কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন শুধু তথ্যের জগতে সীমাবদ্ধ নয়। এআই এখন হয়ে উঠেছে কথোপকথনের সঙ্গীও। কিন্তু ধীরে ধীরে এই চ্যাটবটগুলো বন্ধু, পরামর্শদাতা এমনকি কখনও ‘ডিজিটাল সম্পর্কের’ অংশ হয়ে উঠছে। কোথাও কোথাও এমন কথোপকথন পর্যন্ত হচ্ছে, যা প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী। এখানেই তৈরি হচ্ছে নতুন ঝুঁকি।
যখন কোনো এআই ব্যবহারকারীর সঙ্গে এমন কথোপকথনে যুক্ত হতে শুরু করে, তখন সবচেয়ে বড় ভয়টা হয় শিশু ও কিশোরদের জন্য। বাচ্চারা যদি এমন কনটেন্টের মুখোমুখি হয়, যা তাদের বয়স উপযোগী নয়, তাহলে সেটা মানসিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটেই ভিন্ন পথে হাঁটছে মাইক্রোসফট। মাইক্রোসফটের এআই বিভাগের প্রধান মুস্তাফা সুলেইমান জানিয়েছেন, তারা এমন এআই তৈরি করছে, যা আপনি নিশ্চিন্তে আপনার সন্তানের হাতে রাখতে পারবেন। সিএনএন-কে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক এআই বানাচ্ছি যেটা ‘‘আবেগগতভাবে’’ বুদ্ধিমান হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হবে বিশ্বাসযোগ্য। আমি এমন এক এআই তৈরি করতে চাই যেটি আপনার সন্তানের জন্য বেছে নিতে পারবেন।’
মাইক্রোসফটের এআই বিভাগের প্রধান মুস্তাফা সুলেইমান। ছবি: সংগৃহীতসুলেইমান স্পষ্ট করে দিয়েছেন, মাইক্রোসফট কোনোভাবেই প্রাপ্তবয়স্ক বা রোমান্টিক কথোপকথনের দিকে যাচ্ছে না। তাঁর ভাষায়, ‘রোমান্টিক, ফ্লার্টেশাস বা ইরোটিক আলাপের দিকে আমরা যাব না। এটা আমাদের নীতির অংশ।’
নতুন কী কী ফিচার যুক্ত হচ্ছে
মাইক্রোসফটের নতুন এআই টুল ‘কো-পাইলট’-এ যুক্ত হচ্ছে বেশ কিছু নতুন ফিচার। এর মধ্যে আছে আগের সব কথোপকথনে ফিরে যাওয়ার সুবিধা, গ্রুপ চ্যাট ফিচার এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রশ্নে আরও নির্ভরযোগ্য উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা।
নতুন গ্রুপ ফিচারে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৩২ জন ব্যবহারকারী যোগ দিতে পারবে। যেমন স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রজেক্টে কাজ করছে বা বন্ধুরা একসঙ্গে ভ্রমণের পরিকল্পনা করছে। সেই আলোচনায় কো-পাইলট সহযোগিতা করবে, তথ্য সাজাবে বা প্রস্তাব দেবে।
মুস্তাফা সুলেইমান জানিয়েছেন, মাইক্রোসফট কোনো আলাদা ‘কিড মোড’ বা শিশুদের জন্য বিশেষ সংস্করণ আনছে না। কারণ, তাদের মতে প্রযুক্তিটিই এমনভাবে তৈরি হচ্ছে যাতে শুরু থেকেই এটি নিরাপদ হয়।
স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশ্নে কো-পাইলট এখন নির্ভর করবে যাচাইকৃত চিকিৎসা সূত্রের ওপর, যেমন হার্ভার্ড হেলথ বা অন্যান্য স্বীকৃত উৎস। প্রয়োজনে এটি ব্যবহারকারীর নিকটবর্তী চিকিৎসক বা ক্লিনিকের তথ্যও দিতে পারবে। এছাড়া থাকবে ‘রিয়েল টক’ ফিচার, যেখানে চ্যাটবট আরও স্বাভাবিক ও বাস্তবধর্মীভাবে কথা বলবে।
শিশুদের জন্য আলাদা সংস্করণ নয়
মুস্তাফা সুলেইমান জানিয়েছেন, মাইক্রোসফট কোনো আলাদা ‘কিড মোড’ বা শিশুদের জন্য বিশেষ সংস্করণ আনছে না। কারণ, তাদের মতে প্রযুক্তিটিই এমনভাবে তৈরি হচ্ছে যাতে শুরু থেকেই এটি নিরাপদ হয়।
অন্যদিকে ওপেনএআই, মেটা এআই-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে কঠিন সমালোচনার মুখে পড়েছে। কয়েকটি পরিবার এমনকি মামলাও করেছে। অভিযোগে উল্লেখ আছে যে এসব চ্যাটবট তাদের সন্তানের মানসিক ক্ষতির কারণ হয়েছে।
এমনকি চলতি বছরের শুরুতে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মেটার চ্যাটবট কিছু ক্ষেত্রে এমন ব্যবহারকারীর সঙ্গেও প্রাপ্তবয়স্কদের আলাপ করেছে, যাদের প্রোফাইল ‘মাইনর’ হিসেবে শনাক্ত ছিল। এই বিতর্কের পর বেশিরভাগ কোম্পানি নতুন কনটেন্ট সীমাবদ্ধতা ও বয়স যাচাই প্রযুক্তি চালু করেছে। যদিও এই সিস্টেমগুলো কতটা কার্যকর, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশ্নে কো-পাইলট এখন নির্ভর করবে যাচাইকৃত চিকিৎসা সূত্রের ওপর, যেমন হার্ভার্ড হেলথ বা অন্যান্য স্বীকৃত উৎস। প্রয়োজনে এটি ব্যবহারকারীর নিকটবর্তী চিকিৎসক বা ক্লিনিকের তথ্যও দিতে পারবে। এছাড়া থাকবে ‘রিয়েল টক’ ফিচার, যেখানে চ্যাটবট আরও স্বাভাবিক ও বাস্তবধর্মীভাবে কথা বলবে।
অন্যদিকে ওপেনএআইয়ের প্রধান স্যাম অল্টম্যান সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যবহারকারীরা শিগগিরই চ্যাটজিপিটির সঙ্গে ‘ইরোটিকা’ বিষয়েও আলোচনা করতে পারবেন নতুন সেফটি ফিল্টার যুক্ত করে। তবে মাইক্রোসফট সেই পথে যাচ্ছে না।
প্রতিযোগিতার ভেতর মাইক্রোসফটের ভিন্ন দর্শন
বর্তমানে মাইক্রোসফট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছে ওপেনএআই, মেটা ও গুগলের মতো টেক জায়ান্টদের সঙ্গে। সবার লক্ষ্য এক, আগামী প্রজন্মের কম্পিউটিং যুগে নিজেদের এআইকে প্রধান টুল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
মাইক্রোসফটের ‘কো-পাইলট’ এখন তাদের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে প্রায় ১০ কোটি মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছেছে। সেই তুলনায় ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপটির মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারী সংখ্যা অনেক বেশি।
তবুও মাইক্রোসফট বিশ্বাস করছে, তাদের নিরাপদ, সীমাবদ্ধ ও মানবকেন্দ্রিক এআই পদ্ধতিই দীর্ঘমেয়াদে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। বিশেষ করে যখন চ্যাটবটগুলোর মানসিক প্রভাব ও ‘ডিজিটাল সম্পর্ক’ নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে।
এই প্রসঙ্গে সুলেইমান আগেই এক ব্লগপোস্টে লিখেছিলেন, ‘আমরা এমন এআই তৈরি করছি যা মানুষের জন্য। যেটি কোনো ডিজিটাল মানুষ নয়।’ তাঁর মতে, প্রযুক্তির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ব্যবহারকারীদের মানুষে-মানুষে সংযোগে ফিরিয়ে আনা, কোনো ভার্চুয়াল বিকল্প তৈরি নয়।
মুস্তাফা সুলেইমানের ভাষায়, ‘এখন যখন অনেক এআই ব্যবহারকারীকে একটি প্যারালাল রিয়্যালিটিতে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তারা নিজেদের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই এই প্রযুক্তি মানুষকে মানুষের কাছেই ফিরিয়ে আনুক।’
তথ্যসূত্র: সিএনএন, মাইক্রোসফট