.png)

সৈকত আমীন

ব্রিটিশ ভারতে তখন চলছে অস্থির সময়। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার দাবিতে ফুঁসে উঠেছে পুরো উপমহাদেশ। জওহরলাল নেহরু, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো বাঘা বাঘা নেতারা তখন ব্যস্ত নিজ নিজ ভূখণ্ডকে ধর্মীয় চাদরে ঢাকতে। একই সময়ে আবুল কাশেম ফজলুল হক ওরফে এ. কে. ফজলুল ছিলেন এক ব্যতিক্রম জননেতা। ব্যতিক্রমী চিন্তাবিদ। ওই সময় ভূখণ্ড ভাগ বাটোয়ারার বদলে বাংলাকেন্দ্রিক কৃষকজীবনের স্বপ্নকে তিনি দিয়েছেন নতুন দিশা।
১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি যেমন বাংলার মাটির কাছাকাছি ছিলেন, তেমনি ক্ষমতায় গিয়েও দূরে ছিলেন দিল্লির দপ্তর বা আহমেদাবাদের আভিজাত্য থেকে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত, পদার্থবিদ্যা ও আইন নিয়ে পড়াশোনা ফজলুল হক নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনাকে মিলিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের দুঃখবোধের সঙ্গে। সাধারণ মানুষের দুঃখের প্রতি দরদই তাঁকে একজন আইনজীবী থেকে বানিয়েছিল কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ।
ফজলুল হক বজ্রকণ্ঠের বক্তা ছিলেন না। নিজ সময়ের তুখোড় রাজনীতিবিদদের মতো সাম্প্রদায়িক বা বিভাজনের রাজনীতিও তিনি করেননি। তবু কেন জনগণের অন্তরে ঠাই পেল তাঁর নাম? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় বর্তমান সময়ে বহুল চর্চিত একটা শব্দ দিয়ে। শব্দটা হচ্ছে ‘সংস্কার’।ফজলুলকে হককে বলা যায় এই অঞ্চলের রাষ্ট্র সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ।
ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল বেশ সাদামাটাভাবেই। সালটা ছিল ১৯১৩। ওই বছর তিনি ঢাকা কেন্দ্র থেকে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল রায় বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্র-এর মতো প্রভাবশালী হিন্দু নেতা। এই প্রতিদ্বন্দ্বীকেই ফজলুল হক পরাজিত করেছিলেন মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের সমর্থনে। এই বিজয়ের মধ্যেই ছিল এক লুকনো বার্তা, ফজলুল হকের রাজনীতি পরিচয়বাদের সীমানায় আটকে যাবে না।
এর প্রমাণ পাওয়া যায় ৩ বছরের মধ্যেই। ১৯১৬ সালের মধ্যেই তিনি অর্জন করেন এক বিরল মর্যাদা। একদিকে তিনি নির্বাচিত হন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের সভাপতি, অন্যদিকে নির্বাচিত হন জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক।
তাঁর এই উদার রাজনীতি তখনকার ক্রমবর্ধমান বিভাজনের বাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল এক বিশাল প্রাচীরের মতো।
ওই সময়ে মহাত্মা গান্ধী যখন অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও চরকা কেটে খদ্দর পরার সংযমী পথ বেছে নিয়েছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, সেখানে ফজলুল হক ছিলেন সাংবিধানিক আন্দোলনের পক্ষপাতী।
একদিকে তিনি ব্রিটিশ সরকারের দেয়া নাইটহুডের মতো সম্মান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, অন্যদিকে আইনসভায় সক্রিয় থেকে জনগণের জন্য কার্যকর হক আদায়েও ছাড় দেননি।
১৯২৯ সালে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠা করেন অল বেঙ্গল টেন্যান্টস অ্যাসোসিয়েশন, যা ১৯৩৬ সালে রূপ নেয় কৃষক প্রজা পার্টিতে (কেপিপি)।
এই অঞ্চলের মানুষের জন্য সংগঠনটির উদ্ভব ছিল এক নতুন দিগন্তের সূচনা। এই সংগঠন থেকেই শুরু হয়েছিল জরুরি একেকটা সংস্কার আন্দোলন। সেটা জমিদারদের শোষণে নিষ্পেষিত ক্ষুদ্র জমির মালিক ও কৃষকদের আন্দোলন হোক কিংবা ন্যূনতম মজুরি চালুর আন্দোলন, কিংবা হোক প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার আন্দোলন।
১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টের অধীনে ১৯৩৬-৩৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলায় ২৫০ আসনের মধ্যে ১১৭টি মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এই নির্বাচন কমিউনিটির ভিত্তিতে হলেও কেপিপির সেখানে তুলে ধরেছিল গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা ও অসাম্প্রদায়িক আবেদন।
ওই নির্বাচনে মুসলিম আসনগুলোতে ৩৯টি আসন জিতে নেয় কেপিপি। বিপরীতে মুসলিম লীগ পায় ৩৮টি আসন । কেপিপির বিজয় ছিল মূলত গ্রামীণ মুসলিম কৃষকদের সমর্থনের প্রতিফলন। যারা মুসলিম লীগের শহুরে অভিজাতদের চেয়ে কেপিপির সংস্কারমুখী প্রতিশ্রুতিকে পছন্দ করেছিল।
ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির এই জয় একদিকে যেমন মুসলিম লীগের শহুরে আভিজাত্যের বিপরীতে জনগণের রায় ছিল, অন্যদিকে তা ছিল গান্ধীবাদের বিপরীতে রাজনীতির আরেক নতুন ধারা।
গান্ধীর কৃষক সত্যাগ্রহ ছিল নৈতিকতা ও অহিংস প্রতিবাদের উপর ভিত্তি করে এক প্রতীকী আন্দোলন। অন্যদিকে কেপিপির আন্দোলন ছিল আইনি সংস্কারের মাধ্যমে কৃষকদের দৈনন্দিন কষ্ট কমানোর আন্দোলন।
এই জয়ের পর ফজলুল হক মুসলিম লীগের সাথে জোট সরকার গঠন করেন। সেই সরকারে বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হন ফজলুল হক।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফজলুল হক যে সংস্কারের ঝড় তুলেছিলেন, তা বদলে দিয়েছিল তৎকালীন বাংলার সামাজিক কাঠামো। ১৯৩৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে পাস হয় বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ডেটরস অ্যাক্ট এবং মানি লেন্ডার্স অ্যাক্ট।
এই আইনগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষকে মুক্তি দেয় ১৭৯৩ সালের চিস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার জমিদারি শোষণ থেকে।
এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে প্রণীত প্রাইমারি এডুকেশন বিল, এবং গ্রামীণ অঞ্চলের অবহেলা দূর করতে নেওয়া নানান পদক্ষেপ ছিল তাঁর শাসনের প্রধান অগ্রাধিকার।
এই নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রয়োজন ফজলুল হলের ছিল না। প্রয়োজন ছিল প্রান্তিক মানুষের প্রতি মন থেকে দরদ থাকার। সেই ফজলুল হকের ছিল।
ফজলুল হকের এই অর্থনৈতিক সংস্কারের রাজনীতি ছিল একই সময়ে জওহরলাল নেহরুর ফ্যাবিয়ান সমাজতন্ত্রের শিল্পভিত্তিক কল্পরাজ্য আলাদা। কিংবা আলাদা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অভিজাত সাংবিধানিক রাজনীতির মুসলিম কোটা-নির্ভর চিন্তা থেকেও।
একই বাংলার সন্তান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরবর্তী সময়ে মুসলিম লিগমুখী হয়ে ফজলুল হকের কিছু সংস্কার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি কখনোই জনগণের হৃদয়ে সেই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। অনেকের চোখেই সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতি ছিল শহুরে, অভিজাত সমাজের দিকে ঝুঁকে থাকা। অন্যদিকে ফজলুল হকের রাজনৈতিক চেতনা ছিল গ্রামের মাটিতে, সাধারণ মানুষের পাশে।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব পেশ করার সময় তিনি কেবল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলেননি; তিনি প্রস্তাব করেছিলেন এক বাংলা-অসম ফেডারেশনের, যেখানে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কলকাতাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অর্থাৎ ফজলুল হক চেয়েছিলেন একক, ঐক্যবদ্ধ বাংলা, যা নিজের শক্তিতে দাঁড়াবে।
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ মেনে নেওয়াকে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিযুক্ত করেছিলেন। অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন সরাসরি জিন্নাহর দিকেই।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন উর্দুভিত্তিক মুসলিম ঐক্যের আহ্বানে এক অভিজাত ইসলামি রাষ্ট্রের স্বপ্ন আঁকছিলেন, তখন ফজলুল হকের বাংলাভাষী বক্তব্য সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন সেই ধর্মের নামে দেশভাগ করতে নামা মহাজন ও জমিদারদের, যারা ধর্মের আড়ালে নির্মাণ করতে যাচ্ছিল শোষণের আরেক নতুন হাতিয়ার।
গান্ধীর নৈতিক নিখুঁততা আর নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীনতার ধারণা যেখানে বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করেছিল, সেখানে ফজলুল হক ছিলেন বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতার অবিচল সমর্থক। তিনি বাংলাকে দেখেছিলেন জনগণের মুক্তি ও আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসেবে।
ফজলুল হকের স্বাধীনচেতা মনোভাব তাঁকে নিয়ে এসেছিল নানান বিতর্কের কেন্দ্রে। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় দফা ফজলুল হক গঠন করেছিলেন মন্ত্রীসভা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গভর্নর জেনারেলের ডিফেন্স কাউন্সিলে যোগ দিয়েছিলেন, বাংলায় জাপানি আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেন। ফজলুল হকের উদ্দেশ্যে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘যখন বাঘ আসে, মেষশাবককে সরে যেতে হয়।‘
পরে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখার স্বার্থে, মুসলিম লীগের চাপে এবং যুদ্ধ-সমর্থনের অভাব দেখে ১৯৪৩ সালের ২৮ মার্চ গভর্নর হারবার্ট ফজলুল হককে পদত্যাগের জন্য বাধ্য করেন।
ইতিহাসে এই ঘটনাটি ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’। কারণ অনেকের কাছেই এটি ছিল ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টের ধারা ৯৩-এর অধীনে গভর্নরের বিচারিক ক্ষমতার অপব্যবহার।
১৯৪৭-এর পর পাকিস্তানে তিনি আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসেন, কিন্তু দ্রুতই কেন্দ্রীয় পাঞ্জাবি প্রাধান্যের চাপে পদত্যাগ করেন বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে।
দেশভাগের বিভক্ত রাজনীতির বিপরীতে তাঁর অবদান অনেক সময় আড়ালে পড়ে গেলেও, এ. কে. ফজলুল হকের উত্তরাধিকার আজও গভীরভাবে অনুরণিত।
ফজলুল হক নিখুঁত ছিলেন না। রাজনৈতিক দলাদলিতে তাঁর সরকার ভেঙেছে বহুবার, ব্যক্তিগত জীবনে একাধিক বিবাহ নিয়ে গসিপও কম হয়নি। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে প্রত্যাখ্যান, আর বাংলার ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস তাঁকে পরিণত করেছে একজন বহুত্ববাদী নেতার প্রতিমূর্তি হিসেবে।
আদর্শিক ও ধর্মীয় বিভাজনের এক যুগে ফজলুল হক ছিলেন বাস্তববাদী সংস্কারক। যিনি বাংলার মাটিতে পরিবর্তনের বীজ বুনেছিলেন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা একটু বেশি মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়াতে পারে।

ব্রিটিশ ভারতে তখন চলছে অস্থির সময়। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার দাবিতে ফুঁসে উঠেছে পুরো উপমহাদেশ। জওহরলাল নেহরু, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো বাঘা বাঘা নেতারা তখন ব্যস্ত নিজ নিজ ভূখণ্ডকে ধর্মীয় চাদরে ঢাকতে। একই সময়ে আবুল কাশেম ফজলুল হক ওরফে এ. কে. ফজলুল ছিলেন এক ব্যতিক্রম জননেতা। ব্যতিক্রমী চিন্তাবিদ। ওই সময় ভূখণ্ড ভাগ বাটোয়ারার বদলে বাংলাকেন্দ্রিক কৃষকজীবনের স্বপ্নকে তিনি দিয়েছেন নতুন দিশা।
১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি যেমন বাংলার মাটির কাছাকাছি ছিলেন, তেমনি ক্ষমতায় গিয়েও দূরে ছিলেন দিল্লির দপ্তর বা আহমেদাবাদের আভিজাত্য থেকে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত, পদার্থবিদ্যা ও আইন নিয়ে পড়াশোনা ফজলুল হক নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনাকে মিলিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের দুঃখবোধের সঙ্গে। সাধারণ মানুষের দুঃখের প্রতি দরদই তাঁকে একজন আইনজীবী থেকে বানিয়েছিল কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ।
ফজলুল হক বজ্রকণ্ঠের বক্তা ছিলেন না। নিজ সময়ের তুখোড় রাজনীতিবিদদের মতো সাম্প্রদায়িক বা বিভাজনের রাজনীতিও তিনি করেননি। তবু কেন জনগণের অন্তরে ঠাই পেল তাঁর নাম? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় বর্তমান সময়ে বহুল চর্চিত একটা শব্দ দিয়ে। শব্দটা হচ্ছে ‘সংস্কার’।ফজলুলকে হককে বলা যায় এই অঞ্চলের রাষ্ট্র সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ।
ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল বেশ সাদামাটাভাবেই। সালটা ছিল ১৯১৩। ওই বছর তিনি ঢাকা কেন্দ্র থেকে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল রায় বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্র-এর মতো প্রভাবশালী হিন্দু নেতা। এই প্রতিদ্বন্দ্বীকেই ফজলুল হক পরাজিত করেছিলেন মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের সমর্থনে। এই বিজয়ের মধ্যেই ছিল এক লুকনো বার্তা, ফজলুল হকের রাজনীতি পরিচয়বাদের সীমানায় আটকে যাবে না।
এর প্রমাণ পাওয়া যায় ৩ বছরের মধ্যেই। ১৯১৬ সালের মধ্যেই তিনি অর্জন করেন এক বিরল মর্যাদা। একদিকে তিনি নির্বাচিত হন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের সভাপতি, অন্যদিকে নির্বাচিত হন জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক।
তাঁর এই উদার রাজনীতি তখনকার ক্রমবর্ধমান বিভাজনের বাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল এক বিশাল প্রাচীরের মতো।
ওই সময়ে মহাত্মা গান্ধী যখন অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও চরকা কেটে খদ্দর পরার সংযমী পথ বেছে নিয়েছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, সেখানে ফজলুল হক ছিলেন সাংবিধানিক আন্দোলনের পক্ষপাতী।
একদিকে তিনি ব্রিটিশ সরকারের দেয়া নাইটহুডের মতো সম্মান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, অন্যদিকে আইনসভায় সক্রিয় থেকে জনগণের জন্য কার্যকর হক আদায়েও ছাড় দেননি।
১৯২৯ সালে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠা করেন অল বেঙ্গল টেন্যান্টস অ্যাসোসিয়েশন, যা ১৯৩৬ সালে রূপ নেয় কৃষক প্রজা পার্টিতে (কেপিপি)।
এই অঞ্চলের মানুষের জন্য সংগঠনটির উদ্ভব ছিল এক নতুন দিগন্তের সূচনা। এই সংগঠন থেকেই শুরু হয়েছিল জরুরি একেকটা সংস্কার আন্দোলন। সেটা জমিদারদের শোষণে নিষ্পেষিত ক্ষুদ্র জমির মালিক ও কৃষকদের আন্দোলন হোক কিংবা ন্যূনতম মজুরি চালুর আন্দোলন, কিংবা হোক প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার আন্দোলন।
১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টের অধীনে ১৯৩৬-৩৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলায় ২৫০ আসনের মধ্যে ১১৭টি মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এই নির্বাচন কমিউনিটির ভিত্তিতে হলেও কেপিপির সেখানে তুলে ধরেছিল গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা ও অসাম্প্রদায়িক আবেদন।
ওই নির্বাচনে মুসলিম আসনগুলোতে ৩৯টি আসন জিতে নেয় কেপিপি। বিপরীতে মুসলিম লীগ পায় ৩৮টি আসন । কেপিপির বিজয় ছিল মূলত গ্রামীণ মুসলিম কৃষকদের সমর্থনের প্রতিফলন। যারা মুসলিম লীগের শহুরে অভিজাতদের চেয়ে কেপিপির সংস্কারমুখী প্রতিশ্রুতিকে পছন্দ করেছিল।
ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির এই জয় একদিকে যেমন মুসলিম লীগের শহুরে আভিজাত্যের বিপরীতে জনগণের রায় ছিল, অন্যদিকে তা ছিল গান্ধীবাদের বিপরীতে রাজনীতির আরেক নতুন ধারা।
গান্ধীর কৃষক সত্যাগ্রহ ছিল নৈতিকতা ও অহিংস প্রতিবাদের উপর ভিত্তি করে এক প্রতীকী আন্দোলন। অন্যদিকে কেপিপির আন্দোলন ছিল আইনি সংস্কারের মাধ্যমে কৃষকদের দৈনন্দিন কষ্ট কমানোর আন্দোলন।
এই জয়ের পর ফজলুল হক মুসলিম লীগের সাথে জোট সরকার গঠন করেন। সেই সরকারে বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হন ফজলুল হক।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফজলুল হক যে সংস্কারের ঝড় তুলেছিলেন, তা বদলে দিয়েছিল তৎকালীন বাংলার সামাজিক কাঠামো। ১৯৩৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে পাস হয় বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ডেটরস অ্যাক্ট এবং মানি লেন্ডার্স অ্যাক্ট।
এই আইনগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষকে মুক্তি দেয় ১৭৯৩ সালের চিস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার জমিদারি শোষণ থেকে।
এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে প্রণীত প্রাইমারি এডুকেশন বিল, এবং গ্রামীণ অঞ্চলের অবহেলা দূর করতে নেওয়া নানান পদক্ষেপ ছিল তাঁর শাসনের প্রধান অগ্রাধিকার।
এই নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রয়োজন ফজলুল হলের ছিল না। প্রয়োজন ছিল প্রান্তিক মানুষের প্রতি মন থেকে দরদ থাকার। সেই ফজলুল হকের ছিল।
ফজলুল হকের এই অর্থনৈতিক সংস্কারের রাজনীতি ছিল একই সময়ে জওহরলাল নেহরুর ফ্যাবিয়ান সমাজতন্ত্রের শিল্পভিত্তিক কল্পরাজ্য আলাদা। কিংবা আলাদা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অভিজাত সাংবিধানিক রাজনীতির মুসলিম কোটা-নির্ভর চিন্তা থেকেও।
একই বাংলার সন্তান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরবর্তী সময়ে মুসলিম লিগমুখী হয়ে ফজলুল হকের কিছু সংস্কার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি কখনোই জনগণের হৃদয়ে সেই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। অনেকের চোখেই সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতি ছিল শহুরে, অভিজাত সমাজের দিকে ঝুঁকে থাকা। অন্যদিকে ফজলুল হকের রাজনৈতিক চেতনা ছিল গ্রামের মাটিতে, সাধারণ মানুষের পাশে।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব পেশ করার সময় তিনি কেবল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলেননি; তিনি প্রস্তাব করেছিলেন এক বাংলা-অসম ফেডারেশনের, যেখানে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কলকাতাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অর্থাৎ ফজলুল হক চেয়েছিলেন একক, ঐক্যবদ্ধ বাংলা, যা নিজের শক্তিতে দাঁড়াবে।
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ মেনে নেওয়াকে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিযুক্ত করেছিলেন। অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন সরাসরি জিন্নাহর দিকেই।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন উর্দুভিত্তিক মুসলিম ঐক্যের আহ্বানে এক অভিজাত ইসলামি রাষ্ট্রের স্বপ্ন আঁকছিলেন, তখন ফজলুল হকের বাংলাভাষী বক্তব্য সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন সেই ধর্মের নামে দেশভাগ করতে নামা মহাজন ও জমিদারদের, যারা ধর্মের আড়ালে নির্মাণ করতে যাচ্ছিল শোষণের আরেক নতুন হাতিয়ার।
গান্ধীর নৈতিক নিখুঁততা আর নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীনতার ধারণা যেখানে বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করেছিল, সেখানে ফজলুল হক ছিলেন বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতার অবিচল সমর্থক। তিনি বাংলাকে দেখেছিলেন জনগণের মুক্তি ও আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসেবে।
ফজলুল হকের স্বাধীনচেতা মনোভাব তাঁকে নিয়ে এসেছিল নানান বিতর্কের কেন্দ্রে। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় দফা ফজলুল হক গঠন করেছিলেন মন্ত্রীসভা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গভর্নর জেনারেলের ডিফেন্স কাউন্সিলে যোগ দিয়েছিলেন, বাংলায় জাপানি আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেন। ফজলুল হকের উদ্দেশ্যে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘যখন বাঘ আসে, মেষশাবককে সরে যেতে হয়।‘
পরে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখার স্বার্থে, মুসলিম লীগের চাপে এবং যুদ্ধ-সমর্থনের অভাব দেখে ১৯৪৩ সালের ২৮ মার্চ গভর্নর হারবার্ট ফজলুল হককে পদত্যাগের জন্য বাধ্য করেন।
ইতিহাসে এই ঘটনাটি ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’। কারণ অনেকের কাছেই এটি ছিল ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টের ধারা ৯৩-এর অধীনে গভর্নরের বিচারিক ক্ষমতার অপব্যবহার।
১৯৪৭-এর পর পাকিস্তানে তিনি আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসেন, কিন্তু দ্রুতই কেন্দ্রীয় পাঞ্জাবি প্রাধান্যের চাপে পদত্যাগ করেন বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে।
দেশভাগের বিভক্ত রাজনীতির বিপরীতে তাঁর অবদান অনেক সময় আড়ালে পড়ে গেলেও, এ. কে. ফজলুল হকের উত্তরাধিকার আজও গভীরভাবে অনুরণিত।
ফজলুল হক নিখুঁত ছিলেন না। রাজনৈতিক দলাদলিতে তাঁর সরকার ভেঙেছে বহুবার, ব্যক্তিগত জীবনে একাধিক বিবাহ নিয়ে গসিপও কম হয়নি। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে প্রত্যাখ্যান, আর বাংলার ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস তাঁকে পরিণত করেছে একজন বহুত্ববাদী নেতার প্রতিমূর্তি হিসেবে।
আদর্শিক ও ধর্মীয় বিভাজনের এক যুগে ফজলুল হক ছিলেন বাস্তববাদী সংস্কারক। যিনি বাংলার মাটিতে পরিবর্তনের বীজ বুনেছিলেন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা একটু বেশি মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়াতে পারে।
.png)

আচ্ছা, এমন একজন নেতার কথা ভাবুন তো, যিনি পরাধীন ভারতে বসে ব্রিটিশ দারোগাকেই বুদ্ধির প্যাঁচে ফেলে ঘোল খাইয়ে ছাড়েন! আবার পরক্ষণেই যাঁর এক মজার কাণ্ডে হাসির রোল পড়ে যায়। এরকম তো একজনই ছিলেন। তিনি আর কেউ নন, বাংলার বাঘ, আমাদের সবার প্রিয় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।
৪ ঘণ্টা আগে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন শুধু তথ্যের জগতে সীমাবদ্ধ নয়। এআই এখন হয়ে উঠেছে কথোপকথনের সঙ্গীও। কিন্তু ধীরে ধীরে এই চ্যাটবটগুলো বন্ধু, পরামর্শদাতা এমনকি কখনও ‘ডিজিটাল সম্পর্কের’ অংশ হয়ে উঠছে। কোথাও কোথাও এমন কথোপকথন পর্যন্ত হচ্ছে, যা প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী। এখানেই তৈরি হচ্ছে নতুন ঝুঁকি।
৫ ঘণ্টা আগে
সবুজ ফোলানো ব্যাঙের পোশাক পরে যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় নেমেছেন হাজারো মানুষ। গত সপ্তাহের পর থেকেই টিকটক, ইন্সটাগ্রাম, ব্লুস্কাইসহ যুক্তরাষ্ট্রের নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভরে গেছে ফোলানো ব্যাঙের ছবি ও ভিডিওতে। কিন্তু কেন?
১৪ ঘণ্টা আগে
গতকাল (২৪ অক্টোবর) মুক্তি পেয়েছে কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় সিজনের সপ্তম গান ‘ক্যাফে’। মহীনের ঘোড়াগুলির সম্পাদিত অ্যালবামের জনপ্রিয় গান ‘আমার প্রিয়া ক্যাফে’-কে এবার নতুনভাবে হাজির করা হয়েছে।
১ দিন আগে