিদ ও দয়ালু ফজলুল হক

একবার নোয়াখালীতে এক মোকদ্দমার কাজে গিয়ে তিনি এক অবিস্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী হন। নিজের বিচক্ষণতা দিয়ে এক অসহায় ছেলেকে সাহায্য করেন তিনি। দেখলেন, একটি ছেলে পেঁপে হাতে কাঁদতে কাঁদতে বাজার থেকে ফিরছে। কারণ জানতে চাইলে ছেলেটি জানায়, দুটি পেঁপের মধ্যে বড়টি থানার দারোগা রেখে দিয়েছেন এবং বলেছেন অন্যটি যে দামে বিক্রি হবে, সে দামই তিনি দেবেন।

ফজলুল হক ছেলেটির অসহায়ত্ব উপলব্ধি করে তার কাছ থেকে ছোট পেঁপেটি কিনে নিতে চাইলেন। ছেলেটি দাম চাইল মাত্র এক টাকা। কিন্তু শেরে বাংলা তাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘না, তোমার পেঁপের দাম হবে আড়াই শ টাকা।’ সেই ব্রিটিশ আমলে আড়াই শ টাকার মূল্য ছিল বিপুল। তিনি তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে টাকা বের করে ছেলেটির হাতে তুলে দিলেন।

এরপর তিনি ছেলেটিকে নিয়ে থানায় গেলেন এবং দারোগাকে তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পেঁপের দাম দিতে বললেন। যখন দারোগা শুনলেন যে অন্য পেঁপেটি আড়াই শ টাকায় বিক্রি হয়েছে, তখন তিনি ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং ছেলেটিকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যা দেন। কিন্তু ফজলুল হক শান্তভাবে বলেন, ‘ছেলেটি সত্য বলছে। আমিই নগদ আড়াই শ টাকায় তার পেঁপে কিনেছি।’

পরিচয় পেয়ে দারোগা উপায়ান্তর না দেখে টাকা জোগাড় করে ছেলেটিকে দিতে বাধ্য হন। সেদিন সেই বালক মোট পাঁচ শ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল, যা ছিল তার কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি।

এই ঘটনাটি ফজলুল হকের প্রখর বুদ্ধি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর কৌশলী প্রতিবাদের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

তদবিরের গল্প

এ কে ফজলুল হক মানুষের তদবির করতে ভালোবাসতেন এবং তাঁর কাছে এসে কেউ খালি হাতে ফিরত না বলে জনশ্রুতি আছে। এমনই এক মজার ঘটনার কথা জানা যায় তাপস রায়ের ‘মনীষীদের মজা গল্প’ বই থেকে।

একদিন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে তদবিরের জন্য এলে তিনি তাকে সামনে বসিয়ে ফোনেই অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকজন লোক কক্ষে প্রবেশ করে।

ফজলুল হক ফোন রেখে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে তার সমস্যার কথা জানতে চান। লোকটি বিনীতভাবে উত্তর দেয়, ‘স্যার, আমি টেলিফোন অফিসের লোক। আপনার ফোনের লাইন গতকাল থেকে কাটা, সেটাই ঠিক করতে এসেছি।’ এই কথা শোনার পর ফজলুল হকের মুখের অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়।

এই গল্পটি তাঁর চরিত্রের একটি রসিক ও মানবিক দিক তুলে ধরে।

কৃষকদরদী মহান নেতা

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের হৃদয় কাঁদত বাংলার গরিব কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে। তাঁর সহযোগী বি ডি হাবিবুল্লাহর কাছে তিনি নিজেই এক হৃদয়বিদারক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন।

একদিন গ্রামের পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি দেখেন, এক গরিব কৃষকের বাড়িতে জমিদারের পেয়াদারা ঋণের দায়ে মালপত্র ক্রোক করছে। কৃষকের ছোট ছেলেটি তার ছোট্ট কাঁসার থালাটি বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল, কারণ সে বুঝতেই পারছিল না কেন তার কাছ থেকে এটি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

পেয়াদা যখন শিশুটির হাত থেকে থালাটি ছিনিয়ে নিতে চাইল, তখন তার বুকফাটা কান্নায় ফজলুল হকের হৃদয় গলে যায়। তিনি অনুভব করেন, এ শুধু এক শিশুর কান্না নয়, এ যেন সারা বাংলার শোষিত ও নিপীড়িত কৃষকদের আর্তনাদ।

তিনি তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে পঁয়ত্রিশ টাকা বের করে পেয়াদার দাবি মিটিয়ে দেন এবং বাকি টাকা সেই কৃষককে দিয়ে দেন। শিশুটির হাতে থালাটি ফিরিয়ে দেওয়ার পর তার মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছিল, তা ফজলুল হকের মনে গভীর রেখাপাত করে।

সেদিনই তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যদি কখনও সুযোগ পান, তবে তিনি বাংলার কৃষকদের শুধু থালা-বাটি নয়, তাদের ভিটেমাটি ও ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করার জন্য কাজ করবেন। তাঁর এই প্রতিজ্ঞাই পরবর্তীকালে তাঁকে ‘ঋণ সালিশি বোর্ড’ গঠনের মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল, যা বাংলার লক্ষ লক্ষ কৃষককে মহাজনী শোষণ থেকে মুক্তি দিয়েছিল।

এই ঘটনাগুলো, সত্যি বা কল্পিত যা-ই হোক না কেন, এ কে ফজলুল হকের বিশাল ব্যক্তিত্ব, তাঁর প্রজ্ঞা, রসবোধ এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার পরিচয় দেয়। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই বাংলার বন্ধু, ‘শেরে বাংলা’।

তথ্যসূত্র: মনীষীদের মজার গল্প, তাপস রায়; ছোটদের শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মালেক মাহমুদ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত