ডেভিড হলব্রক সিলভিয়া প্লাথকে (১৯৩২-১৯৬৩) দ্বিধাবিভক্ত স্কিৎসয়ড লক্ষণাক্রান্ত বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এ-ধরনের মানসিক অবস্থা কতটা জেনেটিক আর কতটা পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরাও নিশ্চিত নন। তবে সিলভিয়ার ক্ষেত্রে, তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে বস্টনের নৈসর্গিক পরিবেশে, বেশ আনন্দের সঙ্গে। যদিও অধ্যাপক বাবা অটো অমিল প্লাথ মারা যান সিলভিয়ার বয়স যখন সবে নয় বছর। আর মা অরেলিয়া শোয়েবার বাবার অনুপস্থিতিকে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন লাঘব করতে। দিনরাত শিক্ষকতার পেশায় থেকে ভাই ওয়ারেন-সহ সিলভিয়াকে তিনি মানুষ করেছেন দায়িত্বশীলতা, উদ্যম ও ভালোবাসার সঙ্গে। তারপরও সিলভিয়াকে মানসিক অবসন্নতায় পেয়ে বসে বয়ঃসন্ধিকাল থেকে। মানসিক বিকারগ্রস্ততা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সিলভিয়া তা থেকে মুক্তি হিসেবে আত্মহননের পথ বেছে নেন।
সিলভিয়া প্লাথের স্নায়বিক ও মানসিক বিকারগ্রস্ততা ধরা পড়ে তাঁর উপন্যাস, গল্প ও কবিতায়। সিলভিয়ার প্রথম কবিতার বই দ্য কলোসাস অ্যান্ড আদার পোয়েমস (১৯৬০), প্রথম উপন্যাস দ্য বেল জার (১৯৬৩) কিংবা বহুবিখ্যাত এরিয়েল (১৯৬৫) কাব্যের বিষয়, বর্ণনা ও চিত্রকল্পের মূল উৎস তাঁর জীবন এবং জীবনকে কেন্দ্র করে নানা পরিপার্শ্ব। এজন্য অনেকে তাঁকে স্বীকারোক্তিমূলক সাহিত্যের ‘বিকারগ্রস্ত অথচ সম্পূর্ণ সংযত শিল্পী’ বলে মনে করেন। এছাড়া বাস্তব জীবনের সংকট ও জঞ্জাল দিয়ে তাঁর উপন্যাস ও কবিতাকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব এবং করে আসছেনও অনেকে। পিতা কিংবা পিতার ছায়াকে কেন্দ্র করে সিলভিয়ার কবিতাগুলো একদিকে যেমন তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য বহন করে, একই ভাবে তাতে পিতাকে নিয়ে নিজের অভিমান ও পিতৃতন্ত্রের প্রতি গভীর বিদ্বেষও প্রকাশ করে। এ ধরনের কবিতা বিশ্বকবিতার সোনালি ও সংবেদনশীল ফসল।
সিলভিয়া প্লাথ। সংগৃহীত ছবিদ্য কলোসাস অ্যান্ড আদার পোয়েমস কাব্যের নাম-কবিতাটির বিষয় তাঁর বাবা অটো প্লাথ। কলোসাসের রূপকে বাবার প্রতি তাঁর অন্তর্গত সত্তার অনুরাগ বা বিরাগ কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে, যে-বাবা তাঁর জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলেছিলেন। কবিতায় বাবাকে একজন চিত্তাকর্ষক ও প্রতিভূ সত্তার অধিকারী রূপে উপস্থাপন করে তাঁর উপস্থিতিকে নিজের জীবনের দাসত্বে অন্তহীন অনুভূতির আধার হিসেবে দেখিয়েছেন। কলোসাস প্রাচীন বিশ্বের আশ্চর্যজনক সেই বিশাল মূর্তি যা একসঙ্গে দুটি দ্বীপে চড়ে নিজের ক্ষমতা ও দম্ভকে প্রকাশ করে। নিজের বাবার প্রতিমূর্তি কল্পনা ও স্মৃতি বিনির্মাণে এরূপ রূপক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিজীবনের অনুভূতির সঙ্গে যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর নগ্ন রূপের প্রতি প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন কবি।
উনিশশো ষাট সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য কলোসাস’, কিন্তু বাবাকে নিয়ে লেখা তাঁর প্রথম কবিতা নয়। মৃত্যুর পর কৈশোরেই তিনি লিখেছিলেন একটি কবিতা, বাবাকে নিয়ে। কবিতার নাম ‘ভিলানেল’, ফরাসি কবিতার বিশেষ আঙ্গিকে রচিত কবিতাটি অপক্ব হাতের লেখা ছিল ঠিকই, কিন্তু তার গুরুত্ব কবির অনুভূতি ও উপলব্ধির কবিত্বপূর্ণ প্রকাশের জন্য। বাবা ছিলেন তাঁর কাছে দূরপৃথিবীর মানুষ, ঈশ্বরতুল্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ক্ষমতাবান, আরাধ্যপুরুষ। কিন্তু কবিতায় দেখা যায় বাবাটির মৃত্যু হয়েছে তুচ্ছ মৌমাছির কামড়ে। এটা অসম্ভব ঘটনা বটে। বাস্তবিক, বাবার মতো মানুষের সাধারণ একটি রোগে মৃত্যু সিলভিয়া মেনে নিতে পারেননি। রূপকার্থে তিনি কবিতায় তা-ই প্রকাশ করেছেন, যা একজন ভবিষ্যৎ কবিকে প্রতিনিধিত্ব করে।
বাবাকে নিয়ে পরে লেখা অপর ভিন্নমাত্রিক কবিতা ‘ফুল ফ্যাদম ফাইভ’। এটি সিলভিয়ার ছাব্বিশ বছর বয়সে রচিত। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের দ্য টেম্পেস্ট নাটকের এরিয়েলের গাওয়া একটি গানের অনুষঙ্গ আছে কবিতাটিতে। বাবাকে মৃত ভেবে রাজকুমার ফার্দিনান্দের যে-আর্তি ও আকুতি তার সঙ্গে কবিতার বাবাহীন মেয়েটির অন্তর্বেদনা একাকার হয়ে উঠেছে। কবিতায় ব্যক্তি সিলভিয়া ও তাঁর বাবাকে এভাবে পাই যে, বাবা শুয়ে আছেন সমুদ্রের জলরাশির নিচে, আর মেয়ে ডাঙাতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। সমুদ্রের সঙ্গে সিলভিয়ার শৈশব একাকার হয়ে আছে, হারিয়ে যাওয়া বাবাও জীবনের গভীরতর এক সমুদ্রও। বাবার বিশালতা এবং মৃত্যুর হৃদয়হীন ছোবল তাঁর অবচেতনে যে প্রতিকল্প তৈরি করেছে কবিতায় তারই প্রকাশ ঘটেছে। তিনি মনে করছেন বাবার বিশালতা এমন যে সব কিছুতেই তিনি আছেন : সমুদ্রের নীল জলে, বরফের পাহাড়ে, আর উত্তাল ঢেউয়ে। কিন্তু থই পাওয়া যায় না, তাঁর কাছে পৌঁছা যায় না। বাবাকে ঘিরে এই প্রেম, ভয়, রহস্য, অর্থহীনতা ও মৃত্যুর আকাক্সক্ষা সিলভিয়ার কবিতার প্রধান যে বৈশিষ্ট্য কবিতার শেষ স্তবকেও তা প্রতিফলিত হতে দেখি।
সমকালকে ধারণ করে ‘ড্যাডি’ বাবা-মেয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে জটিল এক মনস্তাত্ত্বিক কবিতা। ঐতিহাসিক ঘটনা, বিশেষ করে নাৎসি জার্মানির ভয়াবহতার সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ এতে ট্রমা ও অবাধ্যতার জটিল ‘টেপেস্ট্রি’ তৈরি করেছে। বাবাকে ফ্যাসিবাদ ও পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতার প্রতীক হিসাবে সম্বোধন করে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে প্রচলিত সামাজিক বিভ্রান্তি এবং মনস্তাত্ত্বিক ট্রমার প্রতিফলন ঘটেছে এতে।
বাবার মৃত্যুযন্ত্রণা, পিতৃহীন পৃথিবীর মৃত্যুময়তা থেকে কবি স্বস্তিও খুঁজেন সাগরের গভীরে, যেখানে তাঁর পিতা শুয়ে আছেন। এই অভিব্যক্তির মধ্যে সিলভিয়ার ভিতরের ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সের আভাসও প্রতিফলিত হয়।
‘লোরেলেই’ কবিতারও প্রধান অনুষঙ্গ সমুদ্র, পিতৃহীনা কন্যার অনুবেদন, পিতা ও মৃত্যু। কবিতার থিমটি জার্মান উপকথা থেকে নেওয়া। মৃত বাবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য সাইরেন মেয়েটি রাইন নদীর জলে আত্মবিসর্জন দেয়। কবিতায়ও কবি জীবনের বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য পিতার সঙ্গে মিলিত হতে চান যাপিতজীবনের গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, ওই জলের রাশিতে।
সাতাশ বছর বয়সে, উনিশশো উনষাট সালেই সিলভিয়া লিখেন আরেকটি কবিতা ‘ম্যান ইন ব্ল্যাক’, যাতে প্রকাশিত হয় জটিল এক পিতৃভাবনা; ভয় ও মৃত্যুর অনুষঙ্গে। পিতা এখানে উপস্থিত হন নেতি হিসেবে, ধ্বংসের প্রতীক হয়ে।
শৈশবের সমুদ্র, ডিয়ার আইল্যান্ড, শুয়োরের খামার, মুরগির ঘর আর গবাদিও চারণভূমি নিজের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পিতার রূপক ও মৃত্যুর নৈর্ব্যক্তিক রূপ কবিতাটিকে আত্মগত বেদনার বাইরে বৃহত্তর জীবনের অর্থকে ইঙ্গিত করে।
এই ধারাবাহিকতায় ‘দ্য কলোসাস’ পিতাকে নিয়ে ও পিতার জীবন ঘিরে সিলভিয়ার উল্লেখযোগ্য কবিতা। কলোনাসের ভাঙা মূর্তির খণ্ড-বিখণ্ড টুকরোর ভিতর দিয়ে পিতার জটিল রূপ অনুসন্ধান করা হয়েছে কবিতাটিতে। পিতার স্মৃতি ও উপস্থিতির টুকরো অংশ একত্রিত করতে প্রতিনিয়ত হাতড়ে বেড়ান কবি অদ্ভুত এক পাশবিক কোলাহল ও বোধাতীত অনুভূতি নিয়ে।
পুরো কবিতাটির আবহ পরাবাস্তবিক, ভাষাও জটিল। কবির অভিজ্ঞতার প্রকৃতিও বিশৃঙ্খল ও খণ্ড-বিখণ্ড। সিলভিয়া প্লাথের কবিতার সাধারণ যে-বৈশিষ্ট্য অতীতের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বিনাশ, শোক ও জীবনার্থের সন্ধান কবিতাটিতে তার এক অগ্রবর্তী রূপ প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও প্লাথের কবিতায় যে-সহিংসতা ও নারী নিপীড়নের বিষয়টি থাকে তার পরিবর্তে এই কবিতা ব্যক্তিক অনুভূতি ও তাঁর আত্মদর্শী রূপের প্রকাশ। কবিতায় হারানো পিতার সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য কবির অন্তর্গত সংগ্রাম প্রতিবিম্বিত হয়েছে। তবে পিতার সঙ্গে কন্যার যে-স্বাভাবিক সম্পর্ক তার পরিবর্তে একটা ভয়াল ও ক্রুর রূপও মূর্ত হতে দেখি কবিতায়।
পুরাণ ও ইতিহাসের উপাদানকে প্রতীকায়িত করে বাস্তবের প্রতিসঙ্গী আকারে চিত্রকল্প ও সুগভীর সংবেদনশীলতার প্রকাশ দ্য কলোসাস কাব্যের অন্য কবিতায় যেমন, এখানেও দেখা যায়। ‘রোমান কর্র্তৃপক্ষ’ কিংবা ‘গ্রিক ওরেস্টিয়া’র মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতা ও দম্ভ এবং ক্ষমতা ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধস্পৃহার বিষয়টিও কবিতাটিতে মূর্ত। বাবা ও মেয়ের সম্পর্কের অন্তরালে এমনকি সমকালীন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধোত্তর যুগের মোহভঙ্গ এবং আধিপত্যশীল সত্তাসমূহকে (কর্তৃপক্ষের/ ব্যক্তিদের) প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস দেখা যায়। কলোসাসের ছিন্নভিন্ন চিত্রটি ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের পতন এবং অর্থের নতুন কাঠামোকে সন্ধান করে।
বাবাকে নিয়ে পরে লেখা অপর ভিন্নমাত্রিক কবিতা ‘ফুল ফ্যাদম ফাইভ’। এটি সিলভিয়ার ছাব্বিশ বছর বয়সে রচিত। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের দ্য টেম্পেস্ট নাটকের এরিয়েলের গাওয়া একটি গানের অনুষঙ্গ আছে কবিতাটিতে। বাবাকে মৃত ভেবে রাজকুমার ফার্দিনান্দের যে-আর্তি ও আকুতি তার সঙ্গে কবিতার বাবাহীন মেয়েটির অন্তর্বেদনা একাকার হয়ে উঠেছে। কবিতায় ব্যক্তি সিলভিয়া ও তাঁর বাবাকে এভাবে পাই যে, বাবা শুয়ে আছেন সমুদ্রের জলরাশির নিচে, আর মেয়ে ডাঙাতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন।
‘ইলেক্ট্রা অন অ্যাজালিয়া পাথ’ সিলভিয়া প্লাথের পিতাকে নিয়ে লেখা কবিতার মধ্যে একটি। এটি লেখা হয় ১৯৫৯ সালে, অটো প্লাথের মৃত্যুর উনিশ বছর পরে। স্বামী টেডকে নিয়ে এ-সময় কবি অ্যাজালিয়া পাথ পরিদর্শন করেছিলেন বোস্টনে। তাঁর বাবাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল অ্যাজালিয়া পাথের উইনথ্রপ কবরস্থানে। এখানে এসে, প্রায় পরিত্যক্ত সমাধিগুলোকে দেখে কবি ব্যথিত হন এবং তীব্র একটা অপরাধবোধ তাঁর মধ্যে কাজ করে। কবিতার মূল বিষয় পিতৃপ্রেম-বাবার মৃত্যুর জন্য শোক ও অপরাধবোধ। বাবার সঙ্গে কবির সম্পর্ক ও সম্পর্কের টানাপোড়েন, স্মৃতি, বাবার মৃত্যুর সঙ্গে নিজের একাকিত্ব ও যন্ত্রণা এবং বাবার মৃত্যুর পথ ধরে নিজের ট্রমা ও মৃত্যুর মতো ব্যক্তিগত আবেগ প্রতিফলিত হয়েছে। প্লাথের কবিতার সাধারণ যে-বৈশিষ্ট্য অতীতের ক্ষতি, শোক, বিরাগ ও ধ্বংসাত্মক মনোভাব তাতেও দেখা যায়। ব্যক্তিগত জীবনের ট্রাজিক আবহও স্মৃতি ও শোকের সমান্তরালে কবিতাটিতে বিবৃত। কবিতাটির শুরুতেই বাবার মৃত্যুতে শিশু সিলভিয়ার মানসিক অবস্থা ধরা পড়ে। বোঝা যায় এই মৃত্যুকে তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি।
এমনকি বাবার সঙ্গে তাঁকেও যেন সমাধিস্থ করা হয়, বিষয়টা এমন ছিল যে বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ভাই ওয়ারেন ও সিলভিয়াকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। তাই সমাধির বিষয়টি তাঁর কাছে কাল্পনিক একটা ঘটনা ছিল। শুধু তাই নয়, বাবার মৃত্যুটাই অবাস্তব মনে হয়েছে সারাজীবন। তাঁর কল্পনায় বাবা যেমন কবরে শুয়ে আছে, সেও অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনো গর্তে মিশে গিয়েছিল। এমন এক উদ্ভট স্থান যেখানে পশুপতঙ্গরা শীতকাল যাপন করে তুষারঝড় এড়িয়ে পাথুরে শক্ত মাটিতে। তাঁর ভাবনা ছিল বাবা একদিন ফিরে আসবেন, যেমন শীতঘুম শেষে বেরিয়ে আসে প্রাণিসকল। বিশ বছর এভাবেই কেটেছে, কিন্তু বাবা ফিরে আসেনি।
বাবাকে তাঁর অস্তিত্বের অংশের চেয়ে নিজেকে তিনি বাবার অস্তিত্ব বলেই মনে করেন। বাবাহীন অস্তিত্ব তাঁর কাছে অলীক। অনেক বছর পরে যখন তাঁর ঘুম ভাঙে, তিনি জেগে ওঠেন তখন বুঝতে পারেন বাবা মৃত। কবিতায় বাবার সমাধির যে পরিবেশ ও চিত্রের রূপ পাওয়া যায় তার সঙ্গে দ্য বেল জারের এসথারের বর্ণনা ছিল একই।
বাবার এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবেন গ্রিক কাহিনির ইলেক্ট্রার মতো। ইলেক্ট্রা ও অ্যাগামেমননের রূপকে নিজেকে ও পিতাকে কবি প্রতিস্থাপিত করে দুঃখ, অসহায়ত্ব ও যন্ত্রণাকে প্রকাশ করেছেন। আটো প্লাথের মৃত্যুকে মা অরেলিয়া স্বাভাবিক মনে করলেও সিলভিয়া একে মানতে নারাজ। কেননা অটো প্লাথ মারা গেলেন অনেকটা অচিকিৎস্য ডায়াবেটিক রোগে। স্বাস্থ্য তাঁর ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিল। বিভিন্ন ধরনের উপসর্গও শরীরে দেখা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই মরবেনই যখন ডাক্তার দেখাবেন না। পরে পায়ের আঙুলের একটি ক্ষত থেকে ভয়ানক গ্যাংরিন দেখা দেয়। গ্যাংরিন-দষ্ট পা হাঁটু থেকে অ্যামপুটেট করে বাদ দেওয়া হয়। তবু তাঁকে মরতে হলো।
কোনো অবস্থাতে এ-মৃত্যু শিশু সিলভিয়া মেনে নিতে পারেননি। সুতরাং এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, আত্মহত্যা। বাবার এমনরূপ মৃত্যু পরবর্তীকালে সিলভিয়াকেও আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। এর মধ্যে উনিশ বছর বয়সে একবার আত্মহনন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। আত্মহত্যার প্রবণতা তাঁকে পেয়ে বসেছিলও, সারাক্ষণ সঙ্গে রেজর নিয়েও ঘুরতেন এবং কী কী উপায়ে আত্মহত্যা করা যায় সারাক্ষণ ভাবতেন।
সিলভিয়া প্লাথ। সংগৃহীত ছবিনিজেকে হত্যা করার জন্য যে-একনিষ্ঠ উদ্যোগ এজন্য নিজেকে সিলভিয়া ‘শিকারী কুকুর’ বলেও বাবার কাছে পরিচয় দেন। কিন্তু তিনি জানেন বাবা তাঁর প্রাণসখা, বাবার আত্মজা তিনি। এই ভালোবাসাই বাবাকে যেমন মৃত্যু কেড়ে নিয়েছে, বাবার মত্যুর কারণে তিনিও মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়েছেন। কবিতাটি লেখার তিন বছরের মাথায় সিলভিয়া প্লাথ আত্মহত্যা করেন।
ইলেক্ট্রার নাম ও অনুষঙ্গ এই কবিতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক। বাবার সঙ্গে সম্পর্কবিচারে তিনি নিজের মধ্যে ইলেক্ট্রাকে দেখেছেন, আর অটো প্লাথকে দেখেছেন নিহত রাজা অ্যাগামেমনন হিসেবে। শুধু মৃত্যুর বিষয়টি নয়, পুরুষের প্রতি নারীর চিরায়ত শরীরী আকর্ষণের স্বরূপও এখানে উন্মোচিত হয়েছে। সিলভিয়া দ্বিধাহীন চিত্তে সেই গোপন বাসনাকে ইলেক্ট্রার সমান্তরালে নিজের মধ্যে প্রত্যক্ষ করে একাকিত্ব, বিষণ্নতা ও গ্লানিকেও মূর্ত করে তুলেছেন।
বাবাকে নিয়ে সিলভিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘ড্যাডি’। ‘ইলেক্ট্রা অন অ্যাজিলিয়া পাথ’-সহ আগের-সব কবিতায় যেখানে প্রকাশিত হয় বাবার বিশালত্ব, বাবার প্রতি অনুরাগ ও অপরাধবোধ, ‘ড্যাডি’তে আছে সেখানে প্রকাশিত হয়েছে তীব্র বিরাগ ও ঘৃণা। ‘ড্যাডি’ লিখিত হয় ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে, টেড উিজের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরপরই। অনেক কিছু ঘটে গেছে সিলভিয়ার জীবনে। মনোবিকারগ্রস্ত জীবন, অসফল আত্মহত্যা, আত্মহত্যাপ্রবণতা, যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবন, টেডের বিশ^াসঘাতকতা প্রভৃতি তাঁকে ক্লান্ত করে দেয়। সিলভিয়ার মানসিক আশ্রয় ছিলেন মৃত বাবা অটো প্লাথ, জীবনের এই সংকট কালে সিলভিয়া তাঁরই ওপর ক্ষিপ্ত হলেন মনে হলো সবচেয়ে বেশি।
‘কলোসাসে’ পিতার স্মৃতি হাতড়ানো ও রূপনির্মাণের পর ‘ইলেকট্্রা অন অ্যাজালিয়া পাথে’ পিতৃপ্রেম ও অপরাধবোধের সঙ্গে নিজের মৃত্যুর জন্য পিতার প্রতি তাঁর ভালোবাসার স্বীকারোক্তি ঘটে। ‘ড্যাডি’তে সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে ঘৃণা ও বিদ্বেষ। টেডের বিশ্বাসঘাতকতা ও নিপীড়নের উল্লেখ করে তার নিপীড়নের অভিঘাতের মারাত্মক প্রতিফল এই কবিতা। টেড পুরুষ, পিতাও পুরুষ-দুজনকেই সিলভিয়া ভালোবাসতেন। একজন নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন পৃথিবী থেকে, অপরজন সিলভিয়াকে পরিত্যাগ করে অপর নারীকে বেছে নিয়েছেন। তাই পিতৃতন্ত্রের প্রতিভূ সমুদয় পুরুষের দায় চাপতে হলো পিতার ওপর। অন্যদিকে হৃদয়ের অসুখ, মৃত্যু যন্ত্রণা ও যুগযন্ত্রণা একাকার ছিল বলে এর বিস্তার সমকালীন মূল্য থেকে ইতিহাসের ক্রুর পথে।
টি এস এলিয়টের সমসাময়িক কবি হিসেবে সিলভিয়া প্লাথের কবিতায় এলিয়টীয় কাঠামো ও মনোভঙ্গীর প্রবণতা লক্ষিত হয়। বিশেষ করে কবিতায় মিথ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমকালীন প্রেক্ষাপটে ব্যবহার ও পুনর্গঠন করে নতুনতর জীবনবোধের অন্বেষণ তঁর কবিতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। কলোসাস, ওরেস্টিয়া, ইলেক্ট্রা, মিডিয়া, এরিয়েল, নাইকি, মেডুসা, গরগান্স, ড্রায়াডস, লেডি ল্যাজারাস প্রভৃতি মিথ-ঐতিহ্যের চরিত্রকে বিনির্মাণ করে নতুন অর্থে পুনঃস্থাপন করেছেন।
সমকালকে ধারণ করে ‘ড্যাডি’ বাবা-মেয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে জটিল এক মনস্তাত্ত্বিক কবিতা। ঐতিহাসিক ঘটনা, বিশেষ করে নাৎসি জার্মানির ভয়াবহতার সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ এতে ট্রমা ও অবাধ্যতার জটিল ‘টেপেস্ট্রি’ তৈরি করেছে। বাবাকে ফ্যাসিবাদ ও পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতার প্রতীক হিসাবে সম্বোধন করে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে প্রচলিত সামাজিক বিভ্রান্তি এবং মনস্তাত্ত্বিক ট্রমার প্রতিফলন ঘটেছে এতে। সারা বিশ্বে তখন যেসব নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছিল তাদের জন্য কবিতাটি এক অনমনীয় উচ্চারণ এবং যেসব নারী নিজের কণ্ঠস্বর পুনরুদ্ধার ও পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিলেন তাদের কণ্ঠেরও প্রতিধ্বনি এই কবিতা। কবিতায় যেখানে শোকার্ত কন্যার বেদনার্ত আবেগ প্রতিফলিত, সেখানে স্বামীর রূপকল্পে পিতাকে প্রতিস্থাপিত হতে দেখি। সুতরাং ‘ড্যাডি’ কবিতার মূল বিষয় পিতৃতান্ত্রিক নিপীড়ন ও স্বাধীনতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও ক্ষতি এবং নারী-পুরুষের সম্পর্ক। কবিতাটি বাবাকে উদ্দেশ্য করে রচিত, এবং কবি বাবাকে আদর্শায়িত করে ঈশ্বরের সমান প্রতিভূ হিসেবে দেখেছেন। একইসঙ্গে স্বস্তিকার সঙ্গে তুলনা করে প্রতীকায়িত করেছেন। এমনকি বাবাকে জার্মান নাজিবাহিনীর সদস্য বিবেচনা করে নিজেকে ইহুদি বন্দিনীর সঙ্গেও তুলনা করে পুরুষের ত্রাস, নৈরাজ্য ও আধিপত্যকে তুলে ধরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দুর্ঘট প্রত্যক্ষ করে পুরুষের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন।
কবিতার প্রথমেই কবি শাসন ও বন্দিদশাকে কালো জুতোর ভিতর বসবাস রূপকে নিজেকে হাজির করেছেন দীর্ণ ও ফ্যাকাশে পা-স্বরূপ। তিরিশ বছর ধরে একটা প্রবল নির্যাতন ও যন্ত্রণার ভিতর শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় তাকে টিকে থাকতে হয়েছে। সুতরাং এমন অত্যাচারীকে হত্যা করার কথা তাঁর, কিন্তু তার আগেই বাবা মারা গেলেন। নিজের জীবনের সমুদয় যন্ত্রণা, বেদনা ও ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হয় এখানে। পুরো কবিতায় পরাবাস্তববাদী ছবির মতো নির্মাণ করা হয়েছে বাবার মূর্তি, যা মনে করিয়ে দেয় ক্যালোসাসের ভাঙা মূর্তির ছিন্নবিচ্ছিন্ন টুকরোকে, যা ছিল তখন সিলভিয়ার কাছে আবছায়া। এখানে সে আবছায়াটিও অস্পষ্ট, তবে তার স্বরূপটা চিনতে অসুবিধা হয় না। কবিতায় সিলভিয়া নিজেও বলছেন ‘আই ইউজড টু প্রে টু রিকভার ইউ।’
স্মৃতি থেকে বাবাকে পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছেন তিনি, যাকে তিনি ছোটোবেলা ঈশ্বর হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। পুনরুদ্ধরের পর অবশ্য সেই একটি পাথররূপী বাবাটাকেই তিনি পাবেন-মৃতবৎ একটি মূর্তি, ছাই রঙের পা আর ঈশ্বররূপী ব্যক্তিত্ব। ‘দ্য কলোসাস’ ও ‘ইলেক্ট্রা অন অ্যাজিলিয়া পাথ’ কবিতায়ও এর উল্লেখ আছে। তাই বাবাকে পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে সেই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞও তাঁর মাথায় ভিড় করে। বাবা পোলিশ বংশোদ্ভূত জার্মান ছিলেন, তাঁর সম্পর্কে সামান্যই জানতে পারেন তিনি, ছেলেবেলায় তিনি বাবার সঙ্গে খুব কম ছিলেন, ছিল দূরত্বও। বাবার কথা মনে পড়লে মনে পড়ে তাই জার্মান ভাষা আর পোলিশ শহর, যে-জার্মান জিহ্বায় শহরটাকে ধ্বংস করা হয়েছে, মানুষদের বিনাশ করেছে নিষ্ঠুর জার্মানরা। সেই ভয়, উৎকণ্ঠা আর বিরাগ উঠে আসে এভাবে, যেখানে তাঁর চাওয়া ছিল বাবার আসঙ্গ।
এই দূরত্ব ও কথা বলতে না-পারা বাবাকে স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছিল, নিজেকে মনে হয়েছে ইহুদিবিশেষ। যারা হিটলারের দ্বারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত ছিল, সেই জার্মান বলে বাবার ভাষাটাও তাঁর কাছে অস্পষ্ট বা অকথ্য মনে হতো। মনে হতো একটা ইঞ্জিনে ইহুদিদের মতো ফালি ফালি হচ্ছেন তিনি। দাখাউ, আউসভিজ বা বেলসেনের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যেভাবে ওদের নির্যাতন ও হত্যা করা হতো। তাই নিজের সম্পর্কে অনুভব ছিল তার ‘আই বিগেইন টু টক লাইক আ জিউ/ আই থিংক আই মে ওয়েল বি আ জিউ।’ ইহুদিদের দুঃসহ পরিণতি লক্ষ করে নিজেও ইহুদি আত্মপরিচয়ে তাদের বিপরীতে বাবাকে প্রকৃত জার্মান হিসেবে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। কবির মনে হতো প্রত্যেকটা জার্মানের প্রতিরূপ হচ্ছেন তাঁর বাবা।
সিলভিয়া গ্রিক সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন, আবার তিনি ফ্রয়েড-ইয়ং উত্তরকালের বিদ্বান মহিলাও ছিলেন। নিজে ছিলেন বিশেষ মনোরোগে আক্রান্ত। এ নিয়েও ব্যাপক পড়াশোনা করেন তিনি। ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স নিয়ে তাঁর ধারণাও ছিল বেশ। শিল্প সাহিত্যে এ-তত্ত্বের ব্যবহারের ব্যাপারে অবগত ছিলেন। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্সের বিপরীত মেরুর সাইকোসেক্সুয়াল বিষয় হিসেবে কার্ল ইয়ং ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স তত্ত্ব হাজির করেছিলেন।
ভয়টা শুধু মানসিক রূপের জন্যই ছিলনা, পিতার জার্মানসুলভ গোঁফ, আর্য শরীর, নীল চোখ প্রভৃতিতেও মনে হতো হিটলার বাহিনীর ট্রাংকচালক কিংবা যুদ্ধবিমান সবই তাঁর বাবা কিংবা বাবার। হ্যাঁ, তিনি সেই-ঈশ্বরের মতো কেউ নন, তবে নাজিবাহিনীর প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন, যা শুধু অন্ধকার ও ক্রুর। এমনই ক্রুর ও নৃশংস যে তাকে তিনি স্বৈরাচারী হিসেবেও অভিহিত করেন।
এমন ঘৃণার প্রকাশ কিংবা চিত্রকল্প ভাবেওনি কেউ আগে-মুখে বুটের কাঠিন্য ও নৃশংসতা লেগে আছে। এমনই বর্বর হৃদয়ের মানুষ, যেমন হৃদয়হীন বর্বর তাঁর বাবা এবং স্বৈরাচার, তাদেরও নারীরা ভালোবাসে, যেমন তিনিও ভালোবাসে তাঁর বাবাকে। এমনকি ব্ল্যাকবোর্ডে দাঁড়ানো পিতার ছবিতে শয়তানরূপী এক মানুষকেও দেখেন, যিনি কৃষ্ণাঙ্গেরও অধম। এই মানুষ তাঁর বাবা যিনি তাঁর হৃদয়কে খান খান করে দিয়েছেন।
সিলভিয়া লিখেন যখন তাঁর বয়স দশ (আসলে নয়) তাঁর বাবাকে কবর দেওয়া হলো, তিনি চেয়েছেন মরতে। বিশ (আসলে উনিশ) বছর বয়সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এবং ভেবেছিলেন বাবার সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন কিন্তু সেটা আর হয় না।
এবারে বাবার প্রতিকল্পে স্বামীর মূর্তি স্থান পায়। কবিতার ব্যক্তিজীবন ও দাম্পত্যজীবনকে প্রতিসঙ্গ করেন। সিলভিয়ার প্রেম ছিল যন্ত্রণা ও পীড়নের, এবং ভয়াল নৃশংস, তাঁর স্বামী একসময় তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে।
টেডকে সিলভিয়া রক্তপিপাসু বলে অভিহিত করেন, যে এক এক করে সাত বছর ধরে তাঁর রক্ত পান করেছে, সিলভিয়ার বিয়ে স্থায়ী হয়েছিল সাত বছর। এই রক্তপিপাসু তাঁর বাবাও; তাই কবিতার শেষ স্তবকে এসে বলছেন তাঁর হৃদয়ে একটা কাঠের পিলার পোঁতা রয়েছে।
এই ধারালো কাঠের পিলার ভ্যাম্পায়ারদের হত্যার কাজে ব্যবহার করা হয়। এমন নৃশংস যার হৃদয় তার সম্পর্কে গ্রামের মানুষের ঘৃণা ছিল। তাই তারা তাঁকে লাথি মারছে এবং শরীরের ওপরে উঠে নাচছেও। সবশেষে ধিক্কার জানিয়েছে বেজন্মা বলে, সুতরাং তাঁর আর কিছু নাই। এখন সব অর্থহীন। তাই পিতার মৃত্যুতে শোক নয়, মুক্তিই প্রকাশিত হয়েছে। এই মুক্তি সহিংসতা, নিপীড়ন, শোষণ ও আধিপত্য থেকেও। পুরুষ ও পুরুষতন্ত্র থেকেও।
সিলভিয়া প্লাথের স্নায়বিক ও মানসিক বিকারগ্রস্ততা ধরা পড়ে তাঁর উপন্যাস, গল্প ও কবিতায়। সিলভিয়ার প্রথম কবিতার বই দ্য কলোসাস অ্যান্ড আদার পোয়েমস (১৯৬০), প্রথম উপন্যাস দ্য বেল জার (১৯৬৩) কিংবা বহুবিখ্যাত এরিয়েল (১৯৬৫) কাব্যের বিষয়, বর্ণনা ও চিত্রকল্পের মূল উৎস তাঁর জীবন এবং জীবনকে কেন্দ্র করে নানা পরিপার্শ্ব। এজন্য অনেকে তাঁকে স্বীকারোক্তিমূলক সাহিত্যের ‘বিকারগ্রস্ত অথচ সম্পূর্ণ সংযত শিল্পী’ বলে মনে করেন।
টি এস এলিয়টের সমসাময়িক কবি হিসেবে সিলভিয়া প্লাথের কবিতায় এলিয়টীয় কাঠামো ও মনোভঙ্গীর প্রবণতা লক্ষিত হয়। বিশেষ করে কবিতায় মিথ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমকালীন প্রেক্ষাপটে ব্যবহার ও পুনর্গঠন করে নতুনতর জীবনবোধের অন্বেষণ তঁর কবিতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। কলোসাস, ওরেস্টিয়া, ইলেক্ট্রা, মিডিয়া, এরিয়েল, নাইকি, মেডুসা, গরগান্স, ড্রায়াডস, লেডি ল্যাজারাস প্রভৃতি মিথ-ঐতিহ্যের চরিত্রকে বিনির্মাণ করে নতুন অর্থে পুনঃস্থাপন করেছেন। নানা তাত্ত্বিক বিষয়ও কবিতায় অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে দেখা যায় এই কবিকে। উদাহরণ হিসেবে ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সের কথা বলা যায়। সিলভিয়ার অনেক কবিতায় এই কমপ্লেক্সের প্রতিফলন ঘটতে দেখি, রূপায়ন করেছেন নানা চরিত্র ও ঘটনায়।
সিলভিয়া গ্রিক সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন, আবার তিনি ফ্রয়েড-ইয়ং উত্তরকালের বিদ্বান মহিলাও ছিলেন। নিজে ছিলেন বিশেষ মনোরোগে আক্রান্ত। এ নিয়েও ব্যাপক পড়াশোনা করেন তিনি। ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স নিয়ে তাঁর ধারণাও ছিল বেশ। শিল্প সাহিত্যে এ-তত্ত্বের ব্যবহারের ব্যাপারে অবগত ছিলেন। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্সের বিপরীত মেরুর সাইকোসেক্সুয়াল বিষয় হিসেবে কার্ল ইয়ং ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স তত্ত্ব হাজির করেছিলেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী ফ্রয়েডের সাইকোসেক্সুয়াল বিকাশের ক্রমধাপের মৌখিক ও ফ্যালিক ধাপের মধ্যবর্তী ধাপে ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স জন্ম নেয়। লৈঙ্গিক কারণে এতে নারীশিশু পিতার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে এবং মায়ের প্রতি ঈর্ষা প্রদর্শন করে। ফ্রয়েড দেখিয়েছেন ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স অমীমাংসিত থেকে গেলে পরবর্তীকালে নারীর মধ্যে নিউরোসিস ও মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়।
ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স বিষয়টি গ্রিক মিথ থেকে নেওয়া। ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্সের অনুকরণে তত্ত্বটি দেওয়া হয়। ফ্রয়েড তাঁর তত্ত্বটি দিয়েছিলেন নারী ও পুরুষ শিশু উভয়ের ক্ষেত্রে। ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স ইয়ং শুধু মেয়েশিশুর বেলায় প্রয়োগ করেন। গ্রিক মিথলজিতে ইলেক্ট্রা রাজা আগামেননের কন্যা। আগামেনন যখন ট্রয়যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন তখন তার স্ত্রী রানি ক্লাইটেমনেস্ট্রা এজিস্থাসের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হন। আগামেনন ফিরে এলে ক্লাইটেমনেস্ট্রা ও এজিস্থাসের দুজনে চক্রান্ত করে তাকে হত্যা করেন। এজিস্থাস পরে ইলেক্ট্রার ভাই ওরেস্টেসকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে ইলেক্ট্রা কৌশলে ভাইকে উদ্ধার করেন। ওরেস্টেস যৌবনে উপনীত হলে ইলেক্ট্রা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে ওরেস্টেসকে উত্তেজিত করে তোলেন। পরে ওরেস্টেস স্বীয় মাতা ক্লাইটেমনেস্ট্রা ও এজিস্থাসকে হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন। ঈস্কিলাসের দ্য ওরেস্টিয়ান ট্রিলজি ও সফোক্লিসের ইলেক্ট্রা নাটকে ইলেক্ট্রা ও আগামেননের সম্পর্কের স্বরূপ বিশেষভাবে চিত্রিত আছে। সিলভিয়া প্লাথের বাবাকে নিয়ে লিখিত ‘কলোসাস’ কবিতায় ওরেস্টিয়ার প্রসঙ্গ দেখা যায়, এবং কবিতাটিতে ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সের প্রতিফলনও রয়েছে। বাবাকে নিয়ে লেখা অপর কবিতা ‘ইলেক্ট্রা অন অ্যাজালিয়া পাথে’ বাবার প্রতি শুধু ভালোবাসার প্রকাশ নয়, মায়ের প্রতি একটা অবিশ্বাস ও বিদ্বেষও প্রতিফলিত হয়েছে : ‘মাই মাদার সেইড : ইউ ডায়েড লাইক ম্যান।/ হাউ শ্যাল আই এইজ ইনটু দ্যাট স্টেট অফ মাইন্ড।’
সুবিখ্যাত ‘ড্যাডি’ কবিতায় পিতৃপ্রেম যেমন প্রতিফলিত, ঘৃণাও তেমনি। তবে পিতার প্রতি কবিতায় কবির এই প্রেমকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের প্রায় সকল তাত্ত্বিকেরা ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। এমনকি বিবিসির কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে একবার ‘ড্যাডি’ কবিতা পড়ার সময় সিলভিয়া নিজেও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, ‘এখানে এমন একটি মেয়ের কথা আছে যার মধ্যে ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স কাজ করে। তার বাবা এমন সময়ে মারা গেছেন যে সময় সে ভাবত তিনি ভগবান। তার অবস্থাটা আরও জটিল হয়ে ওঠে কারণ তার বাবা নাৎসি ছিলেন এবং তার মা খুব সম্ভবত আংশিকভাবে ইহুদি। তার মধ্যে এই দুটি মিলে গিয়ে উভয় দিককে পক্ষাঘাতে পঙ্গু করে দেয় মুক্তি পাবার জন্য তাকে এই ভয়ানক প্রতীকী নাটক আবার অভিনয় করতে হয়।’ অর্থাৎ সরাসরি স্বীকারোক্তি না দিয়ে কবিতার বক্তাকে তিনি আলাদা করে দেন, নাটকীয়ভাবেই, কবিতার মতো। এভাবে কবিতায় পিতা ও পিতৃতন্ত্র সিলভিয়ার কবিতায় এককার হয়ে নিজস্ব কণ্ঠস্বর তৈরি করে।
লেখক:
কবি, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়